রত্নাবাঈ

– হ্যালো
– হ্যাঁ, বল
– বল দেখি, আমি এখন কোথায় !
– আর কোথায় এই সন্ধ্যা বেলায়। গাড়িতে। বাসায় ফিরছো।
– না, এখন সকাল সাতটা। একটু আগে হোটেলে এলাম।
– কি, আমাকে না জানিয়ে ঢাকায় এসেছ ! এত্ত সাহস তোমার ?
– আরে বাবা, খেপার কি আছে। এইতো জানালাম। তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চাইলাম আর কি।
– জানোতো, আজ লিপ ইয়ার ডে। আর আজই কিনা এলে। এটাতো সেলিব্রেট করা দরকার আমাদের।
– সেজন্যই তো সুযোগ পেয়ে চলে এলাম তোমাকে না জানিয়ে।
– ওকে, তুমি ঘুমিয়ে নাও। বিকেলে দেখা হচ্ছে। আমি আসবো।

রত্না ফোন ফোন রাখলো।

সোবহানের সাথে ওর অনলাইনে বন্ধুত্ব হয়েছে বছর দুই আগে। দেখা হয়েছে একবার প্যারিসে। তাও খুব অল্প সময়ের জন্য। ক্যাফেতে বসে এক কাপ কফি খেতে যতক্ষণ লাগে আর কি ! সেবার রত্নার ছেলে মেয়েরা সাথে ছিলো। সোবহান গিয়েছে একটা মিটিং এটেন্ড করতে।

আর দেখা হয় নাই। দেখা করার কারো গরজ ছিল না। ওরা এমনিতে সারাক্ষন কানেক্টেড থাকে উইচ্যাটে। তাতেই খুশী। এর বেশী কিছু চায় না কেউ ।
রত্না বিবাহিতা। বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই করছে। দেখে মনে হয় এখনো ত্রিশ ছাড়ায় নাই। হালকা পাতলা শরীর। লম্বায় পাঁচ ফুট তিন। চোখে পড়ে যে কারো। গ্রীবা সোজা করে হাঁটে গটগট করে। চলাফেরায় ড্যাম কেয়ার ভাব। বুরোক্র্যাট বাবার একমাত্র মেয়ে। নিজের হাতে শিখিয়ে পড়িয়ে ফার্মাসিস্ট মেয়েকে পছন্দের পাত্রের সাথে বিয়ে দিয়েছে। পাঁচ বছর পর দু সন্তান নিয়ে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো।

এরপর নিজে বিয়ে করলো রত্না।বয়সে তারচেয়ে ম্যালা বড় একজনকে। ম্যালা টাকা পয়সার মালিক তিনি। অনেক রকম ব্যবসা স্বামীর। আবার রাজনীতিও করে। ক্ষমতাধর মানুষ। রত্না তাঁর সেকেন্ড ওয়াইফ। বাবা রাজী ছিল না। কিন্তু রত্না তার ধার ধারে নাই।

মিহির আলীকে রত্নার ভাল লেগেছে। বয়সে ভারী যেমন ব্যবহারেও তাই। রত্নাকে তার ইচ্ছামত চলার স্বাধীনতা দিয়েছে।
সবই ঠিক ছিল। শুধু বন্ধুত্বটা হয় নাই। এই জায়গাটা দখল করলো সোবহান।

সোবহান একা মানুষ। বিয়ে থা’র ঝামেলায় জড়ায় নাই। ঠিকানা ওয়াশিংটন ডিসিতে হলেও তাকে কাজের ধারা অনুযায়ী উড়ে বেড়াতে হয় এদেশ ওদেশে।
উইচ্যাটে পরিচয় হয়েছে রত্না’র সাথে। অল্পদিনে খুব ভাল বোঝাপড়া হয় ওদের। নিটোল বন্ধুত্ব। কোন শর্ত নাই। আকাংখা নাই। তবুও কেন যেন অনেক হৃদ্যতা তাদের।

রত্নার একটাই ছেলে। প্যারিসে পড়ছে মুভি মেকিং নিয়ে। মেয়েটা ছোট।সে পড়ে ভারতের কনভেন্ট স্কুলে। ঢাকায় রত্না একটা স্পেশাল স্কুল চালায় যেখানে সুবিধা বঞ্চিত কিশোর কিশোরীদের সে আলোর দিশা দেয়। হাতে কলমে নানা কাজ শেখায়। এই কাজে তার সময় কাটে ভাল।

দিনটা আজ শনিবার, ২৯শে ফেব্রুয়ারী। এমন তারিখ প্রতি বছর আসে না। কেমন যেন উটকো একটা দিন। ছকের বাইরে। হিসাব ছাড়া। এমন দিনে তার রুটিন ছাড়া থাকার ইচ্ছা জাগলো। আর আজই কিনা প্রিয় বন্ধু এসে হাজির। অদ্ভুত কাকতালীয় ব্যাপার।

খুশী লাগছে তার। সোবহানকে নিয়ে কি করা যায় ভাবছে।
ব্যাটার নামটা তার একদম পছন্দ না। জিজ্ঞেস করেছিল – এত স্মার্ট মানুষের এমন খ্যাঁত মার্কা নাম হল ক্যান !

সোবহান হো হো করে হেসে উত্তর দিয়েছিলো – প্লিজ ওয়েক আপ মাই ফাদার ইন হিজ গ্রেইভ এন্ড আস্ক।

রত্না নিজে তার ডাক নাম পছন্দ করে না। তাই ভাল নামটা ব্যবহার করে – রেবেকা। সোবহানের পছন্দ – রত্না। সে ডাকে রত্না বাঈ।

পাঁচটা বাজতেই ফোন বাজলো। ঘুমের ঘোরে ফোন উঠালো সোবহান। অপর প্রান্ত থেকে রত্নার তাগাদা – এখনো ঘুমাচ্ছ কেন ! উঠে রেডি হয়ে পাঁচ মিনিটের ভিতর নীচে নামো। আমি লবিতে অপেক্ষা করছি। দেরী করো না। অনেক দুরে যাবো।

আরেকটু ঘুমাতে মন চাইলেও রত্নার ভয়ে আর শুয়ে থাকতে পারলো না। লাফিয়ে উঠে শাওয়ারে ঢুকল সে। ফ্রেস হয়ে বেভেল্গিরি আফটার শেভিং বাম মাখালো মুখে। গায়ে চড়ালো কালো পোলো গেঞ্জির সাথে আরমানীর ব্লু জিন্স আর স্নিকার। পোশাকের কারণে তাকে বয়সের চেয়ে দশ বছর ছোট মনে হয়। হেয়ার ব্রাশ করে গেঞ্জিতে ক্রিড কোলন স্প্রে করলো। উপরে পরলো আরমানীর লাইট উইন্ডব্রেকার। ফেব্রুয়ারি শেষ। তবুও সকালে তার হাল্কা শীত লেগেছে। ফ্লাইটের ডিউটি ফ্রি থেকে রত্নার জন্য কেনা ছোট গিফটটা জ্যাকেটের পকেটে গুঁজে শিস দিতে দিতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে আলো সোবহান।

লিফট থেকে বের হতেই দেখলো রত্না পায়চারী করছে লবীতে। ওকে দেখে মনটা প্রশান্ত হয়ে গেলো। চঞ্চল মেয়েটাকে দেখে কে বলবে তার বয়স হয়েছে। দুটো বড় বড় সন্তান আছে। ওকে দেখে মনে হয় সবে কলেজে ঢুকেছে। লম্বা জামার সাথে ঢিলা স্ল্যাক্স পরেছে। গলায় ঝুলছে স্কার্ফ। চোখে ঢাউস সানগ্লাস। কাঁধে তেমনি ঢাউস একটা ঝোলা। ওকে দেখতে পেয়ে এক রকম তেড়ে এলো বুনো ষাঁড়ের মত।

এই রে সেরেছে, পাগল খেপলো নাকি ! প্রমাদ গুনলো সোবহান।

কাছে এসে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে হাল্কা একটা হাগ দিয়ে বলে – কেমন আছেন সোবহান সাহেব ? জেটল্যাগ কেটেছে ?

সোবহান তার কথার সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো – হুঁ। আর মনে মনে চেনার চেষ্টা করছে কি পারফিউম মেখেছে রত্না। চিনতে পারলো না। গন্ধটা ভারী মোহ নীয়।

ওয়েস্টিন থেকে বেরুতে ভ্যালে শোফার রত্নার গাড়ী নিয়ে এলো। সোবহানকে প্যাসেঞ্জার সিটে উঠতে ইশারা করে রত্না নিজে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলো।

ওকে গাড়ী চালকের সিটে দেখে সোবহান অবাক হয়ে বলে – ঢাকার জ্যামে তুমি চালাও কেমনে, আমিতো ভাবতেই পারি না।

চোখ মটকে রত্না উত্তর দেয় – এসব আমার বাম হাতের মামলা। চোখ বেঁধে দিলেও চালিয়ে তোমাকে যায়গা মত পৌঁছে দিতে পারব।

সিক্স গিয়ারের ওল্ড মডেলের একটা ছোট্ট ফিয়াট গাড়ী। ম্যানুয়াল গাড়ি চালানো সবার কাজ না। যারা পাকা ড্রাইভার, তাদের হাতে আবার এই জিনিস পাখীর মত উড়তে জানে।

শনিবার ছুটির দিন। রোদের তাপ কমে আসছে। সোনালী রঙ ধরেছে আকাশ। বাইরে হাঁটা মানুষের ভিড় কম না। তবে রাস্তায় গাড়ির চাপ কম। এঁকে বেঁকে বেরিয়ে ফাঁক ফোকর গলে এয়ারপোর্ট রোডে পড়লো তারা।

কোথায় যাচ্ছ শুনি – সোবহান জিজ্ঞেস করে।

নো কোয়েসচেন প্লিজ। এঞ্জয় দি রাইড।

এয়ারপোর্ট পেরিয়ে যেতে গাড়ির কাছ নামিয়ে দিলো রত্না। বিকেলের বাতাস আমার খুব ভাল্লাগে। তোমারও লাগবে আশা করি – রত্না বলে।

বাতাসে রত্নার গলায় বাঁধা স্কার্ফ উড়ছে পতপত করে। তার পারফিউমের মাতাল করা সুবাস বাতাসের সাথে মিশে মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে গাড়ির ভিতর।

মোবাইলে কাকে যেন নির্দেশ দিচ্ছে রত্না – মাছগুলি ম্যারিনেট করে ফেলো। মুরগী ছিলে সেটাতেও মসলা মাখিয়ে রাখো। গ্রিল রেডি করো কয়লা ভরে। কিছু বরফের টুকরা রেডি রেখো। আমরা আধ ঘণ্টার ভিতর পৌঁছুবো।

সোবহান বুঝলো রত্না পার্টি করার মুডে আছে।

রত্না বলে যাচ্ছে – শহরের বাইরে আমার বাবার একটা বাংলো আছে। বাবার খুব প্রিয়। আমারও। সুযোগ পেলে আমি একা চলে আসি। নিরিবিলিতে কিছুটা সময় কাটিয়ে শহরে ফিরে যাই।

তার জীবনের প্রায় সব গল্প সোবহানের শোনা হয়ে গেছে। মা নাই। বাবা আর সে বন্ধুর মত। বাবার কাছে তার কোন সিক্রেট নাই। কিন্তু এই বাংলোর খবর সে জানতো না। নতুন জানলো।

জয়দেবপুর ছাড়িয়ে বেশ কিছুদূর পার হয়ে শালবনের ভিতর সরু রাস্তায় নামলো গাড়ি। বেলা প্রায় ডুবে এলো। বনের ভিতর অন্ধকার লাগছে। আধ মাইলের মত ভেতরে ঢুকে একটা উঁচু লোহার গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে হর্ন দিতে গেইট খুলতে শুরু করলো।

শুভ্র দাঁড়ি, মাথায় গোল টুপি পরা মধ্য বয়সী একজন মানুষ এগিয়ে গাড়ির পাশে এসে হাত তুলে সালাম দিলো।

কেমন আছেন, চাচা – রত্না জিজ্ঞেস করে।

মানুষটা স্মিত হেসে মাথা নাড়ে। তার পাশে দাঁড়ানো শাড়ী পরা কিশোরী দৌড়ে এসে রত্নাকে জড়িয়ে ধরলো।

কিরে – তুই দেখি শুধু লম্বা হচ্ছিস, ব্যাপার কি ! – রত্না ওর কপালে আদর দিতে দিতে দুষ্টামি করে।

কিশোরী এই বাংলোর কেয়ারটেকার হাসমত মিয়ার মেয়ে। রত্নার বাবার বিশ্বস্ত মানুষ তারা। পরিবার নিয়ে এখানেই থাকে।

গাড়ি থেকে নেমে চারিদিকে সবুজের সমারোহ দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সোবহান। ফুল ফলের বাগান। হাস মুরগীর খোঁয়াড়। একটু দুরে দুটো গরু বাঁধা। একটা লাল রঙের ছাগল ছুটে বেড়াচ্ছে বাগানের এ মাথা থেকে ও মাথা। তার পিছে পিছে ঘুরছে ছোট্ট একটা কুকুর। ঝোপ ঝাঁপের আড়ালে দেখে সবুজ রঙ করা টিনের একটা ঘর। রত্নার পিছু পিছু সোবহান সেদিকে এগুলো।

বাইরে থেকে দেখতে সাধারণ মনে হলেও ভেতরটা সুন্দর করে আধুনিক কেতায় সাজানো। সোফা, টিভি, ফ্রিজ, বইয়ের সংগ্রহ সবই আছে। বারান্দায় ওদের জন্য গদিওয়ালা চেয়ার পাতা হয়েছে। টেবিলের উপর গ্লাস, বরফ রাখা আছে। পাশে ঘাসের উপর একটা কয়লার গ্রিল জ্বালানো হয়েছে। সোবহানকে বসতে বলে রত্না সেদিকে গেলো। কিশোরী ময়না পাশে দাঁড়িয়ে আছে ওকে সাহায্য করতে।

রত্না মশলায় ম্যারিনেট করা তেলাপিয়া মাছ গ্রিলের শিকের উপর দিতে লাগলো। দিয়ে পাশে একটা বেতের মোড়ায় বসে সিগারেট ধরালো। সোবহান তাকিয়ে দেখছে রত্নার কাজকর্ম। সে জানে রত্না স্মোক করে। কখনো সখনো এক আধটু ড্রিঙ্ক করে সখের বশে।

ময়নাকে রত্না বুঝিয়ে দিয়ে এলো কখন মাছগুলি উল্টে দিতে হবে। বলে উঠে সোবহানের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে – কি ড্রিঙ্ক করবে বল। আমি দিচ্ছি।

– একটা কিছু হলেই হবে। নো বিগ ডিল। তোমার সাথে আছি এতেই ভাল লাগছে।
– তাইলে একটু ভদকা দেই আইস মিশিয়ে। সাথে লেবু নিতে পারো। ঝলসানো মাছের সাথে ভাল লাগবে।
– তাই দাও তাইলে।

রত্না ফ্রিজ থেকে এবসলুট ভদকার বোতল বের করে আনলো। দুটো গ্লাসে ঢালল। তাতে পানি মিশিয়ে বরফের টুকরা ছাড়ল। এক টুকরা লেবু সামান্য চিপে টুকরাটা গ্লাসে ছেড়ে দিলো। একটা গ্লাস সোবহানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে – নাও। গ্লাসে ঠোকাঠুকি করে ‘চিয়ার্স’ বলে গ্লাস তুলল দুজন একসাথে।
ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে তারা। কথার সব রত্নাই বলে যাচ্ছে। সোবহান শ্রোতা। ময়না ঝলসানো মাছ দিয়ে গেলো। মাছের সুগন্ধে সোবহানের ক্ষুধা চেগিয়ে উঠলো যেন। সে একটা মাছ তুলে গপাগপ খেতে শুরু করলো।

– এই খেয়াল কইরো, গলায় কাঁটা আটকে বিপদে ফেলো না। এখানে কাছে কোন হাসপাতাল নাই কিন্তু।
– ডোন্ট ওয়ারী, আমি ট্রেইনিং ভুলি নাই।

বলতে বলতে সোবহান সত্যি গলায় আটকে ফেললো। ঢোক গিলতে গিয়ে টের পেলো ভেজাল হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও বের করতে পারলো না কাঁটা।

– ধেৎ কি ঝামেলা করে ফেললাম। কাল সকালে তার জরুরী মিটিং আছে মন্ত্রণালয়ে। এই কাজেই সে ঢাকায় এসেছে। এখন কিনা গলায় মাছের কাঁটা আটকে বসে আছে। কি হবে ?

দুই তিন পেগ টেনে রত্নার বেশ টিপসি ভাব এসেছে। মাছের পর সে মুরগী ঝলসাবে ভাবছে। আর এখুনি কিনা বোকা সোকা বিদেশী লোকটা পাকামো করতে গিয়ে গলায় কাঁটা আটকে ফেলেছে। নিজেকে অপরাধী লাগছে। ওর জন্যই তো ঝামেলাটা হল। যা হওয়ার হয়েছে এখুনি ঢাকায় ফিরতে হবে। তারপর কোন ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে কাঁটা বের করাতে হবে।

ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে রাত আটটা বাজে। ঝট করে উঠে দাঁড়ালো রত্না। সোবহানের দিকে ফিরে বলে – চল, ঢাকায় ফিরব। ক্লিনিকে গিয়ে তোমার ঝামেলা শেষ করতে হবে।
বিদায় নিয়ে ওরা গাড়িতে এসে উঠলো।

স্বাভাবিকের চেয়ে জোরে গাড়ি চালাচ্ছে রত্না। তার মনে হচ্ছে যেন দেরী হলে সোবহানের কষ্ট বাড়বে। সেই কষ্টের সব দায় যেন রত্নার।

অন্যমনস্ক ছিল। তাই খেয়াল করে নাই। হঠাৎ টের পেলো কিছু একটার সাথে জোরে ধাক্কা খেয়েছে গাড়ী। সাথে সাথে ব্রেক চাপলো সে। কিসের সাথে লাগলো ! কোন মানুষ নাতো ! যা’ই হোক নেমে দেখতে হবে। একটা গ্রাম্য বাজারের মত এলাকা।

গাড়ী স্লো করছে দেখে সোবহান বলে উঠলো – রত্না বাঈ, এই যায়গায় গাড়ী থামানো মনে হয় ঠিক হবে না।

– না থামতে হবে। আমি এভাবে পালাতে পারি না। – বলে সে রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে নেমে এলো দেখতে।

সোবহান নিজেও নামতে বাধ্য হল। তার ভাল লাগছে না। আস্তে আস্তে লোক জড়ো হতে লাগলো ওদের ঘিরে। এগিয়ে গিয়ে দেখলো ওদের গাড়ি আচমকা রাস্তা পার হতে চাওয়া একটা নেড়ি কুকুরের গায়ে ধাক্কা দিয়েছে। নাহ মরে নাই কুকুরটা। ব্যথা পেয়ে রাস্তার একপাশে বসে কুঁইকুঁই করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
মানুষগুলির দিকে তাকালো সোবহান। দীর্ঘকাল ধরে দেশের বাইরে রইলেও মানুষের এমন চেহারার সাথে তার পরিচয় আছে। সে বিপদের গন্ধ পেলো।

রত্নাকে কাছে ডেকে বলে – চল কেটে পড়ি। নইলে বিপদ হবে।

উপস্থিত মানুষের দিকে তাকায়ে বলে সে – যাক, বাঁচা গেল। কারো ক্ষতি হয় নাই। আমরা এবার যাই। ঢাকায় ফিরতে হবে।

একটা লোক এগিয়ে এসে বলে – কইলেই কি যাওন যায় নাকি ! এইটা মেম্বর সাবের পেয়ারের কুত্তা। বেওয়ারিশ কুত্তা হইলেও মেম্বর সাব নিজের হাতে এই কুত্তারে বিস্কুট খাওয়ায় দৈনিক। ওনার সাথে ব্যাপারটা ফয়সালা না কইরা আপনেরা যাইতে পারবেন না।

রত্না ক্ষেপে উঠতে গেলো। সোবহান তার হাতে চাপ দিয়ে তাকে শান্ত থাকতে বলল। তারপর সেই লোকটার দিকে তাকায়ে বলে – বুঝেছি, আপনেরা কিছু টাকাপয়সা চান। সেটা বললেই হয়। বলে নিজের হিপ পকেট থেকে ওয়লেট বের করে টাকা বের করতে গিয়ে বের করলো এক থোক ডলার। সাথে সাথে বুঝলো বোকামি হয়ে গেছে। সে যে প্রবাসী এরা এবার সেটা জেনে গেলো ওরা তার ভুলের জন্য।

সবার চোখ পড়েছে হাতের ডলারের থোকের দিকে। লোলুপ চাহনি সবার সেদিকে আবার রত্নার দিকে।

বিপদে পড়ে গেছে তারা।

সোবহান ভাবল – হাতে পাঁচশোর বেশী ডলার আছে। সব দিয়ে নিস্তার পেলেও আপত্তি নাই। সে বলে – এখানে পাঁচশো ডলার আছে। দেশী টাকায় চল্লিশ হাজারের বেশী হবে। সব নিয়ে আমাদের যেতে দেন।

না সম্ভব না। মেম্বর সাবের অফিসে চলেন। তারপর ফয়সালা হবে। – বলে সেই ষণ্ডা মার্কা লোকটা।

সোবহান তাকিয়ে দেখে – একজন গাড়ির বনেটের উপর উঠে বসে আছে। আরেকজন গাড়ির সিট থেকে রত্নার স্কার্ফ নিয়ে গন্ধ শুঁকছে। রত্নার দিকে তাকায়ে দেখে তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। রাগ উবে গিয়ে ভয় পেয়েছে মেয়েটা।

ষণ্ডা লোকটা ওদেরকে নির্দেশ দিলো – গাড়ী এখানেই থাক। আপনেরা আমার লগে চলেন। মেম্বর সাব সিদ্ধান্ত দিলে আপনেরা চইলা যাইবেন।

চারিদিকে ঘিরে দাঁড়ানো মানুষের বৃত্ত কাছে এসে ঘেঁষে দাঁড়ালো। ওদের সাথে না গিয়ে কোন উপায় নাই।

সামনে পিছে পাহারা দিয়ে ওদের হাঁটিয়ে নিয়ে এলো একটা দোচালা টিনের ঘরে। ঘরের ভিতর টিমটিম করে হলদেটে একটা বাল্ব জ্বলছে। কাঠের উঁচু পিঠ ওয়ালা চেয়ারে বসে আছে রহমত মেম্বর। খুব বাজে চরিত্রের মানুষ সে। শুধু ধান্ধায় থাকে কাকে কোন বিপদে ফেলে কিছু কামিয়ে নেয়া যায়। ষণ্ডা লোকটা এগিয়ে গিয়ে মেম্বরের কানে কানে কিছু বলল। শুনে তার চোখ দুটা একটু ঝিলিক মেরে আবার স্বাভাবিক হল।

মেম্বর গম্ভীর হয়ে ওদেরকে বসতে বলল। তারপর জানতে চাইলো ওরা কে কোত্থেকে কোথা যাচ্ছিলো। ওদের সম্পর্ক কি।

রত্না নিজের পরিচয় দিলো। তার স্বামীর নাম বলল। সাথে তার প্রবাসী বন্ধু আছে তার নাম জানালো। বলে আরও বিপদে পড়ল।

এবার নড়ে চড়ে বসলো রহমত চেয়ারম্যান। নোংরা হাসি দিয়ে বলে – স্বামীকে ফেলে পরপুরুষের সাথে নষ্টামি করতে এতদূরে আসার সাথে সাথে আপনার স্বামীর সাথে আপনার সম্পর্ক শেষ হয়া গেছে। তিনি জানলেও আমার মত একই বলবেন। তাই আপনে তার ঘরে ফেরত যাইতে হইলে আপ্নেরে আগে হিল্যা বিয়া দিতে হইবো। তিনদিন পর হিল্যা বিয়ার তালাকের পর আপ্নের প্রাক্তন স্বামী রাজী থাকলে তিনি আপ্নেরে আবার বিয়া কইরা ঘরে তুলতে পারবো। এইটা আমার কথা না। এইটা ধর্মের বিধান। কি বলেন ইমাম সাব ? – বলে পেছনে দাঁড়ানো মাথায় পাগড়ি বাঁধা হুজুরের দিকে তাকালো।

হুজুর একমত হয়ে বলে – একদম সঠিক বয়ান দিয়েছেন জ্বনাব।

দুজন লোক দুপাশ থেকে চেপে ধরলো সোবহানকে। পেছন থেকে টেনে নিয়ে বের হয়ে গেল। নিয়ে গিয়ে ঢালুতে ধানক্ষেতের কোমর সমান কাদা পানিতে নামিয়ে গেঁড়ে থাকা বাঁশের সাথে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললো। মাথার উপর নামিয়ে দিলো একটা চটের বাজারের ব্যাগ। গলায় মাছের কাঁটা আটকানো। তার উপর এমন অত্যাচারে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লো সোবহান। কিভাবে উদ্ধার পাবে বুঝতে পারছে না।

রত্নাকে উঠিয়ে নিয়ে গেলো মোটা সোটা এক মহিলা। তাকে নিয়ে একটা ঘরে ঢুকে এক সেট শাড়ি ব্লাউজ এগিয়ে দিয়ে বলে – পরনের ফুটাঙ্গি কাপর খুইলা ঝটপট এগিনি পিন্দা ফালাও। দশ মিলিট টাইম দিলাম। আমি আইয়া জ্যেন দেখি তুমি এক্কেরে রেডি। নইলে কইলাম চুলের মুটি ধইরা পিডায়া আমি নিজের হাতে কাপর পিন্দামু। বলে ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে থেকে কপাট আটকে দিলো।

রত্না ভয় না পেয়ে দ্রুত ভাবছে। হাতে সময় কম। তার স্বামী দেশের বাইরে এখন। সেটাই ভাল। বাবার কথা মনে পড়লো। বাবাই পারবে তাকে উদ্ধার করতে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে স্পীড ডায়াল থেকে বাবার নাম্বারটা বের করে টিপে দিলো। এক রিং হতেই ওপাশ থেকে ফোন ধরে বাবা বলে – আমার মা’টা আজ কোথায় সারাদিন ধরে ! আমার খোঁজ নিলো না যে।

রত্না সময় ক্ষেপণ না করে দ্রুত বলে গেল – বাবা মহা বিপদে পড়েছি। বাংলো থেকে ফেরার পথে এক মাইলের ভিতর যে বাজারটা ওখানে এক্সিডেন্ট করেছি। একটা কুকুরকে ধাক্কা দিয়েছি। আমাকে আর আমার বন্ধুকে এলাকার গুণ্ডারা আটকে ফেলেছে। আমাকে এলাকার রহমত মেম্বরের সাথে হিল্যা বিয়ে দিচ্ছে। তাড়াতাড়ি কিছু কর। বলে ফোন কেটে দিয়ে সেটা লুকিয়ে ফেললো।

বিচক্ষণ ব্যুরোক্র্যাট বাবা কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থম্ভিত হয়ে থেকে হুঁশে এলো। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে নিজের ঘনিষ্ঠ সহচর এক্স জেনারেল সোহেলের নাম্বারে ফোন করে তাকে সব জানালো। তারপর শুধু বলল – দোস্ত, দ্রুত কিছু কর।আমার মেয়েটাকে বাঁচা। তার ইজ্জত বাঁচা। নইলে আমার মরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

তুই কিছু ভাবিস না – বলে ফোন কেটে দিলো জেনারেল সোহেল। তিনি জাঁদরেল সৈনিক। সেনাবাহিনীতে তার ভীষণ কদর। এখনও সবাই তাকে স্মরণ করে। তিনি ফোন করলেন তার প্রিয় জুনিয়র অফিসার কর্নেল শামসকে। ঘটনা খুলে বলে শেষে বললেন – পারলে এই একটা উপকার করে তাকে কৃতজ্ঞ করতে।

– স্যার, ভাববেন না। এখুনি ব্যবস্থা করছি। আমি নিজে সব মনিটর করবো।

কর্নেল শামস খোঁজ নিলো জয়দেবপুরে ফিল্ড ট্রেইনিং এ কারা আছে। তারপর সেখানকার কমান্ডিং অফিসারকে ফোন করে নির্দেশ দিলো – এখুনি যেন কলতা বাজার ঘিরে ফেলে রহমত মেম্বরের আখড়া খুঁজে বের করে রত্না ও তার বন্ধুকে উদ্ধার করতে।

রত্নাকে পাশে নিয়ে বিয়ের আসনে বসেছে বদমাশ মেম্বর। ইমাম সাহেব দোয়া পড়া শুরু করেছে। বাইরে চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সোবহান কাদা পানিতে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে সজোরে লাথি পড়ল রহমত মেম্বরের আখড়ায়। ঘরে ঢুকল উদ্যত কারবাইন হাতে, চোখ মুখে কালি লাগানো ফিল্ড এক্সকারশনে থেকে আসা জলপাই রঙের পোশাক পরা একদল সৈন্য। তাদের ভিতর অফিসার কিসিমের মানুষটা এগিয়ে এসে কষে একটা লাথি চালালো রহমত মেম্বরের চোয়াল বরাবর।
ওরে বাবারে বলে মুখ চেপে ধরে টিনের দেয়ালে ছিটকে পড়লো সে।

রত্নার হাত ধরে তাকে টেনে দাঁড় করালো মেজর রজব। তারপর বলে – ইউ আর সেইফ নাও। লেটস গো হোম, ম্যা’ম।
সোবহানকে খুঁজে বের করলো ধান ক্ষেত থেকে। ওদেরকে মেজর রজব নিজের জলাপাই জিপে তুলে নিয়ে ঢাকার দিকে ছুটলো। পেছনে রত্নার গাড়ি চালিয়ে নিয়ে আসছে রজবের কর্পোরাল।

জিপের পেছনের সিটে বসা রত্না সোবহানের হাত ধরে শুধু বলল – আই এম সো সরি ফর অল ইউর ট্রাবল। মাফ করে দিও, বন্ধু।

সোবহান এতক্ষণ ঠাণ্ডায় কাঁপছিল। সেনাবাহিনীর কম্বলের উষ্ণতায় নরমাল হয়ে রত্নার হাতে শুধু একটা চাপ দিয়ে তাকে তাকে আশ্বস্থ করলো।
রাত প্রায় এগারোটা। জিপ ছুটছে ঢাকার পানে। সোবহান রত্নার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলো নিশ্চিন্তে।

মুরাদ হাই / ২৯শে ফেব্রুয়ারী, ২০২০