সাহসী মেয়ের গল্প

ব্রিটিশ ভারতে জন্ম নিয়েছে দময়ন্তী গুপ্তা। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দেশ বিভক্তি হয় এই ব্রিটিশ ভারতে। ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা শেষ পর্যন্ত ভারত ছাড়ল। তবে ছাড়ার আগে ভারতকে অসমভাবে ভাগ করে ভারত এবং পাকিস্তান নামের দুইটা দেশে বিভক্ত করে গেলো। অখণ্ড ভারতের যে অংশে দময়ন্তীরা থাকতো,সেটা হয়ে গেল পাকিস্তানের অংশ। জীবনযাত্রা খুব সহজ ছিল না সেখানে। সারাক্ষণ হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা লেগে থাকতো। সেই অবস্থাতে পাঁচ বছর বয়সে একদিন মাঝরাতে দময়ন্তীরা তাদের শহর করাচী ছেড়ে মুম্বাইগামী মালবাহী জাহাজে চেপে বসল।

করাচীতে দময়ন্তীর পরিবার অবস্থাপন্ন ছিল। নিজেদের ঘরবাড়ি ছিল। ছিল জায়গা জমি এবং ব্যবসা। জীবন বাঁচাতে খুব অল্প সময়ের সিদ্ধান্তে সব কিছু ফেলে তাদেরকে করাচী ছাড়তে হল।

দময়ন্তীর মা গোপীবাঈ হিঙ্গরানি মাত্র চার ক্লাস পড়া মানুষ ছিলেন। সেই অল্প শিক্ষিত মা দময়ন্তীকে বলেছিল, তুমি এমন কিছু অর্জন করবে যা কেউ তোমার কাছ থেকে কখনো কেড়ে নিতে পারবে না। আর সেটা হল – শিক্ষা। যদিও পরবর্তী এক যুগ তারা শরণার্থীর জীবন কাটিয়েছে ভারতে, তথাপি তার মা তাঁর প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছে।

তার তেরো বছর বয়স হওয়ার আগে পর্যন্ত দময়ন্তী ‘ইঞ্জিনিয়ার’ শব্দটাই শুনে নাই। সেবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু তাদের শহরে এলো সফরে।
তিনি তার ভাষণে বলেন – ‘ইংরেজদের ২০০ বছর শাসনের পরেও ভারতে কোন শিল্প কারখানা গড়ে উঠে নাই। আমাদের দেশে যথেষ্ট ইঞ্জিনিয়ার নাই। আমি শুধু ছেলেদের উদেশ্যে কথা বলছি না। আমি অবশ্যই মেয়েদের কথাও বলছি।’

সেই প্রথম দময়ন্তী ইঞ্জিনিয়ার শব্দটা শুনল। জানল এটি একটা খুব জরুরী পেশা। সেদিন সে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে তার মাকে জানালো – সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। সে হবে ভারতের প্রথম নারী ইঞ্জিনিয়ার।

ভারতে দময়ন্তী সর্ব প্রথম মেয়ে যে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হল। পুরুষ শাসিত সমাজে তার এই আকাঙ্ক্ষা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো। শুধু তা’ই নয়, সংখ্যা গরিষ্ঠ পুরুষের কলেজ বিধায় কলেজ ক্যাম্পাসে মেয়েদের জন্য আলাদা কোন টয়লেট পর্যন্ত ছিল না। টয়লেটের প্রয়োজন মেটাতে তাকে প্রতিদিন আসা যাওয়া মিলিয়ে প্রায় তিন মাইল রাস্তা সাইকেল চালিয়ে নিজের বাসায় যেতে হতো। এতো কষ্ট সয়েও মেয়েটা যখন পড়াশুনার হাল ছাড়তে চাইলো না, তার ডিপার্টমেন্ট ডিন ভদ্রলোক অবশ্য পরে ক্যাম্পাসে তার জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো।

উনিশ বছর বয়সে দময়ন্তী ফোর্ড গাড়ির কোম্পানির মালিক হেনরী ফোর্ডের জীবনী পড়লো। পড়ে মুগ্ধ হল। সেই থেকে সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো – একদিন সে ফোর্ড কোম্পানীতে ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করবে।

ভারতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শেষ হলো তার। ডিগ্রী পেলো। তার চোখে তখন আরো অনেক বড় স্বপ্ন। বাবা মা তার স্বপ্ন পূরণে বাধা না হয়ে বরং সহায়তা করলো। কারণ তার মা খুব স্বপ্ন বিলাসী মানুষ। তাঁরা তাদের জীবনের সব জমানো পয়সা মেয়েকে দিলো তার স্বপ্ন পূরণের জন্য বিদেশে যেতে। তার মায়ের ধারণা, পরিবারে একটা সন্তান সুশিক্ষিত হলে সে’ই বাকিদেরকে টেনে তুলবে। মায়ের ধারণা মিথ্যা হয় নাই। এক সময়ে দময়ন্তী নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তার ভাইবোন এবং মা বাবাকে আমেরিকায় নিয়ে এসেছিলো।

১৯৬৭ সালের জানুয়ারী মাসের কঠিন শীতের দিনে দময়ন্তী আমেরিকার মিশিগান রাজ্যের মোটর সিটি নামের মূল শহর ডেট্রয়েটে এসে পৌছুলো। তার কোন স্নো বুট কিংবা হেভি জ্যাকেট ছিল না।ছিল না কোন গাড়ি। প্রথমবার যখন সে ফোর্ড কোম্পানিতে চাকুরীর জন্য আবেদন করলো,তারা তাকে চাকুরীতে নেয় নাই। তাই বলে সে আশা ছাড়ে নাই। যতবার তারা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, সে ক্ষান্ত না হয়ে বারংবার এপ্লাই করে গেছে। শেষবার তাকে ইন্টারভিউর জন্য ডাকা হলো।

তাকে দেখে ইন্টারভিউ বোর্ডের মানুষেরা বিরক্ত হয়ে জানালো – ‘তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং পোস্টের জন্য আবেদন করেছো। কিন্তু আমাদের কোম্পানিতে কোন নারী কর্মচারী নাই। বিজ্ঞাপনে তেমন কাউকে চাওয়া হয় নাই।’

তার উত্তরে দময়ন্তী বলে – ‘দেখো, আমি এখানে উপস্থিত আছি তোমাদের চাহিদা মোতাবেক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে। তোমরা যদি আমাকে হায়ার না করো, তাইলে কেমন করে নারী কর্মচারী থাকবে তোমাদের ?’

তার অমন কথায় কাজ হলো। ফোর্ড কোম্পানী তাকে হায়ার করলো। দময়ন্তী ফোর্ড মোটর কোম্পানীতে প্রথম নারী ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে জয়েন করলো।
বাবা মায়ের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করা মেয়েদের জন্য তখনো ট্রাডিশন ছিল। দময়ন্তী নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করেছে আমেরিকায়, যাকে সে বলে ‘লাভ ম্যারিজ।’ যদিও তিনি বলেন ওটা লাভ ম্যারিজ, আবার সাথে এটাও যোগ করেছেন – তার অমন চোখ ছানাবড়া করা চাকুরীর কারণে ওই ‘লাভ ম্যারিজটা’ সম্ভব হয়েছিল।

তখন কাজের ক্ষেত্রে মেয়েদের জন্য মেটারনিটি লিভ বলে কিছু ছিল না খোদ আমেরিকাতেও। তাই প্রথম সন্তান নিয়ে প্রেগনেন্ট হলে তাকে চাকুরীটা ছাড়তে হয়েছিল। যদিও সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তিনি তার আগের কোম্পানিতে আবার জয়েন করেছে এবং দক্ষতা দেখিয়ে তিন মাসের ভিতর প্রমোশন পেয়ে তার লস টাইম কভার করতে পেরেছিল।

দময়ন্তী গুপ্তার দুই ছেলে। তারা দুজনেই স্বীয় প্রতিভায় খুব ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বড় ছেলে সঞ্জয় গুপ্তাকেকে না চেনে ! পেশায় সফল নিউরোসার্জন। তারচেয়ে তার বড় পরিচয় হলো সঞ্জয় সি,এন,এন টেলিভিশনের চিফ মেডিকেল করেসপন্ডেট। ছোট ছেলে সুনীল গুপ্তা একজন আইনজীবী। বর্তমানে আমেরিকার কংগ্রেসের সদস্যপদের জন্য প্রতিযোগিতা করছে।

দময়ন্তী গুপ্তা বলেন – তিনি কখনো তার ছেলেদের বলেন নাই তারা কে কি পড়বে। কি পেশায় যাবে। যে যার ইচ্ছামতো পড়েছে। নিজের পেশা বেছে নিয়েছে – ঠিক আমার মতো। আজ আমার পাঁচটা নাতী নাতনী আছে। আমি তাদের বেলাতেও কোন বাধ্য বাধকতা দিবো না। তারা যা হতে চায়, তাই হবে।
শুধু একটা কথা – তাদের অবশ্যই আমার মতো পরিশ্রমী হতে হবে এবং অধ্যবসায় থাকতে হবে।

স্বীয় প্রতিভায় সফল নারী দময়ন্তী গুপ্তা চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছে। থাকছে ফ্লোরিডার ফোর্ট মায়ার্স এ। তিনি ও তার স্বামী সুবাস দুজনে ব্রিজ খেলার পোকা। এছাড়া তার দুনিয়া জুড়ে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে।

সূত্র: TIME ম্যাগাজিন থেকে নেয়া
১৫ই এপ্রিল, ২০১৯