সোফা সেট

রান্না কিছুই পারি না। তবুও ইচ্ছা হল নিজে রান্না করে খাওয়ায়ে সবাইকে সারপ্রাইজ দিব।

ভুনা খিচুড়ি আমার খুব প্রিয় খাবার। খেতে ভাল লাগে কিন্তু কখনো নিজে রাঁধি নাই।
ইচ্ছা হল ভুনা খিচুড়ি রান্না করব। যেই কথা সেই কাজ। চাল,ডাল তো ঘরে আছেই, চিন্তা কি ! কিন্তু কোনটার পর কোনটা দিতে হয় ,কতটূকু পানি মেশাতে হয় এই তথ্য জানা ছিল না।

এনেক্স এর ভুগোল বিভাগের বান্ধবী এগনেজ গোমেজ তখন ওহাইও ইউনিভার্সিটিতে এম,এস করছে। ওকে ফোন করলাম। রান্নার পুরো সময়টা সে আমার সাথে ফোনে থাকল। সে বলে গেল আর আমি রান্না করলাম। খিচুড়ি রান্না হল। সুন্দর সুগন্ধ হয়েছে । যদিও খাওয়ার সময় মনে হয়েছিল চাল একটু শক্ত রয়ে গিয়েছিল। আরো রান্না করেছিলাম পালং শাক দিয়ে মুরগীর মাংস । অনেক ঝোল রাখায় খেতে স্যুপের মত মনে লেগেছিল।

সময়টা ছিল উনিশশো নব্বই সাল। তখনো আমাদের বন্ধুদের এবং সিনিয়রদের সবাই ব্যাচেলর মানুষ। উইকেন্ড আসলেই আড্ডা শুরু হয়ে যেত। আসলে সবাই সারা সপ্তাহ কাজ করে হাঁপিয়ে উঠতাম। তারপর শুক্রবার এলেই অপেক্ষায় থাকতাম কখন কাজ শেষ হবে। আড্ডার সংগী সাথীর অভাব হত না। ফোন করে ডাক দিলেই সবাই হাজির হয়ে যেত।

ছবিতে- খোকন, সিরাজ ভাই, হেলাল ভাই ও আমি

আমাদের সব আড্ডার নিয়মিত সংগী ছিল মাশুক, মুনীর, কামাল, আলী, জহির, জামান। জন্মদিন উপলক্ষে দাওয়াৎ দেয়া হল সিরাজ ভাই, হেলাল ভাই, আব্বাস ভাইকে। আরো ছিল কলাবাগানের খোকন, গেঞ্জেস ট্রাভেলস এর মালিক নজরুল ভাই।
বাসাটা ছিল মাশুকের। শওকত ছিল ওর হাউজমেট। আমি দেশ থেকে এসে ওদের বাসায় উঠে একসাথে থাকা শুরু করেছি।
সবাই খুব সাধারণ কাজ করতাম খরচ চালিয়ে নেয়ার মত। একার জীবন তাই কারোই অনেক পয়সার লোভ ছিল না। লোভ ছিল অনেক বেশী আড্ডা মারা, হৈ চৈ করার।

আমাদের বাসায় কোন সোফা ছিল না। অনেক গেষ্ট আসবে রাতের বেলায় ।তাই মাশুক সেদিনই এক সেট সোফা কিনে আনল তিনশো ডলার দিয়ে। এর চাইতে সস্তা সোফা মনে হয় আর কিছু ছিল না। সেটাই আমাদের কাছে অনেক বড় কিছু ছিল। কিন্তু প্রথম দিনই আমাদের নতুন সোফার কপালে দুর্গতি নেমে এল ।

ছবিতে – মুনির ও আমি 

মুনীর ছিল আমাদের সবার তুলনায় গায়ে গতরে বেশী মোটা তাজা। বিকেলে কাজ শেষ করে সে সোজা আমাদের বাসায় চলে এল আড্ডায় যোগ দিতে । বাসায় ঢুকে নতুন সোফা দেখে বলে উঠল, “ কিরে, নতুন কিনলি নাকি?” বলেই সে ধপাস করে সোফায় বসল তার বিশাল শরীর নিয়ে। আমরা মুনীরের কথার দিকে মনোযোগ না দিয়ে সোফার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কারণ একই সময় আমাদের সোফা করুনভাবে আর্তনাদ করে উঠল। কড়াত করে হাঁড় ভাংগার মত আওয়াজ হল। মানে এই মাত্র আমাদের শখের কিন্তু সস্তায় কেনা সোফার মেরুদন্ড ভেংগে গেল মুনীরের শরীরের ভার সইতে না পেরে। দেখলাম মুনীর কূঁজো হয়ে সোফার ভিতরে ঢুকে গেল। এবং সেভাবেই বসে রইল উঠার চেষ্টা না করে।চেহারার ভিতর অপরাধী ভাব। আমি আর মাশুক অবিশ্বাসে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে।

শওকতের কথায় আমরা নড়ে চড়ে উঠলাম।

সে আমার দিকে ফিরে বলে উঠল,” ওস্তাদ, মুনীর ভাইয়ে তো সোফা ভছকায়ে দিছে।”

সেদিন থেকে সোফার সেই ভেঙ্গে গর্ত হয়ে যাওয়া যায়গাটা মুনীরের জন্যই বরাদ্দ থাকত।

আমার জন্মদিন পালন 

রাতের বেলায় সবাই এল। আমাদের নতুন সোফা দেখে পুলকিত হল। তারপর নতুন সোফা ঘরে আসতে না আসতেই ভেংগেও গেল সেটা নিয়ে হাসা হাসি হল। মোমবাতি জ্বালিয়ে কেক কেটে আমার জন্মদিন পালন হল। তারপর আধা সেদ্ধ ভুনা খিচুড়ি এবং পালংশাক মুরগী রান্না দিয়ে ভুরি ভোজন করে সবাই তৃপ্ত হল। গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা চলল। পরদিন ছুটি তাই কারো ঘরে ফেরার তাড়া নাই। কারো ঘরে কেউ অপেক্ষা করারও ছিল না। এমন ছিল আমাদের বিদেশে শুরুর সময়ের মিষ্টি মধুর আনন্দে ভরা লাগামহীন দিনগুলি ।

জন্মদিনের কেইক 

মুরাদ হাই, নিউইয়র্ক
১৭ই অক্টোবর, ২০১৫