#উত্থান২০ – Rise of a Thug

কায়সার মামু সবসময় এমন কুকর্ম করে। একসাথে বেড়াতে গিয়ে আগেও এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। আজ আবার হল।

রাত এগারোটার নিশিতা ট্রেনে ঢাকা যাবে ওরা। ওরা মানে কায়সার ও আবু তাহের। একটু আগে পৌঁছে যাওয়ায় পাহাড়তলি স্টেশনের পাশের শপিংমলে ঘুরাঘুরি করে সময় কাটাচ্ছিল। একটা সানগ্লাসের দোকানে ঢুকে চোখে লাগিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছে আবু তাহের। দোকানটা বেশ বড় এবং সুন্দর করে সাজানো। কাস্টমারের বসার জন্য সোফা রাখা আছে। এত রাতেও কাস্টমার আছে বেশ কয়েকজন। সেলসম্যানরা তাদেরকে নিয়ে ব্যস্ত।

সুঠাম স্বাস্থ্যের একজন একের পর এক চশমা চোখে পড়ছে আর খুলছে। কায়সার মামু কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে ঐ  সুঠামদেহী মানুষটাকে দেখিয়ে দিলো। চোখের ইশারায় বুঝালো লোকটা চুরি করছে।

সেলসম্যানরা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালো। লোকটার শরীর স্বাস্থ্য দেখে কারো সাহস হচ্ছে না তাকে গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার। মিচকা শয়তান কায়সার মামু এমন কাণ্ড করে ব্যাংককে একবার কুংফু কারাতে জানা এক কাস্টমারের হাতে নিরীহ দুইজন সিকিউরিটি গার্ডকে মার খাইয়েছিলো।

কাউঠা এসে ঢুকল দোকানটায়। ওর চেহারার কাটাকুটি দাগ হিংস্র রূপ এনে দিয়েছে। সে এসে রে-বন সানগ্লাস দেখতে চাইলো শো-কেসের ভেতর থেকে। জন লেনন স্টাইলের একটা গ্লাস পরে আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে বেশ স্মার্ট মনে হল তার। আরও কয়েকটা বের করালো ট্রাই করতে। কাউঠার হিংস্র মুখের দিকে তাকায়ে দোকানীর সাহস বাড়ল। সে তাকে আস্তে করে অনুরোধ করলো ঐ সুঠামদেহী লোকটাকে ধরে সার্চ করে দেখার জন্য। চুরি করেছে সন্দেহের কথাটা জানালো কাউঠাকে। রেবন সানগ্লাসটা চোখে পরে থেকে দুর্দান্ত সাহসী কাউঠা সেই লোকটার দিকে এগিয়ে গেলো।

কাছে গিয়ে বলে – তরে চিনা চিনা লাগে ক্যান ! তুই ক্যাঠা রে ? আইচ্চা যেই হস না ক্যান, চশমা যেইখান পকেটে হান্দাইসস বাইর কইরা দে। নইলে মাইরা তক্তা বানায়া ফালামু।

সুঠামদেহী লোকটা লম্বায় কাউঠার মাথা ছাড়িয়ে গেছে। হাতের বাহু দুইটা বড় সাইজের মুগুরের মত ফুলে আছে। মারামারি লাগলে কাউঠা তার সাথে পেরে উঠার কথা না। কিন্তু শুধু গায়ের শক্তি দিয়ে যে যুদ্ধে জেতা যায় না। তাঁর জন্য লাগে প্রচণ্ড সাহস, কাউঠার যেটার একটুও অভাব নাই। সে চোখের পলকে লাফিয়ে উঠে মানুষের গলায় পোঁচ দিয়ে ধড় নামিয়ে দিতে পারে। তাতে তার একটুও হাত কাঁপে না। চোখের পলক পড়ে না।

ছোটখাটো কুঁচকুঁচে কালো কাউঠার কথা শুনে সুঠামদেহী মানুষটা ঘুরে দাঁড়ালো। তার ভাব দেখে কাউঠা কোমরের দিকে টিশার্টটা সরিয়ে পিস্তলের বাঁটটা দেখালো। দেখে লোকটা একটু দমে গেলো। কথা না বলে নীরবে পকেট হাতড়ে সব বের করে দেখালো। শার্ট উঠিয়ে কোমরে কিছু নাই দেখালো। সবাই বুঝলো লোকটা মোটেও চুরি করে নাই। মুখে কোন কথা না বললেও লোকটার চোখ মুখে আক্রোশ ফুটে উঠলো। সবার দিকে একবার তাকিয়ে কাউঠাকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে নীরবে বেরিয়ে গেল।

এদিকে কায়সার মামু গ্যাঞ্জাম লাগিয়ে দিয়ে চুপটি করে কেটে পড়েছে সেখান থেকে। দোকানের সবাই লজ্জায় পড়ে গেলো। তবুও কাউঠাকে ধন্যবাদ দিলো ওদেরকে সাহায্য করার জন্য। ঘটনার আকস্মিতায় তারা কাউঠার চোখে পরে থাকা দামী রে-বন সানগ্লাসটার দাম নিতে ভুলে গেল। কাউঠাও দাম না দিয়ে হেলেদুলে বেরিয়ে গেল। যদিও পকেটে শুক্কুরের সিন্দুক থেকে নিয়ে আসা অনেকগুলি টাকা আছে যা খরচ করার জন্য হাত নিশপিশ করতেছে।

রাত সাড়ে দশটা বাজে। কাউঠা স্টেশনের দিকে হাঁটা শুরু করলো। ট্রেনের টিকেট কাটার দায়িত্ব তাকে দিছে পিস্টন। ওরা দুজন পরে এসে যোগ দিবে। অথচ এখনো টিকেট কেনা হয় নাই। স্টেশনে গিয়ে দেখে কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছে। সাদা ড্রেস পরা টিটিকে দেখতে পেয়ে তাকে ধরে বলে – ভাই, যেমনে হোক আমারে ৩ টা স্লিপিং কোচের টিকেটের ব্যবস্থা কইরা দেন। নইলে ইজ্জত থাকবো না। টেকা যা লাগে দিমু। এইটা আপ্নের – বলেই টিটির হাতে কয়েকটা একশো টাকার নোট গুঁজে দেয়।

এভাবে টাকা গুঁজে দিচ্ছে দেখে টিটি অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আবার লোভও সামলাতে পারছে না। বলে – সমস্যা নাই। রাতের ঢাকামুখী নিশিতা ট্রেনে আমার ডিউটি আছে। ট্রেনে সিট আছে। আপনারা যে কোন স্লিপিং বার্থের খালি কামরায় ঢুকে আমার নাম বললে চেকার লক খুলে দিবে। আমি এসে টিকেট ইস্যু করে দিবো পরে।

ব্যস, আরামে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেলো।

কাল রাতের অপারেশনের পর তারা শুক্কুরের হোটেলে ফিরে ঘুমিয়েছে। কেউ কিছু টের পায় নাই। কোন সমস্যা হয় নাই। তবে চিটাং শহর পিস্টনের ভাল লাগছিলো না। সে ঢাকায় ফিরতে চায়। এবং ট্রেনে ঘুমিয়ে যেতে চায়। অনেক দিন ট্রেনে ভ্রমণ করে নাই তাই।

ট্রেনে উঠে চেকারকে দিয়ে একটা বার্থ খুলে দেখে নিলো কাউঠা। নিজের ব্যাগটা রাখলো উপরের বাংকে। তারপর দরজাটা টেনে দিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে একটা সিগারেট ধরালো। ওখানে দাঁড়িয়ে লক্ষ রাখলো যেন পিস্টন আর গিট্টু ওকে মিস না করে। সিগারেট টানছে আর বাক্স প্যাটরা হাতে লোকজনের ট্রেনে উঠা দেখছে। কুলিদের হাঁকডাক শুনছে। তখুনি নজরে পড়ল, একই বগিতে উঠছে সেই সুঠামদেহী লোকটা। সাথে আরও ৩ জন। ওর দিকে একবার তাকালো সবাই। আর তখুনি কাউঠা ওদেরকে চিনে ফেললো। ওদের সাথে হামদু আছে। এবার বুঝলো কেন ঐ লোকটাকে তখন তার চেনা চেনা লেগেছিল।

ওরা হামদু’র দলের মানুষ। সুঠামদেহী লোকটাকে পিস্টন একবার ভীষণ মেরেছিল। জানেই মেরে ফেলতো, কিন্তু তার বাচ্চাটা এতিম হয়ে যাবে আকুতি করায় গুলিটা না করে সেবার ছেড়ে দিয়েছিল তাকে। কাউঠা তখন সাথে ছিল। এখন তার সব কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এরা এবার তাদেরকে ছাড়বে না। প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করবে।

দ্রুত ভাবছে কাউঠা, কি করা যায় সেটা নিয়ে। ভয় পাচ্ছে না। একশন প্ল্যান নিয়ে ভাবছে। ট্রেন ছাড়তে আর ৫/৭ মিনিট বাকি। ওরা দুজন কই গেলো, এখনো আসছে না। কি মুসিবত ! শেষে ট্রেন না মিস করে বসে।

এই ট্রেন একদম সময়মত ছাড়ে। এক সেকেন্ড দেরী করে না সে জানে। ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টা বাজলো। ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ করে ধীরে ধীরে চাকা গড়াতে শুরু করেছে সবে, দেখে ডাবল মার্চ করে দৌড়ে আসছে পিস্টন ও গিট্টূ। ওদেরকে দেখে কাউঠা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। বগির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে হাত তুলে নাড়ল যেন ওরা দেখতে পায়।

দৌড়ে এসে লাফিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ল ওরা দুজন। গিট্টূর হাতে কয়েকটা ব্যাগ। কি সব কেনাকাটা করেছে কে জানে ! ওদেরকে নিয়ে নিজেদের বার্থে ঢুকল কাউঠা। চারজনের বার্থ। কিন্তু ওরা তিনজন মাত্র। অপরিচিত কেউ এসে ঢুকলে ঝামেলা। তার আগে সেই পথ বন্ধ করতে হবে। এদিক ওদিক তাকায়ে টিটিকে খুঁজল। পেয়ে গেলো। হাত ইশারা করে কাছে ডেকে বলল যেন আর কেউ এই বার্থে না আসে। টিটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বার্থের দরজায় রিজার্ভ সাইন লাগিয়ে দিলো।

ঠিক এগারোটা বাজে। ট্রেন ছেড়ে দিলো। লাইনের উপর চাকার ঘটাং ঘটাং ধীর লয়ের আওয়াজ দ্রুত বদলে ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক আওয়াজে রূপান্তরিত হল। পিস্টন জানালার পাশে বসে আয়েস করে একটা সিগারেট ধরালো।

তারপর কাউঠাকে জিজ্ঞেস করে – তুই এতক্ষণ কই আছিলি রে ! তরে কুনহানে খুঁইজা পাইলাম না। ভাত টাত খাইছস কিছু ?

কাউঠা জানালো সে কিছু খায় নাই। এটাও জানালো এযাত্রাটা নিরিবিলি নাও হতে পারে। তারপর খুলে বলল হামদু ও তার লোকজনের কথা। সানগ্লাসের দোকানে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ব্যাপারটা।

গিট্টূ স্টেশন থেকে কেনা জিনিসগুলি বের করে সবে ওদেরকে দেখাতে শুরু করেছে, কাউঠার কথা শুনে আবার সব ঢুকিয়ে ফেলে মন দিয়ে সব শুনলো।

তারপর বলে – কায়সার মামুরে দেখলাম আবু তাহেররে নিয়ে ট্রেনে উঠতে।

কাউঠা বলে – এই লোক যেখানে সব গ্যাঞ্জাম সেখানে। উনিই তো ঐ দোকানে চশমা চুরি করছে বইলা হামদুর লোকটারে আমারে দিয়া সার্চ করাইলো খামাকা।

পিস্টন ঠাণ্ডা মাথায় বলে – ভাইবা আর কাম কি, যা হওনের হইবো। সবাই ঘুমাইতে পারবি না। একজন কইরা জাইগা পাহারা দিতে হইবো ঢাকা পৌঁছন পর্যন্ত। মাল মুল কি আছে লগে, ক।

কাউঠা কোমর থেকে শুক্কুরের রিভলভারটা বের করে দেখালো। গিট্টূ তার ক্ষুর আর একটা সিক্স গিয়ার চাকু বের করে দেখালো।

চাকুটা নিজের কাছে রেখে বলে – চলবো। এর বেশী জিনিস দিয়া কি করবি ! বলে কাউঠার চোখের সানগ্লাসটা নিজে পরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। শুয়েই নাক ডাকতে শুরু করলো।

কাউঠার চোখে ঘুম নাই। সে গিট্টুকে বলে – শুন, তুই একটু চোখ খোলা রাখিস। ঘুমায়া যাইস না এক্ষনি। আমি বাইরের ভাব বুইঝা আহি। আর দেহি ঐ হালারা কুন বগিতে উঠছে।

দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে সে করিডোরে বের হয়ে এলো। রিভলভারটা পেছনে কোমরের কাছে গোঁজা আছে। এই বগির পুরোটা স্লিপিং কোচ। কেউ একজন করিডোরের উল্টা পাশ থেকে হেলেদুলে হেঁটে আসছে। অল্প পাওয়ারের বাল্বের মৃদু আলোয় মুখটা ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। তবু কেন জানি চেনা লাগলো তারে। কাছে আসতেই দেখে ওটা আর কেউ না, হামদু নিজে। চমকে উঠলো কাউঠা। এরা সবাই আজ এখানে কেন ? কি উদ্দেশ্যে ? নাকি ওদেরকে টার্গেট করে এই ট্রেনে উঠেছে কে জানে !

একবার যা মারটা মেরেছে পিস্টন হামদুকে, সেই ব্যথা সে ভুলবে কি করে !

শীতের রাত। কাউঠা চাদর দিয়ে মাথাটা ঢেকে রাখায় পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া হামদু তাকে চিনতে পারে নাই। তবুও বলে – এত রাইতে হাঁটাহাঁটি করেন ক্যান মিয়া, সিটে যাইয়া ঘুমায়া পরেন। উত্তরে সে হাল্কা করে মাথা ঝাঁকালো। কিন্তু অলক্ষ্যে কোমরের পেছন থেকে রিভলভারটা তার হাতে এনে লুকিয়ে ধরে রাখলো।

হামদু তাকে পাশ কাটানোর পর কাউঠা চোখের কোণ দিয়ে পেছনে তাকায়ে অনুভব করলো জ্যাকেটের নীচ দিয়ে কালো মত কিছু একটা ঝুলে আছে। চমকে উঠলো। বুঝলো ওটা শটগানের নল। আরও বুঝলো ওরা কাউকে খুন করার মিশন নিয়ে এই ট্রেনে উঠেছে। টার্গেটকে খুঁজছে। টার্গেট যে পিস্টন এটা বুঝতে তার আর অসুবিধা হল না। হামদু উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখছে এদিক ওদিক। প্রায় সব স্লিপিং কোচের দরজা বন্ধ। সে তবুও ধাক্কা দিয়ে খুলতে চাইছে। ওদেরকে সাবধান করার তাড়া অনুভব করলো। আবার হামদুর বাকি চ্যালারা কোথায় কি করছে সেটাও জানা দরকার। ওদের বার্থ পার হয়ে চলে গেলো হামদু। ওটা ধাক্কায় নাই কারণ টিটি তখন উল্টা দিক থেকে হেঁটে আসছে।

বগির শেষে দরজা খুলে অন্য বগিতে ঢুকল হামদু। কাউঠা টিটিকে পেয়ে বলল – এই ট্রেনে সন্ত্রাসী আছে। ওরা হামলা করবে। ওদের কাছে আগ্মেয়াস্ত্র আছে।

শুনে টিটি ভড়কে গেল। বলে – জিআরপিকে জানানো দরকার।

কাউঠা বলে – লাভ নাই। ওরা বাধা দিলে বেঘোরে গুলি খেয়ে মরবে। বলে তারচেয়ে টিটি গিয়ে যেন নিরাপদে আশ্রয় নেয়।

টিটি কাঁপতে কাঁপতে বিদায় হল।

গভীর রাত। ট্রেন চলছে ঝিক ঝিক করে। পরের বগিতে ঢুকল কাউঠা। সিটিং কোচ। দেখে একটা সিটে কায়সার মামু কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আর বগির শেষ মাথায় সেই সুঠামদেহী শয়তানটা দাঁড়ায়ে জানলা দিয়ে সিগারেটের ধুঁয়া ছাড়ছে। ওর গায়ে একটা খদ্দেরের চাদর। তারমানে ওর কাছেও বড় অস্ত্র আছে। কি মুসিবত, ওদের সাথে ফাইট করবে কি দিয়ে ! দ্রুত ভাবতে শুরু করলো কাউঠা। রাতের বেলায় ঘুমিয়ে থাকা নীরব ট্রেনে একটা গুলি হলে সবাই জেগে উঠে হুলুস্থুল বেধে যাবে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলির অনেকের সাথে শিশুরাও আছে।

নাহ, বগির ভিতর সরাসরি গুলি করা যাবে না। যা করার নিঃশব্দে করতে হবে।

পাশে গিট্টুর অভাব অনুভব করলো সে। আবার ভাবল গিট্টু পিস্টনের সাথে আছে, জেগে আছে এটাও আশার কথা।

নিঃশব্দে হেঁটে সুঠামদেহীর পেছনে চলে এলো। সে টের পেলো না। জানালায় মাথা বের করে সুখে সিগারেট টানছে। বগির বাকি মানুষগুলি ঘুমাচ্ছে। রিভলভারটা ওর পিঠে ঠেকিয়ে বলে – নড়েছিস তো মরেছিস। শুনে সাথে সাথে লোকটা মূর্তির মত জমে গেলো। কাউঠা আরেক হাত দিয়ে ওর কাঁধে ঝুলানো শটগানটা বের করে নিলো। ওটা নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে বলে – এবার সামনে হাঁট। আস্তে হাঁটবি। কিছু করার চেষ্টা করবি না। আমি কইলাম খুব নার্ভাস মানুষ। তুই এট্টু নড়লেই ফুটুস কইরা গুল্লি বাইর অইয়া যাইবো আর তুই মরবি।

লোকটা মোটেও উত্তেজিত হল না। ভয়ে কাঁপছেও না। কাউঠা বুঝলো – এই ব্যাটা তারচেয়েও ঠাণ্ডা মাথার খুনী।

লোকটা সামনে হাঁটছে আর ধীরে ধীরে বলে – এইবার তোরে চিনছি। তুই পিস্টনের লগে থাকস। চশমার দোকানে তহন তরে চিনবার পারি নাই।

কাউঠা তাকে টয়লেটের ভিতর ঢুকিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রিভলভার তাক করে জিজ্ঞেস করে – তরা কি মিশন লইয়া এই ট্রেনে, এট্টু কইবি আমারে ?

লোকটা ঠোঁটের কোনায় চিকন হাসি এনে বলে – এহনো বুজস নাই আমরা ক্যান এহানে ? আরে ব্যাটা তগোরে আমরা বাটালী হলের বস্তি থেইকা ফলো করতাছি। বাটমত পাই নাই। হামদুর ইচ্ছা ট্রেনে তগোরে গুল্লি কইরা জানলা দিয়া ফালায়া দিবো। হ্যায় তো গেছে পিস্টনরে গুল্লি করতে।

– তো ঘটনা যে উলটাইয়া গেলো হেইডা বুজ্জস নি রে। তরা যে এহানে আছস এইটা আমি আগেই টের পাইছি।- কাউঠা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলে।

– আইচ্চা, মরণের আগে তর নামডা কইয়া যা। কাউঠা আবার বলে।

লোকটা উত্তর দেয় – মফিজ্জা নামে চিনে বেবাকতে।

কাউঠা বলে – কলমা পড়লে পইরা ল। আমার আতে কইলাম আর সুমায় নাই।

মফিজ্জা কিছুই পড়লো না। শুধু নিস্পলকভাবে তাকায়ে রইলো।

ট্রেনের চাকার আওয়াজে গুলির শব্দ কেউ শুনবে বলে মনে হয় না। কাউঠা আর সময় নিলো না। পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে ওর কপাল বরাবর একটা গুলি করলো। একটা আধুলির সমান ফুটো তৈরি করে গুলিটা মফিজ্জার ভিতর হারায়ে গেলো। শরীরটা পেছনে হেলে পড়ে টয়লেটের দেয়ালে কাত হয়ে দাঁড়ায়ে রইলো। চোখ দুটো তখনো খোলা।

এদিক ওদিক তাকায়ে কেউ নাই দেখে কাউঠা মফিজ্জার শার্টের কলার ধরে টেনে বের করে বগির দরজা খুলে দেহটা বাইরে ফেলে দিলো।

শীতের ঠাণ্ডা বাতাস চোখে মুখে এসে ঝাপটা দিলো। দরজা লাগিয়ে দ্রুত সে তাদের বার্থের দিকে এগুলো। সিটিং বগিটা পার হয়ে স্লিপিং বগিতে ঢুকল। ওদের বার্থটা একদম শেষ মাথায়। কাছে যেতেই দেখে সাদা ড্রেস পরা টিটি করিডরে রক্তাক্ত হয়ে শুয়ে আছে। নাকে ধরে দেখে প্রাণ নাই তার।

মনটা খারাপ হল। লোকটা ভাল ছিল। ওর পকেট হাতড়ে আইডি কার্ডে নামঠিকানা দেখে নিলো। পরে পারলে পরিবারকে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে আসবে। এবার দ্রুত নিজেদের বার্থের দিকে আগালো। কাছে যেতেই দেখে বার্থের বাইরে একজন দাঁড়ায়ে আছে। হাতে বড় একটা রামদা। তার চোখ রুমের ভিতরে তাই কাউঠার উপস্থিতি টের পায় নাই। দ্রুত তার কাছে পৌঁছে পেটের সাথে নলটা চেপে ধরে দেরী না করে গুলিটা করলো। শুধু ধুপ করে একটা ভোঁতা আওয়াজ শুনা গেলো আর লোকটা ধপাস করে পড়ার আগে তাকে ধরে টেনে নীচে শুইয়ে দিলো। এবার রুমের ভিতরে তাকালো। দেখে গিট্টূ সিটে শুয়ে গোঁ গোঁ করে আওয়াজ করছে। মানে এখনো বেঁচে আছে। হামদু দরজার দিকে পিঠ দিয়ে এক পা নীচে আরেক পা পিস্টনর বুকে ঠেকিয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। হাতে একটা পিস্তল। পিস্টন নির্বিকারভাবে তার সিটে শুয়ে থেকে ওর কথা শুনছে।

কাউঠা মনে মনে হিসাব করলো হামদুর আরেকজন লোক আছে ট্রেনে তারমানে সে আশেপাশে আছে পাহারায়। যে কোন সময় এসে পড়তে পারে। তার আগেই হামদুকে কাবু করা দরকার। চাইলে পিছন থেকে গুলি করে শেষ করে দেয়া যায়। কিন্তু ইচ্ছা করলো তাকে একটু খেলিয়ে মারতে। আওয়াজ না করে রুমে ঢুকে রিভলভারের বাঁট দিয়ে সজোরে মাথায় আঘাত করলো কাউঠা। ধপাস করে পিস্টনের গায়ের উপর পড়ল হামদু।

ওকে ঠেলে সরিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো পিস্টন। বলে – তুই এতক্ষণ কই আছিলি রে , আমি তো ভাবছি অরা তরে মাইরা আমার কাছে আইছে। এইটা মনে কইরা মনডা এক্কেরে খারাব হইছিলো রে। কাছে এসে কাউঠারে জড়িয়ে ধরলো সে।

বন্ধুর মমতায় কাউঠার বুকটা ভরে গেলো। সে জানে তবুও আজ তার প্রতি পিস্টনের এত মায়া দেখে একদম গলে গেল। কথা বলার আগে ঝটপট হামদুর হাত পা বেঁধে ফেললো গামছা দিয়ে। তাকে ফেলে রেখে গিটূর দিকে তাকালো। ওর হাতে গুলি করেছে। দরদর করে রক্ত পড়ছে। গুলি খাওয়া যায়গাটা টাইট করে বাঁধল হামদুর জামা কেটে নিয়ে।

গিট্টূ চোখ মেলে ওদেরকে দেখে হেসে দিলো – তরা সবাই বাইচা আছস ! আর কিছু চাই না আমি। বলে আবার জ্ঞান হারালো।

ওকে শুইয়ে চাদর দিয়ে ঢেকে কাউঠা গেলো করিডোরে পড়ে থাকা লাশ দুইটার ব্যবস্থা করতে। টেনে নিয়ে ওগুলি বাইরে ফেলে দিলো। তারপর খুঁজতে বের হল হামদুর আরেক সঙ্গীকে।

পিস্টন একটা সিগারেট ধরিয়ে হামদুর দিকে নজর দিলো। হামদুর জুতা খুলে ময়লা মুজা খুলে সেটা তার নাকের কাছে ধরতেই সে নড়ে উঠে চোখ মেলল। চোখ মেলে দেখে দাবার ছক উলটে গেছে। সে হাত পা বাঁধা অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে আছে। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। মনে পড়লো কেউ পেছন থেকে খুব জোরে আঘাত করায় সে চোখে সর্ষে ফুল দেখে জ্ঞান হারিয়েছিল। চোখ মেলে পিস্টনকে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুঝে ফেললো হিসাবে ভুল হয়ে গেছে। কাউকে মারতে এসে বেশিক্ষণ বাঁচিয়ে রাখতে হয় না। তার ফলাফল হিসাবে আজই তার জীবনের শেষ দিন।

কাউঠা এক বগি থেকে আরেক বগিতে হামদুর সঙ্গীকে খুঁজতে খুঁজতে আবার কায়সার মামুর বগিতে ফিরে এলো। এসে যা খুঁজছিল পেয়ে গেলো। লোকটা অসম্ভব মোটা। মাথা ভর্তি ঢেউ খেলানো লম্বা কোঁকড়া চুল। কপালের উপর বড় একটা কাটা দাগ। সে টয়লেটের সামনে এক মহিলাকে একা পেয়ে তাকে জাপটে ধরেছে। মহিলা ধস্তাধস্তি করলেও বিশাল দেহী মানুষটার সাথে পেরে উঠছে না।

কায়সার মামু তখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তারপাশে একটা প্লাস্টিকের পিভিসি ব্যাগে কি সব রাখা।

কাউঠা ব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে খালি করে লোকটার দিকে এগিয়ে গেলো। দুইহাতে মহিলাকে জাপটে ধরা লোকটার মাথার উপর প্লাস্টিকের ব্যাগটা গলিয়ে দিয়ে পেঁচিয়ে টাইট করে গিঁট দিয়ে ফেললো। নিশ্বাস আটকে যাওয়ায় সে মহিলাকে ছেড়ে দিয়ে মুখের দিকে হাত বাড়াতেই রিভলভার দিয়ে তার কানের কাছে খুব জোরে আঘাত করলো কাউঠা। এতেও সে টলে না। তবে দুই হাত ঝুলে পড়েছে। ব্যাগের ভিতর তার চোখ কঠোর ছেড়ে বেরিয়া যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। কাউঠার নিজ হাতে তাকে খুন করতে ইচ্ছা করলো না।

অজ্ঞান হয়ে পড়ার পর তাকে রেখে কাউঠা সেই মহিলার কাছে গেলো। তাকে দেখে মহিলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কাউঠা হাত ধরে তাকে আশ্বস্ত করে উঠিয়ে আনলো। ট্র্যাপর রিভলভারটা তার হাতে দিয়ে ট্রিগার দেখিয়ে দিয়ে বলে বলে – এইবার ঘোড়াটা টাইন্না দেন।

মহিলা রাগে কাঁপছে। চোখে খুনের নেশা। কিন্ত্যু ট্রিগার টিপতে পারছে না। হাত কাঁপছে।

কাউঠা তখন বলে – আপনি যদি ওকে মারতে না পারেন, তাইলে তার হাতে অপমানের জ্বালা সারা জীবন আপনাকে তাড়া করবে। দুঃস্বপ্ন দেখবেন। গুলিটা করে দেন। দেখবেন বুক হাল্কা হয়ে গেছে। আপনার গায়ে খুনের কোন দাগ পড়বে না। সব দায়িত্ব আমার।

এবার মহিলার কাঁপন থেমে গেলো। ততক্ষণে লোকটার জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু প্লাস্টিক ব্যাগের কারণে ভাল করে শ্বাস নিতে পারছে না। তার উপর সেই মহিলার হাতে রিভলভার দেখে সে বুঝলো তার দফা রফা হয়ে গেছে। সে আর কিছু চেষ্টা না করে চোখ বুঁজলো। মহিলা ট্রিগার টেনে দিলো। গুলিটা গিয়ে লাগলো লোকটার বুকে। সাথে সাথে তার শরীর নিথর হয়ে গেলো। কাউঠা রিভলভারটা নিজের হাতে নিয়ে মহিলাকে তার সিটে বসিয়ে দিয়ে বলে – মনে করবেন স্বপ্ন দেখেছেন। সব ভুলে যান। ঘুমিয়ে পড়েন।

পাশের সিটে ঘুমিয়ে থাকা স্বামীর গায়ে হেলান দিয়ে মহিলা চোখ বুঁজলো।

লাশটা ট্রেনের বাইরে ফেলে দিয়ে কাউঠা পা বাড়াতেই কায়সার মামু বলে উঠে – সব কাম কি শেষ নাকি গো  ?

– আপনে এতক্ষণ জাইগা আছিলেন ?

– হ, আছিলাম তো। ডরে চোখ খুলি নাই। মাগার তামশা দেখতেছিলাম।

– কন কি !

এবার কায়সার মামু বলে – শুন, ট্রেন মনে হয় আর ঘন্টাখানেকের ভিত্রে টঙ্গী স্টেশনে থামবে। তোমরা ঢাকায় না গিয়া টঙ্গীতে নাইমা যাইয়ো।

– আইচ্চা দেহি, কি অয়। এহনো কাম সামাইন্য বাকি আছে। বলে কাউঠা তাদের বার্থের দিকে গেল।

বাইরে আলো ফুটতে শুরু করেছে। প্যাসেঞ্জাররা জেগে উঠছে। কেউ কেউ করিডোরে রক্ত দেখে হতভম্ব হচ্ছে। কিন্তু কিছু বুঝে উঠছে না ব্যাপার কি !

দ্রুত নিজেদের কামরায় ফিরে দরজাটা টেনে বন্ধ করলো। দেখে হামদু চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। তার মুখের ভিতর কাপড়ের পুটুলি ঢুকিয়ে আওয়াজ করার পথ বন্ধ করলো। তারপর পিস্টনকে বলে – এখন আর গুলি করা ঠিক হবে না। ভোর হয়ে গেছে। মানুষজন জেগে উঠেছে। যা করার নিঃশব্দে করতে হবে।

পিস্টন বলে – ওকে জানে মারুম না সিদ্ধান্ত নিছি রে। ওকে লুলা করে বাঁচিয়ে রেখে আজীবন অনুশোচনায় ভুগাবো।

বলে – ক্ষুর দিয়ে পেঁচিয়ে ওর ফুই হাত কেটে প্রায় আলগা করে শুধু চামড়ার সাথে ঝুলিয়ে রাখলো। পায়ের রগ কেটে দিলো। তারপর তাকে ওভাবে ফেলে দুজন দুদিক থেকে গিট্টুকে নিজেদের কাঁধে ভর দিতে দিয়ে স্টেশনে ট্রেন থামতেই চট করে নেমে গেল।

ওরা নামতেই দপ করে ফ্লাডলাইট জ্বলে উঠলো চারিদিকে। দিনের আলোর মত পরিষ্কার সব দেখা যাচ্ছে। এত আলোয় পয়লা ওরা কিছু দেখল না। আলো চোখে আসতেই তাকিয়ে দেখে খাকি পোশাক পরা পুলিশ অস্ত্র হাতে পুরো স্টেশন ঘিরে রেখেছে।

বুঝলো আজ আর পালাবার পথ নাই। মুখ চাওয়া চাওয়ি করে ওরা ধীরে ধীরে দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়িয়ে পড়লো।

চলবে…।

২৫শে ডিসেম্বর, ২০২০