#উত্থান১১ – Rise of a Thug

কুন্তি তার পুলিশ চাচার ভরসা দিলেও কাউঠা সাহস পেলো না পিস্টনকে হাসপাতালে ফেলে রাখতে। পিস্টন চোখ মেলে তাকালে তার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে ভেগে যাওয়ার আইডিয়াটা জানালো। বিপদের সম্ভাবনাটা খুলে বলল। সব শুনে পিস্টন মাথা নেড়ে সায় দিলো। ব্যান্ডেজ বাধা পা’টা ভারী লাগলেও আগের মত ব্যথা অনুভব করছে না। পায়ের উপর উঠে দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করে আস্বস্ত হল।

কুন্তি নাই। হলে চলে গেছে। সে ফিরে আসার আগে ভাগতে হবে। নইলে পরে আর যাওয়া হবে না। বাগড়া দেবে।

এদিক ওদিক তাকিয়ে চুপিসারে তারা দুজন হাসপাতাল ছেড়ে রাস্তায় নেমে এলো ওরা। একটা রিক্সায় উঠে হুড তুলে দিলো।

কই যামু রে – পিস্টন জিগায়।

– আপাতত জেলখানার পিছে আমার দোস্তের বাইতে যাইয়া উঠুম। বাকি চিন্তা পরে করুম।

ওরা চাংখারপুল পার হয়ে জেলখানার দিকে রিক্সা ঘুরালো।

একটা লাল ইটের পুরনো বাড়ির গেটে এসে কড়া নাড়ল কাউঠা। কুচ্ছিত চেহারার একটা মানুষ এসে দরজা খুলে দিলো। ওর নাম গাল কাটা বদু। পিস্টনের বন্ধু। খুব বিশ্বস্ত মানুষ। ওদের দেখে মাথা বের করে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে টেনে ভিতরে নিয়ে এলো। চট করে দরজা লাগিয়ে খিড়কি উঠিয়ে দিলো।

তারপর পিস্টনের দিকে তাকিয়ে সমীহ করে বলে – আপনে আমার বাইতে আইছেন, এইটা আমার সৌভাগ্য। জান দিয়া আপনেরে রক্ষা করুম। আপনে কুনো চিন্তা কইরেন না। এলাকায় পুলিশের টিকটিকি আইলে আমি খবর পায়া যামু। নিশ্চিন্তে থাকেন।

পুরনো বাড়ির জিরজিরে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলো ওরা। একটা চিলেকোঠার তালা খুলে ভেতরে আগে ঢুকল বদু। পেছনে ওরা দুজন। ভেতরে ঢুকে চমকে গেল পিস্টন। বাইরে থেকে দেখে বুঝার উপায় নাই ভেতরটা এতো ফিটফাট। সুন্দর করে গোছানো বড়সড় একটা ঘর। আরাম আয়েশের জন্য যা যা দরকার সব ব্যবস্থা আছে। বেশী খুশী হল, মোটা দেয়ালের উপর একটা এয়ার কুলার লাগানো আছে দেখে। যাক বাবা, ঘুমটা অন্তত আরামের হবে।

ঘরের বাইরে লাগোয়া কল ঘর। বালতি ভরা পানি রাখা আছে। তার পাশে ছোট্ট একটা টয়লেট। নট ব্যাড। মন্ত্রী বেটা সব সামাল না দেয়া পর্যন্ত সে আর এখান থেকে নড়ছে না।

বদুর বউ ওদের ঘরে খাবার নিয়ে এলো। মাথায় ঘোমটা টানা কম বয়েসী মেয়েটা। মুখে কোন কথা নাই। একবার মিষ্টি হেসে খাবার সাজিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো। দুইদিন ঠিক মত খাওয়া দাওয়া হয় নাই। হাসপাতালের খাবার মুখে রুচে নাই তার। তাই গোগ্রাসে গিলতে লাগলো দুই বন্ধু।

বদু এসে ঢুকল।

বলে – সময়ের অভাবে এই বেলা বাসায় রান্না করতে পারে নাই। তাই নীরব হোটেল থেকে খাবার আনায়ে নিছি। খানা খারাপ হইলে মাফ কইরা দিয়েন। রাইতে পোষায়ে দিমু।

খাবার একদম খারাপ না। খুব মজার। মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে পিস্টন তাকে হাত নেড়ে বুঝালো খাবার ঠিক আছে।

খাওয়া শেষে একটা সিগারেট ধরিয়ে পিস্টন ছাদের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে আকাশ কুসুম ভাবতে শুরু করলো। আজকাল শুধু কুন্তির কথা মনে পড়ে।

আরে, সে কি কুন্তির প্রেমে পড়ে গেল নাকি ! কোথায় কুন্তি আর কোথায় সে – একি কখনো সম্ভব ?

আবার ভাবে, সম্ভব নয় কেন !

বদু কাছে এসে জানালো – শেঠ খবর পাঠাইছে। আপনি আইলে যেন তার ওইদিকে যান রাইতের বেলায়। আইজ রাইতেই খুব জরুরী কাম আছে একটা। আমি গাড়ী ঠিক কইরা রাখসি।

প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে পিস্টন কাউঠার দিকে তাকালে সে জানালো – ওস্তাদ আমিই বদুরে কইয়া রাখসি শেঠেরে খবর দিয়া রাখতে। যদি কামে লাগে, কওন যায় নাতো।

পিস্টনের খুব ইচ্ছা হল, কুন্তির সাথে কথা বলার। তাকে হাসপাতাল থেকে তার ভেগে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে হবে। নইলে খুব খারাপ ভাববে তাকে।

সে বদুর দিকে তাকায়ে বলে – একটা কাম করো, মিয়া। রোকেয়া হলের অফিস রুমের ফোন নম্বরটা যোগাড় কইরা আনো।

– ওস্তাদ, আপনের ফোন করন লাগবো নাকি ! খারান ব্যবস্থা আছে আমার। রাস্তার দোকান থেইকা তার টানা আছে। দরকার হইলে দোকানের ফোনটা ব্যবহার করি।
তার টেনে লাগায়ে ফোন সেটটা কানে লাগিয়ে দেখল ডায়াল টোন আছে কিনা।

টোন আছে দেখে সে বলে – আমি দোকানের মালিকরে কইয়া আহি ফোন যেন না উঠায়। আর আপনের লম্বরটা জুগার করতে অখখনি লোক পাঠাই।
বলে বদু বের হয়ে গেল।

কাউঠা আড়চোখে পিস্টনের দিকে তাকালো। ভাবের চোখ দেইখা বুঝলো বেডার মনে পিরিত উথলাইয়া উঠসে মাইয়াডার লাইগা। কি একটা উপরি ঝামেলা বাধাইলো মানুষটা,বুঝি না। এই কেইস অনেকদূর গড়াইবো- সে সিউর হয়ে গেল। মুখে কিছু বলল না।

*
*
*
আধা ঘণ্টা পর বদু নম্বর যোগাড় কইরা ফিরা আইলো। নম্বরটা পিস্টনের হাতে দিলো।

পিস্টন বদুর দিকে তাকায়ে বলে – তোমার বউটারে ডাকো। অরে কও – এই নম্বরে ফোন কইরা হলের এই রুম থেইকা এই ছাত্রীরে ডাইকা দিতে। কইতে কইবা তার আত্মীয় হয় তোমার বউ। এরপর কুন্তির নাম রুম নম্বর লেখা একটা কাগজ বদুর দিকে আগায়ে দিলো।

পিস্টনের হাতে মাইয়া মাইনষের নাম লেখইন্যা কাগজ – এইটা বদুর কাছে ভিরমি খাওয়া ব্যাপার মনে হইলো। মুখে কিছু কইলো না সে। শুধু একবার চোরা চোখে কাউঠার দিকে তাকালো।

কাউঠা নিরুপায় চেহারা বানিয়ে হাল্কা করে মাথা নেড়ে বুঝালো – যা বলছে কর। পাগল খেপাইস না।

লাইনটা লাগিয়ে কুন্তিকে ডাকতে বলে ফোন পিস্টনের হাতে দিলো বদুর বউ নসিমন। ফোন কানে লাগিয়ে প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর কুন্তি লাইনে এলো।

কুন্তির গলায় ‘হ্যালো’ শুনে পিস্টন যেন অবশ হয়ে গেল। গলা দিয়ে আওয়াজ করতে গিয়ে ফ্যাস ফ্যাস করে দুর্বোধ্য স্বর বের হল।

বুঝতে না পেরে কুন্তি বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলো – কে বলছেন আপনি। আমি চিনতে পারছি না।

পিস্টন গলা খাঁকারি দিয়ে এবার পরিষ্কার গলায় বলে উঠলো – কুন্তি, আমি পিস্টন। আপনি রাগ করবেন না প্লিজ। আমাকে পালিয়ে চলে আসতে হয়েছে হাসপাতাল থেকে।

পুলিশ খোঁজ পেলে আমাকে ধরে ফেলবে। কোন উপায় ছিল না। আমার লোকেরা আমাকে ওখানে থাকতে দিতে নিরাপদ বোধ করছিলো না। তুমি কিছু মনে করো না। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও।

এক নিশ্বাসে এতোগুলি কথা বলে ফেলে তারপর থামল পিস্টন। তারপর হটাৎ মনে হল, সে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। মনের অজান্তে কুন্তিকে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ বলে ফেলেছে। সেই মুহূর্তে পিস্টন টের পেলো – সে সত্যি কুন্তির প্রেমে পড়ে গেছে।

অপর প্রান্তে কুন্তি টের পেলো ‘আপনি’ ‘তুমি’র ব্যাপারটা। নাহ, সে অবাক হয় নাই। বরং তার রাগে কাঁপতে থাকা মন হটাৎ খুশীতে নেচে উঠলো। সেতো সেই প্রথম দিন থেকে এই মানুষটাকে পছন্দ করে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারে নাই। অপেক্ষা করছিলো যদি ছেলেটা নিজে থেকে কিছু বলে। আজ জেনে গেল মানুষটা তাকে পছন্দ করে। জেনে নিজেই লজ্জা পেলো।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলো – আপনি এখন কোথায় ?

– আমি যেখানে আছি তুমি জানতে চেয়ো না। তবে নিরাপদ আছি। ভাল আছি।

– আচ্ছা, ঠিক আছে। পালিয়ে গিয়ে ভাল করেছেন। চাচা জানালো আপনাকে নাকি মার্ডার কেইসে জড়ানো হয়েছে। আমি জানি, আপনি অমন মানুষ না। যেখানে থাকুন, ভাল থাকুন। যোগাযোগ রাখবেন।

বলে লাইন কেটে দিলো।

যাক বাবা, মেয়েটা তাকে বুঝতে পেরেছে। ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।

বদু এলো ঘরে।

– ওস্তাদ, এলায় একটা ঘুম দিয়া লন। সইন্ধা হইলে গাড়ি আনুম। আপনেরে লইয়া শেঠের আস্তানায় যাইতে হইবো।
বলে বের হয়ে গেল।

কাউঠা বলে – ওস্তাদ আমি তাইলে যাইয়া নুলারে লইয়া আহি। আপনে ঘুম দিয়া উঠেন। আর লন এইটা বালিশের তলায় রাহেন। বলে একটা রিভলভার বের করে এগিয়ে দিলো।

– এইটা কই পাইলি !

– বদুর মাল।

– ওহ আচ্ছা। পোলাটা ভালই কামের মনে হইতাছে। আইচ্চা যা। তাড়াতাড়ি আয়া পড়িস।

বলে দরজাটা আটকে দিয়ে সে শুয়ে পড়লো বালিশের তলায় রিভলভারের বাটে হাত রেখে।

*
*
*
মুহূর্তে ঘুমে তলিয়ে গেল পিস্টন। ঘুমিয়ে স্বপ্নে দেখে সে একটা খুন করে ফেলেছে। পালাতে গিয়ে দেখে সব দিকে শুধু দেয়াল আর দেয়াল। অনেক উঁচু দেয়াল। সেই দেয়ালের উপর পা দুলিয়ে বসে আছে গাজীপুরের বাসের ভিতর দেখা সেই দুই পুলিশ।

ওরা তার দিকে তাকিয়ে বলে – কি রে, এবার পালাবি কেমনে ? তুই তো ইঁদুরের গর্তে আটকা পড়েছিস। এবার কেমনে পালাবি। বল তোর আইডিয়া শুনি।
হটাৎ শুনল কাছে কোথাও দুড়ুম দুড়ুম করে বোমা ফাটছে। ভয়ে কুঁকড়ে গেল পিস্টন। একদম একা সে। হাতে একটা রিভলভার। আর কেউ নাই আসে পাশে। পুলিশের দিকে গুলি ছুঁড়ে তাদের মারতে পারলেও সে পালাতে পারবে না। এই দেয়াল টপকানোর কোন উপায় নাই।

আহারে, আর বুঝি বাঁচার কোন উপায় রইলো না। এবার তাইলে জেলের ভিতর পঁচতে হবে। তারপর একদিন ফাঁসী হয়ে যাবে তার।

কুন্তির মুখটা ভেসে উঠলো মনে। বেচারী খুব মন খারাপ করবে যখন জানবে সে সত্যি একটা খুনী। সে মোটেও ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র না। বস্তির একটা ছেলে। হোটেলের মেসিয়ার ছিল। এসব ভাবতে ভাবতে ঘেমে জবজবে ভিজে গেল পিস্টনের পুরো শরীর।

ঠিক তখুনি ছিটকিনি ভেঙ্গে গিয়ে দুই পাটি দরজা ঠাস করে খুলে গেল। লাফিয়ে ঘরে ঢুকল কাউঠা, নুলা এবং বদু। সবার হাতে উদ্যত পিস্তল। ওদের ধাক্কাধাক্কিতে দরজা খুলছিল না দেখে পিস্টনের খারাপ কিছু হয়েছে সন্দেহ করে ওরা লাথি মেরে দরজার ছিটকিনি ছুটিয়ে ফেলেছে।

দরজা খোলার শব্দ এত জোরে হয়েছে যে তার আওয়াজে ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো পিস্টন। তার হাতেও রিভলভার উঁচানো। হাত একটুও কাঁপছে না। চোখা চোখি হতে সবাই হাতের অস্ত্র নামিয়ে কোমরে গুজলো।

সবার আগে খেঁকিয়ে উঠলো কাউঠা – ওস্তাদ, আপনের কি হইছে ! এতবার কড়া নাড়লাম আর আপনের কুনো নড়ন চড়ন নাই। আমরা এক্কেরে ডরায়া ভছকায়া গেছিলাম।

– আর কইছ না। এমুন ঘুম ধরছে, কিসসু টের পাই নাই রে।

বলে স্বপ্নের কথাটা মনে পড়ায় লজ্জা পেয়ে গেল। হাঁপও ছাড়ল ভেবে যে ওটা বাস্তব না, স্বপ্ন ছিল।

উঁচু জানালায় তাকিয়ে দেখে বাইরে অন্ধকার। এতোক্ষণ ঘুমিয়েছে সে, টেরও পায় নাই।

বদু বলে – ওস্তাদ, গাড়ী রেডি। আপনে রেডি হইলেই রওনা দিমু।

পিস্টন বাইরে গিয়ে টয়লেটে গেল। বের হয়ে চাতালে বসে হাত মুখ ধুলো। তারপর কাউঠার নিয়ে আসা নতুন জামা কাপড় পরে রিভলভারটা কোমরে গুঁজে বলে – চল যাই।

*
*
*
গেইটের কাছে দাঁড়ানো একটা মাইক্রোবাসে উঠলো ওরা সবাই। গাড়ী ছুটলো আহসান মঞ্জিলের দিকে। ওখানেই শেঠের আস্তানা। চারিদিক থেকে ঘিরে পিস্টনকে নিয়ে ওরা ঢুকল বাড়িটার ভিতর।

একটা ঘরে সাদা লুঙ্গী আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা শেঠ ইজি চেয়ারে শুয়ে আছে। দুই তিনজন পেশী ওয়ালা পোলা শেঠের হাত পা টিপছে। পাশে কয়েকটা চেয়ার, তার পাশে টেবিলে বড় একটা শিভার্স রিগালের বোতল, বরফ আর কয়েকটা গ্লাস রাখা আছে।

পিস্টনকে অনেকবার মরার হাত থেকে বাঁচিয়েছে শেঠ। পছন্দও করে খুব। বেশী পছন্দ করে তার সততা। যা বলে সে সেটা করে। কোন নড়ন চড়ন নাই। তারচেয়ে বড় কথা পিস্টনের কোন লোভ নাই।

আজ শেঠ তাকে ডেকেছে কোন দরকারে। তাকে তো আসতেই হবে। তাই এলো। শরীর খুব ভাল না। তবুও আসতে হয়েছে।

শেঠ তাকে দেখে উঠে বসলো।

তারপর বলে – আহো আহো, ছোড ভাই। তোমার লেইগাই ওয়েট করতাছি।

তারপর ছেলেগুলির দিকে তাকালো। তারা উঠে চলে গেলো।

শেঠ নিজে উঠে বোতল খুলে গ্লাসে গ্লাসে সবার জন্য হুইস্কি ঢালল। বরফ মেশালো। তারপর সবার হাতে হাতে দিলো।

নিজের গ্লাস উঠিয়ে বল – চিয়ার্স, মিয়ারা। আইজ রাতের অপারেশন সফল হোক।

শেঠের হাত থেকে গ্লাস পাওয়া অনেক সন্মানের ব্যাপার ওদের জন্য। সন্মানিত বোধ করলো। কিন্তু কেউ বুঝতে পারলো না – কিসের অপারেশনের কথা বলছে শেঠ !
শেঠ নিজের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করলো – আমার নিজের লোক নিমু না। তোমারে ডাকছি ক্যান জানো ? তোমারে আমি আপনা ভাইয়ের চেয়ে বেশী বালা জানি। বিশ্বাস করি।

বলে থামল আবার চুমুক দিতে।

তারপর বলা শুরু করলো – আইজ রাইতের মেইন অপারেশনে থাকুম শুধু তুমি আর আমি। আর পোলাপান সব বাইরে খাড়ায়া পাহারা দিবো। দরকার হইলে ডাকুম। ভিত্রে ঢুকুম তারপর যেই কয়টারে সামনে পামু, ফালায়া দিমু। তয় খেয়াল রাইখো মহব্বত যেন কুনভাবে ভাইগা যাইবার না পারে। অরে আইজ খাইতেই হইবো। নইলে হেয় আমারে খায়া ফালাইবো পয়লা চান্সেই।

অপারেশনের বিষয় শুনে চমকে উঠলো পিস্টন। আবার খুন করতে হবে। তার বোধ হয় আর মুক্ত থেকে বাঁচা হল না। হয় মরতে হবে, নয়ত জেলের ভাত খেতে হবে। এজন্যই মনে হয় তার জন্ম হয়েছে। কুন্তি এরপর তাকে দেখলে ঘেন্না করে থুথু ছিটাবে।

কিন্তু শেঠের জন্য দরকার হলে সে জান দিতে পারে। তাই কোন কথা জিজ্ঞেস না করে চুপচাপ তার প্ল্যান শুনে যাচ্ছে।

শেঠ বলে যাচ্ছে – পাক্কা খবর আছে, আইজ রাইতে মহব্বত বখরা উঠাইতে আইবো কান্দু পট্টিতে। ওইখানে বইসা নাচ গান হুনবো। মাল টানবো। অরা যখন মাল টানতে বইবো। ঠিক তক্ষণ আমরা এটাক করুম। বুঝলা !

অগোরে মাইরা সোজা স্পিড বোটে উইঠা ঢাকার বাইরে যামুগা কয়দিনের লেইগা। মাঝ নদীতে বজরা নৌকা রেডি আছে। কুনো চিন্তা নাই। মউজ হইবো নদীর উপ্রে।
তারপর শেঠ হুংকার দিলো – অই তরা কই রে সব ! খাওন দে। খিদায় ত প্যাট জ্বলতাছে আমাগো।

হাজীর বিরিয়ানী এলো। বাহ, অনেকদিন খাওয়া হয় নাই এই প্রিয় খাবার। কাঁঠাল পাতায় করে আনা বিরিয়ানী আর বোরহানি খেলো সবাই পেট পুরে।

– বড় ভাই, আমি কাউঠা আর নুলারে লগে লইতে চাই। আপিত্তি আছে আপ্নের ?

– না নাই। লইয়া লও। জানি, অরা তুমার বেশী আপনা মানুষ।

– মাল আছে সবার লগে নাকি লাগবো ?

– আছে তয়, গুলি বেশী নাই।

তাইলে আমার এখান থেইকা বদলাইয়া লইয়া লও। নতুন চালান আইছে। একদম খাসা মাল। সব অটোমেটিক।

রাত বারোটার দিকে শেঠের রেকি টিম খবর পাঠালো মহব্বতের গ্রুপ পট্টিতে ঢুকেছে। সাথে তিনজন আছে।

একটা’র দিকে খবর এলো, ওরা এখন আমিনা মাসীর ঘরে বসে বোতল টানছে আর বাইজী নাচ দেখছে।

শেঠ উঠে দাঁড়ালো। নিজের ঘরে গিয়ে সাদা লুঙ্গি পাল্টে কালো শার্ট প্যান্ট পরে এলো। চোখে কালো সানগ্লাস। তাকে দেখতে এখন একদম নানা পাটেকরের মত লাগছে। ভয়ঙ্কর লাগছে।

সবাই বেরিয়ে শেঠের জন্য আনা কালো একটা গাড়ীতে উঠে বসলো। গাড়ী ছুটতে শুরু করলো ইংলিশ রোডের দিকে।

রাস্তায় গাড়ী কম। রিক্সা যাচ্ছে টুংটাং করে বেল বাজিয়ে। কে যেন বাঁশী বাজাচ্ছে কাছে ধারে কোথাও। খুব করুন সুর সেই বাঁশীর। বাঁশির সুর শুনলে পিস্টনের খুব মন খারাপ লাগে। একটা কুকুর হটাৎ করুন স্বরে কেঁদে উঠলো কোথাও।

একি, আজ কি তার উপর সত্যি কোন বিপদ নেমে আসবে নাকি কে জানে !

ট্রাফিক পুলিশটা তখনো চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে বাঁশী ফুঁকছে। বেচারা মনে হয় অপেক্ষা করছে কখন তার বাড়ি ফেরার সময় হবে। আহারে, কত কষ্ট করে রোদের ভিতর সারাদিন। তবুও মানুষের গালি খায় এরা। হারামী মানুষ সব।

গাড়ী এসে থামল ইংলিশ রোডের সাইডের রাস্তায়। এন,সি,এল অফিসের সামনে। গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো শেঠের টিকটিকিরা। ফিসফিস করে শেঠের কানে কানে জানালো, পট্টিতে মজমা জমে গেছে।

শেঠ গাড়ি থেকে নামলো। চোখে কালো চশমা। কালো শার্ট প্যান্টের উপর একটা চাদর জড়ানো গায়ে। চাদরের আড়ালে কাঁধ থেকে ঝুলছে ইজরায়েলে তৈরি উজি সাব মেশিন গান।

সাইজে ছোট কিন্তু মারাত্বক মারদাঙ্গা জিনিস। খুব নির্ভরশীল অস্ত্র। ‘৪৫ ক্যালিভারের বত্রিশ রাউন্ডের ম্যাগাজিন। উজি গরম না হয়ে মিনিটে সর্বোচ্চ ছয়শ’ রাউন্ড পর্যন্ত ফায়ার করতে পারে। খুব সখ করে শেঠ এই জিনিস জোগাড় করে এনেছে ভারত থেকে।

পিস্টনের কোমরে আছে ওয়ালথার পিপিকে। এই ছোট পিস্তলের নিশানা কখনো মিস হয় না। এর বেশী কিছু সে সাথে রাখতে পছন্দ করে না।

নুলা এনেছে নাইন এম এম ল্যুগার। একটু ভারী কিন্তু গুলি করে শান্তি পাওয়া যায়। গুলির গর্তটা অনেক বড় হয়ে যায়।

কাউঠা সব সময় ‘৪৫ ক্যালিভারের রিভলভার পছন্দ করে। ছয় রাউন্ডের চেম্বার। এছাড়া সাথে আছে তার প্রিয় ছোট্ট ছুরিটা। এই জিনিস দিয়ে পেঁচিয়ে গলা কাটতে খুব ভাল লাগে তার।

তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল পট্টির সব কয়টা গেইটের দিকে। নুলা আর কাউঠা গেইটে থাকবে। একশনে যাবে শেঠ এবং পিস্টন।

*
*
*
দুদিক থেকে ভেতরে ঢুকল শেঠ ও পিস্টন। মহব্বতের আড্ডায় নাক গলিয়ে দিলো তারা। লম্বা আলখেল্লা পরা মহব্বত চোকিতে কাত হয়ে বসে গেলাস তুলছে মুখে। বাকি তিনজন মেয়েদের সাথে দুষ্টামি করছে। দুটো ধুমসি মেয়ে কোমর দুলিয়ে নাচতেছে হিন্দি গানের তালে তালে।

পিস্টন মুহূর্তে সবাইকে রেকি করে ফেললো। বুঝল সবার কাছে অস্ত্র আছে। মহব্বতের আলখেল্লার আড়ালে অবশ্যই তার প্রিয় সামুরাই সোর্ডটা আছে। সে জুডোতে ব্ল্যাক বেল্ট, পিস্টন জানে সেটা। সোর্ড ভাল চালাতে জানে। তাকে কোনভাবে সেই সুযোগ দেয়া যাবে না। তাইলে পরিস্থিতি আর সামলানো যাবে না। তার আগেই তাকে খতম করতে হবে।
ঢুকেই গোলা গুলি শুরু না করে শেঠ মুখ খুলল – কি গো মিয়ারা, ভাল মজমা জমাইছো দেহি। আমারে দাওয়াত দিলা না, ক্যান !

শেঠের হাত চাদরের তলায় উজির ট্রিগারে। প্রস্তুত। পিস্টন দুই হাত বুকে বেঁধে নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে আছে সবার দিকে চোখ রেখে। সেও প্রস্তুত।

ওদের দেখে মেয়েরা নাচ থামিয়ে দৌড়ে বের হয়ে গেলো। আমিনা মাসী’র কাছে পিস্তল আছে। পিস্টন টের পেলো। তার দিকেও চোখ রাখতে শুরু করলো। আমিনা মাসী উঠে দাঁড়াতে গেল। পিস্টন ইশারা করে তাকে বসে থাকতে বলল। শুনে মাসী থমকে গেল।

মহব্বত একটুও না নড়ে সেই একইভাবে কাত হয়ে শুয়ে আছে। এক পা মাটিতে আরেক পা বিছানার উপর। তার কোমরে ঝুলানো আছে হাতির দাঁতের বাটওয়ালা একটা এন্টিক রিভলভার। এসব জিনিস জোগাড় করার নেশা আছে তার। পায়ে কুমিরের চামড়ার বুট। তার পেছনে ধাতব স্পার লাগানো আছে। সাধারণত এমন বুট পরে ওয়েস্টার্ণ কাউবয়রা। মহব্বত ঠিক তাদের মত করে পোশাক পরে। মাথায় কাউবয় হ্যাট পরে।

মহব্বতের এক হাতে গেলাস। আরেক হাত পেছনে। তারমানে পিঠের খাপে আটকানো সোর্ডের হাতলে আছে সেই হাত। গেলাস হাতে হলেও সে প্রচণ্ড স্থির মাথার মানুষ। চোখের পলক পড়ছে না একদম। ওভাবে থেকেই মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো – এইদিকে কি মনে কইরা আইলা, শেঠ ! কুনো খাস বান্ধবী আছে নাকি এখানে ?
তারপর আমিনা’র দিকে ফিরে বলে – তুমি বইসা আছো ক্যান ! শেঠ আইছে তোমার আখড়ায়। তার সেবা যত্ন কর।

ভুল সিগনাল পেলো আমিনা। কোমরের পেছন থেকে ঢাউস রিভলভারটা তার হাতে চলে এলো। এবং গুলি করলো। সেটা গিয়ে লাগলো শেঠের মাথার উপর দিয়ে গিয়ে চৌকাঠে।

বিদ্যুৎ খেলে গেল পিস্টনের শরীরে। মুহূর্তে ওয়ালথারটা বের করে পয়লা গুলি করলো আমিনাকে। তারপর মহব্বতের দিকে নল ঘুরালো। ততক্ষণে শেঠ চাদরের তলা থেকে উজি দিয়ে বাকি তিনজনের দিকে ব্রাশ ফায়ার করলো।

পিস্টন গুলি করতে গেল মহব্বতকে। তাকিয়ে দেখে সে তার জায়গায় নাই। উঠে দাঁড়িয়েছে সে। হাতে চলে এসেছে কালো ব্লেডের সামুরাই সোর্ড। সাঁই সাঁই করে ঘুরাতে ঘুরাতে সে ধেয়ে এলো পিস্টনের দিকে। পিস্টন বামে চেপে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে গিয়ে মহব্বতের সোর্ড ধরা হাতের দিকে গুলি চালালো। গুলিটা গিয়ে লাগলো হাতের বদলে সোর্ডের হাতলে। সেটা ছুটে গেল মহব্বতের হাত থেকে। এবার মহব্বত কোমরে ঝুলানো রিভলভারের দিকে হাত বাড়ালো। তার আগেই পিস্টন তিনটা সীসা ঢুকিয়ে দিল মহব্বতের বুকে এবং কপালে। কাটা কলাগাছের মত ধপাস করে পড়লো সে ফ্লোরের উপর।

গুলির আওয়াজে কাউঠা ছুটে এলো। এসে দেখে রক্তারক্তি কাণ্ড। শেঠের কাঁধে একটা গুলি লেগেছে। দরদর করে রক্ত পড়ছে। ফ্লোরে অনেকগুলি লাশ।

কাউঠা মাত্র সোর্ডটা উঠাতে হাত বাড়িয়েছে। তার আগে মহব্বত সেটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেল। কিন্তু মাঝপথে ভাঁজ হয়ে স্লো মোশনে আবার পড়তে শুরু করলো। তার আগে সোর্ডটা চালালো কাউঠাকে লক্ষ করে। মুহূর্তের ভিতর কাউঠার শরীরের বাম পাশে পিঠ থেকে পা পর্যন্ত পোঁচ দিয়ে চিরে দিলো।

কাউঠা শুধু বলতে পারলো – ওস্তাদ, আমি মনে হয় শেষ। আপনে পারলে পালান।

পিস্টন কাউঠাকে ধরতে গেল। দুই দিন আগে পায়ে গুলি খেয়েছে। আজ ওষুধ খাওয়া হয় নাই। পায়ের ব্যাথাটা জ্বালাতে শুরু করলো। অবশ অবশ লাগছে পা টা। সেই পা উঠিয়ে এক পা সামনে বাড়াতে গিয়ে ফ্লোরে জমে থাকা রক্তের বন্যায় পা পিছলে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। থুতনিটা গিয়ে সজোরে বাড়ি খেলো কংক্রিটের ফ্লোরে। সাথে সাথে জ্ঞান হারালো পিস্টন।

মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। কতক্ষণ অজ্ঞান ছিল জানে না। যেন অনেকগুলি ঝিঁ ঝিঁ পোকা একসাথে সেখানে ঢুকে পড়েছে। অনেক মানুষের কথা কানের কাছে শুনলো। জ্ঞান ফিরে এলো পিস্টনের। চোখ মেলে দেখলো খাকি পোশাক। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

এই রে কাম সারছে ! পুলিশ আইলো কোইত্থেকা ? এইবার আর রক্ষা নাই। হাতে নাতে ধইরা ফালাইলো খুনের কেইসে।

সদরঘাট ওসি রমজান খুব নীচ আর ধুরন্ধর প্রকৃতির মানুষ। পিস্টন তাকে একদম লাইক করে না। রমজানও পিস্টনকে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু কিছু করতে পারছিল না। এবার আর ছাড়া পাবে না বাছা। হাতেনাতে ধরে ফেলেছে।

পটাপট ক্রাইম সিনের ছবি তুলছে পুলিশের ফটোগ্রাফার। এম্বুলেন্স এলো। পিস্টনের হাতে হাতকড়া পায়ে ডাণ্ডা বেড়ি পরিয়ে এম্বুলেন্সে তোলা হল।

রমজান নির্দেশ দিলো – এইটাকে পুলিশ হাসপাতালে নিয়া যা। কাউরে কিছু জানাবি না। বাকি গুলিরে ঢাকা মেডিক্যালে পাঠায়া দে।
বলে পিস্টনের গায়ে কষে একটা লাথি দিয়ে বের হয়ে গেল ওসি রমজান।

পিস্টন পায়ের ব্যথায়, থুতনির ব্যথায় গোঙাচ্ছে। এর ভিতর তাকিয়ে দেখে নিলো – মহব্বত মরে পড়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। আরও পড়ে আছে মহব্বতের তিন চেলা আর আমিনা। কিন্তু শেঠ কিংবা কাউঠাকে কোথাও দেখলো না। তারমানে ওরা সটকে পড়তে পেরেছে।

যাক, বাঁচা গেল।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে।

তারপর হাত পা বাঁধা অবস্থায় স্ট্রেচারে শুয়ে এম্বুলেন্সে উঠলো পিস্টন। সেটি শুধু তাকে নিয়ে সাইরেন বাজিয়ে হূহূ করে ছুটলো রাতের ঢাকার প্রায় শূন্য রাস্তা ধরে।

এম্বুলেন্সের রেডিওতে দেশাত্ব বোধক গান বাজতেছে। হঠাৎ মনে পড়লো – রাত পোহালেই তো ১৬ই ডিসেম্বর। বাংলাদেশের বিজয় দিবস।

এতো কষ্টতেও মনটা ভাল হয়ে গেল। শেঠকেও সে আজ মহব্বতের রাহু থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনে দিয়েছে। নিজে ধরা পড়ে গেলেও তার জয় হয়েছে। ভেবে ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
১৬ই ডিসেম্বর, ২০১৮
চলবে..