আমার স্যান্ডেল

বাবার সাথে শুক্রবারে বাধ্যতাম্যুলক মসজিদে যাইতে হইত জুমা’র নামাজ পড়ার জন্য। তখন নামাজে মনোযোগ দেয়ার চাইতে বেশি মনোযোগ থাকত স্যান্ডেল ঠিক আছে, নাকি কেউ চুরি করতেছে সেইদিকে।

যুদ্ধের সময় আমরা কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। ঝড় বৃষ্টি হইলে অনেক সময় মুয়াজ্জিন আর আজান দিতে আসতো না মসজিদে। বাবা তখন আমাদের কয় ভাইকে অনিচ্ছা সত্বেও মসজিদে পাঠাইত আজান দিয়ে নামাজ পড়ে আসার জন্য।

আজান ঠিকই দেয়া হইতো যেন বাবা বাড়ি থেকে শুনতে পায়। তারপর মসজিদের দানবাক্সের উপর হামলা চলতো। ব্লেড ঢুকিয়ে দরকার মত পয়সা বের করে মোড়ের দোকানে গিয়ে মুড়ির মোয়া আর চা খেয়ে সময় কাটিয়ে মাথায় টুপি দিয়ে বাড়ি চলে আসতাম।

গ্রামের মসজিদে সব মানুষ কম বেশি পরিচিত ছিল। তাই স্যান্ডেল চুরি নিয়ে মাথা ব্যথা হইতো না।

তারপর কত বছর কেটে গেছে ।

এখন যখন ঢাকায় যাই ইস্তিরী করা পাঞ্জাবি পায়জামা পরে, আতর মেখে জুমার নামাজে যাই বড় ভাই’র সাথে। সুন্দর পায়জামা পাঞ্জাবীর সাথে তো আর স্পঞ্জের সস্তা স্যান্ডেল পরা যায় না। ভাবেরও একটা ব্যাপার আছে। তাই ভালো আর দামী স্যান্ডেল পরি।

ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকার মসজিদ তো আর গ্রামের টিনের চালের আর মাটিতে চাটাই বিছানো মসজিদ না। শহরে  মসজিদ তো না যেন দুনিয়ার বেহেস্ত। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, অসংখ্য ফ্যান ঘুরছে মাথার অপর, পা ডেবে যায় নরম কার্পেট বিছানো জায়নামাজের আদলে। দামি সাউন্ড সিস্টেম লাগানো। সিংহাসনে দাঁড়ানো ইমাম সাহেবের সেকি আলখেল্লা জাতীয় বাহারি পোশাক, দেখলে মনে হয় যেন সম্রাট শাহজাহান কথা বলতেছে। শুধু কোমরে তলোয়ার ঝুলানো নাই।

দামী এলাকার দামী মানুষদের ইবাদতের জন্য কত আরামদায়ক আয়োজন।

অনেক চেষ্টা করেও মসজিদে গিয়ে আমি ইমাম সাহেববের ওয়াজে  মনোনিবেশ করতে পারি না কখনই। স্বভাবসুলভভাবে আমি শুধু চারিদিকে তাকিয়ে দেখি কে কি করে।

জানালার পাশে দেখি চেয়ারে বসে নামাজ পড়ে অনেকে।

অবাক লাগে। আল্লাহর ইবাদত করার জন্য মসজিদে চেয়ার। এর আগে জীবনে কোন দিন এটা দেখি নাই। বলতে পারেন, শারিরিক অক্ষমতা থাকলে কি আর করা যাবে ! হয়ত এরপরের বার দেখব, মসজিদে কেউ কেউ লেদারের সোফায় বসে নামাজ পড়তেছে।

যাইহোক, মুল কথায় ফিরে আসি।

অভ্যাসবশতঃ এখনো মসজিদে গেলে আমি স্যান্ডাল ঠিক আছে কিনা নামাজে দাঁড়ায়েও ওই চিন্তায় থাকি। তার সাথে যোগ হইছে  বাড়তি চিন্তা – পাঞ্জাবির এক পকেটে মোবাইল ফোন, আরেক পকেটে ওয়ালেট।

চেষ্টা করি আমরা পরিবারের সবাই নিজেরা পাশাপাশি থাকতে নামাজ পড়ার সময়। কিন্তু কাতার সোজা করার সময় সামনে পিছনের খালি জায়গায় আমি যেতে না চাইলেও সামনে পিছনের আকুল আবেদনে ( না গেলে যেন নামাজই হবে না) সাড়া দিয়ে দলছুট হয়ে এদিক ওদিকে ছড়িয়ে পড়ি। তখন আড়চোখে চেয়ে দেখি আমার দুই পাশের মমিন ভাইদের গতিবিধি কেমন। প্রায়শঃই সুবিধাজনক চেহারা আর ভালো পোশাকের সঙ্গী পড়েনা আমার পাশে।

ব্যস, আমার তখন নামাজ পড়ার বারোটা বেজে গেলো আর কি!

এম্নিতেই স্যান্ডালের চিন্তায় অস্থির, তার সাথে যোগ হইছে মোবাইল আর মানিব্যাগ।

বড়ভাই বলে এসব বাসায় রেখে যা। আরে, মোবাইল ছাড়া তো নিজেরে মনে হয় যেন পুরা এতিম ( যেন জন্ম থেকেই মোবাইল ছিল আর কি)। আর মানিব্যাগ না থাকলে দান খয়রাত করবো কেম্নে?

ভাইকে জিজ্ঞেশ করি – এত অভিজাত এলাকার মসজিদে পকেট মার আসবে কোত্থেকে?

ভাই বলে – এসব মসজিদে ওরা আরো বেশি আসে।  কারন এখানে আয় রোজগার ভাল হয়।

তাকিয়ে দেখি, মুসল্লি তো নয় যেন সব বড় বড় রুই কাতলাদের মিলন মেলা। সরকারি দল, বিরোধি দলের নেতারা, বড় বড় আমলা, ব্যবসায়ি, নাটক সিনেমার নায়ক, পরিচালক – কি নাই ওখানে?

কে কার পাশে বসবে সেটার ও নিরব প্রতিযোগিতা চলে।

এত কিছু খেয়াল করতে হইলে আমি ক্যামনে আল্লার ধ্যানে মগ্ন হমু, কন তো?