বেলালের কথা মনে পড়ে
রবিবার সকাল। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বাসার সবাই নাক ডেকে ঘুমায়। আমি কাজ করি রবিবারে। সেজন্য কোন দুঃখ নাই। বরং আমার খুব ভালো লাগে রবিবারে কাজে যেতে। ছুটির দিন হওয়াতে রাস্তাঘাট, শহর, চুপচাপ নিরিবিলি থাকে। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম থাকে না। খুব আরামে গাড়ি চালানো যায়। পার্কিং পেতে ঝক্কি নাই।
আজকের রবিবার একটু ভিন্ন। সকালে উঠে দেখি বৃষ্টি হচ্ছে। সেটা কোন মাথাব্যথা নয়। নিজের নাস্তা নিজে বানিয়ে খেয়ে রেডি হয়ে বের হয়ে পড়লাম। আমার প্রিয় সিসেমি সিড দেয়া বেগেল আর বাবাগনেশ সাথে এক কাপ চা আমার নাস্তা।
এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে ব্যাগ নিয়ে দরজার বাইরে পা দিয়ে ঝামেলা বাধিয়ে ফেলছিলাম প্রায়। বুঝতে পারি নাই দরজার বাইরে পড়া বৃষ্টির পানি জমে ‘ব্ল্যাক আইস’ মানে কাঁচের মত স্বচ্ছ বরফ জমে সব পিচ্ছিল হয়ে আছে। মাথায় এই চিন্তা ছিল না। তাই পা ফেলেই স্লাইড করার মত কয়েক ফুট চলে গেলাম। তারপর পার্থপ্রতিম মজুমদার (আমাদের সময়ের বিখ্যাত মূকাভিনেতা) এর মত আচমকা ব্রেক করে থামার চেষ্টা করলাম। কোন রকমে পাশের রেলিং ধরে স্লাইডিং থামালাম। তারপর পার্থ’র মত এক পা তুলে একটুও না নড়ে পিছনে হটতে শুরু করলাম।
যাইহোক এ যাত্রা পিছলে পড়ে গিয়ে কোমর ভাঙ্গা থেকে কোনো রকম রক্ষা পেয়ে পা টিপে টিপে গাড়িতে ঢুকে পড়লাম। কাল রাতের টেম্পারেচার অনেক কম থাকায় রাতের বৃষ্টির পানি জমে ব্ল্যাক আইস হয়েছে। রেডিও চালাতেই শুনলাম বলছে রাস্তা ঘাট খুব পিচ্ছিল হয়ে আচ্ছে। খুব প্রয়োজন না হলে গাড়ি চালাতে নিষেধ করছে। আমি বিসমিল্লাহ বলে বের হয়ে পড়লাম। হাইওয়ে ফাঁকা পেলাম মোটামুটি। শুধু কিছু বেশি সাবধানী মানুষ খুব বেশি রকম আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিল। আসলে বৃষ্টির কারণে সামনের ভিজিবিলিটি খুব কমে যায়।
ঝামেলা বেধে গেল শহরমুখী টানেল বন্ধ করে দেয়াতে সব গাড়ি ব্রিজে উঠার জন্য লাইন দেয়ায়। পনের মিনিটের রাস্তা দুই ঘন্টা লেগে গেল। পিঁপড়ার মত এগুতে এগুতে আর রবি বাবু’র সেতার শুনতে শুনতে ঘুম চলে আসলো চোখে। ঠিক তখুনি মনে পড়ল বেলাল এর কথা।
বেলাল হলো ঢাকায় আমার বড় ভাই’এর বাসার বহু বছরের পুরনো বিশ্বস্ত ড্রাইভার। ঢাকায় গেলে বাসায় দুইটা গাড়ি, দুইজন ড্রাইভার থাকলেও আমি শুধু বেলালকে প্রেফার করি।
বন্ধুরা, বোনেরা সবাই গাড়ি দিতে চায়। কিন্তু আমি বেলালের সাথে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। কারণ অনেক বছরের পুরনো ড্রাইভার হওয়ায় বেলালের সাথে আমার রাস্তায় চলাচলের ব্যাপারটা ক্লিক করে গেছে।
বেলাল আমার যাওয়ার জায়গাগুলি সব চেনে। শুধু শান্তিবাগ বললে বুঝে নেয় খালার বাসায় যাব। কিংবা যদি বলি বারিধারা, তাহলে ঠিক বুঝে নেয় আমি বন্ধু তাহেরের বাসায় আড্ডা মারতে যেতে চাচ্ছি।
রাস্তায় যত ট্রাফিক হোক, আমার ফিরতে যত দেরি হোক – বেলালের কোনো কমপ্লেইন নাই।
আমি যেখানে যাই, যা’ই খাব, সেসব বাসার মানুষদের বলে দেই – আমার ড্রাইভারকে আগে খাওয়া পাঠাও। এবং প্রতিবার বাইরে ঘুরে বাসায় ফিরলে কিংবা কোথাও নেমে গাড়ি ছেড়ে দিলে সেটা পাঁচ মিনিট হোক আর পাঁচ ঘন্টা হোক বেলাল আমার কাছ থেকে একশ টাকার একটা নোট পাবে। নোটটা হাতে পাওয়ার পর বেলালের চেহারাটা একদম শিশুর মত হয়ে যায় আনন্দে।
যদিও মুখে বলে – লাগবে না চাচা। এত দেন কেন !
কিন্তু দেরী না করে সাথে সাথে হাত বাড়াতে ভুল করে না।
গাড়িতে আমি ব্যাগ, মোবাইল, ক্যামেরা ফেলে গেলেও কোন কিছুর নড়চড় হয়না। শুধু কিছু কেনার জন্য টাকা দিলে সবসময় চেইঞ্জ ফেরত দিতে ভুলে যায়। সেটা একশ হোক, আর পাচশো হোক। না চাইলে ফেরত দিবে না। জিগ্গেস করলে সেই হাসি দিয়ে বলে – ওহ ভুলে গেসিলাম।
রাস্তায় অনেক বেশি ট্রাফিক হলে আমি অনেক সময় গাড়িতে ঘুমিয়ে যাই। বেলাল জায়গা মত পৌঁছেও সহজে আমাকে ডাকে না, পাছে আমার ডিস্টার্ব হয়। চুপচাপ বসে থাকবে গাড়ির এসি চালিয়ে রেখে।
ঢাকার রাস্তায় কিলবিল করা ট্রাফিকের ভিতর গাড়িতে একটা আঁচড় না লাগিয়ে খুব সুন্দর গাড়ি চালিয়ে জায়গা মত পৌঁছে যায়। আমাকে দিয়ে এই কাজ কোনদিন সম্ভব হবে না। কেউ ওভারটেক করলেও বেলাল উত্তেজিত হয়্না। একদম ঠান্ডা মাথার মানুষ।
আমার প্রিয় বন্ধু খোকাকে দেখেছি কেউ ওভারটেক করলে তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। সেও একে ওকে ওভারটেক করে ওই গাড়ির পাশে পৌছাবে। তারপর গাড়ির গ্লাস নামিয়ে চিল্লাচিল্লি করবে। যদি অন্য গাড়ির ড্রাইভার বা আরোহী কেউ উল্টাপাল্টা জবাব দেয় তাহলেই হলো। খোকা সোজা ড্যাসবোর্ড ড্রয়ার থেকে তার রিভলবার বের করে ওটা তাক করে বলবে – আর একটা কথা কৈলে খুলি ফুটা কইরা ফালামু। আমার তো ভয়ের চোটে চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে যায়। আমি খোকারে থামানোর চেষ্টা করি – তোর কি মাথা খারাপ, তুই কি এখনো পোলাপাইন নাকি ? যদি অন্য গাড়ির বেটার কাছে আরো বড় বন্দুক থাকে তখন কি করবি, কিংবা যদি কোনো বড় মাস্তান হয়, তাহলে তো তোরে খবর কইরা দিব। খোকা এসবে থোড়াই পরোয়া করে।
কিন্তু বেলাল এমন করে না। পাবনার মানুষ সে। অনেক কুল থাকে যে কোনো পরিস্থিতিতে।
একবার বারিধারা থেকে আড্ডা মেরে রাতের বেলায় প্রগতি স্বরণী দিয়ে খিলগাঁও শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছি। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা ছিল। বেলাল মিয়া গ্যাস পেডালে পা দাবায়ে দিল। হটাৎ দেখলাম ময়দার বস্তার মত বিশাল কিছু গাড়ির বনেটের সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল। বেলাল একটু থতমত খেয়ে পালানোর পায়্তারা করছিল। আমি নিষেধ করলাম যেতে। তার আগেই দেখি চারিদিক থেকে ঝড়ের মত মানুষ এসে গাড়ি ঘিরে ফেলল। বুঝে ফেললাম আজ কপালে দুঃখ আছে। শেষ পর্যন্ত রাস্তার মানুষের গণপিটুনি খেয়ে মরতে হবে।
কল্পনার চোখে দেখলাম, আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে কেউ ঘুসি মারতেছে। কেউ লাথি মারতেছে। আমার নাক চোখ ফেটে রক্ত ঝরছে। আমি করুণভাবে বলতেছি – ভাই, আমারে জানে মাইরেন না। আমার একটা বউ আর দুইডা ছাওআল আছে। আমারে মাইরা ফালাইলে অরা এতিম অয়া যাইবো।
বেলালের অবস্থা আরো খারাপ কল্পনা করলাম। দেখলাম ওরে রাস্তায় ফেলে মানুষ ওর ভুড়ির উপর লাফাচ্ছে। পেট ফেটে নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে গেছে। রাস্তার কুকুর সেসব টেনে টেনে খাচ্ছে কাড়াকাড়ি করে। তারপর পুলিশ আসলো। আমাকে গণ পিটুনির হাত থেকে উদ্ধার করে গাড়িতে উঠিয়ে জিগ্যেস করলো – বাসা কোথায়? অবলীলায় বলে ফেললাম – ভাই আমি আমেরিকায় থাকি। বেড়াতে এসেছি দেশে। বন্ধুর বাসায় জুয়া খেলে ত্রিশ টাকা জিতেছি। আপনি চাইলে নিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু আমাকে থানায় নিয়েন না।
বেলালের ডাকে হুঁশ ফিরে এলো। বেলাল বলে – আপনি চুপ করে গাড়িতে বসে থাকেন। আমি কথা বলতেছি। এই বলে বেলাল গাড়ি থেকে নেমে গেল।
হটাৎ রাস্তার আইল্যান্ড থেকে লাফ দিয়ে নামা মানুষটা ছিল একজন মাঝবয়সী মহিলা। গাড়ির ধাক্কা খেয়ে সাথে সাথে উঠে দাড়িয়ে রাস্তার পাশে চলে গেছে।
কিন্তু রাস্তার মানুষেরা খুব দরদী হয়ে অনেক ক্ষতিপুরণ দাবি করা শুরু করলো। বুঝলাম মহিলা যা পাবে, এরাও তাতে ভাগ বসবে। কিন্তু তাতে আমার কি, কোনমতে আমার এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পেলেই হল।
বেলাল ওদের সাথে কথা বলে এসে আমাকে বলল – ওরা পাঁচ হাজার টাকা চায়। আপনি তিন হাজার দেন, তাহলেই হবে। টাকা দিলাম।
বেলালকে বললাম – বেলাল, ওই মহিলাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত।
বেলাল হেসে বলে – লাগবে না। উনি সাধারণ কেউ নয়। ওনারা সংঘবদ্ধ দল। এটাই এদের ব্যবসা। রাস্তা ফাঁকা ছিল, আমি চলে যেতে পারতাম। কিন্তু আপনি যেতে দিলেন না।
আমি বললাম – কিন্তু এটা তো কোনো নিয়মের কথা হলো না। উনি একজন ভালো মানুষও হতে পারত।
বেলাল জানালো, ঢাকা শহরে কিছু মানুষ এসব করেই পেট চালায়। কারো কিছু করার নাই। এদের অল্প দিয়ে বাঁচা যায়। কিন্তু পুলিশ ধরলে অনেক ঝামেলা, অনেক টাকা লাগে।
বুঝলাম, বেলালরা দেশের রাস্তার সব কিছু জানে। সব বুঝে। ওদের কিছু হয় না। ওরা যাদের চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়, সেই সব সাহেবরা শুধুই তাগাদা দেয়, সবাইকে পাশ কাটিয়ে নিয়ম ভেঙ্গে তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌছাতে। আমরা বিদেশ থেকে দেশে বেড়াতে যাই, তাদের কাছে এত নিয়ম ভঙ্গ দেখে অস্বাভাবিক লাগে, অস্থির লাগে। কিন্তু এক সময় সয়ে যায়।
আজ এই বিরূপ ওয়েদারে গাড়ি চালাতে গিয়ে বেলালের কথা খুব মনে পড়ছিল। ভাবছিলাম, আহা বেলাল যদি থাকত তাহলে আমি কি আরামে গাড়ির পিছনে বসে ঘুমাতে পারতাম ননীর পুতুলের মত। নইলে আইফোনে ফেইসবুক ব্রাউজ করতে পারতাম। পরে আবার মনে হলো, না আমি যেমন আছি সেটাই ভালো।
এত ট্রাফিক ছিল আজ, কিন্তু কারো কোনো হর্ন দেয়া শুনি নাই। কেউ অধৈর্য হয় নাই। নিয়ম ভাঙ্গে নাই। হয়্ত মনে মনে বিরক্ত হয়েছি, কিন্তু অন্যের দেখাদেখি আমিও বিরক্তি চেপে রেখেছি। এমন কোনো ক্ষতি তো হয়নি।
১৮ জানুয়ারী, ২০১৫