#প্রেম রোগ_৬

প্রথম দেখায় আড্ডাবাজ আর ভবঘুরে ছেলেটির নাজনিনকে ভাল লেগে গেলো, যা কিনা তার চারিত্রিক বৈশিষ্টের বিপরিত।

বাংলা ডিপার্টমেন্টের মেয়ে নাজনিন আর দশটা মেয়ের চেয়ে ভিন্ন। ছিপছিপে লম্বা, সব সময় চুড়িদার সালোয়ার কামিজ আর পাতলা চটি স্যান্ডাল পায়ে, কাঁদে চটের ঝোলা ব্যাগ, সামান্য প্রসাধন আর লম্বা বিনুনি সব মিলিয়ে অদ্ভুত সুন্দর যা দেখলে মন ভাল হয়ে যায় এমন কিছু।

চরম আড্ডাবাজ, নিজের সম্পর্কে উদাসিন যুবক তার দৈনন্দিন জীবনের রুটিন ভুলে যখন তখন বাংলা বিভাগের বারান্দায় ঘোরাঘুরি শুরু করে, অপেক্ষায় থাকে কখন নাজনিন পাশ কাটিয়ে যাবে। ছেলেটির তখন আর কিছু ভাল লাগেনা।  শুধু নাজনিনকে দেখতে ইচ্ছা করে। দেখলে বুকের ভিতর ধুকপুক আওয়াজ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু সাহস করে আর বলা হয়ে উঠেনা নাজনিনকে নিজের পছন্দের কথা।

বন্ধুরা ছেলেটির এই পরিবর্তন খেয়াল করলো। জিজ্ঞেস করে কোন উত্তর পেলো না। কিন্তু প্রায়ই ছেলেটি কাউকে কিছু না জানিয়ে দলছুট হয়ে যায় দেখে সবাই অবাক হয়ে ওকে ফলো করে আবিস্কার করল বাংলা ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায়। হলে ফিরে গিয়ে বন্ধুরা সবাই জানতে চাইলো ঘটনা কি, কোন মেয়ের জন্য তার এই পরিবর্তন ? বন্ধুদের কাছে তখন আর কিছুই লুকালো না,  বলে দিলো নিজের পছন্দের কথা।

বন্ধুরা বলে, এতে এত চিন্তার কি আছে, বলে ফেল মেয়েটাকে ডেকে তোর পছন্দের কথা, যা হয় হবে। বলা খুব সহজ কিন্তু কাজটা করা ছেলেটার জন্য মোটেও সম্ভব নয় কারন সে যতই আড্ডাবাজ আর মিছিলের প্রথমে থেকে স্লোগান দেয়া, চিকা মারায় ওস্তাদ, কাওকে ঝাড়ি মারতেও ওস্তাদ, কিন্তু মেয়েদের সাথে কথা বলার বেলায় চরম লাজুক। তার উপর সেই কথা বলার ব্যাপারটা যদি হয় নিজের অনেক পছন্দে্র কাউকে তাহলে তো আরো বিপদ। ভাবে যদি ঠিকমত কথা বলতে না পারে, যদি কথা উলটা পালটা হয়ে যায়, যদি মেয়েটা রেগে যায় তাহলে তো সব আশা ফুরিয়ে যাবে।

নিজের পক্ষে মেয়েটাকে নিজের পছন্দের কথা বলা সম্ভব না।  সেই সাহস নাই। বন্ধুদের জরুরি মিটিং ডাকা হল। সিদ্ধান্ত হল পরদিন মুকুল গিয়ে মেয়েটাকে জানাবে এই ব্যাপারে।সারা রাত ঘুম এলোনা ছেলেটার টেনশনে।

পরদিন সকালে রেডি হয়ে গেলো। লম্বা মুখ ভর্তি লম্বা দাঁড়ি মোচ, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুলওয়ালা ছেলেটি ( বন্ধুরা ঠাট্টা করে ডাকতো নির্মলেন্দু গুন ) তার চিরাচরিত লম্বা খদ্দেরের পাঞ্জাবি আর জিন্স পড়ে। হল ক্যাফেটারিয়াতে পরোটা আর ডিম দিয়ে নাস্তা খেয়ে ক্যাম্পাসে গেল সবাই দল বেঁধে। বাংলা ডিপার্টমেন্টের সেমিনারের সামনের হাফ দেয়ালের উপর লাইন দিয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো সবাই ছেলেটাকে মাঝখানে বসিয়ে।

কিছুক্ষন পরেই ক্লাস শেষ করে বের হয়ে এলো নাজনিন আর তার প্রিয় বান্ধবি সম্পা। মুকুল উঠে এগিয়ে গেলো ওদের দিকে। শান্ত স্বভাবের কবিতা প্রেমিক মুকুল ওদের সামনে গিয়ে কথা বলতে চাইলো। বেশ কদিন ধরে ছেলেটিকে নিজের সেমিনার রুমের সামনে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে নাজনিন। আজ তাই ওই ছেলেকে দল বেঁধে এখানে দেখে সে যা বোঝার বুঝে নিলো।

মুকুল নিজের প্রিয় বন্ধুর পছন্দের কথা সরাসরি নাজনিনকে বললে মেয়েটা যদি না বলে দেয় তাই এইভাবে এপ্রোচ করলো, আপনার সাথে কি একটু কথা বলতে পারি?

মেয়েটা উত্তর দেয় – জ্বী বলুন।

মুকুল বলে – আপনাকে আমাদের খুব পছন্দ।  আপনি কি আমাদের বন্ধু হবেন?

নাজনিন ভ্রু কুঁচকে উলটা জিজ্ঞেস করে – মানে কি?

তখন মুকুল আমাদের সবাইকে দেখিয়ে বোকার মত অতি উৎসাহে বলল – এই যে আমাদের বন্ধুদের গ্রুপ। আমাদের কোন মেয়ে বন্ধু নাই। আপনি হবেন আমাদের গ্রুপের একমাত্র মেয়ে বন্ধু। আর তাহলে শুধু এই ক্যাম্পাসে নয়, সারা ঢাকা শহরে কোন ছেলে আপনার দিকে চোখ তুলে তাকাবে না। চিন্তা করে দেখেন কি মজা হবে।

নাজনিন এই কথা শুনে কিছুক্ষন কথা বলতে পারলো না। পরে বলল – এতগুলি ছেলের একমাত্র মেয়ে বন্ধু হব আমি?  সরি, দরকার নাই।

যা ভেবেছিলাম তাই হল। নাকচ হয়ে গেল সম্ভাবনা। বিরস বদনে ফিরে গেলো সবাই। হলে ফিরে গিয়ে গাঁজার কল্কিতে টান দিয়ে হেঁড়ে গলায় গান গাইতে শুরু করল লেবু – পাপড়ি কেনো বুঝেনা, তাই ঘুম আসে না।

ডালিম এরমধ্যে নাজনিনের বান্ধবি সম্পা’র সাথে খাতির করে ওকে দিয়ে পটানোর চেষ্টা করলো। রিক্সার পিছন পিছন ফলো করে নাজনিন দের সেগুন বাগিচার বাসাও চিনে এলো অতি উৎসাহী ডালিম।

গিট্টু শাহিন ক্যাম্পাসের টোকাই বাহিনি আর জুনিয়র  গ্রুপকে ডেকে নাজনিনকে দেখিয়ে হুলিয়া জারি করে দিলো যে – এই মেয়েকে যদি কখনো কোন ছেলের সাথে ঘুরতে দেখা যায় তাহলে যেন সাথে সাথে তাকে খবর দেয়া হয়।

কয়দিন পরের ঘটনা। ছেলেটা তার বন্ধুদের নিয়ে হাকিম চত্তরে বসে চা গিলছিলো।  ইকনমিক্সের পিঙ্কু এসে খবর দিলো নাজনিন একটা ছেলের সাথে রেজিস্ট্রার বিল্ডিং এ ঘোরাঘুরি করতেছে। সবাইকে বসিয়ে রেখে লক্ষিপুরের স্বপনকে নিয়ে গিট্টু ওদিকে রওনা দিলো।

ওখানে গিয়ে নাজনিনের সাথের ছেলেটিকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো – আপনি কে, এই মেয়ের সাথে কি করেন?

ছেলেটি উত্তর দেয় – তাতে আপনার কি দরকার?

গিট্টু তার কোমর থেকে .৩২ পিস্তল বের করে দেখিয়ে বলে – এইবার নিশ্চয়ই বলবেন আপনার কি কাজ এই মেয়ের সাথে।

ছেলেটি পিস্তল দেখে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। বলে – আমি বাংলা ডিপার্টমেন্টের অনার্স ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। নাজনিন আমার কাছ থেকে নোট নেয়। আর কোন রিলেশন নাই।

গিট্টু তখন পকেট থেকে ক্ষুর বের করে ওটা খুলে দেখিয়ে বলে – অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাইসেন। মাস্টার্সে ও নিশ্চয় পাওয়ার আশা রাখেন, তাইনা?

ছেলেটি উত্তর দেয় – জ্বি।

গিট্টু বলে – এই ক্ষুর দিয়ে যদি আপনার আঙ্গুলগুলি আমি কেটে নেই, তাহলে আপনি কেমন করে লিখবেন আর ফার্স্ট ক্লাস পাইবেন মিয়া ভাই?

এই কথা শুনে ছেলেটি আর কোন দিন নাজনিনের সাথে ঘুরবে না কথা দিয়ে দৌঁড়ে পালালো।

এরপর অনেকদিন আর নাজনিনকে কোন ছেলের সাথে দেখা যায় নাই। নাজনিনের বান্ধবী সম্পা’র সাথে দেখা হলেই ডালিম জিজ্ঞেস করে কোন খবর আছে কিনা ।  সম্পা উত্তর দেয়, না ভাই সে রাজি না।

একদিন ছেলেটা তার বন্ধুদের নিয়ে টি,এস,সি অডিটোরিয়ামের সামনে গোল হয়ে বসে ম্যান্ড্রেক্, চা আর সিগারেটের আড্ডা দিচ্ছিলো। হঠাৎ একজন বলে উঠলো –  ওই দেখ ক্যান্টিনের কোনায় সিড়িতে নাজনিন বসে আছে এক ছেলের সাথে। এই কথা শুনে সবাই ঘুরে তাকালো। ছেলেটা কে চেনার চেষ্টা করতে দেখা গেলো খুব পরিচিত এক বড় ভাই।  মাহমুদ ভাই।  সুর্যসেন হলে ওদের ব্লকে থাকে। নারায়নগঞ্জের ছেলে।  মাস্টার্স শেষ হয়ে গেছে কিন্তু এখনো হলে থেকে চাকুরির ইন্টারভিউ দিচ্ছে। বেপরোয়া টাইপ কিন্তু ওদের সাথে খুব ভাল সম্পর্ক আর খুব স্নেহ করেন সবাইকে।

ওনাকে দেখে সবার কথা বন্ধ হয়ে গেলো। কি করা যায় ভাবতে লাগলো।

কিছুক্ষণ পর মাহমুদ ভাই আর নাজনিন উঠে হেঁটে এদিকেই আসতে লাগলো। সবাই মাথা নিচু করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।

মাহমুদ ভাই কাছে এসেই বলে উঠলো – কি খবর পোলাপাইন, আড্ডা বসাইছো  নাকি? এই বলে বেন্সন সিগারেটের ভরা প্যাকেট ওদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল – নাও সিগারেট খাও। বিসিএস এ টিকে গেছি। পরে বিরিয়ানি খাওয়াবো।

নাজনিন না হয়ে অন্য কোন মেয়ে হলে সবাই মাহমুদ ভাইকে ঘিরে ধরে অনেক প্রশ্ন করতো আর মিস্টি খাবার জন্য টাকা চাইতো। কিন্তু আজ কেউ কিছুই বলল না। সবাই বুঝে গেছে কেস কি হইছে । হয়ত নাজনিন ওদের দেখিয়ে বলছে যে এরা  ডিস্টার্ব করে আর সেটা শুনে মাহমুদ ভাই উত্তর দিছে – আরে এগুলি আমার হলের পোলাপাইন। আমার সাথে দেখলে আর কোন সমস্যা হবেনা।

সবাই চুপ করে থাকল কিন্তু গিট্টু মাথা নীচু করে রেখেই গম্ভীর ভাবে বলে উঠল – ভাই, আমাগো দোস্তের ভালবাসাটা কাইড়া  লইলেন, কামডা কি বালো অইলো?

মাহমুদ ভাই কিছু না শোনার ভান করে হাত নেড়ে চলে গেলো নাজনিনের হাত ধরে। ছেলেটা ওইদিনের বরাদ্দ ডিঙ্গিয়ে আরো দুইটা ম্যান্ড্রেক্স গিলে ফেল্লো।  কেউ বাধা দিলো না।

কিছুক্ষন পর ওখানেই ঘুমিয়ে পড়লো। তারপরের কয়দিন ছেলেটা আর হল ছেড়ে বের হল না। ম্যান্ড্রেক্স খেয়ে অচেতন হয়ে ঘুমিয়ে থাকলো।  কয়টা ইন কোর্স পরিক্ষাও মিস করল।

কিছুদিন পর হলের দারোয়ান খাম বন্ধ কার্ড দিয়ে গেল। উপরে সবার নাম লিখা। মাহমুদ ভাই আর নাজনিনের বিয়ের কার্ড।

কেউ যায় নাই বিয়েতে। শুনেছি মাহমুদ ভাই বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারে টিকে এ এস পি হয়েছেন।দেখতে হ্যান্ডসাম, ভাল চাকুরি, পাত্র হিসাবে যে কোন মেয়ের কাছেই গ্রহনযোগ্য।

মাস ছয়েক পরের ঘটনা। ওইদিন ছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডে। আর্টস ফ্যাকাল্টি আর রেজিস্টার বিল্ডিঙ্ এর মাঝখানের সবুজ  লনে ( মল বলা হত ) বিশাল মঞ্চ বানিয়ে বর্তমান আর প্রাক্তন সকল ছাত্রছাত্রীদের সমাগমে ভরপুর। সেই ছেলেটিও তার বন্ধুদের নিয়ে আয়োজন স্থলের পাশে জড়ো  হয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো।

হঠাৎ ডালিম বলে – দেখ দেখ পুলিশের জিপ থেকে কে নামছে !

সবাই তাকিয়ে দেখে মাহমুদ ভাই। পাশে নাজনিন। প্রেগন্যান্ট।

ওদের দেখে মাহমুদ ভাই এগিয়ে এসে হ্যান্ডসেক করে পরিচয় করিয়ে দিলো – এই হল তোমাদের ভাবী। ওকে তো চেনোই।

সবাই হাত নাড়লো, ছেলেটা ছাড়া। কিছুক্ষন পর মাহমুদ ভাই নাজনিনকে ওখানে রেখে অন্যদিকে গেলো কারো সাথে কথা বলতে।

নাজনিন ছেলেটার দিকে এগিয়ে গিয়ে ফিস ফিস করে বলে – কেমন আছেন আপনি?

ছেলেটি চুপ করে থাকে। তখন নাজনিন বলে – শুনেন একটা কথা বলি। নিজের কথা নিজেকেই বলতে হয়। অন্যদের দিয়ে বলাতে হয় না।  আর সব কিছু কিন্তু  গায়ের জোরে হয়না। আমি সব বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু আপনি আমাকে বলেন নাই, তাই আমার কিছু করার ছিল না। আই অ্যাম সরি।

মুরাদ হাই, নিউইয়র্ক
১৩ই জুলাই, ২০১৩