#প্রেমরোগ_৪

যুদ্ধ শেষ। দেশ স্বাধীন। বেঁচে থাকা মানুষেরা সবাই যে যার ঘরে ফিরে এসেছে। আমি গ্রামেই রয়ে গেলাম আরো দুই বছর। তারপর যখন বড়দের হুঁশ হল, এক সময় গ্রাম থেকে ঢাকায় এনে আমাকে মতিঝিল গভঃ স্কুলে ক্লাস এইটে ভর্তি করিয়ে দিল।

ছেলেদের স্কুল। পাশে মেয়েদের স্কুলও আছে।কিন্তু আলাদা।যদিও অডিটোরিয়াম একটাই। সেই অডিটোরিয়ামের দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে ছেলেরা মেয়েদেরকে দেখত। চিরকুট গলিয়ে দিত। আমি এসবে পাকা ছিলাম না। তাছাড়া ভিতুর ডিম ছিলাম। কিন্তু মনের ভিতর খাতির করার খায়েস ছিল ঠিকই। খায়েস থাকলেও উপায় তো ছিল না। ক্লাসে তো সব ছেলে।

তখন খিলগাঁও বাগিচায় থাকি আমরা।বাসায় টিভি নাই।সামনের টিনের বাসায় টিভি আছে। হাওয়াই ফাইভও, লিটল হাউজ অন দি প্রেইরী দেখি ওয়ালের পাশে ইট দিয়ে তার উপর দাঁড়িয়ে থেকে। মশা কামড়ে পা ফুলিয়ে ফেলত। কিন্তু পুরো এক ঘন্টা ঠিক ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে টিভি দেখতাম।

টিভিওয়ালা বাসার মালিক ফাহিম সাহেব ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীতে চাকরি করত। ফটফটি মটরসাইকেল চালিয়ে অফিসে যেত। ওনার ছিল খুব ছোট দুই জমজ মেয়ে। ওদের বাসায় বেড়াতে আসত এক কিশোরী তার বড় বোনের সাথে। একদিন চোখ আটকে গেলো সেই কিশোরীর উপর। নাম ছিল নাজমা।

আমি দেখতে একদম যা তা টাইপ ছিলাম। শুকনা, চিকন চিকন হাত পা। চাপা ভাংগা। মাথা ভর্তি কাকের বাসার মত কোঁকড়া চুল। কোন মেয়ে ভুলেও তাকানোর কথা নয়। নাজমাকে ভাল লেগে গেল। তারা বাসাবোতে থাকে। এসব তথ্য জোগাড় করে দিল সেই সময়ের সকল কুকর্ম শিখিয়ে দেওয়ার ওস্তাদ বিশ্বস্ত বন্ধু বাসার কাজের ছেলে ‘মিয়া’। বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড়। আমাদের গ্রাম থেকে আসা ছেলে। চোখ কান খোলা। সব কিছু বুঝে। বাজারের পয়সা থেকে কেমন করে দক্ষভাবে কারো সন্দেহ না জাগিয়ে পয়সা চুরি করতে হয়, সেই ট্রেইনিং তার কাছ থেকেই আমার পাওয়া।

সেই ‘মিয়া’ আমাকে শেখাতো কেমন করে মেয়েদের সাথে খাতির করতে হয়। চোখাচোখি হলে নাকি চোখ টিপতে হয়। তারপর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ইচ্ছা করে ধাক্কা দিতে হয়। এই ব্যাপারগুলি আমার একদম পছন্দ হয় নাই। বরং মনে হয়েছে, এমন করলে উলটা ফল হতে পারে। বাসায় নালিশ চলে আসবে। তারপর আপাদমস্তক উত্তম মধ্যম খেতে হবে।
মিয়া’র পদ্ধতি বাদ দিয়ে আমি গোবেচারা হয়ে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।

নাজমা যখন ওর বোনের সাথে শাহজাহানপুর রেল লাইনের উপর দিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরে যেত, ওর পিছু পিছু গিয়ে একদিন ওদের বাসা চিনে এলাম। বাসাবোতে থাকে। ঐ পর্যন্তই। আর কিছু বলার বা করার সাহস হচ্ছিল না।

একদিন টিভি ওয়ালা বাসার ভাবী আমাকে ডেকে বাসায় নিয়ে গেল। এটা সেটা খেতে দিল। তারপর লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে দোকান থেকে কিছু জিনিস এনে দিতে বলল। এমন কয়েকদিন করার পর একদিন সাহস করে ভাবীকে জিজ্ঞেস করলাম – ভাবী, ঐ মেয়েটা আপনার কে হয় ?

ভাবী বলে – আমার ননদ হয়। তারপর চোখ পাকিয়ে বলে – কেন, ওকে তোমার মনে ধরেছে নাকি ?

আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নেড়ে অস্বীকার করি। ভাবী ঠিকই বুঝতে পারে। হেসে দেয়। ভাবীর পিচ্চি মেয়ে দুইটাকে আমি অনেক আদর করি। মাঝে মাঝে হাতে ধরে পার্কে নিয়ে যাই খেলতে। তাই ভাবী আমার উপর খুশী থাকে।

এরপর একদিন নাজমা ভাবীদের বাসায় এলে ভাবী আমাকে ডেকে পাঠান। ভাই বাসায় থাকলে আমি যেতে চাই না। ভয় লাগে ওনার রাগী, গম্ভীর চেহারা দেখলে। মনে হয় যেন এখুনি আমাকে কানে ধরে অঙ্ক কষতে বসাবে। তাই যখন দেখি ফটফটি হোন্ডা বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, ভাবী ডাকলেও আমি আর যাই নাই সেদিন।

কিন্তু ভাবী মনে হয় নাজমাকে কিছু বলেছিল। সেই মেয়ে দেখি, আমাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসে। আর সেই হাসি দেখে আমার বুকের ভিতর দ্রিম দ্রিম করে ড্রাম বাজতে থাকে। আনন্দ হয় আবার ভয়ও পাই। মিয়াকে জিজ্ঞেস করি, এরপর কি করতে হবে। মিয়া বলে ছাদে ডেকে এনে গল্প করতে। একদিন অনেক ভয় নিয়ে ওকে আমাদের বাসার ছাদে আসতে ইশারা করলাম। সেও এলো। কিন্তু মাঝপথে তার বড় বোন দেখে ফেলে ডেকে নিয়ে গেলো। মর জ্বালা, দেখার আর সময় পেলো না। সুবর্ন সুযোগ হাতছাড়া হল।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কোমরের চাইতে বেশী ঢিলা প্যান্ট পাজামার দড়ি দিয়ে বেঁধে টাইট করে পড়ি। শার্টের হাতা গুটিয়ে নেই। লম্বা লম্বা চুল তেল দিয়ে চুপচুপে ভিজিয়ে নিয়ে আঁচড়াই। বেল্ট ওয়ালা সেন্ডেল পরে ফুলবাবু হয়ে বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু সে আর আসে না। অথচ চলেও যায় নাই। গেলে আমার গুপ্তচর ঠিক টের পেতো।
অপেক্ষায় থেকেও দেখা হল না। রাত হয়ে গেল। ওদের বাসার ওয়ালের পাশে ইটের উপর দাঁড়িয়ে টিভি দেখছিলাম। চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়েও ঘরের ভিতর কোথাও ওকে দেখলাম না। হঠাত টের পেলাম, কেউ যেন আমাকে চেপে ধরে টান মারলো। আর আমি তিন চারটা ইটের উপর থেকে হুড়মুড় করে উচু নিচু ইটের রাস্তায় গড়িয়ে পড়ে মাথায় ব্যথা পেলাম। তাকিয়ে দেখি, সেই ব্যাক্তি আর কেউ নয়, নাজমার বড় বোন। আমাদের চেয়ে অনেক বড় বয়সে। হয়ত কলেজ পড়ুয়া হবে। সেই মহিলা কেন জানিনা, আমার উপর খুব ক্ষিপ্ত ছিল। হয়ত ওনার বোনের দিকে আমার চোখ পড়েছে এটা পছন্দ হয় নাই।

কিন্তু তাই বলে কি কোন মহিলা একজন কিশোরের অন্ডকোষ চেপে ধরে, এমন কথা শুনেছেন কোন দিন ?
আসোলেই এটা করা হয়েছিল আমার সাথে।

মাটিতে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েও ভয়ের চোটে কোন প্রতিবাদ না করে সেদিন কোনরকমে মাটি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ধন সম্পদ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম।

এতই ভয় পেয়েছিলাম যে এরপর থেকে বারান্দায় দাঁড়াতেও ভয় পেতাম। আহারে, কি সুন্দর সম্ভাবনাটা অংকুরে ঝরে গেল। দু:খে মরি। এরপর অনেকদিন নাজমাকে আর এমুখো হতে দেখি নাই। লুকিয়ে লুকিয়ে বাসাবোতে গিয়ে রাস্তার উল্টাদিকে অনেকক্ষন ধরে অপেক্ষা করেও তার দেখা পাই নাই কোন দিন।

লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে একদিন সুযোগ বুঝে ভাবীকে ওর কথা জিজ্ঞেস করলাম। আর তখুনি জানলাম, নাজমারা আসোলে ঢাকায় থাকে না। বেড়াতে এসছিল। বেড়ানো শেষে ফিরে গেছে তাদের শহরে। আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি নাই।

ইশ, তখন যদি মোবাইল ফোন থাকতো, কতই না ভাল হত ! 😩

১৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

আগের পরবগুলিঃ
#প্রেমরোগ_১ ,#প্রেমরোগ_২ , #প্রেমরোগ_৩
#প্রেমরোগ_৫