ড্রাইভিং এর আতঙ্ক

প্রবাস জীবনের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক হল বৈধ কাগজ ছাড়া থাকা। আমার আরেকটা আতঙ্ক ছিল, সেটা হল গাড়ী চালানো। প্রবাসে এসে দেখি আমার আগে আসা সব বন্ধুরা গাড়ি চালাতে পারে। তাদের ভিতর শুধু মাশুক দেশে গাড়ি চালাতো।

আমি গাড়ি তো দূরে থাক, কোন দিন বাইসাইকেলও চালাই নাই জীবনে। কলেজে পড়ার সময় মতিঝিল কলোনীর বন্ধু কামাল ৫০ সিসি হোন্ডা বাইক কিনে আনলো। সব বন্ধুরা ওটা নিয়ে একবার করে চক্কর মেরে আসলো। এরপর আমি যখন ট্রাই করতে গেলাম, ডান হাত দিয়ে পিকআপ বাড়াতেই হোন্ডা আমাকে ফেলে উপর দিকে লাফ দিলো আর আমারও হোন্ডা চালানোর ইতি ঘটলো।

যখন অনেক পিচ্চি ছিলাম, মনে আছে আমাদের একটা নীল রঙের ফিয়াট গাড়ি ছিল। ওটা সব সময় বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। ওই গাড়িতে পরিবারের অন্য সবার সাথে একসাথে বেড়াতে যাবার কোন স্মৃতি আমার নাই। শুধু মনে আছে সকাল বেলায় বাবা যখন পার্লামেন্টে যাবার জন্য গাড়িতে চড়তে যেতো, তখন আমি আর ছোটভাই আজাদ গাড়ির পাশে করুন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দাঁড়ায়ে থাকতাম। বাবার সাথে চোখাচোখি হলে মাঝে মাঝে আমাদেরকে বাসার কাপড় পড়া অবস্থাতে গাড়িতে তুলে নিতো। তখন আমাদের সে কি আনন্দ হত। বনানী থেকে নাখালপাড়ার পুরাতন সংসদ ভবনের দুরত্ব খুব কম ছিল। চোখের পলকে গাড়ি ওখানে পৌছে যেত আর আমাদের মন খারাপ হয়ে যেতো।

কখনো কখনো বাবা ড্রাইভারএর সাথে আমাদেরকে গাড়িতে বসিয়ে রাখতো। যেদিন বেশি দেরি হতো, সেদিন বাসায় পাঠিয়ে দিতো।

মাঝে মাঝে বায়তুল মোকাররমে যেতাম বাবার সাথে, নইলে ঠাটারি বাজারে মাছ মাংশ কেনার জন্য। কিন্তু কখনো গাড়ি থেকে নামার অনুমতি ছিল না। সব সময় গাড়িতে বসে থাকতে হত।

মনে আছে একবার খুব ভয় পেয়েছিলাম। সন্ধার সময় বাবা ঈদের বাজার করতে আমাদেরক গাড়িতে বসিয়ে ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে সেই যে বাজারের ভিতর ঢূকেছে আর ফেরার নাম নাই। বাইরে তাকিয়ে দেখি বাজারে মাংশের দোকানে লোহার হুক দিয়ে গরু খাশীর মাংশের বড় বড় টুকরা ঝুলিয়ে রেখেছে। কসাই গাছের গুড়ির উপর মাংশের টুকরা রেখে বড় ছুরি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে কাটছে। মাত্র কয়দিন আগে বাসায় কেউ একজন গল্প শুনিয়েছে ছেলে ধরারা আমাদের মত ছোট ছেলে মেয়েদের ধরে বস্তায় ঢুকিয়ে নিয়ে যায়। তারপর কুপিয়ে মেরে ফেলে। সেই থেকে ছেলেধরার ভয় সবসময় মাথায় থাকতো।

বাজারে মাংশ কাটার দৃশ্য আর আশেপাশের মানুষের আমাদের দিকে তাকানো দেখে আমরা ভেবেছি ওরা সব ছেলেধরা। এখন আমাদের ধরে বস্তায় ঢোকাবে তারপর কেটে ওভাবে হুক দিয়ে ঝুলিয়ে বিক্রি করবে। এই ভেবে আমরা দুই ভাই ভয়ে কাঁদা শুরু করে দিলাম। জানালার কাঁচ নামানো ছিলো। রা্স্তার মানুষেরা সহানুভুতি দেখিয়ে কথা বলতে চাইলে আমরা ভয়ে আরো জোরে কাঁদা আরম্ভ করলাম। একটু পরে বাবা ফিরে এলো ড্রাইভার আর কুলির মাথায় অনেক বাজার নিয়ে। বাবাকে দেখে কান্না বন্ধ হয়ে গেলো।

দেশে আমি শুধু গাড়িতে চড়েছি কিন্তু কখনো গাড়ি চালানো শেখার আগ্রহ হয় নাই।

বাইরে এসেও অনেক বছর বন্ধুদের গাড়িতে রাইড নিয়ে অনেক বছর কাটিয়ে দিয়েছি। এক সময় দেখা গেলো আমার পরিচিত মহলে আমি ছাড়া সকল আদম সন্তান গাড়ি চালায়।

গাড়ি চালাতে পারি না তাই আমাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করে বন্ধু, বন্ধুর স্ত্রীরা। এমন কি অপরিচিত মানুষেরাও আমার গাড়ি চালাতে না পারা নিয়ে ভ্রু কুঁচকাতে শুরু করলো। ভাবটা এমন যেন গাড়ি চালাতে না পেরে আমি একদম খ্যাঁত রয়ে গেলাম আর কি ! গাড়ি চালানোর ভীতির কারনে প্রথমে গায়ে না মাখলেও অবশেষে এই অপারগতা আমার ইগোতে লাগতে শুরু করলো।

প্রবাস জীবনে গাড়ি চালাতে জানা এবং গাড়ি থাকা বলা যায় একরকম বাধ্যতামূলক ব্যাপার। আমিই মনে হয় একমাত্র ব্যাক্তি হব যে কিনা প্রায় দশ বছর কেটে যাবার পর ভীতিকে উপেক্ষা করার কথা ভাবতে শুরু করলাম। অবশেষে, বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝে ওদের গাড়ি নিয়ে এক আধটু প্র্যাকটিস করতে লাগলাম। পরে একজন বাঙ্গালী ইন্সট্রাক্টর খুজে বের করলাম। লেসন নেয়া শুরু করে দেখলাম গাড়ি চালানো যত কঠিন ভেবেছিলাম আসোলে ব্যাপারটা অত কঠিন নয়।

একই মানুষের কাছে ঐ সময়ে লেসন নিচ্ছিলাম আমি, শেফালী, আমার বাসার ভাড়াটে ফারুক ভাই। লেসনের সময় প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া ছাড়াও অনেক বেশি কথা বলতো নোয়াখালীর মানুষ জহির। কে কেমন শিখছে সেই গল্পও বলতো। জিজ্ঞেস করতাম, আমার স্ত্রী কেমন চালাতে পারছে ?

উনি হেসে এভাবে বলতো – বুইজ্জেন নি, বাবী জেন্নে স্টিয়ারিং ঘুরায়, লাগে জেন হ্যাতেনে গাড়ি ন, হানিত নৌকা ছালার।

ফারুক ভাই আমার আগে লেসন নেয়া শুরু করেছে, তাই ওনার রোড টেস্ট আমার আগে হওয়ার কথা। জহির সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম ফারুক ভাইএর রোড টেস্ট কবে হবে। শুনে উনি হেসে দিয়ে বলে – ফারুক ভাই তো ফেল মাইচ্ছে, কিন্তু আন্নেরে কইতে না কইচ্ছে আঁরে।

আমিও ফারুক ভাইকে দেখে বলতাম, ফারুক ভাই আপনি যে রোড টেস্ট এ পাশ করেন নাই, এটা জহির আমাকে বলে নাই। শুনে উনি হো হো করে হেসে দিতেন।

দ্বিতীয়বারে রোড টেস্টে পাশ করে লাইসেন্স পেলাম। আহা, মনে হলো বিশাল একটা লটারি জিতে গেলাম আর কি। লাইসেন্স পেয়ে গাড়ি কিনলাম। কিন্তু আমি শুধু লোকাল রাস্তা গুলিতে চালাই। হাইওয়েতে চালানোর সাহস হয় না। চালানোর কথা ভাবতেই পারি না। জহির সাহেব আমাকে ২/১ দিন হাইওয়েতে নিয়ে চালাতে দিলেও আমি শুধু সামনে তাকিয়ে এক লেইনে গাড়ি চালিয়ে যেতাম। লেইন চেঞ্জ করতে বললে মনে হত যেন আমাকে ফুলসিরাতের করাতের সেতু পার হতে বলতেছে। কারন ৪০/৫০ মাইল বেগে চালাতে গেলে আমি আর ডানে বামে কিংবা সাইড মিররে তাকাতেও ভয় পেতাম।

জহির সাহেব তো লাইসেন্স পাইয়ে দিয়ে কাজ শেষ করেছে। আমি শুধু আশেপাশের রাস্তায় চালাই। হাইওয়েতে চালিয়ে দূরে কোথাও যাওয়ার কথা চিন্তাও করি না। তখন একদিন আমার এক বন্ধু আমাকে নিয়ে হাইওয়েতে নামলো।

আমি ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি চালাচ্ছি। দুপুরবেলা তাই হাইওয়েতে গাড়ি মোটামুটি কম।

বন্ধু আমাকে বলছে – স্পীড বাড়া, আরো বাড়া।

আমি সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে গ্যাস পেডাল চেপে যাচ্ছি। আশেপাশে কিংবা স্পীড মিটারের দিকে তাকানোর সাহস নাই। মনে হচ্ছিল যেন আমি এক মহা সমুদ্রে আছি। এখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোন উপায় নাই। সাহস করে একবার তাকিয়ে দেখি গাড়ির স্পীড ৮০ মাইল ছাড়িয়ে গেছে। দেখে বুকের ভিতর ধুকপুক করতে শুরু করলো।

এই অবস্থায় বন্ধু আমাকে বলে, এবার রাইট লেইনে যা।

শুনেই আমারে পেটে কামড় দিয়ে উঠলো, ঠিক যেমন হয়েছিল এস,এস,সি পরীক্ষার সময় অঙ্ক পরীক্ষার দিন প্রশ্ন হাতে পেয়ে।

এত জোরে গাড়ি চলছে, আর আমারে কইতেছে লেইন চেঞ্জ করতে। এর চেয়ে নদীতে ঝাঁপ দিতে বল্লেও মনে হয় সহজ হত।

ব্যাপারটা তখন এমন হয়েছিল। আমি সাইড মিররে তাকাতে ভয় পাচ্ছিলাম পাছে গাড়ি লেইনের বাইরে গিয়ে অন্য গাড়িতে ধাক্কা খা। বন্ধু পিছনে তাকিয়ে দেখে নিয়ে বলে – লেইন ফাঁকা আছে। এবার যা। যা যা এবার যা।

আমি মিররে না তাকয়ে অত স্পীডে একটু হেসিটেট করে লেইন চেঞ্জ করতে গেলাম। লেইনে প্রায় অর্ধেক ঢুকে পড়েছি, কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। পিছন থেকে কেউ হর্ন দিয়ে উঠলো। আমি ভয় পেলাম। বন্ধু বলে উঠলো, না, না এখন আর যাইস না।

কি আজব ! আমি অর্ধেক ঢুকেও আবার লেইনে ফিরে আসলাম। হাত কেঁপে যাওয়ায় আশেপাশের গাড়ি ভয় পেয়ে পাশ থেকে হর্ন দিয়ে সরে যেতে থাকলো। আর আমার তখন ইছা করছিলো অত ব্যাস্ত হাইওয়ের মাঝখানে ব্রেক চেপে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে যেতে। বন্ধুকে বললাম, আমি আর চালাতে পারব না, তুই চালা। শুনে সে বলে, আরে, এখন কেমন করে চালাবো, তুই চালিয়ে আগে কোন একজিটে বের হ।

তারপর অনেকদিন আমি আর ভয়ে হাইওয়েতে যাই নাই। এরপরও অনেকদিন লেগেছে আমার এই হাইওয়ে ভীতি কাটতে।

নিজ দেশের বাইরে ভিন দেশে থেকেও কোন কিছুতে ভয় ভীতি লাগে নাই কখনো। শুধু শুরুর জীবনে ইমিগ্রেশন পুলিশ পরবর্তিতে হাইওয়েতে গাড়ি চালানো ছাড়া।

কিন্তু আজকাল ভয় পাই সন্ধার পর বাসার পিছনে শিয়ালের মত দেখতে রেক্কুন দেখলে।

ধুর ধুর করে মুখ দিয়ে আওয়াজ করলেও ভয় পায়না রেক্কুন। কেমন যেনো চোখে চোখে তাকিয়ে দেখে। তাই দেখে আমার শিরদাঁড়া ভয়ে শির শির করে উঠে। আমি আর বেশি সাহস না দেখিয়ে পিছু হেটে ঘরে ঢুকে যাই ।

৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪