রানী মাতা

কিছুদিন আগেও যখন বাসে ট্রেনে কোন বুড়ো মানুষ দেখতাম আস্তে করে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতাম এই ভয়ে যদি কোন সাহায্য চেয়ে বসে। সাবওয়েতে একটা সীট পেয়ে আরাম করে বসেছি, একটু পরেই হয়ত একজন বয়স্ক মানুষ ট্রেনে উঠলো, লাঠি ঠুকে ঠুকে ঠিক আমার সামনে এসে লাঠি ফ্লোরে জোরে ঠুকে আওয়াজ করে আমার দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করবে। চোখাচুখি হলে যেন আমি সীট ছেড়ে দেই। আমি এই অবস্থার সাথে পুর্ব পরিচিত। তাই বুড়ীর দিকে একটুও না তাকিয়ে চোখ বুজে ঘুমের ভান করে থাকি। কেমন শয়তান ছিলাম আমি !

হটাৎ আমি খুব ভাল হয়ে গিয়েছি। কি অবাক পরিবর্তন আমার ভিতর, দেখলে আমার নিজের কাছে নিজেকে অপরিচিত মনে হয়। এখন আমি রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে কিংবা ফুটপাথে কোন বয়স্ক মানুষ দেখলেই অনেক মায়ার দৃষ্টিতে তাকাই। সেই দৃষ্টিতে অনেক মায়া, ভালবাসা, শ্রদ্ধা। ভাল করে তাকাই। হাসিমুখ করে ‘হাই, হ্যালো’ বলি। বসার সীট ছেড়ে দেই। সিড়ি বেয়ে উঠার সময় ওদের ভারী ব্যাগ থাকলে উঠাতে সাহায্য করি।

এইতো সেদিন রানী এলিজাবেথ এর মত দেখতে খুব সুন্দরী আর হাসিমুখের এক বুড়ি রানী মাতার মত বিশাল হ্যাট পড়ে কড়া সেন্টের গন্ধ ছড়িয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলো। খেয়াল করলাম বুড়ির হাঁটার গতির চাইতে ওয়াক সাইনের ২৪ সেকেন্ডের সময়সীমা দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে, অথচ বুড়ি তখনো রাস্তার মাঝখানে। দৌড়ে গেলাম বুড়ির কাছে। হাত বাড়াতেই বিরাট হাসি দিয়ে জড়িয়ে ধরলো আমার হাত। আরেক হাতে নিলাম বুড়ির ঢাউস ব্যাগ। পার হয়ে গেলো রাস্তা। হাসিমুখে ‘গড ব্লেস ইউ, মাই লাভ’ বলে আবার হাঁটা শুরু করলো।

আমি ‘বাই’ বলে অন্যদিকে হাঁটা শুরু করার পুর্ব মুহুর্তে চোখে পড়লো বুড়ির সাদা রঙের জুতার এক পাটির ফিতা খুলে মাটিতে লুটাচ্ছে। দেখে মায়া লাগলো। ‘হেই ম্যা’ম, ওয়েট’ বলে বুড়িকে দাঁড় করিয়ে নীচু হয়ে জুতার ফিতা বেঁধে দিলাম। দেখে খুসির চোটে আমাকে কাছে টেনে আমাকে নীচু করে দুই গালে আদর করে দিলো। তাকিয়ে দেখি বুড়ির চোখের কোনায় পানি টলমল করছে। আমিও যদি অমন দেখে কেঁদে ফেলি এই ভয়ে ‘টেক কেয়ার, ম্যাম’ বলে হাঁটা শুরু করলাম।

কিছুদুর গিয়ে কি মনে করে পিছনে তাকাতে দেখি বুড়ি তখনো ওখানেই দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচুখি হতেই হাসি মুখে হাত নাড়ল। আমিও হাত নেড়ে চলে আমার পথে চলা শুরু করলাম পিছনে না তাকিয়ে।

তারপর আরো অনেকবার ওই পথে হেঁটেছি কিন্তু আমার খুব সুন্দর হাসি মুখের সেই রানী মাতাকে আর দেখি নাই। অনেক দিন খুঁজেছি। বাস স্টপে অন্য মানুষদের জিজ্ঞেস করেছি বুড়ির বর্নণা দিয়ে কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারে নাই।

এই বিশাল ব্যস্ত নগরীতে কারোর সময় নাই অন্যদের দিকে তাকানোর। আজ যার সাথে দেখা হলো, রাস্তায়, বাসে কিংবা ট্রেনে – পাশাপাশি বসে হয়ত অনেকদুর চলে গেছি। চোখে পড়লে হয়ত আস্তে করে একবার ‘হ্যালো’ বলে আবার নিরবতা। হয়ত পাশে বসে একসাথে কাজে যাওয়ার আজকের সঙ্গীকে আর কোনদিন দেখা যাবে না।

অন্যদের নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। কিন্তু সেই রানী মাতাকে আর তাঁর সেই ভুবন বুলানো মায়াময় হাসির কথা আমি কোন দিন ভুলতে পারি না।
জুন ২৮, ২০১৪