Heaven can wait

আগের ইতিহাস না জানলে আজকের নম্র,ভদ্র জাপানীদের দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এই জাত কেমন শক্তিশালী হিংস্র দানবের মত ছিল। তেমন না হলে কি আর আমেরিকানদের ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দেয় নাকি ! হিসাবে দেখা যায় জাপানীদের আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে অন্যান্য দেশ ছাড়া শুধু আমেরিকা হারিয়েছে সাড়ে পনেরশ’ যুদ্ধ জাহাজ, পঁচানব্বই হাজার সব রকমের প্লেইন। প্রাণ হারিয়েছে চার লাখের উপর আমেরিকান সৈন্য। ইজ্জত বাঁচাতে শেষমেশ আণবিক বোমা ব্যবহার করা ছাড়া জাপানীদের কামাকাজি আক্রমণ ঠেকানোর আর কোন উপায় জানা ছিল না আমেরিকানদের। হ্যাঁ, এই অপরাধে আমেরিকা বিশ্ববাসীর চোখে আজও অপরাধী হয়ে আছে। অথচ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখলে পরিষ্কারভাবে আন্দাজ করা যায় তখন জাপানীদের দোর্দণ্ড প্রতাপ এবং বিশ্ব জয় করে পদানত করার সংকল্প।

সেই যুদ্ধে হতাহত এবং নিখোঁজ হওয়া অগণিত সৈনিকের একজন ছিল পাইলট সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট থমাস কেলী জুনিয়র। ১৯৪৪ সালে থমাসের বি-২৪ বম্বার ভূপাতিত হয় তৎকালীন হানসা বে, মানে পাপুয়া নিউ গিনির উপুকুলে।

২১ বছর বয়সী থমাস কিংবা তার বোমারু বিমানের কোন ধ্বংসাবশেষ কখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই। তার পরিবার সেই প্লেইনের ড্রয়িংসহ শুধু একটা স্মৃতি স্তম্ভ স্থাপন করে তার কাল্পনিক সমাধিতে। কিন্তু পরিবারের কেউ কখনোই ভুলতে পারে নাই এই অকুতোভয় বোমারু পাইলটকে। তার কথা ভেবে এতোগুলি বছর থমাসের মা কখনো ক্রিস্টমাসের গান পর্যন্ত শুনে নাই।

থমাস সব সময় চিঠি লিখত তার মাকে। ১৯৪৪ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারিতে লেখা চিঠিতে জানিয়েছিল সব ঠিক থাকলে বড়দিনের আগেই সে ঘরে ফিরে আসবে। তার মাত্র অল্পদিন পরে তার একুশতম জন্মদিন হবে।

শেষ চিঠি লিখেছিল সে বছরের ২৯শে ফেব্রুয়ারিতে। লিপ ইয়ার ছিল। লিখেছিল – ‘বাবা, মা তোমরা কেমন আছো ? নিশ্চয়ই খামোকা অনেক চিন্তা করে পাগল হচ্ছো !’ তার দুই সপ্তাহেরও কম সময় পরে থমাসের বোমারু বিমান Heaven can wait এক অপারেশনে জাপানীদের হাতে ভূপাতিত হয় ।

থমাসের বম্বিং অপারেশন ছিল ১১ই মার্চে। অনেকের সাথে তারও সেদিনের দায়িত্ব ছিল জাপানের রসদ বহনাকারি জাহাজের উপর হামলা চালানো। তার পাশাপাশি জাপানের এয়ারফিল্ডে আঘাত হানা। নিজের Heaven can wait নামধারী বোমারু বিমান নিয়ে সে তার দায়িত্ব সে পালন করেছে। ধ্বংস করেছে এয়ারফিল্ড। ডুবিয়ে দিয়েছে রসদের জাহাজ। কিন্তু নিজের বিমানকে জাপানী কামাকাজি আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে নাই। ভূপাতিত হয়েছে হানসা বে’র অতলে।

উদ্ধারকারীরা খুঁজে পায় নাই থমাস কিংবা তার সাথের আরও দশজনের কাউকে। তাদের সন্মানে প্রতি বছর মেমোরিয়াল ডে তে হানসা বে’র উপর দিয়ে উড়ে যায় আমেরিকার সেই আমলের বোমারু বিমান বি-২৪ ।

থমাসের মা বাবা কেউ আর বেঁচে নাই। বেঁচে আছে তার এক ভাতিজী। ২০১৩ সালে সেই ভাতিজী ক্রিস্টি জানতে পারে, একটা নন প্রফিট সংস্থা তাদের ডুবুরী নামিয়ে পাপুয়া নিউ গিনির উপুকুলে ডুবে যাওয়া অনেক প্লেইনের ভিতর প্রায় ত্রিশটা আমেরিকান যুদ্ধ বিমানের হদিশ পেয়েছে। আশা করছে তার ভিতর থমাসের Heaven can wait নামের বি-২৪ বোমারু বিমানটাও রয়েছে।

কয়েক সপ্তাহ আগে ক্রিস্টির কাছে ফোন আসে যে ডুবুরীরা থমাসের প্লেইনটা সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। ক্রিস্টি জানায় – এই খবর জেনে আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। আমি আমার চাচাকে কখনো দেখি নাই। তবুও হারিয়ে যাওয়া সেই মানুষটার শেষ স্মৃতি চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেছে জেনে আমি অভিভূত হয়ে পড়েছি। এবার হয়তো আমি পারব তার সৎকার কাজটা সম্পন্ন করে তাকে যথাযথভাবে সমাধিস্থ করে আমার দায়িত্ব শেষ করতে।

সূর্য সন্তানদের অবদান ভুলে না গিয়ে ক্রমাগত উদ্ধার অভিযান চালিয়ে পেন্টাগন এ যাবত ২৩৮১ জন হারিয়ে যাওয়া যোদ্ধাদের স্মৃতি খুঁজে পেয়েছে। হিসাব মতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অংশ নেয়া ৭২০০০ আমেরিকান সৈন্য এখনো মিসিং রয়েছে যাদের কোন হদিস পাওয়া যায় নাই। আশা করা যায় এর ভিতর ২৬০০০ সৈন্যের খবর উদ্ধার করা সম্ভব হবে অচিরে।

চাইলে কি না সম্ভব হয় ! তার প্রমাণ রাখছে আমেরিকা। কত যুগ আগে শেষ হয়ে যাওয়া যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া যোদ্ধাদেরকে এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছে আমেরিকা। শেষ ব্যাক্তিটা পর্যন্ত খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত থামবে না তারা। এমনই তো হওয়া উচিৎ। এই জাত সারা পৃথিবীতে ছড়ি ঘুরালেও নিজের জাতের মানুষদের হেফাজত করতে জানে যথাযথভাবে। দেখে খুব গর্ব লাগে। উৎফুল্ল হই। স্বপ্ন দেখতে শিখি।

এমন এক দেশ থেকে এসেছি আমি যে দেশে মহান যোদ্ধাদেরকে যথাযথ সন্মান তো দেয়াই হয় না, উপরন্ত ভুয়া যোদ্ধারা সকল সুবিধা ভোগ করে। আজ পর্যন্ত আসল যোদ্ধাদের কোন সঠিক তালিকা পর্যন্ত বানাতে পারে নাই সেই দেশ। তার উপর নাজেহাল করে, অপমান করে কথা বলে সত্যিকারের যোদ্ধাদেরকে। দেখে শুনে মাথা হেঁট হয়। এই বিভূঁইয়ে এসে তাদের কর্ম কাণ্ড দেখে নিজের দুঃখ ভোলার চেষ্টা করি। অনেক পরে হলেও আমি তো এখন তাদেরই একজন। তাই তাদের কোন অর্জন দেখলে নিজের ভিতর শান্তির ধারা অনুভব করি।

অনুবাদ : ৩০শে মে, ২০১৮