শীতের রাজ্য – অয়মায়াকন গ্রাম

দেশে এখন মাঘ মাস। মানে শীতকাল। তাপমাত্রা সেন্টিগ্রেডের হিসাবে চৌদ্দ ডিগ্রী। তাতেই মানুষের শীত নিয়ে অভিযোগের শেষ নাই। সবাই নাকি কাঁপতে কাঁপতে শেষ। কাঁপার তো কথাই। ইট পাথরের বাড়িঘরে শীত বেশী লাগে। শীত ঠেকানোর ব্যবস্থা নিয়ে ঘরবাড়ি তৈরী হয় নাই। তাই গরমকালে গরম বেশী, আবার শীতকালে শীত ও বেশী লাগে।

চায়নার সাংহাইতে আমার একজন বাল্য বন্ধু থাকে। ওদেরও এখন শীতকাল। সাংহাই শহর একটা নদী দিয়ে ভাগ করা। তার একপাশের ঘর বাড়িতে হিটিং সিস্টেম আছে। আরেকপাশে নাই। কেউ চাইলে গাঁটের পয়সা খরচ করে আলাদা ইলেক্ট্রিক হিটার ব্যবহার করতে পারে।

বাস্তব হল, অনেক ঠান্ডা তাপমাত্রায় পুরো বাসায় হিটিং এর ব্যবস্থা না থাকলে ঘরের ভিতর একটা ছোট পোর্টেবল হিটার চালিয়ে আসোলে বিশেষ কোন উষ্ণতা পাওয়া যায় না। তাই বন্ধূকে যখনই ফোন করি, শুনি সে লেপের তলায় শুয়ে আছে। এই হল অবস্থা।

আমেরিকা অনেক বড় দেশ। দেশ না বলে আসোলে মহাদেশ বলাই ভাল হবে। কারন, আমেরিকার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে উড়ে যেতে যত সময় লাগে, তার অনেক আগে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ইয়োরোপ কিংবা দক্ষিন আমেরিকার অনেক দেশে চলে যাওয়া যায়।

শুধু কি তাই নাকি ! নিউইয়র্ক, নিউজার্সি কিংবা ভার্জিনিয়ায় যখন মানুষ বোঁচকা পরেও শীতে কাঁপে, বরফে আছাড় খেয়ে পড়ে, ঠিক একই সময়ে ফ্লোরিডা কিংবা ক্যালিফোর্নিয়ায় মানুষ শুধু একটা টিশার্ট পরে ঘুরে বেড়ায়। দুরত্ব শুধু নয়, তাপমাত্রাও ভিন্ন।

দীর্ঘকাল ধরে আমি নিউইয়র্ক রাজ্যে বসবাস করি। জন্মের পর নিজের জন্মভুমিতে যত বছর থেকেছি আজকের হিসাব মতে সমপরিমান সময় আমি এই শহরে কাটিয়েছি। তাই এই শহরের মানুষ, খাবার, রাস্তাঘাট, গলি, ঘুপচি থেকে শুরু করে আবহাওয়ার সাথেও নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছি।

জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী – এই দুই মাস এই রাজ্যের শীতকালের সবচেয়ে কঠিন সময়। তাপমাত্রা নামতে নামতে কখনো মাইনাসে চলে যায়। তুষারপাত হতে হতে এক কোমর ছাড়িয়ে যায়। আবার দুই দিন পর হটাৎ তাপমাত্রা ফারেনহাইটে ষাট ডিগ্রীতে উঠিয়ে দিয়ে সবাইকে ভ্যবাচ্যাকাও খাইয়ে দেয়। এই শীত নিয়ে আমাদের কত অভিযোগ। কত বিরক্তি।

ইন্টারনেট, ক্যাবল,টিভি, মোবাইল ফোনের সুবিধার কারনে দেশের মানুষের কাছে বিদেশের কোন খবর এখন অজানা থাকে না।

তাঁরা বলে, তোমরা এই ঠান্ডার ভিতর থাকো কেমন করে ?

হ্যাঁ ,থাকি তো এবং খুব আনন্দের সাথে।

কারন, শীত তো আমাদের গায়ে লাগে না। ঘরে, বাইরে, গাড়িতে, কাজে, দোকানপাটে সর্বত্র হিটিং এর কারনে। সময়োপযোগী কাপড়চোপড় পড়ার কারনে শীত আসোলে টেরই পাই্ না।

সত্যি কথা হল, শীতকাল নিয়ে আমার অভিযোগ শুধু একটাই – সেটা হল, ঘরের বাইরে মাটি খুব ঠান্ডা হয়ে যায়। যার কারনে গাছ পালা মরে যায়। বাগান করা যায় না। এছাড়া আমার অন্য কোন অভিযোগ নাই।

এত আরামে থেকে আমি যদি শীত নিয়ে অভিযোগ করি, তাহলে যারা আসোলেই অসহনীয় শীতের ভিতর মাসের পর মাস কাটায়, তাদের প্রতি অবিচার করা হবে।

এন্টার্টিকায় না হয় মানুষ থাকে না। তাই যতই ঠান্ডা হোক না কেন, তাতে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু মানুষের বসতি আছে, এমন জায়গাতেও এন্টার্টিকার মত শীত পড়ে, এটা আমি আজই জানলাম। জেনে নিজের এত আরামে থাকার পরেও শীত নিয়ে অভিযোগ করার জন্য অনুতপ্ত বোধ করছি।

রাশিয়ার শীতকাল খুব কঠিন, এটা জানি। সে দেশে সব নাগরিকের সব ধরনের মৌলিক সুবিধা নাই সেটাও জানি। আজ রাশিয়ার এমন এক গ্রামের কথা জেনেছি, এর আগে আমি যা কোনদিন শুনি নাই। যা কিনা এন্টার্টিকাকেও হার মানায়। কারন এন্টার্টিকায় মানুষ থাকে না, কিন্তু রাশিয়ার সেই গ্রামে মানুষ বসবাস করে, যেখানে শীতকালে গড়পড়তায় তাপমাত্রা কখনোই মাইনাস পঞ্চাশ সেন্টিগ্রেডের উপরে উঠে না।

আসুন জানি, বিশাল দেশ রাশিয়ার সাখা (Sakha Republic) প্রদেশের অয়মায়াকন (Oymyakon,Rusia) গ্রামের কথা। এই গ্রামকে পৃথিবীর সবচাইতে শীতলতম মানুষের বসতি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। অয়মিয়াকন নদীর নামে এই গ্রামের নামকরন হয়। প্রবাদ আছে এই নদীর নামকরন হয় সাইবেরিয়া অঞ্চলের মানুষের ভাষা ‘Even’ এর একটা শব্দ kheiyum যার ইংরেজী অর্থ unfrozen lake. বলা হয়, এই নদীর একটা অংশে পানি কখনো জমে যায় না। শীতকালে নদীর সেই অংশে মাছ এসে বসতি করে। যা কিনা এই গ্রামের মানুষের খাদ্য রসদের একটা বড় উৎস। এছাড়াও বল্গা হরিনের দল আসে এই লেকে পানি খেতে। সেই হরিন ও গ্রাম বাসীর খাদ্যের উৎস।

Amos Chapple নামে ওয়েদার ডট কম এর এক সাহসী ফটো সাংবাদিকের দুঃসাহসী ভ্রমন এবং ছবির উপর ভিত্তি করে আমার এই লেখা।
অয়মায়াকন গ্রামের জনসংখ্যা মাত্র পাঁচশো জন মানুষ। সমুদ্র জলসীমার সাড়ে সাতশো মিটার উপরে অবস্থিত এই গ্রামে শীতকালে দিনের আলো থাকে মাত্র তিন ঘন্টার জন্য আবার গরমকালে এই দিনের আলোর স্থায়িত্ব একুশ ঘন্টাও হয়ে যায়।

কোন মানুষ বাস করে এমন এলাকা হিসাবে অয়মায়াকন সবচাইতে ঠান্ডা এলাকা হিসাবে শীর্ষস্থান পাবে নিঃসন্দেহে। ১৯২৪ সালে এই গ্রামের তাপমাত্রার রেকর্ড ছিল -৭২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। এরপর থেকে শীতকালে যা কখনোই – ৫০ ডিগ্রীর উপরে উঠে নাই। অক্টোবর থেকে জুন মাস পর্যন্ত অয়মিয়াকন গ্রামের তাপমাত্রা কখনোই ফ্রিজিং পয়েন্টের উপরে উঠে না।

যদিও এই অঞ্চলের শীতকাল অনেক দীর্ঘ এবং কঠিন, কিন্তু গরমকাল অনেক উষ্ণ হয়। জুন, জুলাই, আগষ্ট মাসের তাপমাত্রা দিনের বেলায় সেন্টিগ্রেডে ৩০ ডিগ্রী ছাড়িয়ে যাওয়ার রেকর্ড ও আছে। তাহলেও গড়ে সাত মাস তাপমাত্রা ফ্রিজিং পয়েন্টের নীচে থাকার দরুন মাটি জমে যায়। শীতকালে আবহাওয়া অনেক শু’স্ক থাকে। তারপর যখন গরম আসে সেই অল্প সময়টুকু আবহাওয়া অনেক আদ্র থাকে। কিন্তু মাটি ঠান্ডায় জমে থাকার কারনে সেখানে কোন ফসল হয় না।

এত ঠান্ডায় অয়মায়াকনের মানুষ বাঁচে কি করে, জানতে চাওয়া হলে ওরা উত্তর দিয়েছিল – ” রাশকি চাই” মানে রাশিয়ান চা পান করে ওরা বেঁচে থাকে। এই রাশিয়ান চা বলতে ওরা কিন্তু গরম চা বুঝায় নাই। বুঝিয়েছে রাশিয়ার সবচাইতে জনপ্রিয় মদ ‘ভদকা’।

আগেই বলেছি অয়মায়াকন মানে আনফ্রোজেন ওয়াটার। আসোলে নদীর একটা অংশের পানি কখনো ঠান্ডায় জমে যায় না। বল্গাহরিনের পাল এই লেইকের পানি খেয়ে জীবন ধারন করে। আবার এই বল্গাহরিনের দুধ এবং মাংশ খেয়ে শীত প্রধান অয়মায়াকন গ্রামের মানুষ জীবন ধারন করে।

ঠান্ডায় জমে থাকা মাটিতে যেহেতু কোন ফসল হয় না, তাই এই গ্রামের মানুষ বল্গাহরিন, ঘোড়ার মাংস, গরুর দুধ, আনফ্রোজেন লেইকের মাছ খেয়ে জীবন ধারন করে।

ঠান্ডার তীব্রতা এত বেশী যে কেউ যদি চোখে চশমা পরে ঘর থেকে বের হয়, তাহলে আশংকা থাকে যে চশমার ফ্রেম জমে গিয়ে চোখের সাথে আঁটকে যেতে পারে। এটা অনেক কঠিন অবস্থার ভিতর একটা সাধারন উদাহরন মাত্র।

অয়মায়াকনের ভুমি এত ঠান্ডা যে সেখানে বাসার ভিতর টয়লেট বানিয়ে পয়ঃনিষ্কাশন নালা বসানো মানে সব কিছু জমে বরফ হয়ে বিপদে পড়ে যাওয়া। তাই বাংলাদেশের আগের জমানার গ্রামের বাড়ির টয়লেটের মত বাসা থেকে দূরে বানানো আলাদা কাঁচা টয়লেট ব্যবহার করে ওরা। একবার টয়লেটে যেতে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতির মত সব ভারী কাপড় চোপড় এবং জুতা পরে প্রস্তুতি নেয় ওরা।

ভুমির মাটি ঠান্ডায় জমাট বেঁধে কঠিন পাথরের মত শক্ত হয়ে যায়। তাই যদি কেউ শীতকালে মারা যায় ওখানে, তাহলে বিপদ হয়ে যায়। চাইলেও কঠিন বরফের স্তর ভেদ করে মাটি খোড়া যায় না। তখন কবরের জায়গায় কাঠ জমিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। কয়েক দিন আগুন জ্বলার পর বরফ গলে মাটি যখন নরম হয়, তারপর কবর খোঁড়া সম্ভব হয়।

মানুষ ইন্স্যুলেটেড গ্যারেজের ভিতর গাড়ি রাখে। বাইরে বের হলে একবার স্টার্ট দিলে সারাদিনে আর কেউ গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে না, যদি আবার স্টার্ট না নেয় এই ভয়ে।

অয়মায়াকনে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে তৈরী একটা এয়ারপোর্ট থাকলেও শীতকালে সেখানে কোন প্লেন উঠা নামা করতে পারে না। নিকটস্থ বড় শহর ইয়াকুতস্ক থেকে দুই দিন গাড়ি চালিয়ে এই গ্রামে পৌঁছানো যায়।

এই গ্রামে একটা ইউনিভার্সিটি, স্কুল, সিনেমা হল, যাদুঘর সবই আছে।

অয়মায়াকনের মানুষেরা এখনো তাদের ঘরবাড়িতে কয়লার আগুন ব্যবহার করে হিটিং এর ব্যবস্থা করে আদিম পদ্ধতিতে। আধুনিকতার অনেক ছোঁয়া লাগে নাই তাদের গায়ে। তাঁরা কিছু জানতে চায় ও না।

খাবারের সংস্থান ভাল না হলেও ওরা অপুষ্টিতে ভুগে না। তার কারন হিসাবে ডাক্তাররা বলে – বল্গাহরিনের মাংস, ঘোড়ার মাংস, দুধ এবং সামুদ্রিক মাছে প্রয়োজনীয় সব ভিটামিন এবং মিনারেল থাকার কারনে তাদের শরীরে কোন রোগ বাসা বাঁধতে পারে না।

ঠান্ডা এত বেশী যে সেখানে কলমের কালি জমে যায়। লেখা বের হয় না। কথা বলার জন্য মোবাইলের টাওয়ার থাকলেও শীতের দাপটে মোবাইলের ব্যাটারির চার্জ নিমিষে উবে যায়।

লেখক ছবি তোলার জন্য পাজামা পরে ঘরের বাইরে কয়েক মুহুর্ত্য দাঁড়িয়ে অনুভব করেছে যেন কেউ ছুরি দিয়ে তার পা দুটি শরীর থেকে আলাদা করে ফেলেছে। ফ্রস্ট বাইট এটাক বলে এটাকে। ছবি তুলতে গিয়ে লেন্সে তাকিয়ে লেন্স স্থির করার আগেই ঠান্ডায় লেন্স জমে যাচ্ছিলো। তাই ভারী জ্যাকেটের ভিতর ক্যামেরা লুকিয়ে রেখে ছবির লক্ষ্য স্থির করে গায়ের উষ্ণতায় গরম হওয়া ক্যামেরা বের করে সেকেন্ডের ভিতর ছবি তুলেই আবার ক্যামেরা লুকিয়েছে।

সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা বর্ননা করতে গিয়ে লেখক বলেছে – অনুভব করছিলাম,নিজের নিঃশ্বাসের বাস্প যেন জমে যাচ্ছে। মুখের লালা জমে গিয়ে কুঁচি পাথরের মত হয়ে যাচ্ছে। ঠোঁট যেন নিজে থেকে ফেটে যাচ্ছে। কেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিলো যেন আর কয়েক মুহুর্ত বাইরে থাকলে জান খুইয়ে বসব আমি।

সেই গ্রামে একটা মাত্র দোকান আছে। মানুষ তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ঘরের জিনিসের জন্য সেই দোকানের উপর নির্ভর করে। দোকানী তার দোকানের সামনে সব সময় আগুন জ্বালিয়ে রাখে ড্রামের ভিতর পুরনো কাগজ পুড়িয়ে। যেনো ঠান্ডার ভিতর কেউ এলে আগুন পোহাতে পারে।

আজকাল অনেক ট্রাভেল কোম্পানী শীতকালে এই গ্রাম ভ্রমনের জন্য বিশেষ প্যাকেজের ব্যবস্থা করছে। জানা হয় নাই, তাতে কেমন সাড়া মিলেছে। তবে আমার খুব ইচ্ছা আছে, একবার শীতকালে এই গ্রাম ভ্রমনে যাওয়ার।

 

 

অনুবাদঃ ১৭ই জানুয়ারী, ২০১৭