জার্নি ফ্রম খোদা হাফেজ টু আল্লাহ হাফেজ
পাকিস্তানে এক সময় নিজেদের সামাজিক মানদণ্ডের তারতম্য বুঝাতে মানুষের ভিতর বিলাতের বিশুদ্ধ উচ্চারণের ইংরেজী কিংবা আমেরিকান উচ্চারণে ইংরেজী বলতে পারার চর্চা আয়ত্ব করার প্রতিযোগিতা ছিল।
এমন চর্চা এখন অবধি আছে। কিন্তু সেই চর্চার ভিতর ফিরিঙ্গিপনা দেখা দেয় কারণ অনেক পাকিস্তানী ইংরেজী,উর্দু এবং অন্যান্য পাকিস্তানী ভাষার সাথে আরবী শব্দ যোগ করে নেয়। পাশ্চাত্বের অনুকরণে বিশুদ্ধ ইংরেজী উচ্চারণ রপ্ত না করে আরবী স্টাইলে কথা বলার চেষ্টা করে।
যেমন উর্দু শব্দ শুকরিয়া ( ধন্যবাদ ) ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হয়ে আরবী শব্দ জাজাকাল্লাহ ( আল্লাহ আপনাকে পুরস্কৃত করুক ) হয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, শুকরিয়া আরবী শব্দ শুকরান থেকে এসেছে যদিও উর্দু শব্দ শুকরিয়া তুর্কী শব্দ উকরি থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে।
আরেকটা উদাহরণ দেয়া যায় – উর্দু শব্দ আল্লাহ কা শুকর ( আল্লাহকে ধন্যবাদ ) পরিবর্তিত হয়ে আরবী শব্দ আলহামদুলিল্লাহ হয়ে গেছে।
অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, পাকিস্তানের উর্দু ভাষার নিজস্বতা, সংস্কৃতি ধীরে ধীরে আরবীকরন হয়ে যাচ্ছে। ঐতিহ্যগত ভাবে ব্যবহৃত উর্দু খোদা হাফেজ ( বিদায় ) খুব দ্রুত আল্লাহ হাফেজ হয়ে যাওয়াও আরবিকরনের আরেকটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
অবাক ব্যাপার হল, এই আল্লাহ হাফেজ এর ভিতর আরবী কিছু নাই। আরব বিশ্বে কিংবা অনারব মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলির কোনটায় আল্লাহ হাফেজ বলা হয় না বিদায়ের বেলায়। বিদায় এর স্বাভাবিক আরবী শব্দ হল তাওদি, ওয়াদায়ে অথবা ওয়াদায়ী।
আল্লাহ হাফেজ কথাটা মুলতঃ দক্ষিণ এশীয় মুসলমান তথা পাকিস্তানী, ভারতীয় এবং বাংলাদেশীরা ব্যবহার করে থাকে।
২০০৯ সালের এক অনুসন্ধানী গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৯৮৬ সালে পাকিস্তানের সরকারী টিভি চ্যানেলের ঘোষিকা সালমা বেগ প্রথম আল্লাহ হাফেজ কথাটা উচ্চারণ করে। এস সামাদ আলী নামের একজন লেখক ও সাংবাদিক ২০১২ সালের ১৭ই এপ্রিল দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় এর সত্যতার বিষয়ে নিশ্চিত করেন।
আরও অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত লম্বা জোব্বা পরা কিছু মোল্লা শ্রেণীর মানুষ পাকিস্তান, ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশে পোস্টার, ব্যানার এবং ওয়াজের মাধ্যমে খোদা হাফেজের বদলে আল্লাহ হাফেজ বলার জন্য জোর প্রচারণা চালায়।
খোদা হাফেজ পারস্য শব্দ যার বাংলা হল বিদায়। পারস্যে শুরু হয়ে দক্ষিণ এশিয়া সহ মধ্য যুগীয় পারস্য সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত দেশগুলিতে ব্যবহার হতে থাকে খোদা হাফেজ।
ভুলে গেলে চলবে না, পারস্য সব সময় শিয়া সংখ্যা গরিষ্ঠ ছিল।
খোদা হাফেজ কে আল্লাহ হাফেজ এ পরিবর্তন করার পেছনে সৌদি আরবের অন্য দেশে আরবীকরন এবং ইরান ও পারস্য সভ্যতার প্রতি বিমাতা সুলভ মনোভাব ভীষণভাবে দায়ী। যদিও তাদের এই প্রচেষ্টা শুধু দক্ষিণ এশীয় দেশগুলিতেই কার্যকর হয়েছে।
পাক ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান আলাদা হলেও তারা শুরু থেকে সৌদি আরবের ইচ্ছায় চলে নাই। বরং পাকিস্তান অতীতের মোগলদের অনুসরণ করে যা সৌদি আরব একদম পছন্দ করে নাই।
১৯৪৯ সালে পাকিস্তান মুসলিম ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করলে সৌদি আরব তাতে যোগ দেয়ার কোন আগ্রহ প্রকাশ করে নাই।
১৯৫৩ সালে পাকিস্তান তাদের ধর্মীয় নেতা আবুল আলা মউদুদি কতৃক আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা দেয়ার আন্দোলন শুরু করে ২০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটানোয় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এই কারণে সৌদি আরব পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।
১৯৫৫ সালে পাকিস্তান আমেরিকার নেতৃত্বে গঠিত সাউথ এশীয় ট্রিটি অর্গানাইজেশনে যোগ দিলে সৌদি আরব নাখোশ হয়। তারা বলে পাকিস্তানের এমন পদক্ষেপ যেন আরবদের বুকে ছুরি মারার মত হীন কাজ হয়েছে।
১৯৬০ এর পর পাকিস্তান অনারব মুসলিম দেশ তুর্কি ও ইরানের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুললে সৌদি আরব পাকিস্তানের কট্টর ধর্মীয় দলগুলিকে উস্কানি দেয়া শুরু করে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে আরবীকরনে ব্যর্থ হয়ে সৌদি রাজতন্ত্র কখনোই পাকিস্তানের প্রতি সদয় ছিল না। আর্থিক দান অনুদান দিতে গেলেও তাদের শর্ত মেনে চলার মারাত্বক বাধ্য বাধকতা ছিল। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে আরবীকরনের সুযোগ না পেলেও বিভিন্ন গোষ্ঠী, দলকে অর্থ দিয়ে সৌদি রাজতন্ত্র দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলের মুসলিমদের কথা বার্তা, ধর্ম চর্চা, পোশাক আশাকে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে।
তারা যা কিছু করেছে এসব কোন কিছুই ধর্ম চর্চার অংশ নয়। একদম না। অর্থের দম্ভে তারা তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছে শুধু।
অনুবাদ: মুরাদ হাই, ১০ই মার্চ, ২০২০
মুল লেখক: নাদিম এফ পরাচা। ৮ই মার্চ ২০২০
ডেইলী ডন, পাকিস্তান।