#প্রেমরোগ_৫

এস,এস,সি পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর থেকে নিজেকে বাসার বড় ভাইদের সমতুল্য ভাবতে শুরু করে দিলাম। সন্ধ্যা হলে পড়তে বসতে হয় না। উলটা বন্ধুদের সাথে রাত করে বাইরে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরি। চোখ রাংগানী থাকলেও অনেক বকা ঝকা খাই না। পরীক্ষার রেজাল্ট বের না হওয়া পর্যন্ত কোন পড়ার ব্যাপার তো নাই।

তবে দস্যু বনহুর থেকে নিজে নিজে প্রমোশন নিয়ে এডাল্ট স্পাই থ্রিলার মাসুদ রানা পড়ছি তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে। মাসুদ রানা যে শুধু ঢিসুম ঢিসুম করে সব শত্রুকে কুপোকাত করে ফেলছে, তা’ নয় – প্রতি এপিসোডের দেশী বিদেশী বান্ধবীদের কেমন করে ধরাশায়ী করছে, হাল্কা সুড়সুড়ি দেয়া সেই বর্ননাও আমার কাছে কম আকর্ষনীয় ছিল না। এখানে একটা কথা না বললেই নয়। সেটা হল, কৈশোরের দুরন্ত দিনগুলিতে যারা মাসুদ রানা সিরিজ পড়ে নাই, তারা আসোলেই জীবনের শিক্ষার অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছে । কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেবের সুদক্ষ লেখনী শুধু বিদেশী গল্পের অনুবাদ ছিল না। বরঙ প্রয়োজনীয় অনেক কিছু শেখার ছিল।

বন্ধু বান্ধব মেলা তখন। পাড়ার ভিতর মিন্টু, কাজল, রুমি ওরা থাকলেও আমার আকর্ষন ছিল মতিঝিল কলোনীতে গিয়ে স্কুলের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া। অনেকগুলি বন্ধু এক কলোনীতে থাকত। তাই ওখানে গেলে একসাথে অনেককে পাওয়া যেত। এটাই ছিল মুল আকর্ষন।
নাই কাজ তো খই ভাজ।

সকাল বিকাল দুইবেলা আড্ডা চলে কলোনীতে। দিনের বেলায় বসি কম্যুনিটি সেন্টারে। সন্ধেবেলায় খেলার মাঠে। ক্যাপস্টেন সিগারেট টানি। চা খাই। তাস খেলি। আর হাহা হিহি চলে সারাক্ষন গল্পের ফাঁকে ফাঁকে। অভিসার হলে নতুন ইংরেজী ছবি এলে দল বেঁধে ফ্রন্ট স্টলের টিকেট কেটে সেই ছবি দেখে আসি।
সেই বয়সে পোলাপানের গল্পের বিষয় তো একটাই – ‘বালিকা’। ষোল সতের বছরের ছেলেদের মনে রঙ লাগবে এটাই তো স্বাভাবিক। বন্ধুরা সবাই রোমিও’র মত ভাব নিয়ে কলোনীর মেয়েদের দিকে তাকায়। কারো কারো এরই ভিতর জোড়া তৈরী হয়ে গেছে। কেউবা তখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আড্ডার ভিতর থেকে কেউ একজন বিনা নোটিশে হটাৎ গায়েব হয়ে যায় কিছুক্ষনের জন্য। আবার ফিরেও আসে। এসে কখনো গল্পের অংশ বিশেষ সবাইকে শোনায়। আবার কেউ কেউ মুখে কুলুপ এঁটে রাখে। তবুও কিছু গোপন থাকত না। সবার সব গোমর ফাঁক হয়ে যেতো।
কলোনীর বন্ধুগুলি ছিল শফিক, নাসিমুল, ইলিয়াস, সাকী, শান্তি, ফটিক, পুতুল, কালাম, সামসু মামু, কামাল। বাইরে থেকে প্রতিদিন এসে যোগ দিতাম আমি আর খোকন। সবাই প্রেমিক পুরুষ। আমি আর খোকন সে সব প্রেমের গল্প শুনি।
‘সারেং বউ’ ছবিটা সে সময় মুক্তি পেয়েছিল। কবরী, ফারুকের সুপার হিট ছবি।আমাদেরও দেখা হয়ে গেছে। শফিক তখন নুরী নামের একটা মেয়েকে খুব পছন্দ করে। কিন্তু বলতে পারে না। প্ল্যাটোনিক প্রেম। সেই জুটির নাম হয়ে গেল সারেং আর নবিতুন। শুধু আসা যাওয়া আর চোরাই চোখে দেখা দেখি।

ইলিয়াস পছন্দ করে নাসিমুলদের বিল্ডিং এর সালমা নামের এক মেয়েকে। ওদের ভিতর খাতির হয়েছে। হলেই কি ! তখন কেউ কারো সাথে সরাসরি দেখা করার সাহস দেখাতো না। তাই লুকোছাপার ব্যাপার ছিল। ওরা দেখা করতো অনেক ভোরবেলায়, যখন বড়রা ফজরের নামাজ পড়ে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়ত। সে সময় ওরা বিল্ডিং এর সিড়িঘরে এসে দেখা করত।

আহারে, কত ভয়, কত কষ্ট। তবুও প্রেম যেন করতেই হবে। নইলে যে জীবন অসম্পুর্ন রয়ে যায়। ওদের একদিনের দেখা করার গল্প শুনে আমরা হেসে গড়াগড়ি খাই সবাই। প্রেম হলে তো একে অপরকে চুমু খেতে হয় এমন ধারনা ছিল। চুমু মানে গালে চুমু খাওয়া। কেউ যে কারো ঠোটে চুমু খায় এটা আমি ভাবি নাই। ইলিয়াস ওর বান্ধবীর সাথে দেখা করে এসে বিকেলের আড্ডায় সেই গল্প বলছিল সবাইকে।

সবার খুব উৎসুক প্রশ্ন – কি করলি, বল না !

সে খুব লজ্জা নিয়ে বলে – চুমু খেয়েছি।

– বলিস কি ! ডিটেইল বল। সব কিছু। কিছু বাদ দিবি না কিন্তু।

বলে – ধুর, মজা নাই। শুধু টূথপেষ্টের গন্ধ লাগে।

চুমু খেলে টুথপেষ্টের গন্ধ কেন লাগবে, আমার মাথায় ঢুকছিল না। পেষ্ট কি গালে মেখে রাখে নাকি কেউ ? বোকার মত জানতে চাইলাম আমি। আমার কথায় সবাই হেসে দিল যেন আমার মত বেকুব ওরা আগে কখনো দেখে নাই।

একজন বলে – কেন, তুই ইংলিশ ছবিতে চুমু খাওয়া দেখিস নাই ? ওরা কেমন করে চুমু খায় মনে করে দেখ।
এতক্ষনে আমি টুথপেষ্টের গন্ধের রহস্য বুঝলাম। আবার বোকার মত ভাবতে লাগলাম – বিদেশীরা অমন করে চুমু খায় জানি। কিন্তু আমাদের দেশে তো এসব কেউ করেনা।

কামাল ছিল পুরা রোমিও। তার প্রেম পর্ব নীরব ছিল না। বরং সরবে প্রেম করত। আসতে যেতে জিব দিয়ে কেমন করে যেন একটা আওয়াজ করত। সেই আওয়াজ শুনে তার প্রেমিকা কোয়েল বারান্দায় চলে আসত। তখন কামালের গলা দিয়ে সুরের মুর্চনা বের হত। বেসুরো গলায় তার গান শুনে সিড়িঘরে বসা আমরা সবাই হেসে গড়াগড়ি খেতাম। কামাল তার বান্ধবীর জন্মদিনে, ঈদের দিনে একই রকমের শুভেচ্ছা কার্ড তিনটা করে পাঠাতো।

কারন জানতে চাইলে বলত – তোরা তো প্রেম করতে পারিস না। তাই এসব বুঝবি না। ভালবাসার বন্ধন শক্ত করতে হলে বেশী বেশী দিতে হয়।
নিজের তো কোন অভিজ্ঞতা নাই, তাই তার কথা বেদ বাক্য হিসেবে মেনে নিলাম।

নাসিমুল সারাক্ষন শর্টওয়েভ রেডিও কানের সাথে লাগিয়ে ক্রিকেট খেলা শুনে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান কারো খেলাই সে বাদ দেয় না। বাংলাদেশ তখনো দেশের বাইরে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে নাই। খেলা ছাড়া সে আরেকটা বিষয়ে খুব বেশী মজা পেত। সেটা হল স্ট্যাম্প কালেকশন। এছাড়া পৃথিবীর আর কোন বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই।

আর খোকন ! সে এসব প্রেম পিরিতির ধার ধারে না। প্রয়োজনে অন্যের প্রেমের চিঠি লিখে দেয়। কিন্তু নিজে কিছু করবে না।

বাকী থাকি আমি। আমার তো একটু সখ আহলাদ ছিলই। থাকলেই কি আর হয় নাকি।

চাচা মানে শফিকের মাথা থেকে মনে হয় কুট বুদ্ধিটা উদয় হয়েছিল। আমাদের আড্ডার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো মেয়েটা।ফর্সা, গোলগাল মানুষ। শফিকদের বিল্ডিঙে থাকে। ইলিয়াসের আবার সম্পর্কে আত্মীয় হয় সে। তার নাম ফিরোজা।

শফিক বলে উঠে ফিরোজার সাথে মুরাদের খাতির করায়ে দিলে কেমন হয় ?

ব্যস, সবার মাথা কাজ করা শুরু করে দিল।

ইলিয়াস আগেই জানিয়ে দিলো সেই মেয়ে তার আত্মীয়। তাই সে কোনো হেল্প করতে পারবে না। কামাল আসতে যেতে ওকে নাম ধরে ডাক দেয়। সে কোন উত্তর দেয় না। অকালপক্ক বেকুবদের কান্ড আর কি। নাসিমুল হৈ চৈ করে না। কথা বলার চেয়ে শোনে বেশী। সে বুদ্ধি বাতলে দিলো।

বলে – ফিরোজাকে বেয়ারিং চিঠি পাঠা।

ডাকটিকেট না লাগিয়ে “বেয়ারিং” লিখে চিঠি পাঠালে প্রাপকের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে শুধু তার হাতেই চিঠি দিবে ডাকপিয়ন। চিঠি নয়, একটা ঈদকার্ড পাঠানো হলো ফিরোজার নাম লিখে।পরিচিত পিয়ন মতিন ভাই ফিরোজার হাতে খামটা দিয়ে এলো। এরপর অপেক্ষার পালা।

বেশী অপেক্ষা করতে হয় নাই। খুব তাড়াতাড়ি উত্তর এলো। তবে কোনো চিঠি নয়। ফিরোজার বড়ো বোন স্বয়ং এসে হাজির হলো আমাদের আড্ডাস্থলে। আমি কলোনীর বাইরের ছেলে।আমাকে চেনে না। চেনে কামাল, শফিক ওদেরকে। বকা ঝকা করে শাসিয়ে গেলো। শুনে আমি ভয়ে চুপসে গেলা।

মনে মনে ভাবলাম, থাক বাবা, এসবের দরকার নাই।

আমি চাইলেও সেটা তখন আর শেষ হওয়ার নয়। দুষ্ট বালকদের ইজ্জতে খোঁচা লেগেছে। ওরা এভাবে ধমক খেয়ে পিছু হটতে রাজী না।

ওরা যেনো মনে মনে বলছিলো – দাঁড়াও, আমাদেরকে থ্রেট করার মজা দেখাচ্ছি।
আমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেসও করছে না আর।

কলোনীর সবাই আমার স্কুলের সহপাঠী ছিল না। কেউ সমবয়সী, কেউ ছোট, কেউ একটু বড় বয়সে – তবুও সবাই ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম।

কালাম নামের একজন ছিল যার বয়স আমাদের চাইতে বেশী। সে ক্লাবের ভিতর বড়দের সাথে আড্ডা দেয়। তাস খেলে। আবার আমাদের সাথেও খুব খাতির আছে।
কালাম শুধু দুরন্ত নয়, মারদাঙ্গা টাইপ ছেলে। বনিবনা না হলে এপাড়া ওপাড়ার ছেলেদের ধরে মেরে হাড় মাংস এক করে দেয়। সেও কঠিন প্রেমিক মানুষ। নিজে টাঙ্গাইলের ছেলে। সেখানেই এক মেয়ের সাথে প্রেম হয়ে যায়। কঠিন প্রেম। মেয়ের বাবা জানতে পেরে মেয়েকে ঘরে আটকে রাখে। কালাম তাকে নিয়ে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে। কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে সোজা নিজের বাসায় এনে তোলে বউকে।

সেই কালামের কানে গেল ফিরোজার বোনের শাসানির কথা। সে ছুটে এলো। সে এসে সব শুনে ঘোষনা করলো ফিরোজার সাথে আমাকে নিয়ে বিয়েই দিয়ে দিবে।

হা হা। কি বলে এসব ! মাথা খারাপ নাকি !

শুধু তা’ই নয়, কালাম নিজে বিবাহিত, আমাকেও বিয়ে করায়ে দিবে, সেজন্য আমাকে ‘ভায়রা’ বলে ডাকা শুরু করে দিয়েছে।

বিয়ে করার কথা শুনে আমার কিন্তু খুশী লাগে নাই। ভয়ের চোটে কাঁপুনি ব্যারাম হয়ে যাওয়ার দশা। কালামের সামনে অবশ্য কিছু বলি নাই। কালাম প্ল্যান করে ফেলেছে, কয়েকদিনের ভিতর তার দল বল নিয়ে ফিরোজাকে সিদ্ধেশ্বরী স্কুল থেকে তুলে নিয়ে যাবে। তারপর আমার কাজি অফিসে নিয়ে গিয়ে আমার সাথে বিয়ে পড়িয়ে দিবে।

ওহ মাই গড ! এসব কি বলে !!

এমন ঘটনা ঘটে গেলে তো আমাকে ফুটপাথে দিন কাটাতে হবে। কারন আল্লাহ মাফ করুক, সত্যি সত্যি যদি কালাম এমন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে, আর আমাকে যদি ফিরোজার হাত ধরে আমাদের বাসায় যেতে হয়, তাহলে নির্ঘাত ঘাড় ধরে আমাকে বাসা থেকে বের করে দিবে।

ইয়া আল্লাহ, আমাকে বাঁচাও।

কে কি দায়িত্ব পালন করবে, কালাম ঠিক করছে সব। তারিখ ঠিক করলো। আমাকে বলে দিল, যেন আমি সময় মত স্কুলের গেটে হাজির থাকি। কিন্তু আমি যাই নাই। শুধু তা’ই নয়। পরের কয়েকদিন কলোনীতেই যাই নাই ভয়ে।

তারপর একদিন কলোনীতে গেলাম আড্ডায়। আমাকে দেখে সবাই হো হো করে হেসে দিলো। কারন আমাকে বোকা বানাতে পেরেছে। আমি ওদের ফাঁদে পা দিয়ে ভয়ে পালিয়ে ছিলাম। ওরা মোটেও কেউ ফিরোজাকে ইলোপ করত না বাস্তবে।

কালাম এসে আমাকে দেখে বলে – আরে আমার ভিতুর ডিম ভায়রা ভাই, কই আছিলা এই কয়দিন ? বেশী ডরায়া গেসিলা নাকি ! আমিতো তোমারে পরীক্ষা কইরা দেখতাসিলাম, কইলজায় জোর আছে নাকি। বলে হা হা করে হেসে দিল।

আমি শুধু বললাম, না ভাই, যদি এমন করে প্রেম করতে হয়, তাইলে আমি নাই। আমার আর প্রেম করার সখ নাই।
ব্যস, শেষ হয়ে গেল ফিরোজা পর্ব। অথচ সেই মেয়ে জানতেও পারলো না তাকে নিয়ে এত কিছু হয়ে গেছে। শুধু ভেবেছে এই আড্ডার কোন ইচড়ে পাকা ছেলে তাকে সেই বেয়ারিং চিঠিটা পাঠিয়েছিল।

২রা মার্চ, ২০১৭
আগের পর্বগুলি –
#প্রেমরোগ_১ , #প্রেমরোগ_২ , #প্রেমরোগ_৩ , #প্রেমরোগ_৪