Debriefing The President: The Interrogation Of Saddam Hussein,

প্রেসিডেন্ট বুশ সি,আই,এর ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে ইরাক আক্রমন করে। ইরাক তছনছ করে সাদ্দাম হোসেনকে ধরে ফেলার পরও সন্দেহ ছিল – এটা কি আসোলেই সাদ্দাম হোসেন, নাকি দেখতে তাঁর মত অনেক নকল মানুষদের একজন।

সাদ্দামকে নিয়ে গবেষনা করা সি,আই,এর’র এনালিষ্ট জন নিক্সনকে দায়িত্ব দেয়া হয় তাঁকে সনাক্ত করার। জন নিক্সন সাদ্দাম হোসেন এর জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে গবেষনা করে। প্রেসিডেন্ট বুশ তাই নিক্সনকে সঠিকভাবে সনাক্তকরনের দায়িত্ব দেয়।

সি,এই,এ’র এই সিনিয়র এনালিষ্ট সম্প্রতি সাদ্দাম হোসেনের সনাক্তকরন এবং জবানবন্দী নিয়ে বই লেখে, যার নাম দিয়েছে –
Debriefing The President: The Interrogation Of Saddam Hussein,

বইটা বাজারে আসবে ২৯শে ডিসেম্বর। পত্রিকা সংক্ষিপ্ত সার ছেপেছে। আমি সেটা অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি।

এই বইতে নিক্সন বর্ননা করেছে, আমেরিকান সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্স কেমন করে সাদ্দামের গ্রামের বাড়ি টিকরিটের এক খামার বাড়ি্তে গর্তের ভিতর লুকানো শুশ্রমন্ডিত সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেফতার করেছে। তারপর তাঁকে মিলিটারি প্লেনে করে বাগদাদ এয়ারপোর্টের আমেরিকান সেনা ছাউনীতে আনা হয়।

আরেক দল সৈন্য শত্র এলাকার ভিতর দিয়ে অন্ধকারে একশো মাইলের বেশী গতিতে গাড়ি চালিয়ে নিক্সনকে নিয়ে আসে সেই সেনা ছাউনীতে, যেখানে এক সময় সাদ্দাম হোসেনের রিপাব্লিকান গার্ডের আস্তানা ছিল।

একটা ঘরে নিক্সনকে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। ঘরের ভিতর তাকিয়ে দেখে নিক্সনের দম বন্ধ হয়ে আসছিলো অবিশ্বাসে।

তার ভাষায় –

“যাকে নিয়ে মাসের পর পর মাস গবেষনা করেছে সে, সেই শক্তিমান পুরুষ সাদ্দাম হোসেন একটা লোহার চেয়ারে বসে আছে। পরনে সাদা ‘ডিশডাশা’ মানে আলখেল্লার মত আরবীয় পোশাক আর নীল রঙের জ্যাকেট। দেখতে বিশাল, শক্তিশালী পুরুষ। ছয় ফুট এক ইঞ্চির মত লম্বা হবে। অস্বীকার করার উপায় নাই যে তাঁর চেহারায় বিশেষ আভিজাত্য আছে। যদিও জানি তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে কিন্তু চাহনি এবং বসার ঋজু ভাবে মনে হয়েছে, তিনি একজন বিশাল ব্যাক্তিত্বশীল গুরুত্বপুর্ন ব্যাক্তি।”

দোভাষীর মাধ্যমে আমি তাঁকে জানাই যে আমি তাঁকে কিছু প্রশ্ন করবো এবং আশা করবো তিনি যেন সব সত্য উত্তর দেয়।

সাদ্দাম হোসেন মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

জিজ্ঞেস করলাম – শেষ কখন তিনি তাঁর ছেলেদের জীবিত দেখেছে ?

ভেবেছি, সাদ্দাম অস্বীকৃতি জানাবেন উত্তর দিতে।

কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বজ্র কণ্ঠে তিনি উলটা প্রশ্ন করে বসেন –

“তোমরা কারা ? মিলিটারি ইন্টিলিজেন্স নাকি সিভিলিয়ান কেউ ? পরিচয় দাও আগে। আমার কথার উত্তর দাও।”

সাদ্দামের আচরন, স্বভাব, কথা বলার ধরন, শত শত ঘন্টা ধরে পুরনো ভিডিও দেখে তাঁর শরীরের নানারকম দাগ নিয়ে গবেষনা করে জেনেছি, তাঁর ডান হাতের পিঠে উপজাতীয় টাট্টূ আছে। বাম পায়ে বুলেটের আঘাতের দাগ আছে। তদুপরি কথা বলার সময় সাদ্দামের নীচের ঠোঁট একদিকে সামান্য ঝুলে পড়ে।

অনেক নকল সাদ্দামের ভীড়ে আসল মানুষকে চিহ্নিত করার জন্য আমাকে আনা হয়েছে। এই মুহুর্তে কথা বলার সময় হটাৎ খেয়াল করলাম তাঁর হাতে সেই টাট্টু আছে। উত্তেজিত হয়ে কথা বলার সময় তাঁর নীচের ঠোঁটও একপাশে ঝুলে পড়ে। আর শুধু দেখা প্রয়োজন তাঁর পায়ে সেই বুলেটের ক্ষত চিহ্ন রয়েছে কিনা।

আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর জানার ছিল। কেমন করে সে বাগদাদ থেকে পালিয়েছে। কে তাঁকে সাহায্য করেছে এইসব। কিন্তু তিনি শুধু তাঁর যেটা ইচ্ছা সেটারই উত্তর দিচ্ছিলেন।

আচমকা ভারী গলায় গর্জে উঠে বলে – “কেন তুমি আমাকে রাজনীতি নিয়ে জিজ্ঞেস করছো না ? তাহলে তুমি কিছু শিখতে পারবে।”

তারপর রাগতঃ কন্ঠে অভিযোগ করা শুরু করলেন, স্পেশাল ফোর্সের সেনারা তাঁর সাথে কেমন খারাপ ব্যবহার করেছে। তাঁকে পথে কত অত্যাচার করেছে।

আমি আনমনে ভাবছিলাম- এই মানুষ চোখের পলকে মতের অমিল হলে তাঁর নিজের মানুষদের খুন করে ফেলে। তিনি কিনা এখন সামান্য অত্যাচারের বিষযে অভিযোগ করছেন। অভিযোগ করতে করতে সাদ্দাম আলখেল্লা উঠিয়ে সৈন্যদের আঘাতে তাঁর ভাঙ্গা পা দেখালেন। ঠিক সেই মুহুর্তে আমি দেখতে পেলাম, তাঁর বাম পায়ে বুলেটের সেই পুরনো দাগ। এই বিষয়ে আমি তাঁকে জিজ্ঞেসও করলাম। তিনি মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

তাঁকে চেনার আমার শেষ ধাপ পার হল। আমি পুরো নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে ইনি আর কেউ নয়, কোন নকল মানুষও নন। ইনিই ইরাকের দীর্ঘকালের একনায়ক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন।

সাদ্দামকে ধরে ফেলা এবং পরিচয় নিশ্চিতকরন শেষ হল। এবার জানা দরকার তার দেশ আক্রমনের পিছনের মূল কারন, মানে তাঁর কাছে যে সব মারাত্বক মানব সভ্যতা বিধ্বংসী মারনাস্ত্র রয়েছে তাঁর সত্যতা সম্পর্কে।

আমার এমন প্রশ্নের উত্তরে সে আমাকে রিতিমত ভেংগিয়ে দিলেন। তারপর বলে্ন –

“আমার দেশে তোমরা একজন বিশ্বাসঘাতককে পেয়েছ যে তোমাদেরকে আমার কাছে পৌঁছে দিয়েছে। এমন কি আরেকটা বিশ্বাসঘাতক খুঁজে পাবে না যে তোমাদেরকে সেই আজগুবি মারনাস্ত্রের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে ?”

তিনি পরিবেশ উত্তপ্ত করলেন তাঁর বাচনভংগী দিয়ে। তারপর বলেন –

“আমেরিকানরা আসোলে একদল বেকুব শয়তানের দল। তারা ইরাককে বুঝতে পারে নাই, আমাকে চেনে নাই। কিন্তু ইরাককে ধ্বংস করার নেশায় মত্ত হয়েছে।”

“ইরাক কোন সন্ত্রাসী দেশ নয়” তিনি বলেন।

“লাদেনের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নাই। আমাদের কাছে কোন মারনাস্ত্র নাই। আমরা কখনোই আমাদের প্রতিবেশীদের জন্য হুমকির কারন নই। কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ বলেছে, আমরা নাকি তার বাবা বুশকে আক্রমন করেছি। তাই সে আমাদেরকে ধবংসের খেলায় মেতেছে।”

সাদ্দামের কথায় কান না দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম –

“তাঁর কি এমন কোন মতলব ছিল নাকি যে সে সউদি আরবে আমেরিকান সৈন্যদের উপর রাসায়নিক বোমা ব্যবহার করবে ?”

তিনি আকাশ থেকে পড়লেন – “আমাদের কাছে এমন কিছু নাই। এসব নিয়ে কখনো আমাদের আলোচনা হয় নাই। কেউ আমাদেরকে আক্রমন না করলে সুস্থ মস্তিস্কে কেমন করে আমরা পৃথিবীর বিরুদ্ধে এমন ষড়যন্তের কথা ভাববো? ”

এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। আমি এসব কি শুনছি। তাহলে কি আমাদের সব তথ্য ভুল ছিল ?

সাদ্দাম উত্তর দিলেন – “আসোলে বিষয়টা নিয়ে পরিস্কারভাবে কথা বলা এবং শোনার কেউ ছিল না।”

তারপর বলে – “এই দোষ আমাকেও দেয়া যায়।”

বুঝতে পারছিলাম না। সাদ্দাম কি আসোলে আমাকে নিয়ে খেলছে ? সত্য গোপন করে যাচ্ছে ?

এবার আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি – “তাহলে আপনি ইরাক ইরান যুদ্ধের সময় কুর্দিদের উপর মারাত্বক গ্যাস ব্যবহার করেছিলেন কেনো ?”

তিনি গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলেন – “আমার দেশকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে আমি আবার এমন করবো।”

তারপর বলে্ন – “সেই গ্যাস ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত কিন্তু আমার ছিল না।”

কার সিদ্ধান্ত ছিল আমি আর জিজ্ঞেস করলাম না।

সাদ্দামের সাথে আমার প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হল। তাঁকে বের করে নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু মনের ভিতর আমি দোটানায় পড়ে গেলাম। যা তথ্য জানতাম তাঁর সম্পর্কে সব যেন অতিরঞ্জিত। আগে জেনেছি সাদ্দামের সৎ পিতা তাঁকে খুব অত্যাচার করত। তাই সে এমন ঘাড় ত্যাড়া হয়েছে। তাঁকে এই প্রশ্ন করে জানলাম যে, তাঁর সৎ বাবা কোন দিন তাঁর গায়ে হাত তোলে নাই। বরং নিজের আপন ছেলের চাইতে সাদ্দামকে বেশী আদর স্নেহ করতেন।

এছাড়াও আমি সি,আই,এর রিপোর্টে পড়েছি, সাদ্দাম তাঁর ব্যাক পেইনের কারনে তাঁর প্রিয় সিগার এবং রেড মিট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এসব ডাহা মিথ্যা কথা। তিনি এখনো দৈনিক চারটা সিগার এবং প্রচুর মাংশ খান।

কথাগুলি সত্য মনে হয়েছে। কারন তাঁকে দেখে খুব সুস্বাস্থের অধিকারী মনে হয়েছে।

রিপোর্টে জেনেছি, সাদ্দাম নাকি অনেক মিথ্যা কথা বলে। পুরো দেশ একাই শাসন করে কঠিন হাতে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে যেন এই কথাগুলি সব সত্য নয়।

৯/১১ প্রসংগে তিনি বলেন – “দেখো সেই আক্রমনে আমাদের কোন হাত নাই। আমার দেশের কোন নাগরিক ছিল না সেখানে। ছিল সউদি আরব এবং মিসরের নাগরিক। তাহলে আমাকে কেন খামোকা অপবাদ দাও তোমরা ?”

তারপর বলেন – “তোমরা ইরাকে ব্যর্থ হবে। ইরাক কোন সহজ দেশ নয় শাসন করা। ইরাককে শাসন করতে হলে এই দেশের ভাষা জানতে হবে। বিভিন্ন উপজাতির ভাব বুঝতে হবে। আবহাওয়া বুঝতে হবে। শীত গরমের তারতম্য বুঝতে হবে। রাতের ঠান্ডা এবং দিনের অসহ্য গরমে আরবীদের মতি গতি বদলে যায় খনে খনে। আজ যে সব আরব তোমাদের বন্ধু হয়েছে, কাল তারাই হয়ত তোমাদের দিকে বন্দুকের নল ঘুরিয়ে দিবে। তুমি তোমার প্রেসিডেন্ট বুশকে এটা জানিয়ে দিও।”

২০০৬ সালে সাদ্দামকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়। ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট বুশ আমাকে হোয়াইট হাউজে ডাকেন। তিনি জানতে চান সাদ্দাম সম্পর্কে।

আমি আমার মতামত জানিয়েছি। প্রেসিডেন্ট খুশী হন নাই। আমি শুধু বলতে পারি নাই, আমার সহকর্মীর সি,আই,এর রিপোর্টে কোথাও অনেক বড় ভুল ছিল। বললে নিজের গায়ে থুথু পড়ে যায়। তবুও বলেছিলাম – সাদ্দাম সত্যিকার অর্থে কোন হুমকি ছিল না।

প্রেসিডেন্ট সেটা শুনে রেগে যান। পাত্তা দেন নাই। তারপর অবশ্য এটাও বলেছে, তাহলে সি,আই,এ’র তথ্য তাদের পশ্চাদে ঢুকিয়ে রাখতে বোলো।

২০১০ সালে বুশ তাঁর নিজের বইতে লিখেছে –
‘I decided I would not criticize the hard working patriots of the CIA for the faulty intelligence on Iraq.’

সমালোচনা করবে না বলেও এই কথাতেই তার সময়ে তার গোয়েন্দা সংস্থার অনেক বড় সমালোচনা করা হয়ে গেছে।

আমি বলব না, সাদ্দাম কোন ধোঁয়া তুলশি পাতা ছিল। কিন্তু মনে করি, সাদ্দামকে ক্ষমতায় রাখলে হয়ত চার হাজার আমেরিকান সৈন্যের প্রানহানি ঘটত না। আইসিস এর উত্থান হত না। এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইরাক পুনর্গঠনে আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হত না।

অনুবাদঃ মুরাদ হাই
২৫শে ডিসেম্বর, ২০১৬