জন্মদিন
জন্মদিন কি জিনিস বুঝতে আমার অনেকদিন সময় লেগেছিল। আমাদের বাসায় এসবের কোন বালাই ছিল না। তিনবেলা খাও, স্কুলে যাও, লেখা পড়া কর আর পরীক্ষা দাও। রেজাল্ট বের হবার সময় এলে ভয়ে আধমরা হয়ে থাক। জন্মদিন কথাটা কখনো শুনি নাই, বুঝা তো পরের কথা।
যুদ্ধের সময় গ্রামের বাড়িতে থাকি। গ্রামের স্কুলে পড়ি। বিলাস বলতে ঢাকা থেকে নিয়ে আসা ব্যাট বল দিয়ে ক্রিকেট খেলি আর নিজে সবজান্তা ভাব নিয়ে গাঁয়ের ছেলেদের কেমন করে ব্যাট ধরে বল পেটাতে হয় এসব শেখাই। বিকেল পেরিয়ে দিনের আলো ফুরিয়ে অন্ধকার নামলে সব ভাই বোন মিলে বারান্দার লম্বা টেবিলে বসে হারিকেনের আলোয় চিৎকার করে স্কুলের পড়া পড়ি আর টেবিলের নীচে হাত দিয়ে পায়ের উপর বসা মশা মারি।
একবার আমাদের গ্রাম চরইশ্বর থেকে হাতিয়া টাউনে বেড়াতে গেলাম সবাই মিলে মামার বাসায়। মামা রিটায়ার্ড ম্যাজিষ্ট্রেট মানুষ। গ্রামে থাকলেও টিনের ঘরবাড়ি অনেক আধুনিকভাবে সাজানো। আমরা যখন খাস আঞ্চলিক ভাষা ছাড়া আর কিছু বলি না – মামার বাসায় দেখি সবাই ব্যাকরণ মেনে শুদ্ধ বাংলা বলে। এক মামাতো ভাই যুদ্ধে গেছে। আরেক মামাতো ভাইকে পাকিস্তান আর্মি ধরে নিয়ে গিয়েছিল। অনেক কায়দা করে ছাড়াতে হয়েছে। এসব নিয়ে মামা পুরোদস্তুর ব্যস্ত এবং গর্বিত পিতার ভাব নিয়ে বাসার সামনের বাগানে পেতে রাখা ইজি চেয়ারে শুয়ে শুয়ে হুক্কা টানেন আর পাকিস্তানীদের গালমন্দ করতে থাকেন চোস্ত ইংরেজিতে।
কিশোর বয়সে আমার ধারনা ছিল না যে ঔ বাড়িতে আজ একটা বিশেষ অনুষ্ঠান হবে। মামাতো ভাই রাতুল ছিল আমার চাইতে সামান্য বড় আর আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই জামালের ছোট। তাই আমরা এই তিনজন নিজেদের ভিতর ‘তুই, তোকারি’ করে কথা বলতাম। আমি ঢাকা থেকে গ্রামে গিয়েছি। রাতুল বরাবর মফস্বল শহরে থাকে। তবুও তার ধারনা সে আমাদের চাইতে স্মার্ট। কারণ একটাই – সে খুব শুদ্ধ কথা বলে আর আমরা খাস আঞ্চলিক ‘চরুয়া’ ভাষায় কথা বলি।
বাসার পাশে খালি জায়গায় মাটি খুঁড়ে গর্ত করে তার পাশে ইট বসিয়ে লাকড়ি দিয়ে আগুন জ্বালাতে দেখে আমি রাতুলকে জিজ্ঞেস করলাম – ওখানে কেন আগুন জ্বালানো হচ্ছে।
রাতুল অবাক হয়ে বলল – কেন তোমরা জাননা নাকি, আজ তো আমার বার্থডে। তোমরা আমার জন্য বার্থডে গিফট আন নাই ?
আমি ভাবলাম সেটা আবার কি ! এই কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও হজম করে ফেললাম যেন ওর কাছে হাসির খোরাক না হই। আমি আমার ভাই জামালকে জিজ্ঞেস করলাম এই বার্থডেটা কি।
জামাল আমার কানে কানে বলে – আমিও জানি না। চুপ করে থাক, জেনে যাব।
বাইরে চুলা বানিয়ে বড় হাঁড়িতে রান্না হচ্ছিল যেন বিয়ে বাড়ি। ওদের বাসার লম্বা টানা বারান্দায় তার দিয়ে অনেকগুলি বাল্ব লাগিয়ে পুরো বারান্দা আলোয় ভরে ফেলা হল। সাত মাইলের দুরত্বে আমাদের গ্রামে তখন ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না। চেরাগ, হারিক্যান জ্বলত সবার ঘরে ঘরে। শুধু কোন বিশেষ আয়োজন হলে হ্যাজাক বাতি জ্বালানো হত। সাদা আলোর হ্যাজাক বাতি ধরানো আজও আমার কাছে এক বিশাল রহস্য হিসাবে রয়ে গেছে। যতবার জ্বালানো হত আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। হারিক্যানের মত চাইলেই যে কেউ হ্যাজাক বাতি জ্বালাতে পারত না। কেরামতি জানতে হত। নইলে সাদা ছোট্ট কাপড়ের পুটুলির মত দেখতে ম্যান্টেল পুড়ে ছাই হত আর নাহয় ফুস করে ফেটে যেত। কিন্তু একবার জ্বালাতে পারলে সারারাত ধরে জ্বলত। শুধু মাঝে মাঝে লিভার টেনে ফুটবলে হাওয়া দেয়ার মত করে বাতাস ভরতে হত।
আসল কথায় ফিরে যাই। আমাদের গ্রামে কারেন্ট না থাকলেও সাত মাইল দূরে হাতিয়া টাউনে ঝকঝকে বৈদ্যুতিক আলো ছিল। রাতের বেলাতেও সব কিছু দিনের মত ফকফকা লাগত। সেই আলোতে দেখি বারান্দায় বিয়েবাড়ির মত লাল নীল কাগজ কেটে লাগানো হয়েছে। অনেক বেলুন ফুলিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব আমি আগে কখনো দেখি নাই। টেবিলের উপর একটা কেইক এনে রাখা হল – তাতে লেখা “হ্যাপী বার্থডে টূ রাতুল।” তার উপর মোমবাতি বসানো হল। কেউ একজন ফস করে ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে মোম বাতি জ্বালিয়ে দিল। আমার কৌতুহল বেড়েই যাচ্ছে এই ভেবে এসব কি হচ্ছে। কিছুক্ষন পর সবাই এসে দাঁড়াল টেবিলের পাশে। রাতুল ফু দিয়ে মোম নিবিয়ে ছুরি দিয়ে কেইকের মাঝখানে কেটে দিল। মামা, মামী কেউকের টুকরা তুলে রাতুলের মুখে দিল। সবাই হাতেতালি দিল। কেইকের একটা টুকরা আমার ভাগেও এল অন্য সব মজার স্ন্যাকস এর সাথে।
আমার কেন এমন হয়না এসব ভাবতে ভাবতে আপন মনে কেইক খাচ্ছিলাম। রাতুল কাছে আমাকে জিজ্ঞেস করে বসে – মুরাদ, তোমার বার্থডে কবে ?
আমি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে অবলীলায় সত্যি কথা বলে দিলাম – আমি জানি না।
এই কথা শুনে সে ভীষন অবাক হয়ে খুব জোরে হেসে দিল। আর আমি তাতে খুব অপমানিত বোধ করলাম। মনে মনে দুঃখ লাগল মানুষের মা থাকলেই মনে হয় এসব বার্থডে ফার্থডে করে ছেলে মেয়েদের জন্য। আমার তো মা নাই, তাই আমার কিছু পালন হয় না।
পরদিন শুনলাম আমাদের দ্বীপে নাকি পাকিস্তান আর্মি আসতেছে। এই বাড়ির ছেলেরা যুদ্ধে গেছে সবাই জানে। তাই নিরাপদ নয়। দেরী না করে পরদিন আমরা হাতিয়া টাউন ছেড়ে আমাদের গ্রামে ফিরে গেলাম গরুর গাড়িতে করে। গরুর গাড়ির উপর ছাউনি দেয়া থাকত। সেই ছাউনির পেছন এবং সামনের দিক শাড়ি দিয়ে আটকে দেয়া হত পর্দার মত করে। তার ভিতর মেয়েরা বসত। ছেলেরা কেউ গাড়ির পেছন দিকে পর্দার বাইরে পা ঝুলিয়ে বসত কিংবা সামনের দিকে। সাত মাইলের রাস্তার পুরোটাই আমার ভাবনায় কোন যুদ্ধ ছিল না, ছিল আমার বার্থডে কবে, সেটা কেন পালন হয় না।
বাড়িতে এসে আমি একে একে সবাইকে জিজ্ঞেস করেও জানতে পারি নাই আমার জন্মদিন কবে, আমি কোন সালের কি মাসের কোন তারিখে জন্মেছিলাম। বাবাকে জিজ্ঞেস করার সাহস নাই। মা তো মরেই গেছে। বাকীরা কেউ এসব জানে না। আমার এক বোন আছে – রেজু বুজি। মায়ের সাথে নাকি অনেক খাতির ছিল। মায়ের অনেক গল্প আমি এই রেজু বুজির কাছ থেকেই শুনেছি। উনি আমাকে অনেক আদর করে। লেখাপড়া না করলেও ভাল বুদ্ধি রাখে মাথায়। অনেক কথা মনে রাখতে পারে।
একদিন ওনার গা ঘেঁষে বসে খুব আহলাদ করে জিজ্ঞেস করলাম, “ আইচ্চা বুজি, আন্নে ত বেজ্ঞিন মনে রাকেন। হেলে কন সেন আঁই কবে অইসি ? সন তারিক এগিন মনে আছে নী ?” ( আচ্ছা বুজি, আপনি তো সব মনে রাখেন। তাহলে বলেন তো দেখি ,আমি কবে হয়েছি। সন ,তারিখ এসব কি মনে আছে ? )
উনি খুব চিন্তা করে এভাবে জবাব দিল, “ হেই বছর খুব বইন্যা অইসিলো। তুফানের চোডে বেজ্ঞিন ওলড ফালড অই গেছে গৈ। বইন্যার কারণে ধান ক্ষেত ডুবি গেসে। ঘরের ভিত্তে বইন্যার হানি হান্দাই গেছে। এই তুফানের ভিত্তে ছোডাম্মার হ্যাডে বেদনা উইটসে। কাঞ্চার মা হু বালা ধাই আছিলো। বাইগ্য বালা হ্যাতেনে হেইদিন আঙ্গো বাইত আছিলো। কাঞ্চার মা হু’র হাতে তুঁই অইসো। তুফানের দিন অইসত হিয়াল্লাই ব্যাকে তঁরে তুফাইন্না কই বোলাইতো।” ( সেই বছর খুব বন্যা হয়েছিল। তুফানের চোটে সব কিছু ওলট পালট হয়ে গিয়েছিল। বন্যার পানিতে ধান ক্ষেত ডুবে গেছে। ঘরের ভিতর বন্যার পানি ঢুকে গেছে। এই তুফানের ভিতর ছোট’মার প্রসব বেদনা উঠে যায়। কাঞ্চনের মা ফুফু ভাল ধাত্রী ছিলেন। ভাগ্য ভাল সেদিন তিনি আমাদের বাড়িতে ছিলেন। সেই ফুফুর হাতেই তুই জন্মেছিলি। তুফানের দিন জন্ম নেয়ায় সবাই তোরে তুফাইন্না বলে ডাকত। )
উনি আমার জন্মের ইতিহাস বলে ফেললেও আমার জন্মতারিখ, সাল বলতে পারল না কিছুতেই। আমি যে তিমিরে ছিলাম সেখানেই রয়ে গেলাম।
অনেক বছর পরের কথা। নটরডেম কলেজে পড়ি তখন। এস,এস,সি পরীক্ষায় স্কুলের মাষ্টার মশাই আমার জন্ম তারিখ লিখে দিয়েছিল জানুয়ারীর এক তারিখ। সেটা নিয়েই জীবন কাটাচ্ছিলাম। একদিন বাবার একগাদা পুরনো ডাইরী দেখে কি লেখা আছে জানার খুব আগ্রহ হল। খুলে দেখি কোনটায় উর্দুতে লেখা যার এক বর্নও আমি পড়তে পারি নাই। আবার কিছু কিছু বাংলা, কিছু ইংরেজিতে লেখা আছে। জমিজমার বিষয়, কোন মিটিং এর বিষয় এসব লেখা। আবার কোনটায় পাতার পর পর পাতা ভরে কি সব ইতিহাস লেখা। আগ্রহ পেলাম না পড়ার।
এমন খুঁজতে খঁজতে একটা ডাইরিতে দেখি আমার নাম লেখা। পুরা নাম বিভিন্ন ভাষার সাথে ইংরেজিতেও লেখা। সেখানে দেখি আমার জন্মের সাল, মাস, তারিখ, জন্ম সময় এবং জন্মের পর কে আজান দিয়েছে দোতলায় দাঁড়িয়ে সেই কথাও লেখা আছে। দেখে মনে হল যেন হাতে সাতরাজার ধন পেয়েছি। বাবার কাছে নিজেকে খুব কৃতজ্ঞ মনে হল। কয়দিন আগেও যেই বাবাকে মনে হয়েছিল এসব ব্যাপারে কেয়ারলেস এখন তেমন ভাবার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হল। পরে একদিন সাহস করে বাবাকে জিজ্ঞেস করে বসলাম, বাবা আমার জন্ম তারিখ কবে ? বাবা কোন খাতা, ডাইরি এসব না দেখেই মুখস্থ ঠিক যেই তারিখ লেখা ছিল সেটা বলে দিল। একবার জিজ্ঞেস করতে মন চাইল, বাবা আরো ছোট বেলায় কেন আমাদেরকে আমাদের জন্মতারিখ জানানো হল না ? কিন্তু সাহসে কুলায় নাই। তারপর ভাবলাম, আসোলে জন্মতারিখের কোন প্রয়োজন পড়ে নাই কোথায় তাই হয়ত এটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নাই। আর জন্মদিন পালন এসব তো সেই যুগে বিরল ঘটনা ছিল।
যখন খুব সখ ছিল বেলুন ফাটিয়ে, মোম বাতি নিভিয়ে, গান গেয়ে কেইক কাটব, মানুষ আমার জন্য লাল নীল কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে অনেক খেলনা নিয়ে আসবে তখন এই সখ আমার পুরন হয় নাই। এখন আমার শুভাকাংখীরা যারা জানে, আমার ছেলেরা জন্মদিন এলে আমাকে উইশ করে, সারপ্রাইজ গিফট দেয় – ভাল লাগে, অবশ্যই ভাল লাগে। তবে শিহরন জাগে না আনন্দে। এই শিহরণ মনে হয় শুধু ছোট বেলাতেই হয়। তখন না পেলে বড় বেলাতে আর কোন কিছুতে মন ভরে না।
৩রা জানুয়ারী, ২০১৬