জিয়াউর রহমানের উত্থান পতন
জিয়াউর রহমানের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৯শে জানুয়ারীতে এবং নিহত হন ১৯৮১ সালের ৩০শে মে’তে। যুদ্ধে জীবিত ফিরে আসা সৈনিকদের সাহসিকতার জন্য শ্রেষ্ঠ সন্মাননা হিলাল ই জুরাত ( পাকিস্তান ) ও বীর উত্তম ( বাংলাদেশ ) মেডাল প্রাপ্ত জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি প্রথমে একজন সেনা কর্মকর্তা এবং পরে রাজনিতিবিদ হন যিনি ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল তিনি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে চিটাগাং এ একদল সৈনিকের ষড়যন্ত্রের কারণে তাদের হাতে নিহত হন।
জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের শুরুতে শুরুতে বাংলাদেশ বাহিনী বিডিএফ সেক্টর ১ এর কমান্ডার, সেক্টর ১১ র কমান্ডার, সেই স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের বিজয় পর্যন্ত বাংলাদেশ বাহিনীর ‘জেড ফোর্স’ এর বিগ্রেড কমান্ডার ছিলেন।
তিনি ২৬শে মার্চে চিটাগাং কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পড়েন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার হন। পরে উপ প্রধান সেনাপতি এবং প্রধান সেনাপতিতে উন্নীত হন।
দেশের স্থপতি প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশাল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নিহত হলে জিয়াউর রহমান দেশের ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেন। ক্ষমতা দখলের জন্য সেনাবাহিনীর ভিতর অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থানের ফলাফল হিসাবে জিয়াউর রহমান দেশের প্রধান হিসাবে অধিষ্ঠিত হন সামরিক আইনের ভিতর যা খন্দকার মুশতাকের সরকার আগেই জারী করে রেখেছিল। ১৯৭৭ সালে তিনি দেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন।
প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি ১৯৭৮ সালে তার রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সৃষ্টি করেন। তিনি বহু দলীয় রাজনীতি, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, মুক্ত বাজার এবং জবাবদিহিতা ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রম এবং মাটিকে ভালবাসতে উদ্বুদ্ধ করেন। খাল খননের মাধ্যমে সেচ প্রকল্প, কাজের বিনিময়ে খাদ্যসহ নানাবিধ সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষের জীবন ব্যবস্থা উন্নয়নের ব্যবস্থা করেন। তিনি উদ্যোগী হয়ে প্রথম এশিয় অঞ্চলের দেশগুলিকে নিয়ে সার্ক প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর কঠোর পরিশ্রম এবং উদ্যোগের কারণে বর্তমান সংসদ ভবন এবং ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কার্যক্রম চালু হয়। তিনি পাশ্চাত্য এবং চিন দেশের সাথে আন্তঃ দেশীয় সম্পর্ক উন্নয়ন করেন। এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর দেশ ভারত এবং রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি করেন।
আভ্যন্তরীণভাবে তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের জন্য তিনি কম বেশী একুশটা ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হন। তিনি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের শাস্তি দেয়া যাবে না বিষয়ক ইমডেম্নিটি বিল এবং ধর্মীয় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত দলগুলির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে সমালোচিত হন।
জিয়াউর রহমান দক্ষিণ এশিয়ায় দুটি যুদ্ধে বীরত্বের সাথে অংশগ্রহণের জন্য দুটি বীরত্ব মেডাল প্রাপ্ত হন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের হয়ে ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য জীবিতদের জন্য সাহসিকতার শ্রেষ্ঠ খেতাব হিলাল ই জুরাত এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁর বীরত্বের জন্য পুরস্কৃত হন বীর উত্তম খেতাবে। বিখ্যাত সাংবাদিক এন্থনি মাস্কারেনহাসের ‘বাংলাদেশঃ এ লিগেসি অফ ব্লাড (১৯৮৬) বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ২৮শে এপ্রিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল ( স্বীয় পদোন্নতি ) হিসাবে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন।
তাঁর বানানো রাজনৈতিক দল বিএনপি বাংলাদেশের দুইটা সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের একটা হয়ে যায়। তাঁর স্ত্রী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দলটির বর্তমান চেয়ার পারসন।
~ শৈশব ~
বাবা মনসুর রহমান এবং মা জাহানারা খাতুনের দ্বিতীয় ছেলে জিয়াউর রহমান। বাবা রহমান একজন কেমিস্ট ছিলেন যিনি কাগজ এবং কালির কেমিস্ট্রিতে পারদর্শী ভদ্রলোক কোলকাতার সরকারী ভবন ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ চাকুরী করতেন। শিশুকালে জিয়া যার ডাক নাম ছিল কমল, খুব লাজুক, শান্ত থাকলেও অনেক বিষয়েই তাঁর তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাঁর জন্ম হয় বগুড়ার গাবতলিতে। বড় হয় বগুড়ার বাগবাড়ি গ্রামে এবং পড়াশুনা করেন বগুড়া জিলা স্কুলে।
১৯৪৬ সালে তাঁর বাবা কমলকে কোলকাতার ভাল স্কুল ‘হেয়ার স্কুলে’ ভর্তি করিয়ে দেয়। ১৯৪৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় ইংরেজদের রাজত্ব শেষে ভারত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়া পর্যন্ত তিনি সেই স্কুলে পড়াশুনা করেন। বাবা মনসুর রহমান মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ পাকিস্তানের নাগরিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পরিবার নিয়ে কোলকাতা করাচীতে চলে যায়। তখন ১১ বছরের জিয়াউর রহমান করাচীর একাডেমী স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হন। তিনি তাঁর বয়ঃসন্ধিকাল করাচীতে কাটায়। ১৯৫২ সালে ষোল বছর বয়সে সেই স্কুল থেকে সেকেন্ডারি এডুকেশন শেষ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি করাচীর ডি,জে কলেজে ভর্তি হন। একই বছর কাকুলের পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীতে অফিসার ক্যাডেট হিসাবে যোগদান করেন।
~ বিয়ে ~
১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে ফেনীর ইস্কান্দার মজুমদার এবং তাইয়েবা মজুমদারের কন্যা খালেদা মজুমদারের সাথে অনাড়ম্বরভাবে জিয়াউর রহমানের বিয়ে হয়। ফেনী তখন বৃহত্তর নোয়াখালীর অংশ ছিল। বিয়ের সময় খালেদা মজুমদারের বয়স ছিল পনের। খালেদা মজুমদার পরবর্তীতে খালেদা জিয়া হন। তিনি তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। বিয়ের সময়ে জিয়াউর রহমান পাকিস্তান আর্মির একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন। জিয়া’র বাবা করাচীতে থাকায় এই বিয়েতে যোগ দিতে পারেন নাই। তাঁর মা আগেই মারা গেছেন।
~ পাকিস্তান মিলিটারিতে জিয়া ~
পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী থেকে পাশ করার পর ১৯৫৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জিয়া ১২তম পিএমএ’র লং কোর্সে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসাবে কমিশন লাভ করে। তাঁর ক্লাসের টপ টেন পারসেন্টের ভিতর জিয়া কৃতিত্ব অর্জন করেন। সেনাবাহিনীতে তিনি কমান্ডো, প্যারাট্রুপার, বিশেষ গোয়েন্দাগিরির প্রশিক্ষণ লাভ করেন।
এক সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে জিয়া পূর্ব পাকিস্তানে গেলে বাঙ্গালী মধ্যবিত্তদের মিলিটারির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দেখে আহত হন। কারণ মিলিটারি দেশের বিত্তের অধিকাংশ ভোগ করছিলো। সেনাবাহিনীতে বাঙ্গালীদের খুব সংখ্যক অফিসার থাকাটা তাঁর কাছে চরম বৈষম্যমূলক মনে হয়েছে। তবে তিনি এটাও অনুভব করেছেন বাঙ্গালীদের মিলিটারির প্রতি নেতিবাচক মনোভাবও সেনাবাহিনীতে তাদের অন্তর্ভুক্তির প্রতি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। তখন তিনি বাঙ্গালী অফিসার হিসাবে যুবকদেরকে মিলিটারিতে অংশগ্রহণের জন্য আহবান জানায়।
দুই বছর করাচীতে থাকার পর ১৯৫৭ সালে তাঁকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। মিলিটারি ট্রেইনিং নিতে পশ্চিম জার্মানি এবং বিলাতে যান। তিনি ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেছেন।
১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আইয়ুব খানের সফল সামরিক শাসনামল দেখে জিয়া অনুভিব করেন মিলিটারির প্রতি বাঙ্গালীদের ভাবনার মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৯৬৫ সালের ইন্দো পাক যুদ্ধে জিয়া পাঞ্জাবের খেমকারান সেক্টরে ১০০ থেকে ১৫০ সদস্যের সেনা ইউনিটের কমান্ডার হিসাবে যুদ্ধ করেন। সেই যুদ্ধে তাঁর বীরত্বের জন্য তাঁকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রধান সামরিক মেডাল হিলাল ই জুরাত পান। এবং তাঁর কোম্পানি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেই যুদ্ধে জেতার জন্য তিনটা সিতারা ই জুরাত এবং আটটা তমঘা ই জুরাত মেডাল লাভ করে।
১৯৬৬ সালে জিয়া পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমীর পরিচালক হিসাবে যোগ দেয়। তাঁর কিছুদিন পর তিনি কোয়েটায় কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজে যান। সেখানে তিনি কমান্ড এন্ড ট্যাক্টিক্যাল ওয়ারফেয়ারের উপর কোর্স সমাপ্ত করেন। স্টাফ কলেজে প্রশিক্ষক থাকাকালীন সময়ে জিয়া অষ্টম এবং নবম বেঙ্গল নামের দুইটা ব্যাটালিয়ন তৈরির কাজে অবদান রাখেন।
১৯৬৬ সালের ২০শে নভেম্বর তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়ার গর্ভে তাদের প্রথম সন্তান তারেক রহমান জন্ম নেয়। ১৯৬৯ সালে জিয়া ঢাকার গাজীপুর জিলার জয়দেবপুরে দসেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহ অধিনায়ক হিসাবে যোগ দেয়।
~ প্রাক স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ~
কিছুদিন জার্মানিতে ট্রেইনিং শেষে পরের বছর জিয়া পাকিস্তানে ফিরে যায় এবং মেজর পদে প্রমোশন পায়। ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড হয়ে চিটাগাং এ বদলি হয়। পূর্ব পাকিস্তান তখন সত্তুরের ভয়াবহ ভোলা সাইক্লোনে পর্যুদস্ত। কেন্দ্রীয় সরকারের গা ছাড়া ভাব দেখে এপারের মানুষের ভিতর তাদের প্রতি ক্ষোভ, অনীহা বাড়ছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লিগ এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির ভিতর রাজনৈতিক বিরোধ বাড়ছিল। সত্তুরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পর তার প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান সরকার গঠন করতে চায়। কিন্তু ভুট্টোর চাপে পড়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই নির্বাচন বাতিল করে দেয়।
~ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ~
আলোচনা ব্যর্থ হলে ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারী করে। বাঙ্গালীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর সামরিক অভিযানের আদেশ দেয়। ২৬শে মার্চের মধ্যরাতের আগে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে তেজগাঁ এয়ারপোর্টে নিয়ে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
দেশের এমন অবস্থায় চিটাগাং এ অবস্থানরত মেজর জিয়া বিদ্রোহ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো। কালরাতের পরদিন জিয়া বিদ্রোহ করে। তিনি তাঁর কমান্ডিং অফিসার লে কর্নেল জাঞ্জুয়াকে গ্রেফতার করে পরে হত্যা করে।
বিদ্রোহের পর ২৭শে মার্চ জিয়া চিটাগাং কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন –
I, Major Ziaur Rahman, Provincial Head of the government, do hereby declare that Independence of the People’s Republic of Bangladesh.
একই দিনে মানে ২৭শে মার্চ তারিখে তিনি সংশোধিত দ্বিতীয় ঘোষণা পত্র পাঠ করেন, যা ছিল এমন –
I, Major Ziaur Rahman, do hereby declare the Independence of Bangladesh in the name of our great leader Sheikh Mujibur Rahman.
পরবর্তীতে জার্মান রেডিওর সাথে ইন্টার্ভিউতে জিয়া তাঁর ২৭শে মার্চের ঘোষণার বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।
জিয়া মিলিটারি এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালী সৈন্যদের যোগাড় করে একটা পদাতিক বাহিনী তৈরি করেন। এই বাহিনীকে তিনি সেক্টর নং ১ নাম দেন যার হেডকোয়ার্টার সেব্রুমে। সপ্তাহ কয় পড়ে তাঁকে তেলঢালায় স্থানাতর করা হয় যেখানে তিনি সেক্টরনং ১১ সমন্বয় করে। সকল সেক্টরের পুনঃবিন্যাস করে আনুষ্ঠানিকভাবে নাম দেয়া হয় বাংলাদেশ ফোর্সেস। যার নিবাস হয় চিটাগাং এবং পার্বত্য এলাকায়। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের পক্ষ থেকে সকল সেক্টরের সুপ্রিম কমান্ডার হয় কর্নেল এম এ জি ওসমানী।
১৯৭১ এর ৩০শে জুলাই জিয়া বাংলাদেশের প্রথম কনভেনশনাল ব্রিগেডের কমান্ডার হিসাবে নিয়োজিত হন, যার নাম হয় তাঁর নামের প্রথম অক্ষর জেড দিয়ে ‘জেড ফোর্স।’ প্রথম, তৃতীয় এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘জেড ফোর্স’ যা কমান্ডার জিয়াকে পাকিস্তানী বাহিনীর উপর কঠোর আক্রমণ করতে সহায়তা করে। ‘জেড ফোর্স’ এর কারণে সক্ষম মরনাঘাত হানতে কামিয়াব হওয়ায় জিয়া ‘ইস্পাত শীতল’ সাহসিকতার সুনামে ভূষিত হয় বলে ‘দি নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকা জানায়। তাঁর এই অসীম সাহসিকতা এবং বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দ্বিতীয় প্রধান সামরিক খেতাব ( জীবিতদের জন্য সর্বোচ্চ ) ‘বীর উত্তম’ এ ভূষিত হন।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের জীবনাবসান এবং তার পরের অবস্থা –
শেখ মুজিবকে হত্যা করার বহু আগে থেকে তাঁকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার গভীর ষড়যন্ত্র আভ্যন্তরীণ এবং বহিরাগত শত্রুরা বহুদিন ধরে করছিলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সেনাবাহিনীর সদস্যদের ভিতর বন্দুক যুদ্ধের জের হিসাবে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারের নিহত হন। তারপর শেখ মুজিবের মন্ত্রী সভার একজন সদস্য এবং প্রধান ষড়যন্ত্রকারী খোন্দকার মোশ্তাক আহমেদ প্রেসিডেন্টের স্থালিভিশিক্ত হয়। তিনি মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহকে সেনা প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনা প্রধান নিযুক্ত করেন।
~ এরপর যা ঘটলো ~
১৫ই আগস্টের ঘটনা সেনাবাহিনীর ভিতর অস্থিরতা তৈরি করলো। ৩রা নভেম্বর একের পর এক পাল্টা ক্যু ঘটতে লাগলো। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ৪৬তম ব্রিগেডের প্রধান কর্নেল শাফায়াৎ জামিল খোন্দকার মোস্তাকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করলো। তারা জিয়াউর রহমানকে বাধ্য করলো তাঁর পদ ছেড়ে গৃহ বন্দী হতে। পর্দার আড়ালে থাকা শক্তিরা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে একটা পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে চাইলো। অসহিশ্নতা, অবিশ্বাস, ভয় ভিতিত দেশের অধিকাংশ অংশের মানুষকে অস্থিরতায় ফেলে দিলো। ৭ই নভেম্বরে ঘটলো সিপাহি জনতা বিপ্লব। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল তাদের নেতা অবসরে থাকা কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে একদম সমাজতান্ত্রিক সেনা অফিসারের সহযোগিতায় এই অভুত্থান ঘটালো। এই অভ্যুত্থানে খালেদ মোশারফকে হত্যা করা হয়। কর্নেল জামিলকে গ্রেফতার করা হয়। দ্বিতীয় আর্টিলারী ডিভিশনের লে কর্নেল রশিদ জিয়াকে গৃহ বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে পুনরায় সেনা প্রধান পদে ফিরিয়ে আনে যেটায় সেনাবাহিনীর সবার পূর্ণ সমর্থন ছিল।
সেনা দপ্তরে এক সভার সিদ্ধান্তে একটা অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয় যেখানে বিচারপতি আবু সায়েমকে প্রধান সামরিক প্রশাসক, সেনা প্রধান জিয়া, বিমান বাহিনী প্রধান এম এ জি তাওয়াব এবং নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খ্যাঁকে উপ প্রধান সামরিক প্রশাসক নিয়োগ করা হয়।
সিপাহী বিপ্লবের পর টান টান অস্থিরতা সৈনিকদেরকে নিরস্ত্র করে ব্যারাকে ফেরাতে এবং ডিসিপ্লিন ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন ব্যাপার হয়ে গেল। জিয়া দেখলো সিপাহী জনতা বিদ্রোহ সেনাবাহিনীর আইন কানুন এবং শৃঙ্খলা ভেঙ্গে দিয়েছে। বাঙ্গালদেশ সেনাবাহিনীকে পুনরায় দিসিপ্লিন্ড ফোর্স হিসাবে ফিরিয়ে আন্তঃে হলে তাদের ভিতর আইন মানা এবং র্যাংক মানার প্রবণতা ফেরাতে হবে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদেরকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে। তখন তিনি জাসদ এবং গনবাহিনিরর উপর স্টিম রোলার চালানো শুরু করলো। সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে কর্নেল আবু তাহেরকে সামরিক আদালত মৃত্যুদণ্ড দেয়। অন্যান্য নেতাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদের জেল জরিমানা করা হয়।
১৯৭৬ সালের ১৯শে নভেম্বরে বিচারপতি সায়েম দেশের প্রেসিডেন্ট হলে জিয়া প্রধান সামরিক প্রশাসকের পদে উন্নীত হয়। জিয়া পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা অফিসারদের যোগ্যতা এবং জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী সেনাবাহিনিতে পুনর্বাসিত করে সেনাবাহিনীতে সমতা আনার চেষ্টা করেছে। এতে করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়া অফিসাররা তাঁর উপর ক্ক্ষুব্ধ হয় যারা একাত্তুরের পর দ্রুত প্রমোশন পেয়ে উঁচু পদে পৌঁছে যায়। তাদের অসন্তোষ দুর করতে জিয়া বীতশ্রদ্ধ অফিসারদের বিদেশের দূতাবাসে পাঠিয়ে দিয়ে বাহিনীতে শান্তি ফিরিয়ে আনে।
~ বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ~
১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল জিয়া বাংলাদেশের সপ্তম প্রেসিডেন্ট হন। পূর্বের আওয়ামী লিগ এবং বাকশাল সরকারের বছরের পর বছর অনিয়ম বাংলাদেশের সকল সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলিকে এলোমেলো করে ফেলে। ১৯৭৭ সালে সামরিক আইন উঠিয়ে নিয়ে জিয়া দেশের উন্নয়নের লক্ষে মারাত্বক সব কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া শুরু করে।
একই বছরের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে একটা ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটে। সে সময় জাপানের রেড আর্মি তাদের একটা বিমান হাইজ্যাক করে ইন্দিয়া থেকে ঢাকা তেজগাঁ এয়ারপোর্টে নিয়ে আসে। সরকার যখন এই হাইজ্যাক নিরসনের কাজে ব্যস্ত, ঠিক তখুনি বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে একটা সেনা অভ্যুত্থান ঘটে। যদিও খুব দ্রুততার সাথে সেই ক্যু থামিয়ে দেয়া হয়। এই ক্যু সহজে থামিয়ে দেয়া গেলেও ২রা অক্টোবর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আরেকটা ক্যু হয়ে যায়। এই ক্যু করে ভুল তথ্য পাওয়া বিমান সৈনিকেরা। তারা কিছু পদাতিক সৈনিকের সাথে জোট বেধে প্রথমে জিয়ার বাসভবন আক্রমণ করে। পড়ে তেজগাঁ এয়ারপোর্টে এসে ত্রিশ জন বিমান সৈনিক যারা হাইজ্যাক নিরসনের কাজে ছিল তাদেরকে হত্যা করে। সরকারের ভীত নড়ে গেলেও উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খানের মধ্যস্থতায় এই দ্রোহ ও ঠাণ্ডা করা হয়। হামিদুল্লাহ খান পুরস্কৃত হয় পদোন্নতি পেয়ে। ক্যুয়ের বিষয়ে আগাম তথ্য পেতে ব্যর্থ হওয়ায় চাকরী হারিয়েছে এনএসআই ( ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স ) এবং ডিএফ আই ( ডাইরেক্টরেট অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স ) প্রধানেরা।তারপর ডিএফআই অফিস বেইলী রোড থেকে সরিয়ে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হয়। এই ক্যু এর সাথে জড়িত দুইশ’ সৈনিকে সামরিক আদালতে বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেয়া হয়, যার কারণে অনেকে জিয়াকে নির্দয় বলে নিন্দা করে।
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয় এবং সামরিক বাহিনীর সৈনিকের সংখ্যা ৫০০০০ থেকে বাড়িয়ে ৯০০০০ হাজার করা হয়। ১৯৭৮ সালে জিয়া হুসেইন মুমম্মদ এরশাদকে সেনাপ্রধান বানিয়ে তাকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল র্যাংকে উন্নীত করেন। এরশাদকে মনে হয়েছে একজন সৈনিক ছাড়া তার কোন রাজনৈতিক স্বপ্ন নাই কিন্তু যার ভারতের প্রতি কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে। একাত্তুরের যুদ্ধের সময় তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী ছিলেন। ধীরে ধীরে সে জিয়ার খুব ঘনিস্ট জঙ হয়ে যায়।
~ নির্বাচন ~
১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে বিপুল ভোটে জয়ী পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় বসেন। পরের বছর সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যদিও বিরোধী শিবিরের মানুষ এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
১৯৮১ সালে তিনি শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনেন।
~ আভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতি ~
ক্ষমতায় গিয়ে সমস্যা জর্জরিত দেশে জিয়া আপোষহীন নেতা হিসাবে পরিচিতি পায়। বাংলাদেশ ভুগছিল অশিক্ষা,দুর্ভিক্ষ,বেকারত্ব,অভাব,অর্থনৈতিক বন্ধাত্বের অভিশাপে। জিয়া তাঁর উত্তরসূরি মুজিবের ধর্ম নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র এবং ভারত নির্ভর মনোভাব থেকে দেশকে সরিয়ে আনে। জিয়া জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন, মুক্ত বাজার ব্যবস্থা, স্বনির্ভরতা, গ্রামীণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, এবং বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে ১৯ দফার অর্থনৈতিক উন্নয়নের ঘোষণা দেন। আশার রাজনীতির বানী নিয়ে সারা দেশব্যাপী ঘুরে বেড়ান এবং সবাইকে কঠিন পরিশ্রম করে বেশী ফসল ফলিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের আহবান জানান। দেশের আনাচাকানাচে বসে মন্ত্রী সভা করেন। তাঁর মুল লক্ষ ছিল কৃষি এবং শিল্প খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন বিশেষ করে খাদ্য এবং শস্য খাতে। তাঁর দৃষ্টি ছিল গ্রামীণ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনে বিশেষ করে জনসংখ্যাকে কাজে লাগানো। তিনি পাট এবং চাল গবেষণা ইন্সটিটিউটগুলি খুলে দেন। তিনি একটা সুদুর প্রসারী গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয় যেটি দৃশ্যত কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্প ছিল এবং খুব জনপ্রিয় হয়। তিনি ব্যাক্তি মালিকানাধীন ব্যবসার প্রসার, রফতানী বৃদ্ধি,ক্ষেত খামারগুলিকে সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর হাত থেকে মুক্ত করেন। তাঁর সরকার কৃষি এবং শিল্প কারখানার উপর কোটা এবং বিধিবদ্ধ নিয়ম শিথিল করে। জিয়া অনেকগুলি মেঘা প্রজেক্ট হাতে নেয় যার ভিতর ছিল সেচ প্রকল্প উন্নয়নের জন্য খাল খনন,বিদ্যুত কেন্দ্র, বাঁধ,রাস্তাঘাট এবং অন্যান্য জনহিতকর কাজ। তাঁর এইসব প্রকল্পগুলি বাস্তবায়নের জন্য তিনি গ্রাম সরকার পদ্ধতি এবং গ্রামের অপরাধ দমনে ভিলেজ ডিফেন্স পার্টি তৈরি করে। দেশব্যাপী বয়স্ক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন। এই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত অগ্রগতি লাভ করে।
জিয়া বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কিছু গোঁড়া ডানপন্থী এবং সুবিধাবাদী বামপন্থী মানুষ যাদের বিশ্বাস ছিল অর্থনৈতিক এবং সামরিক নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশকে শুধু ভারত নির্ভর থাকতে হবে – জিয়া সেই ধারনা থেকে বেড় করে আনে বাংলাদেশকে। তিনি ভারত এবং রাশিয়ার কবল থেকে ছুটিয়ে আনে দেশকে। সম্পর্ক গড়ে তোলে আমেরিকা এবং পাশ্চাত্য, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাথে। জিয়া এছাড়াও সম্পর্কের জ্বাল বুনে সৌদি আরব এবং চিন দেশের সাথে, যারা পাকিস্তানের পক্ষে থাকায় ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয় নাই। জিয়া পাকিস্তানের সাথে ঠাণ্ডা সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তোলে। ভারতের সাথে দূরত্ব তৈরি করে জিয়া মুসলিম দেশগুলির সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। জিয়ার এই পদক্ষেপের কারণে মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নতি হয়। ইতিহাসবিদেরা লেখেন, জিয়ার এমন পদক্ষেপের ফলে তেল সমৃদ্ধ দেশগুলিতে বাংলাদেশের জনশক্তি রফাতানির দুয়ার খুলে যায়। এই ক্ষেত্রে জিয়া এমনই সফল হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি থেকে আসা রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তিকে মজবুত করে তোলে।
জিয়ার প্রস্তাবিত সাউথ এশিয়ার দেশগুলুর ভিতর অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ক প্রকল্প জিয়ার পড়ে এরশাদের সময় সার্কে আলোচিত হয় এবং প্রশংসা কুড়ায়।
~ ইসলাম এবং জাতীয়তাবাদ ~
জিয়া বিশ্বাস করে দেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মীয় পরিচয়হিনতায় ভুগছে। তাই তিনি বাংলাদেশকে ইসলাম ধর্মই ভিত্তিক রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে নেয়। তিনি সংবিধান সংশোধন করে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বাদ দিয়ে তাতে অভিবাদন ‘বিমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যোগ করেন। সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে তিনি লেখেন ‘ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নয়য় বিচার। দেশের স্বার্থে ধর্ম নিরপেক্ষতা থেকে সরে এসে ইসলামের প্রতি জোর দেয়ায় মুসলিম দেশগুলির সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বাংলাদেশের প্রতি তাদের সাহায্যের হাত প্রসারিত হয়েছে বহুদূর। যদিও অনেক বুদ্ধিজীবী দেশকে শেখ মুজিবের ধর্ম নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বদলে ইসলামিক মনোভাবের করার কারণে জিয়ার কট্টর সমালোচনা করে।
জিয়া স্কুলগুলির পাঠ্যক্রমে মুসলমান ছাত্রদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে।
বাংলাদেশ সৃষ্টির পর অনেক মৌলবাদী মানুষ পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। ১৯৭২ সালের স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে তাদেরকে কলাবরেটর হিসাবে চিহ্নিত করে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। জিয়া সেই আইন বাতিল করে তাদেরকে বাংলাদেশে আবার রাজনীতি করার সুযোগ দেয়।
জিয়া শেখ মুজিব কতৃক জাতীয় পরিচয় ‘বাঙ্গালী’কে বদলে ‘বাংলাদেশী’ করে। বাঙ্গালী ভাষা ভিত্তিক পরিচয় কিন্তু বাংলাদেশী পরিচয় ধর্মীয় গুরুত্ব পায় বেশী। তিনি বলেন জাতীয় পরিচয়ে ধর্মের গুরুত্ব অধিকতর। তিনি বলেন বাঙ্গালী একটা গোষ্ঠীর পরিচয় কিন্তু বাংলাদেশী একটা জাতির পরিচয় বহন করে। তিনি কথা দেন সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তাই তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে আলাদা করে কথা বলেন।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সৃষ্টির পর জিয়া ছাত্রদের উদ্ধেস্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ নিয়ে ক্লাস নিতেন।
~ ইমডেম্নিটি এক্ট ~
জিয়া অনেকগুলি বিতর্কিত বিষয়ের বিধি পাল্টায়। কিছু করে সেনাবাহিনীর ভিতর ডিসিপ্লিন বাড়াতে। কিছু করে নিজের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে। কিছু করে জামাতের মত ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিতে। জিয়া মুসলিম লীগসহ সকল ইসলামিক দলগুলিকে দেশে রাজনীতি করার পথ সুগম করে দেয়। খুব বিতর্কিত স্বাধীনতা বিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রাজনীতি এবং ক্ষমতায় পুনরায় প্রতিষ্ঠা দিয়ে। ( শাহ আজিজকে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে জেল থেকে মুক্তি দেয়।)
শেখ মুজিব হত্যার সাথে জড়িত সেনা অফিসারদের জিয়া বিদেশে বাংলাদেশের মিশনে চাকরী দিয়ে সমালোচিত হয়।
~ জিয়া হত্যা ~
সাধারণ মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয় থাকলেও সেনাবাহিনীতে তার দয়া মায়া হীন মনোভাবের জন্য বিরোধী পক্ষের কাছে জিয়া চক্ষুশূল ছিল। ক্ষমতায় অনেক বিতর্কিত মানুষকে নিয়োগ দিয়ে জিয়া আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং মুক্তিবাহিনীর ভেটারানদের চরম বিরোধিতার মুখোমুখি হয়। এত বিরোধিতা, অসহযোগ সত্বেও চিটাগাং এর বিএনপি’র আভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে ১৯৮১ সালের ২৯শে মে সেখানে যান। সার্কিট হাউজে অবস্থানকালে ৩০শে মে রাতে জিয়া একদল সেনা অফিসারের হাতে খুন হয়ে যায়।
মারাত্বক জনপ্রিয় জিয়ার জানাজায় প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ জমায়েত হয়।
~ সমালোচনা এবং উত্তরাধিকার ~
যুদ্ধে বীরত্বের জন্য জিয়ার ভূমিকা অনেক রাজনিতিকের কাছে প্রশংসার হলেও ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে শেখ মুজিব এবং তার পরিবারের হত্যাকাণ্ডের পর তার ভূমিকা বিতর্কিত রয়ে গেছে। ইমডেম্ননেটি এক্টের মাধ্যমে খোন্দকার মোশতাক শেখ মুজিবের খুনিদের মাফ করে দেয় যা পরে জিয়ার আমলে বৈধতা পায়। জিয়ার আমলে শেখ মুজিবের খুনিদের অনেকে সপরিবারে বিদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ পায়।
হাইকোর্টের এক রায়ে ১৯৭৫ এবং ১৯৭৯ এ মিলিটারি কতৃক ক্ষমতা দখলকে আইন বহির্ভূত অভিহিত করা হয়। জিয়ার মিলিটারী শাসনকে বেআইনি এবং সংবিধান বহির্ভূত বলা হয়। জিয়ার সামরিক আইনের নিয়তি, তার প্রেসিডেন্ট হিসাবে উত্থান, ১৯৭৮ সালের রেফারেন্ডামকে সংবিধান্যের সাথে সাংঘর্ষিক বলা হয়।
কর্মরত ইমডেম্নিটি এক্টকে অগ্রাহ্য করেছে যার দ্বারা অনেক অন্যায়কে মেনে নেয়া হয়েছে।
জিয়াকে বাহবা দেয়া হয়েছে শেখ মুজিবের শেষের সময়কালের বাকশালের অনিয়মকে রোধ করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করায়। অন্যদিকে তার সমালোচনা হয় বিরোধীপক্ষকে কোণঠাসা করার জন্য। বলা হয় তার সময়কালে বিরোধিতা করায় প্রায় তিন হাজার সেনা অফিসারকে গুম করা হয় এবং ফাঁসি দেয়া হয়। জিয়াকে উৎখাত করার ব্যর্থ চেষ্টার ফলাফল হিসাবে একটা সামরিক বিচারে একদিনে ১১৪৩ জনকে বিভিন্ন জেলে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে।
যাইহোক জিয়ার সংস্কার নীতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের দাবীদার হিসাবে প্রশংসিত হয়। দেশকে ইসলামিক করায় দেশের সাধারণ মানুষের সমথন পায়। ধর্ম নিরপেক্ষ নীতি থেকে সরে ইসলামী জাতীয়তাবাদে সরে এসে জিয়া সংখ্যাগুরু মানুষের মন জয় করেছে। ভারত এবং সোভিয়েত ব্লক থেকে বেড় হয়ে চিন এবং মধ্যপ্রাচ্য ঘেঁষা হয়ে দেশের ব্যাপাক উন্নয়ন সাধন করেছে। যদিও সংখ্যালগু সম্প্রদায় তার উপর সন্তুষ্ট ছিল না। যদিও এটাও বলা হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অসন্তুষ্টির জন্য জিয়াকে একা দায়ী করা যাবে না।
জিয়া খুব সাধারণ জীবন যাপন করেন। এবং সচরাচর সেনা বাহিনীর ক্যান্টিনের খাবার খেতেন প্রেসিডেন্ট হয়েও।
~ পরিবার ~
জিয়া মৃত্যুকালে স্ত্রী খালেদা জিয়া এবং দুই ছেলে রেখে যান। খালেদা জিয়া ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। বড় ছেলে তারেক রহমান দলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। ধারনা করা হয় ২০০৪ সালে শেখ মুজিব কন্যা আওয়ামী লীগ প্রধান এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা ও দলের সিনিয়র নেতাদের উপর গ্রেনেড হামলার মুল নায়ক তারেক রহমান।
~ সন্মাননা ~
তুরস্কের আংকারায় জিয়ার নামে একটা প্রধান সড়কের নামকরণ করা হয়। ২০০৪ সালে বিবিসি পোলে জিয়াকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীদের তালিকায় বিশ নম্বর স্থান দিয়েছে। সার্ক তাকে স্টেটসম্যান হিসাবে সন্মানিত করেছে। এছাড়া মিশর তাকে খেতাব দিয়েছে অর্ডার অফ দি নাইল, যুগোস্লাভিয়া দিয়েছে অর্ডার অফ দি জুগোস্লাভ স্টার, নর্থ কোরিয়া দিয়েছে হিরো অফ দি রিপাবলিক।
অনুবাদ – মুরাদ হাই, ১লা আগস্ট, ২০১৯
Source:
https://en.wikipedia.org/wiki/Ziaur_Rahman?fbclid=IwAR3xV7ZoLstrbFLXnhLwDs66pPxLifJwesIAFVUKjhmB-BQijEMFWcx8JK4#/media/File:Ziaur_Rahman_1979.jpg
Rezaul Karim
Excellent article on this subject.
Something could be more cleared. Truth must be told against falsehood. Some Ambiguity remains. But oveall, its one of the best, ive read on zia.
Chacha
great article.
I was not aware of the facts since i left country in March 1972.