লাইফ ইন সুর্যসেন হল – জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়
এলোমেলো ভাবে অনেকবার লিখেছি আমি আমার জীবনে কাটানো শ্রেষ্ঠ সময় নিয়ে। গুছিয়ে কখনো হলের জীবন নিয়ে বিশদভাবে লেখা হয় নাই। তাই ভাবলাম আবার চেষ্টা করি।
শ্রেষ্ঠ সময়টুকু কেটেছে পরিণত বয়সে বাসার বাঁধাধরা নিয়ম কানুনের শৃঙ্খল ছেড়ে স্বাধীনভাবে বন্ধুদের সাথে ভার্সিটির হলে থাকার দিনগুলিতে। ক্যাম্পাসে ভাল সময় কেটেছে তবে মুল সুখটা পেয়েছি হলের আবাসিক ছাত্র হয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইটা হলের আকৃতি দেখতে যমজ সন্তানের মত। এগুলি হল মহসীন হল ও সুর্যসেন হল। মহসীন হল দানবীর দয়ালু হাজী মুহম্মদ মহসীনের নামে স্থাপিত। আর সুর্যসেন হল যার স্বাধীনতা পুর্ব নাম ছিল জিন্নাহ হল, যেটা ১৯৭২ সালে নাম বদলে হয়ে যায় মাস্টারদা সুর্যসেন হল। সুর্যসেন কে ছিলেন সেটা নিশ্চয়ই নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। নামের তেজের মত হলটার তেজও তেমনি।
হ্যাঁ, সত্যি এই হলটাকে আমার কাছে ভীষণ তেজী আর প্রাণবন্ত মনে হত যতদিন ওখানে ছিলাম।
আমেরিকায় এসে নিউইয়র্কে বাস করা শুরু করে জানলাম, এই শহরের প্রাণকেন্দ্র ম্যানহাটান নাকি কখনো ঘুমায় না। ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকে। পয়লা বুঝি নাই। ম্যানহাটানে কাজ করতে গিয়ে টের পাই, শহরটা আসোলেই ঘুমায় না। পর্যটক কেন্দ্রিক ম্যানহাটান রাতদিন মানুষের হইচই, আনাগোনায় গমগম করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার আবাসন সুর্যসেন হলকে আমার কাছে ঠিক তেমনি প্রাণবন্ত সজীব মনে হত।
কলেজে পড়ার সময়েও সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে হত। রাত এগারোটায় বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হত। প্রতিদিন একই নিয়ম। একই খাবার। খুব বোরিং লাগতো। ব্যাগ হাতে থাকার জন্য হলে পা দিয়ে যেন জীবন আমূলে বদলে গেলো আমার।
১৯৭৯ সালে এইচএইচশি পাশ করে সে বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টির মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হলাম।
ফার্স্ট ইয়ারের মাঝামাঝি সময়ে আমি মগবাজারের বাসা থেকে হলে এসে ঢুকেছি। থাকার যায়গা পেলাম ডায়নিং হলের পাশে গণভবনে। মানে একটা খোলা হলরুমে সার বেঁধে রাখা নড়বড়ে চকি। পাশে একটা করে পড়ার টেবিল। দেয়ালের পেরেকে আটকানো দড়িতে শার্ট প্যান্ট লুঙ্গি ঝুলছে। ঝুলছে মশারীর দড়ি। চকির তলায় ঢাউস তালা ঝুলানো একটা করে টিনের ট্রাঙ্ক। সেই ট্রাঙ্কে সবার সব গুপ্তধন রাখা।
আমার অনেকগুলি ক্লাসমেট থাকে সেই গণভবনে। ডালিম, যহির, রশিদ, ফজলু, ওয়াসিম। ওরা সবাই মফস্বল থেকে এসেছে। আমি ঢাকার ছেলে। ঢাকার ছেলেরা হলে থাকে না। বাসা থেকে এসে ক্লাস করে। আমিও তাই করছিলাম। কিন্তু হলে থাকার স্বাদ পেতে বাসা ছেড়ে হলে এসেছিলাম। এসে যে অমন চিৎকাত বোর্ডিং এ থাকতে হবে এটা তো ভাবি নাই। ভেবেছি একা সিঙ্গেল রুমে থাকবো জমিদারের মত। এসে দেখি বিধি বাম।
কি আর করা, বড় গলা করে বাসা ছেড়ে এসে যখন পড়েছি, ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। ডালিম খুলনার ছেলে। রশিদ মহেশখালীর ছেলে। কুমিল্লা বোর্ডের স্ট্যান্ড করা ছাত্র। ভীষণ হাসিখুশি মানুষ। সে আমাকে টেনে নেয়। আলাদা চকি পাই নাই। কারো সাথে ডাব্লিং করতে হবে। যায়গা হল রশিদের চকিতে। আমি হ্যাংলা পাতলা মানুষ। রশিদ নাদুস নুদুস তেলেতেলে মানুষ। গায়ের সাথে গা লাগলে মনে হয় যেন নরম গদিতে হেলান দিলাম। সব ঠিক আছে শুধু ওর গায়ের বিদঘুটে টক টক গন্ধে আমার জান যায় যায় অবস্থা।
ধীরে ধীরে সেই গন্ধটাও সয়ে যায়। মেনে নেই। ওদের সাথে পাশের ডায়নিং হলে দুপুরে খেতে যাই। একদিন খেয়ে আর ওমুখো হই নাই। খুবই অখাদ্য টাইপ ডাল ভাত মাছ। ডাল এত স্বচ্ছ ছিল যে পাতালে ডালের বাটির চলটা উঠা দাগগুলি স্পষ্ট দেখা যেতো।
ক্লাস শেষে টিএসসি থেকে খেয়ে হলে চলে আসি। এসে ঘুমাই। বিকেলে হল গেইটে বসে চা বিস্কুট খাই। বাসার বন্ধুরা আসে। ওদের সাথে নিউমার্কেট এলিফ্যান্ট রোডে ঘুরতে যাই। রাতে ফিরে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় পড়তে বসি। আমার পড়তে বসা দেখে হলের বন্ধুরা হাসে। টিটকারী মারে। আমার অবাক লাগে। ওরা বলে – আরে ব্যাটা, প্রতিদিন পড়তে হয় না। পড়ব শুধু পরীক্ষার আগের রাতে। আয় তাস খেলি।
রাতের বেলায় মাঝে মাঝে আরেকটা কাজ করতে হয়, সেটা হল মিছিল করা। নইলে নাকি হলে থাকতে দেবে না। সবাই যায়, আমিও যাই। শ্লোগান দেই। হলের একমাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হেঁটে দৌড়ে মিছিল করে ক্লান্ত হই। মিছিল শেষে হল গেইটে বসে চা সিগাত্রেট টানি। কখনো মুফতে রাতের খাওয়াটা হয়ে যায়।
বাসা থেকে আমার মাসিক বরাদ্দ ছিল পাঁচশো টাকা। শুরুতে হয়ে যেতো। পরের দিকে সপ্তাহ গেলেই ফুরিয়ে যায়। কত খরচ তখন। বাকির খাতায় নাম উঠে। বাসায় গিয়ে বই কিনতে হবে, ফর্ম ফিলাপ করতে হবে এমন সব মিথ্যা বাহানা দিয়ে বাড়তি টাকা আনি।
সেই সময়ে একদিন সুযোগ এলো একটা সিঙ্গেল রুম দখল করার। রুমের বাসিন্দা পাশ টাশ করে রুম দখল করে বসে আছে। এমন খবর পেয়ে নেতাদের সিগনাল পেয়ে রুমটা আমাদের বন্ধুরা তালা ভেঙ্গে দখল করে নিলো। ব্যস, আমরা গণভবন ছেড়ে ৩২২ নম্বর রুমে উঠে এলাম। একটা মাত্র সিঙ্গেল রুমে বেডে, ফ্লোরে গাদাগাদি করে ঘুমাই। তবুও খারাপ লাগে না। ধীরে ধীরে ব্লকের আরও রুম আমাদের দখলে চলে এলো। আমি ও ডালিম গিয়ে উঠলাম ৩১৬ নম্বর রুমে। ৩২৪ তে ফজলু, ৩১৯ এ যহির এনু, ৩১৭ তে আজাদ, ৩১৪ তে মুকুল এভাবে প্রায় ব্লকের অর্ধেকটা আমাদের বন্ধুদের দখলে চলে এলো। আমাদের মাঝে ৩১৮ নম্বর রুমে থাকতেন সিনিয়র সেলিম ভাই। ৩০১ এ আব্দুস সোবহান গোলাপ ভাই, ৩০৩ এ ডাকসু জিএস, জিয়াউদ্দীন বাবলু ভাই, ৩০৪ এ এজিএস হেলাল ভাই থাকতেন। সবাই ভিন্ন ভিন্ন দলের সমর্থক কিন্তু নিজেদের ভিতর কোন রাজনীতি চলত না। সবাই যেন এক পরিবারের মানুষ।
হলের পাশাপাশি গোসলখানায় ঢুকে এক সাবানে ৩/৪ জন গোসল সারি। এক টুথপেস্টে সবাই শেয়ার করি। টয়লেটে কল নাই। টানা চেইনের ফ্লাশ নষ্ট। কে পানি না ঢেলে পালায়, ডালিম গিয়ে তাকে ধরে রগচটা ডালিম জুতার আওয়াজ তুলে কেউ রুমের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেও ধমকায়।
কে কাড় জামা গায়ে দিলো, কার জুতা পরল ব্যাপার না। একজন আরেকজনের আন্ডারওয়ার পরেও চলে যায়। কোন সমস্যা নাই। তবে সমস্যা না থাকলেও আমরা কেউ লুঙ্গি পরে হলের বাইরে যেতাম না। কাউকে পরা দেখলে ডালিম বলে উঠতো – দেখ ডোমেস্টিকের অবস্থা, দেখ। ঢাবি’র ইজ্জত আর রাখলো না।
টিংটিঙে লম্বা ঝাঁকড়া চুলের আমি কুমিল্লার খদ্দেরের সাদা চাদর গায়ে দিয়ে বের হলে অন্যরা ভাবে কাঁধে বোধ হয় কাটা রাইফেল ঝুলছে। বন্ধুরা দুষ্টামি করে – ভাব নিয়া থাক না।
হলের ডায়নিং রুমে খাওয়া বাদ দিলাম। হলের বাইরে জসিমুদ্দিন হলের কাছে আমাদের হলের ক্যাফেটারিয়া। ওখানে খেতাম দুপুরের খাবার সকালের নাস্তা। পয়সা না থাকলে হলগেইটের বাইরে এখন যেখানে সাইকেল স্ট্যান্ড ওখানে অনেক টং দোকান ছিল, যেখানে আমরা বনরুটি কলা চা খেয়ে নাস্তা সেরে নিতাম। নাস্তা কিংবা দুপুরে কি খেলাম সেটা জরুরী ছিল না। তবে খাওয়ার পর একটা ৫৫৫ বা বেনসন সিগারেট টানতে পারলে বড় সুখ পেতাম।
একটা সিগারেট কেউ কোনদিন একা টেনে শেষ করতে পারি নাই। কয়েক টানের পরই হাত ঘুরতে শুরু করতো।
হলের ভিতর টিভি রুমের উল্টা পাশে ছিল হল ক্যান্টিন। বরিশালের জয়নাল মিয়াচালাতো সেই ক্যান্টিন। শুধু বিকেলের স্ন্যাক্স পাওয়া যেতো। ডালপুরি, সামি কাবাব, সিঙ্গারা, সমুসা, মুড়ি বুট। খুব সাধারণ খাবার কিন্তু স্বাদ ছিল অসাধারণ।
টিভি রুমে সামনের সারিতে বসা নিয়ে কম কলহ হয় নাই। সাপ্তাহিক নাটক দেখার দিন টিভি রুম ফুল হয়ে যেতো। এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, এগুলি মনে হয় তখনই দেখা হয়েছে।
টেলিফোন করার দরকার হলে প্রভোস্টের অফিস ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। মাগার প্রভোস্ট ছিল শক্তের ভক্ত নরমের যম। একদিন খুব দরকার হলে গিয়ে খুব নরম সুরে ফোন করতে চাইলে উনি প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে আমাকে বের করে দিলেন। পরে হলের জিএস বন্ধু খোকন আমাকে সাথে নিয়ে প্রভোস্টের রুমে গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করে ফোন করতে শুরু করলে স্যার থামকে গিয়ে ভয়ে খোকনকে বাবা ডাকা শুরু করলো। হ্যাঁ, মিষ্টি ব্যবহারের কোনই দাম ছিল না রে ভাই।
একদিন আলাদীনের চেরাগের মত হলের গেইটের পাশে দেয়ালে নীল রঙের কয়েন টেলিফোন বসানো হল। একটা বাঘ মার্কা সিকি দিয়ে ৩ মিনিট কথা বলা যেতো। এই ফোনটা রাত দিন ২৪ ঘণ্টা বিজয়ী থাকতো। হলের বড় ভাই শান্ত যিনি বিশ্বপ্রেমিক খেতাবে ভূষিত ছিল, ফোনটা প্রায় সময় ওনার দখলে থাকতো। পকেট ভর্তি সিকি নিয়ে সেই যে কথা বলা শুরু করতো, ঘণ্টা পেরুলেও ওনার কথা বলা আর শেষ হয় না। একদিন সকালে উপর থেকে নেমে গেইটে এসে দেখি নীল রঙের ফোনটা নাই দেয়ালে। কেউ টেনে ছিঁড়ে খুলে নিয়ে গেছে ওটা। পরে জেনেছি শান্ত ভাইয়ের উপর রাগ করে এই কাজটা করেছে কেউ। এরপর আর সেটা তার যায়গায় ফিরে আসে নাই। কোন রিপ্লেসমেন্টও পাই নাই।
গেইটের পাশে হলের গেস্টরুম। নিয়ম ছিল কেউ ছাত্রদের সাথে দেখা করতে এলে তাদের সাথে ওখানে বসে গল্প করতে হত। বাস্তবে অমন কিছু হত না। রুমটা ব্যবহার হত রাজনৈতিক দলের মিটিং করার কাজে। আর না হয় অলস কেউ নীল রেক্সিনের সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে থাকতো ফ্যান চালিয়ে।
ঘুমানোর টাইম পেতাম খুবই সামান্য। ঘুমাবো কেমন করে ! কত রাজ্যের কাজ করতে হত আমাদের। আড্ডা, মিছিল মিটিং, ঝগড়া মেটানোর দরবার, গাঁজার আড্ডা, কারো সৌজন্যে একটা বিদেশী লিকারের বোতল পেলে বিশেষ আয়োজনে তার সাশ্রয় করা। শুধু পরীক্ষার সময় এলে আমাদের রুমগুলিতে হইচই বন্ধ হয়ে যেতো। সুনসান নীরব সবাই, যে যার রুমে চিতকাত হয়ে শুয়ে বসে পড়াশুনায় মগ্ন। নোট জোগাড়ে ব্যস্ত। এক হল থেকে আরেক হলে ছুটাছুটি করে নোট জোগাড় করে নীলক্ষেতে গিয়রে ফটোকপি করে সবার রুমে রুমে পৌঁছে দেয়া হত। কেউ কেউ পরীক্ষার খবর না রেখে নীলক্ষেতে গাঁজার আড্ডায় পড়ে থাকতো। ওদেরকে ধরে এনে গোসল করিয়ে খাইয়ে হাতে নোট ধরিয়ে দেয়া হত যেন পরদিনের পরীক্ষা কেউ মিস না করে।
ইমপ্রুভ ডায়েট – পরীক্ষা এলে সবার ভাল খাবার খেতে ইচ্ছা করতো। নইলে যেন পরীক্ষায় ফেইল মারবো আর কি ! আমাদের ইমপ্রুভড ডায়েট বলতে ছিল চাংখার পুলের নীরব হোটেলের মগজ ভাজি দিয়ে ভাত খাওয়া আর না হয় ঢাকা কলেজের উল্টা পাশের চিটাগাং হোটেলের বিখ্যাত গরুর মাংস দিয়ে ভাত খাওয়া। ঐ খাবার খেতে পারলেই আমরা ধন্য হয়ে যেতাম।
ঢাকা ফুটবল লীগের দুইটা টপ রেটেড দল ছিল মোহামেডান ক্লাব এবং আবাহনী ক্লাব। হলের ছেলেরা এই দলের সমর্থক হয়ে বিভক্ত ছিল। যেদিন এই দুই দলের খেলা থাকতো আমরা দলবেঁধে যেতাম ঢাকা স্টেডিয়ামে। খেলার হাড় জিতের মারামারি স্টেডিয়াম থেকে শুরু হয়ে হলে এসেও শেষ হত না। না। হলে আমরা মারামারি করতাম না। তবে অনেক হইচই করতাম। টিনের মগ প্লেট দিয়ে আওয়াজ করে, পানি ছিটিয়ে হেরে যাওয়া দলের সমর্থক বন্ধুদের খেপাতাম।
জানেন, কখনো কারেন্ট চলে গেলে, পরদিন পরীক্ষা থাকলেও আমরা মন খারাপ করতাম না। বরং ছেলেবেলার মত আজ আর পড়তে হবে না এই খুশীতে ফেটে পড়তাম।
ট্রাস্ট মি, এই হলে তখন পর্যন্ত একা কোন দল রাজত্ব করতে পারে নাই। একদম যে কোন সময় ফেটে যাওয়ার মত টাইম বম্ব ছিল এই হল। বলতে পারেন, দুইটা শক্তিশালী দলের সহাবস্তানের কারণে কেউই একক দখল নিতে পারতো না। তাই ঝগড়া ঝাটি মারামারি হলেও আবার মিলমিশ হয়ে যেতো।
মারামারি হত। রুম ভাঙ্গাভাঙ্গি হত। কিন্তু কেউ সরাসরি কারো গায়ে হাত তুলত না। একদল প্রবল শক্তি নিয়ে আক্রমণ করলে আগেই তারা খবর পাঠিয়ে দিতো যেন অন্য দলের ছেলেরা সরে যায়। হ্যাঁ অমন আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল বৈকি !
মাঝে মাঝে অস্ত্র উদ্ধার করতে পুলিশ আর্মি হল রেইড করতো। পেঁয়াজ কাটার ছুরি ছাড়া আর কিছুই পেতো না তারা। কারণ যার কাছে যা থাকতো, সবই হলের টোকাইদের কোমরে চলে যেতো। ওরা ওসব নিয়ে তাদের ময়লা দুর্গন্ধময় লেপ কাঁথা গায়ে দিয়ে করিডরে শুয়ে থাকতো।
হলে ভিন্ন দল করলেও হলের বাইরে আমাদের কোন বাসিন্দা বিপদে পড়ার খবর এলে পুরো হলের সব ছেলেরা একদল হয়ে যেত। আমাদের হল অন্য হলের সাথে খেলাধুলায় হারছে এমন খবর এলে ব্যস, সেলিম ভাই পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে সবাইকে সাথে নিয়ে খেলার মাঠের দিকে রওনা দিতো। আহ, প্রিয় সেলিম ভাইটা এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ট্রাক চাপা পড়ে মারা গেছেন। ভিন্ন মতের মানুষ হলেও বড় ভালবাসতেন আমাদেরকে।
আমরা দুইটা ডাকসু নির্বাচন পেয়েছি। সেই সময়টা ভীষণ আনন্দের ছিল। জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে কোন অংশে কম হইচই হত না হল সংসদ ও ডাকসু নির্বাচনে।
হলে থাকতে গিয়ে নিজের ডিপার্টমেন্ট ছাড়াও কত ভাই বন্ধু যে পেয়েছি, যাদের সাথে নাড়ির সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সোশিওলজির খোকন, জাকির, আলম, বাকের, হাসান, জিওগ্রাফীর বকুল, একাউন্টিং এর রুমি, জামি, দোলন, সাইদ, ভিপি ডিউক ভাই, জিএস গোলাপ ভাই, বাশার ভাই, এনাম ভাই, ফারুক ভাই, পিন্টু ভাই, হান্টু ভাই, লোকমান ভাই, স্বপ্ন ভাই, বুলবুল ভাই, লাবু-মোশারফ ভাই এমন কত শত মানুষ। মনে পড়ে সোশিয়লজির রাউফুন বসুনিয়ার কথা। ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে গুলি খেয়ে মারা যায়।
ওহ হ্যাঁ, আমাদের সময়ে হলে যার যার মেয়ে বন্ধুরা আসতে পারতো। রুমে গিয়ে আড্ডা দিতে পারতো। কোন সমস্যা কিংবা কেউ বিরক্ত করতো না। কেউ কারো দিকে এসব নিয়ে আঙ্গুল তুলত না, মাথা ঘামাতো না। মনে মনে ঈর্ষা হয়ত করতো নিজের বান্ধবী না বলে।
হল লাইফ কোন প্রাচুর্যের না। বিলাসিতার না। তবুও রাজকীয় লাগতো। কেন জানেন ? ১৮/১৯ বছর বয়সে যারা মুক্তিযুদ্ধে গেছে তারা জেনেছে যুদ্ধের স্বাদ। মুক্তির এনে দেয়ার উল্লাস। সেই একই বয়সে বাসার চার দেয়ালের বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে আমার মনে হয়েছে আই যেন ৭১ এ না, ৮০ তে স্বাধীনতা পেয়েছি। হ্যাঁ, হল একটা যুবককে স্বয়ং সম্পূর্ণ মানুষে পরিণত করে। স্ট্রিট স্মার্ট বানায়। হলে থাকা ছেলেরা ফার্মের মুরগী না, ট্রু ফাইটার মানে জীবন যুদ্ধে ফাইট করে বাঁচতে শেখায়। সারভাইব কোর্টর শেখায়। ৮০ থেকে ৮৫ এই ৫টা বছর হলে থেকে আমি যা শিখেছি, তারপর আর কোনদিন কিছু জানার জন্য কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয় নাই। আমার পথচলায় কোন আলাদা জিপিএস লাগে নাই। হল লাইফ মাথার ভিতর জিপিএস, কম্পিউটরের হার্ড ড্রাইভ সবই ষেট করে দিয়েছে।
হ্যাঁ, আমি খুব গর্ব বোধ করি রণাঙ্গন হিসাবে পরিচিত সুর্যসেন হলের একজন সাধারণ বাসিন্দা হতে পেরে। হল ছেড়ে যাওয়ার পর দুনিয়ার কত দেশে গেলাম, কত কি দেখলাম। কত ভাল খাবার খেলাম। কত আধুনিক বাসায় থাকলাম। কিন্তু জানেন, হল জীবনের সুখের সাথে আর কোন কিছুর তুলনা হয় না আমার কাছে।
মুরাদ হাই,
১৪ই জানুয়ারী, ২০২১