কাদা মাটির সোনা মানুষ

ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে নিউইয়র্কে ফিরছিলাম। পাশের সিটের প্যাসেঞ্জার কেমন হবে তাকিয়ে দেখে নেয়া আমার চিরাচরিত অভ্যাস। তাকিয়ে দেখি শান্ত শিষ্ট এক দেশী ভাই চুপ করে বসে আছে। সাধারনতঃ আমি যেচে কারো সাথে আলাপ জমাই না। তার চেয়ে কি মুভি দেখা যায় সার্চ করা শুরু করে দিলাম।

ঢাকার মাটি ছেড়ে প্লেন আকাশে উড়লো।কিছুক্ষন পর এয়ারহোষ্টেস বেভারেজ ট্রলি নিয়ে কাছে এসে জানতে চাইলো আমি কি নিবো। আমি বরফ আর টমেটো জুস নিলাম।
আমার পাশের ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করল উনি কি নিবেন। ভাই মনে হয় এয়ারহোষ্টেসের কথা বুঝতে পারছিল না। তাই কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে আছে।
অগত্যা আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আপনি কি কিছু পান করবেন, তাহলে বলেন। উনি সাহস পেয়ে আমাকে বলে আমি কোকাকোলা খামু। তাই নেয়া হল।

কেন জানিনা আমার খুব ইচ্ছা করলো এই মানুষটার সাথে গল্প করার। কাঁচুমাচুঁ হয়ে বসে থাকা সাদাসিদা মানুষটার দিকে তাকালাম। ত্রিশের মত বয়স হবে। ছোটখাট অবয়বের সাদামাটা চেহারা,মাথায় তেল দিয়ে সিথি করে চুল আচড়ানো। কালোর উপর চোখ ধাঁধানো হলুদ স্ট্রাইপের টেট্রন কাপড়ের শার্ট আর কালো ঢোলা প্যান্ট পরা।

জানতে চাইলাম, ভাই আপনি কোথায় যাচ্ছেন। একটু আগে তাঁকে আমি বেভারেজ নিতে সাহায্য করেছি কথা বলে। এখন আবার কথা বলছি। চেহারায় হাসি ফুটিয়ে আস্তে করে জবাব দিল, সৌদি আরব। আমি ওনাকে আস্বস্ত করার জন্য নিজের নাম বলে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলাম। তারপর আস্তে আস্তে আমার যা কিছু জানতে ইচ্ছা করছিল সব কিছু জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের মানুষ। নাম আবদুল মালেক। লেখাপড়া তেমন করে নাই। বার বছর যাবত সৌদী আরবের আল-সানায় একটা খেজুর প্রসেসিং কোম্পানীতে প্যাকেজিং এর কাজ করে। আমার ধারনাকে ভুল প্রমাণ করে নিজের বয়স জানালো পঁয়ত্রিশ। স্ত্রী সন্তানদের সাথে ছয় মাসের ছুটি কাটিয়ে মন খারাপ করে আবার কাজের যায়গায় ফিরে যাচ্ছে।

জানতে চাইলাম কেমন লাগে দেশের বাইরে কাজ করতে। জানালো কাজ ভাল। বেতনও ভাল পায়। সাত বছর আগে বিয়ে করেছে। ছয় বছর আর সাড়ে তিন বছরের দুই সন্তান আছে। ওদের ফেলে বাইরে থাকতে একটুও ভাল লাগে না। বলেই চেহারাটা কাঁদো কাঁদো করে ফেলল। এত সহজ সরল মানুষ হয় কি করে ! দেখে খুব মায়া লাগল।

কথায় কথায় জানতে পারলাম পাঁচ ভাই এখনো তাদের মা’কে নিয়ে এক বাড়িতেই থাকে। মায়ের জন্য ভালবাসার কোন কমতি নাই কারো। সেও নিশ্চিন্তে তার স্ত্রী ছেলেদের মা ভাইএর জিন্মায় রেখে সৌদীআরবে কাজ করে।

বারো বছরের বেশি সময় ধরে বিদেশে চাকুরি করছে আবদুল মালেক। কিন্তু পরিবার দেশেই রেখে যাচ্ছে। ওদের বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে না কেন জিজ্ঞেস করলে উনি উত্তর দেয় ইচ্ছা করেই তাদের নেয় না। ওরা দেশেই ভাল আছে। মা আছেন তাই ওরা মায়ের কাছে ভাল থাকে। নিজের বাড়ির খোলামেলা পরিবেশ, আত্মীয় স্বজন নিয়ে সবাই আনন্দে থাকে।

বিদেশে চাকুরীস্থল থেকে কর্মচারীদের থাকার জন্য আলাদা করে বাসস্থানের ব্যবস্থা আছে। ওখানে অনেক মানুষের সাথে কিছু বাঙ্গালীও থাকে। আবদুল মালেক চারজন বাংগালীর সাথে এক ঘরে থাকে। ওখানে কারো পরিবার নাই। শুধু পয়সা উপার্জনের জন্যই আবদুল মালেক বিদেশে থাকে। তাছাড়া বিদেশের প্রতি তার কোন ভালবাসা নাই। তার দেশ তার কাছে অনেক প্রিয়, আরামের, সস্তির।

পত্রিকায় পড়েছি, অনলাইনে ভিডিও দেখেছি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে কর্মরত বাংলাদেশের মানুষদের সাথে ঐ দেশের মানুষেরা খুব খারাপ ব্যবহার করে। দেখেছি চাবুক দিয়ে পিটায়। খুব অন্যায় আচরণ করে।

কেন এই অন্যায় আচরণ করে জানতে চাইলাম। আবদুল মালেক তখন সবিস্তারে জানালো আসল ঘটনা।

বলে, আমি তো আজ বারো বছর ধরে সৌদী আরবের এই কোম্পানীতে কাজ করছি। কই আমার সাথে তো মালিক কোন দিন এমন আচরণ করে নাই।

তাহলে আমরা যে সব খবর দেখি সেগুলি কি মিথ্যা, জানতে চাইলাম।

তখন তিনি জানালেন, ভাই চুরি রাহাজানি করলে নিজের দেশেই তো মানুষ তাদের চরম শাস্তি দেয়। নিজের বাবাও অন্যায় করলে তার ছেলেকে পিটুনি দেয়। তাহলে অন্যায় করলে অন্য দেশে শাস্তি পাবে না কেন !

ভাগ্যের অন্বেষনে অন্য দেশে কাজ করতে গিয়ে একজন বাঙ্গালী কি ধরনের অন্যায় করতে পারে যে কেউ তাদের গায়ে হাত তুলতে পারে।

তখন আবদুল মালেক বলে, লজ্জার কথা কি বলব ভাই, আমাদের দেশের মানুষের চুরির অভ্যাস তো নতুন কিছু না। সুযোগ পেলেই হাত সাফাই করে। ধরা পড়লে চরম শাস্তি পায়। তবুও ভাগ্য ভাল যে চাবুক দিয়ে পিটিয়ে ছেড়ে দেয়। হাতের কব্জি কেটে দেয় না দয়া করে। এসব শুনে অবাক হয়ে গেলাম। সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল।

আবদুল মালেকের কাজের জায়গার মালিক খুব ভাল মানুষ। জাতিতে সৌদী। তার ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের প্রতি তিনি খুব দয়াশীল। ভাল খেতে দেয়। ভাল বেতন দেয়। অসুখ বিসুখ হলে ডাক্তার দেখায়। ছুটিতে দেশে যাবার সময় বাড়তি বোনাস দেয়। তারপর জানালো, বিদেশে বাসা ভাড়া দিয়ে থাকতে হলে অনেক পয়সা খরচ হত। তার মালিকের মত অনেকেই শ্রমিকদের থাকার জন্য বিনা খরচে আবাসনের ব্যবস্থা করে দেয়। ওসব আবাসনে খুব আধুনিক ব্যবস্থা নাই। তবে এসব শ্রমিকেরা দেশে নিজের বাড়িতে এর চেয়েও খারাপ অবস্থায় থাকে।

তারপর জানালো, আচ্ছা বলেন ভাই, ওরা যদি এতই খারাপ মানুষ হত তাহলে কি আমি ছয় মাসের ছুটি কাটিয়ে ফিরে গিয়ে আবার আগের চাকুরি ফিরে পেতাম? কিছু মানুষ হয়ত খারাপ আছে। তাই বলে ঢালাও ভাবে সবাইকে খারাপ বললে অন্যায় হবে তার ধারনা।

আবদুল মালেক অনেক বেশি শিক্ষিত নয়। কিন্তু তার বুদ্ধি দেখে আমি হতবাক।

তারমতে পরিবার নিয়ে বিদেশে চলে গেলে দেশের প্রতি, আত্মীয় স্বজনের প্রতি মায়া কমে যায়। দেশে ফেরার ইচ্ছা কমে যায়। বিদেশের আরাম আয়েশ, সুযোগ সুবিধা দেশকে ভুলিয়ে দেয়। তিনি অনেকের ভিতর এমন আচরন দেখেছে। তাই তিনি পরিবার বিদেশে নিতে রাজি নয়। দেশে মা ভাই রা আছেন। তাদের প্রতি তার অনেক ভালবাসা। তাই তিনি দেশেই ফিরে যেতে চান।

জানালেন, বাবার রেখে যাওয়া কিছু জয়গা জমি আছে। নিজের থাকার ঘর বাড়ি আছে।

ভাইদের ভিতর অনেক মিল আছে। বিদেশে অর্জিত টাকা দিয়ে তিনি বাজারে নিজের কেনা জায়গায় সাত/আটটা দোকান ঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়েছে। সেগুলি থেকে ভাল আয় হয়। আর কিছুদিন পর তিনি দেশে থাকা শুরু করবেন স্থায়ী ভাবে। সারাজীবন বিদেশে গোলামী করে জীবন শেষ করে দেয়ার পক্ষে নন তিনি।

তার ইচ্ছা দেশে ফিরে এসে, ছেলেদের লেখাপড়ার প্রতি যত্নবান হবেন। নিজে কোন ব্যবসা শুরু করবেন। তার দেশ তার কাছে সবচেয়ে সুন্দর আর আরামের। বিদেশে সব সুযোগ সুবিধা থাকলেও সেটা নিজের দেশের নয়। তাই সস্তি লাগে না। নিজের দেশে থাকলে নাকি কলিজা অনেক বড় লাগে, বুকে অনেক সাহস আসে। কিন্তু অন্য দেশে সারাক্ষন ভয়ে বুক কাঁপে কখন কোন ঝামেলায় জড়িয়ে যায়। তখন কেউ তো নাই সেখানে তাকে বাঁচানোর। নিজের দেশ, নিজের মাটি সব কিছুর চেয়েও খাটি।

আবদুল মালেকের কথা শুনে আমি খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম।

অল্প শিক্ষিত এই শ্রমিক শ্রেনীর মানুষগুলির ভিতর দেশের প্রতি যত টান আছে, দায়িত্ববোধ আছে – আমার মত ইয়োরোপ আমেরিকায় থাকা শিক্ষিত মানুষগুলির ভিতর তার লেশমাত্র নাই। আমরা বিদেশের তৃতীয় শ্রেনীর নাগরিকত্ব পেয়ে, আরাম আয়েশের জীবন পেয়ে বেমালুম ভুলে গেছি নিজের জন্মস্থানের কথা। দেশের প্রতি দায়িত্ববোধের কথা। নিজেকে মনে করতাম অনেক ভাগ্যবান। কিন্তু আবদুল মালেকের কথা শুনে, দৃষ্টিভঙ্গী দেখে নিজেকে তার তুলনায় অনেক ছোট মনে হল।

বুঝলাম, শুধু স্কুল কলেজ পাশ করলেই মানুষ সব শিখে ফেলে না। আবদুল মালেক আমাকে তার চেয়ে বড় শিক্ষা দিয়ে আমার চোখ খুলে দিল।

মনে মনে তাকে স্যালুট করে নিজের সিট পিছনে রেক্লাইন করে চোখ বুঝলাম।

আবদুল মালেক, আপনিই বাংলাদেশের সুযোগ্য নাগরিক, আমি নই। আমাকে ক্ষমা করবেন।

মুরাদ হাই, নিউইয়র্ক,
২রা মে, ২০১৫