মাউরিল্যান্ড কিউইল্যান্ড নিউজিল্যান্ড
আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টি এই বিশাল দুনিয়ায় খুব কম দেশ আছে যেখানে ইংরেজ জাত বাম হাত ঢুকিয়ে দিয়ে সেই দেশের আদিবাসীদের এক ঘরে করে দিয়ে নিজেদের আগ্রাসন প্রতিষ্ঠা করে নাই। তারা সুঁই হয়ে ঢুকেছে আর ফাল হয়ে বের হয়েছে। শুধু ভারত উপমহাদেশ থেকে লুটপাট করে দুইশ’ বছর পর বের হয়ে গেছে। কলোনী বানিয়ে রাখতে পারে নাই। অথচ বাকি প্রায় সবগুলিকে নিজেদের রাজত্বের প্রভাবে রেখেছে অল্প বিস্তর হলেও। তেমন একটা সুন্দর দেশ হল নিউজিল্যান্ড।
অস্ট্রেলিয়া থেকে নয়শ মাইল পুর্বে ডাইনে বামে তাসমান সাগর আর প্রশান্ত মহাসাগরের কোলে দুইটা মেইনল্যান্ড এবং ছয়শ ছোট ছোট দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর দেশ ‘নিউজিল্যান্ড’। সাইজে বাংলাদেশের ডাবল সাইজ। কিন্তু লোক সংখ্যা মাত্র সাড়ে চার মিলিয়ন মানে পঁয়তাল্লিশ লাখ ( বর্তমানে )।
পলিনেশিয়ানদের কথা তো আমরা সবাই অল্প বিস্তর জানি। প্রশান্ত মহাসাগরের আশেপাশের প্রায় হাজার খানেক ছোট ছোট দ্বীপের আদি বাসিন্দাদের এই নামে ডাকা হয়। ধারনা করা হয় এই জাতের মানুষেরা সাড়ে বারো শ’ থেকে তেরো শ’ শতাব্দীর দিকে এই দেশে প্রবেশ করে বসতি স্থাপন করে। তাদের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়,যার নাম ‘মাউরি’ সংস্কৃতি। নিউজিল্যান্ডের বাসিন্দারা ‘কিউইস’ ( Kiwis ) নামে পরিচিত হলেও ‘মাউরি’ হল সে দেশের আদি সংস্কৃতি।
১৬৪২ সালের দিকে ওলন্দাজ ( ডাচ ) পর্যটক আবেল টাসমান মাউরি ভূমিতে আসে। সেই প্রথম ‘ইয়োরোপীয়’ ব্যাক্তি – যে এই ভূমিতে পা রেখেছে। ডাচ ল্যান্ডে নিজের ‘জিল্যান্ড’ প্রদেশের নামানুসারে পরবর্তীতে মাউরি ল্যান্ডের নামকরণ হয় ‘নিউজিল্যান্ড।’
১৮৪০ সালে বিলাতের দূত এবং মাউরি জাতির প্রতিনিধির ভিতর চুক্তি সম্পাদিত হয় এই মর্মে যে ইংরেজরা তাদেরকে আদব কায়দা শেখাবে। আধুনিক বানিয়ে দেবে। অতএব নিউজিল্যান্ড ইংরেজদের অধীনস্থ কলোনিতে পরিণত হল।
১৯৪৭ সালে নিউজিল্যান্ড পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করলেও বিলাতের রাজা সেই দেশের সরকার প্রধান রয়ে গেলো।
আজ পৃথিবীর অর্থনৈতিকভাবে উন্নত এবং আধুনিক দেশগুলির একটা নিউজিল্যান্ড। সাড়ে চার মিলিয়ন বাসিন্দার ভিতর ৭৪ ভাগই হল ইংরেজিভাষী ইয়োরোপীয় অভিবাসী, আর মাত্র ১৫ ভাগ প্রাচীন আদিবাসী ‘মাউরি’রা।
ইংরেজী দেশের প্রধান ভাষা হলে ‘মাউরি’ ভাষাও সরকারী ভাষার একটি।
সংসদীয় গণতন্ত্র অনুযায়ী দেশ পরিচালনার জন্য একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী থাকলেও বিলাতের রানী এলিজাবেথ ( দ্বিতীয় ) দেশটার সরকার প্রধান এবং রানীর প্রতিনিধিত্ব করে তারই নির্বাচিত একজন গভর্নর জেনারেল।
দেশটার বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নাম হল জেছিন্দা আরদার্ন। দেশটার চল্লিশতম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাস থেকে দায়িত্বে আছে জেছিন্দা। এই মানুষটা অনেক ব্যতিক্রম একজন রাজনীতিবিদ। তার কথা একটু বলে গল্প শেষ করবো।
সাইত্রিশ বছর বয়সী জেছিন্দা পৃথিবীর সর্ব কনিষ্ঠ সরকার প্রধান। এর আগে বেনজির ভুট্টো তার দেশের প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সন্তানের মা হয়। এরপর জেছিন্দা প্রথম কোন ইয়োরোপীয় প্রধান নির্বাহী যিনি মা হল মাত্র সেদিন।
কোন কাটা ছেঁড়া করে নয়, সেই দেশের নিয়ম অনুযায়ী সনাতন পন্থায় ধাত্রীদের সহায়তায় তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। ইয়োরোপীয় বংশোদ্ভূত শ্বেতাঙ্গ হলেও জেছিন্দা ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। নির্ভীক, ঠোঁটকাটা, প্রগতিশীল জেছিন্দা তার সন্তান জন্মের মাত্র দুইদিন পর প্রেস কনফারেন্স করে দেশবাসীর সাথে তার সন্তানের পরিচয় করিয়ে দেয়। দেশের মানুষ তাতে আপ্লুত হয়। মেয়ের নাম রেখেছে আইরিশ মাউরি ভাষার সংমিশ্রণে Neve Te Aroha. মাউরি ভাষায় Te Aroha মানে হল The Love। দেশের সব উপজাতির সন্মানার্থে সব ভাষার সংমিশ্রণে নিজের মেয়ের নাম রেখেছে।
ছবিতে জেছিন্দার সাথে যাকে দেখছেন সে কিন্তু তার স্বামী নয়। বয় ফ্রেন্ড। তার হাত ধরে নবজাত শিশুকে নিয়ে প্রেস কনফারেন্সে আসে জেছিন্দা। দেশের প্রধান নির্বাহী হয়ে বিয়ের বন্ধনের বাইরে সন্তানের মা হয়ে সন্তানের বাবাকে নিয়ে সবার সামনে দাঁড়াতে একটুও দ্বিধা করে নাই সে। সাধারণ মানুষের দুনিয়া অনেক আধুনিক হলেও দেশের কর্নধারের দাম্পত্য জীবন ছকে বাঁধা না হলে সবার চোখ কপালে উঠে যায়। ভোট দিতে ইতস্তত করে। কিন্তু এসব নিয়ে সে কখনো ভাবে নাই। যা কিছু স্বাভাবিক মনে হয়েছে সে তাই করে গেছে। তবে নিজ জাতি এবং দেশের স্বার্থের ব্যাপারে একদম আপোষহীন মানুষ সে।
জেছিন্দার বয়ফ্রেন্ডের নাম ক্লাক গেইফোর্ড। টেলিভিশনে মাছ ধরা বিষয়ের উপর শো’য়ের হোস্ট। ছয় সপ্তাহের মাতৃকালীন ছুটির পর জেছিন্দা তার দায়িত্বে ফিরে যাবে। তখন নবজাতের দেখাশুনা করার জন্য তাদের একজনকে ঘরে থাকতে হবে। তাই ক্লার্ক তার চাকুরী ছেড়ে দিয়েছে। আপাতত সে বাসায় থেকে সন্তানের দেখাশুনা করবে।
ব্যাপারটা শুনেই তো কেমন ভাল লাগছে, তাই না !
তার সন্তান জন্মের এক সপ্তাহ পরে জেছিন্দা পাঁচ বিলিয়ন ডলারের ‘পরিবার বিষয়ক সুবিধার’ এক বিলে সন্মতি জানায়। অচিরে সংসদে উপস্থাপন করা হবে সেটা। বিলে উল্লেখ করা হয় সন্তান জন্মের প্রথম কয়েক বছর মা বাবার খুব জটিল সময় কাটে। এসময় তাদের বাড়তি আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন হয়। তাই নতুন বিল নতুন সন্তানের পরিবারকে দিনপ্রতি বাড়তি ষাট ডলার করে ভাতা দেবে। এছাড়াও শীতকালে অত্যধিক হিটের বিল পরিশোধের সুবিধার্থে অতিরিক্ত সাতশ ডলার করে দেবে। বিলে বেতনসহ মাতৃকালীন ছুটি আঠারো সপ্তাহ থেকে বাড়িয়ে বাইশ সপ্তাহ করার কথা বলা হয়েছে।
জেছিন্দা তার লেখাপড়া শেষে নিজ দেশের প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক ছাড়াও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছে। নিউইয়র্কের ‘হেলস কিচেন’ এ দুঃস্থ মানুষের জন্য খাবার তৈরি এবং বিতরণের কাজ করেছে অনেকদিন। রাজনীতির প্রতি তার ঝোঁক ছিল শুরু থেকেই। ২০০৮ সালে সে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। এবং পরবর্তী দশ বছর সে এই পদে বহাল থাকে।
২০১৭ সালে নিজ দল লেবার পার্টির সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে জনপ্রিয় জেছিন্দা দলের ডেপুটি লিডার হয়। এবং একই বছর তার দল সরকার গঠন করলে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করে।
মজার ব্যাপার হল, সে টনি ব্লেয়ারের উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করলেও তখন কখনো সে তার মুখোমুখি হয় নাই । ব্লেয়ারকে দেখে নাই। কিন্তু ২০১১ সালে নিজ দেশের এক ইভেন্টে টনি ব্লেয়ারকে পেয়ে সে জিজ্ঞেস করে বসেছিল – ‘তারা কোন যুক্তিতে ইরাক আক্রমণ করেছে ! ব্লেয়ার এই প্রশ্নের উত্তর পাশ কাটিয়ে গেছে।
কট্টর ক্যাথলিক হিসাবে বেড়ে উঠলেও ২০০৫ সালের পর থেকে সে তার চার্চ পরিত্যাগ করেছে। এ বিষয়ে তার যুক্তি হল, তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং চার্চের গতানুগতিক নিয়ম সংঘাতময়। চার্চ সমর্থন করে না কিন্তু জেছিন্দা সমকামী মানুষদের অধিকারের পক্ষে কথা বলে। ২০১৭ সাল থেকে জেছিন্দা নিজেকে নিরীশ্বরবাদী হিসাবে ঘোষণা করেছে।
মুরাদ হাই, ১০ জুলাই ২০১৮