ব্যাংকক বিভীষিকা

সকাল দশটা বাজে। আটটায় আমরা তিন বন্ধু মিলে মর্নিং ওয়াক শেষ করে দেশী রেস্তরাঁয় নাশতা খেলাম রুটি, আলুভাজি, ডাল আর ডিমের অমলেট দিয়ে।
আর মাত্র দুই রাত বাকী। তারপর আমি চলে যাবো নিউইয়র্কে আর ওরা ঢাকায়।

আমেরিকায় থাকি আর চান্দের দেশে থাকি, শপিং ইজ এডিক্টিভ। স্বজনের এক্সপেকটেশন তো থাকেই। কিছু কিনে না নিলে বউ ছেলে সবাই গাল ফুলাবে। হোটেলের ক্যান্টিনে আরেক পশলা চা খেলাম। তারপর বের হলাম। প্ল্যান হল, ডলার ভাঙ্গাবো। তারপর শপিং এ বের হব। থাইল্যান্ডের শপিং মলগুলি খুব জোস।

ডলার ভাঙ্গাতে পারি নাই। তার আগেই এক লোক এপ্রোচ করে বসলো খুব বিনীতভাবে। চোস্ত ইংরেজিতে কথা বলল। বলে – তোমরা যদি কোথাও ঘুরতে যেতে চাও, তাইলে আমাকে নিতে পারো। আমার নতুন গাড়ী আছে। তাকিয়ে দেখি লাল রঙের নতুন একটা এস,ইউ,ভি। সবার আগে জাকির পটে গেল সুন্দর গাড়ি দেখে।

নিজের ক্যাটালগ বের করে দেখালো। বলে – চল তোমাদেরকে ফ্লোটিং মার্কেট দেখিয়ে আনি। আসতে যেতে ট্যাক্সি ভাড়া পাঁচশো বাত দেবে। আর ওখানে গেলে মাথাপিছু হাজার বাত করে খরচ হবে।

– সময় কতক্ষণ লাগবে। জিজ্ঞেস করলাম।

– আসতে যেতে দুই ঘণ্টা আর ওখানে যতক্ষণ লাগে আর কি।

ব্যবহার মানে ভাল ব্যবহার সবসময় আমাকে টানে। আমার ইচ্ছাতেই বন্ধুরা যেতে রাজী হয়ে গেল। শপিং এর কথা ভুলে আমরা ওর গাড়িতে চড়ে বসলাম।

চেহারা দেখে আমার মনে হয়েছে সে সিরিয়া’র মানুষ। যদিও সে দাবী করেছে সে বাই বর্ণ থাইল্যান্ডি। আমি বিশ্বাস করি নাই। আমার সিক্সথ সেন্স কেন জানি কখনো বেইমানী করে নাই আমার সাথে।

যাইহোক, গাড়ী ছুটছে ঝড়ের গতিতে। সে আমাদের সাথে চুটিয়ে গল্প করছে। বাংলাদেশের গল্প শুনতে চাইছে। আমরাও বোকার মত তাকে অসাধারণ একজন মানুষ ভেবে তার প্রশংসা করে যাচ্ছি। মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে সে দুই সন্তানকে থাইল্যান্ডে মানুষ করছে যার একজন নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী শেষ করার পথে আছে। শুনে তার প্রশংসায় আমরা পঞ্ছমুখ হলাম।

গাড়ী এয়ারপোর্ট এর পথ ছাড়িয়ে গেল। পথ অজানা লাগছে এবার। জিজ্ঞেস করলে বলে – পুকেত যাওয়ার পথের উপর এটি। মনে কোন সন্দেহ জাগে নাই। থাইল্যান্ডের মানুষের খুব ভক্ত আমি। কখনো খারাপ কিছু সন্দেহ করি না।

রওনা হওয়ার পর প্রায় দুই ঘণ্টা কেটে গেল। তখনো গাড়ী ছুটছে। এবার হাইওয়ে ছেড়ে লোকাল রাস্তায় গাড়ী। প্রায় জনমানবহীন রাস্তা। এতো নীরব তো হওয়ার কথা না। ট্যুরিস্ট স্পটে মানুষের ভিড় থাকবে। ট্যুরিষ্ট ভর্তি গাড়ী যেতে আসতে দেখবো। কিন্তু কিছু দেখলাম না।

জিজ্ঞেস করি – আর কতদূর ! সে বলে – আর পাঁচ মিনিট।

কিন্তু আধ ঘণ্টা পার হলেও তার পাঁচ মিনিট পথ শেষ হয় না। এবার আমার সন্দেহ হল। দেয়ার মাস্ট বি সামথিং রং হিয়ার। মনে হচ্ছে লোকটার কোন কুমতলব আছে।

জাকির ড্রাইভারের পাশে সিটে বসেছে। সে গ্রাম দেখে অভিভূত। সে কিছু টের পায় নাই। মুনির পেছনে আমার পাশে বসা। আমি ওকে বললাম – গোলমেলে লাগছে ব্যাপারটা।
সে সায় দিল।

বন্ধু বিহারে আমি অনেকবার গেছি। তখন গ্রুপে খোকা ছিল সবসময়। খোকা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। মেন্টর। গার্ডিয়ান এঞ্জেল। সে সাথে থাকলে সবার দেখ ভাল করে। সবকিছু সেটেল করে। বট গাছের মত আগলে রাখে সবাইকে। কারো কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হয় না।

এবার খোকা নাই সাথে। সেখানেই হয়েছে যত ঝামেলা। অনেক ভুল ভ্রান্তি হচ্ছে। খোকা দূরদর্শী মানুষ। ভুল করে কদাচিৎ। আমি ভুল করি দৈনিক।

যাইহোক, আমার মনে হয়েছে, হয়ত আমরা কোন বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছি। সাথে আছে জাকির। বেচারা একদম নিরীহ ভদ্রলোক। কিছু টের পাচ্ছে না। আর আছে মুনির। কলাবাগানের বাঘা ছেলে। সেও দেখি কিছু টের পায় নাই। টের পেলাম আমার মত একদম ছাপোষা মানুষটা।

আচমকা ড্রাইভারকে বললাম – শোন, আমাদের হাতে এত টাইম নাই আজ। তুমি গাড়ী ঘুরাও। আমাদেরকে শহরে ফিরিয়ে নাও। ঠিক এক ঘণ্টা পর ডাক্তারের এপয়েমট্মেন্ট আছে আমাদের। ওটা মিস করা যাবে না।

শুনে সে থতমত খেয়ে গেল। আমার হুকুমের ভিতর বোল্ডনেস ছিল। সে ইতস্থত করে বলে – তাইলে আমার তেলের পয়সা কে দিবে ?

বললাম – আমি দিবো। তুমি ফিরে যাও।

আমি এমনিতে ভীষণ মাথা গরম মানুষ। গরম হয়ে সব এলোমেলো করে ফেলি। কিন্তু অবাক কাণ্ড হল, আজ একটুও উত্তেজিত হই নাই। খুব ঠাণ্ডা মাথায় ওকে হুকুম দিলাম। বললাম – এখুনি গাড়ী ঘুরিয়ে কোন সেভেন এলেভেন এ থামাও। পানি খাবো।

মনে মনে আমার প্ল্যান হল, সে গাড়ী ঘুরাতে রাজী না হলে পেছনের সিট থেকে তার গলা টিপে ধরবো। তারপর যা হওয়ার হবে। মুনিরকে সেইরকম ইশারা দিলাম। সে রাজী হল।
লোকটা ভয় পেলো। সে অনিচ্ছায় হলেও গাড়ী ঘুরাল। এবার আর গল্প করছে না। চুপচাপ গাড়ী চালাতে লাগলো।

আমি খোকাকে ঢাকায় ফোন করে সব জানালাম। সে বলে – পুলিশ কল কর।

কেমন করে কোন নাম্বারে কল করতে হবে সেটা তো আগে জেনে রাখি নাই। তাছাড়া এই দেশে মানুষ খুব কম ইংরেজী জানে। সেই কাজে না গিয়ে ফোনের জিপিএসে তাকে ফলো করতে থাকলাম সে ঠিকমত আমাদেরকে ব্যাংকক শহরে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কিনা।

হ্যাঁ তা যাচ্ছে। তবুও আমি খুশী হতে পারছিলাম না হোটেলে পৌঁছানো পর্যন্ত। ড্রাইভার লোকটা আর কথা বলছে না। আমরাও কিছু বলছি না। এক পর্যায়ে সে গ্যাস স্টেশনে গাড়ি থামিয়ে বলে – গ্যাস নিতে হবে। এক হাজার বাত দাও।

আমি তাকে পাঁচশো দিয়ে বললাম – বাকিটা পরে পাবে। এবার সোজা আমাদের হোটেলে যাও।

এখনো আমি রাগ করছি না। ইনফ্যাক্ট ভয়ে রাগ হচ্ছি না – যদি হিতে বিপরীত হয়ে যায়।

সে মহা বিরক্ত হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। আমি হাতের ফোন উঠিয়ে ভাব নিলাম কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তাকে শুনিয়ে বললাম – আমরা আর কিছুক্ষণের ভিতর বারমুংরাদ হাসপাতালের গেইটে পৌঁছে যাবো। না পৌঁছুলে পুলিশে খবর দিও।

শুনে সে সত্যি ভড়কে গেল। বুঝে ফেললো – আমরা কোন নিরীহ ট্যুরিস্ট না। বড় ত্যাঁদড় মানুষ। গাড়িতে উঠার প্রায় চার ঘণ্টা পর সে আমাদেরকে আমাদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলো।

তাকে প্রতিজ্ঞা করা টাকা দিয়ে আমি কড়া ভাষায় শুধু বললাম – তুমি কাজটা ভাল করো নাই। তুমি একটা প্রতারক। আর কারো সাথে অমন কইরো না। ভাল হয়ে যাও। তোমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু মাফ করে দিলাম এই যাত্রা। – বলে চলে এলাম।

আমরা আজ সত্যি ভয়ে পেয়েছিলাম। খুব খারাপ কিছু ঘটতে পারতো। কপাল গুনে বেঁচে গেলাম।

সত্যিকারের থাই মানুষেরা এমন বদ হয় না কখনো। লোকটা নিজেকে থাই বলে দাবী করলেও আসোলে সে সিরিয়ান বংশোদ্ভূত অনেক বড় এক প্রতারক।

আজ আবার শিখলাম, জানলাম – বিদেশে হোটেলের গাইড ছাড়া কখনো রাস্তার কারো হেল্প নিতে হয় না চালাকি করে। পয়সা বাঁচাতে গেলেও বড় বিপদে পড়ে যেতে হয়। অতি চালাকের গলায় দড়ি তো পড়বেই।

বিদেশ ভ্রমণে একা নয়, শুধু নিজের পরিবার নিয়ে নয় – সাইট সিইং করতে গেলে একটা বড় দলের সাথে থাকা নিরাপদ। অপরিচিত মানুষের প্ররোচনায় না পড়ে, পয়সা বেশী লাগলেও হোটেলের নির্দেশিত ট্যুর গাইড ব্যবহার করা সবচেয়ে নিরাপদ।

মনে রাখলেই মঙ্গল। নইলে কপালে শনির দশা নেমে আসলেও আসতে পারে।

২৭শে নভেম্বর, ২০১৮