চীন সফর

একচল্লিশ বছর পর স্কুলের বন্ধু খাইরুলের সাথে দেখা হল তার বর্তমান ঠিকানা চীন দেশে। ওর দেশে ওর দাওয়াতে বেড়াতে গেছিলাম ২০১৬ এর নভেম্বরে। গুছানো না হলেও চীনে সেই কদিনের ভ্রমণের গল্প লেখার ইচ্ছা হল।

প্রায় সব দেশ তাদের সীমান্তে কাঁটাতারের নিরাপত্তা বেড়া দেয় মানুষের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে। নিজ দেশে বেড়া থাকলেও মানুষের কাফেলার অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না, তাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্তে উঁচা ওয়াল বানাতে চাইছে। এছাড়া প্রতিদিন হাজার হাজার অবৈধ অভিবাসী এবং মাদক কালোবাজারীর অনুপ্রবেশ ঠেকানোর আর কোন উপায় নাই। শুধু টাকার অভাবে বানাতে পারছে না।

ট্রাম্পের ওয়াল বানানোর প্রস্তাব শুনে সবাই ছি ছি করে, অথচ চীনের গ্রেট ওয়াল দেখতে যায় প্লেনের টিকেট কেটে। সেই গ্রেটওয়াল আবার দুনিয়ার সপ্তম আশ্চর্যের একটা।
গ্রেট ওয়াল বানানোর পেছনের কারণ একদম শুভ কিছু ছিল না। প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা মনে হলেও বাস্তবে অন্যের সীমানার অংশ নিজের দাবী করে জবরদখল করাও এই ওয়াল বানানোর একটা কারন ছিল বলে আমার মনে হয়েছে।

চীন দেশের প্রথম রাজা কুইন শী হুয়াং চীন-মঙ্গোলিয়ার সীমান্তে তের হাজার মাইল লম্বা গ্রেট ওয়াল বানানোর কাজের সূচনা করে। তারপরের অনেক রাজা সেই নির্মাণ কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।

বিখ্যাত মঙ্গল রাজা চেঙ্গিস খানের অপ্রতিরোধ্য সেনাবাহিনীকে ঠেকাতে এই ওয়াল দারুণ ইফেক্টিভ একটা কৌশল ছিল। নিজের চোখে দেখার পর পাহাড়ের উপর বানানো ওয়ালের কার্যকারিতার আলামত দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি।

চীন ভ্রমণ করতে এলাম, আর সপ্তাম আশ্চর্যের একটা না দেখে চলে যাব তা কি হয় নাকি ! না, শুধু দুর থেকে দেখে আর টেলিফটো লেন্সের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে চলে আসি নাই। আমার হাঁটুর জোর কেমন আছে, কতটুকু লোড নিতে পারে, সেটা তো প্রমাণ হওয়া দরকার। তাই ওয়ালের উপর উঠেছি পায়ে হেঁটে। সিঁড়ি বেয়ে। পথ একদম মসৃণ না, বরং বুড়ো হাড্ডির হাঁটু আর চশমা পরা কানা মানুষের জন্য মারাত্বক বিপদজনক অভিযান ছিল সেটি।

ট্যুর বাসে যাই নাই। কোন গাইড নেই নাই। বন্ধু খাইরুল তিন যুগের বেশী সময় ধরে সেই দেশে অবস্থান করেও একবার সেই ওয়ালে উঠে নাই। তবে এবার সে ওয়ালের পাদদেশ পর্যন্ত আমাকে সঙ্গ দিয়েছে।

গনপরিবহনে চড়ে যাতায়াত করা একদম সহজ ব্যাপার। আমার খুব ভাল লাগে। আমার নিজের শহরে আমি প্রতিদিন বাস ট্রেইন নিয়ে কাজে যাতায়াত করি। চীনের শহরগুলিতে গন পরিবহনে যাতায়াত এত সহজ এবং সস্তা, ভিন দেশী পর্যটক হয়ে এসব জানতে পারতাম না যদি না, বন্ধুর চীন রক্তের মেয়েটা সাথে না থাকতো। সে’ই আমাকে গাইড করে নিয়ে গেছে।

খাইরুল ওয়ালের শুরুতে গিয়ে থ মেরে দাঁড়িয়ে গেলো। সে সিঁড়ি বাইতে পারে না। দুর্বল হাঁটু। উপরে উঠতে আমাকে নিরাশ করার চেষ্টা করলো। ওর সমবয়সী মানুষ আমি। তাই বলে আমিতো নন্দলাল নই। পণ করলাম, আমি উপরে উঠবো। কোন ফাঁকিবাজি করে নয় – একদম নিজের পায়ে হেঁটে।

টং দোকান থেকে এক বোতল প্রিয় পানীয় ফানটা আর মাত্র ভেজেছে দেখে সানফ্লাওয়ার সিডের গরম একটা প্যাকেট কিনে নিজের পিঠের ঝোলায় পুরে নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।

মেয়েটা আগে আগে উঠছে আর আমি তার পিছে পিছে। সিঁড়ির ধাপগুলি প্রায় জায়গায় অসমান। বেশ অসামঞ্জস্য আছে ধাপের মাপে। ভাল করে খেয়াল না করলে পা মচকাতে পারে যখন তখন।

ভাগ্যিস বুদ্ধি করে একজোড়া জগিং স্নিকার পরে এসেছি। জুতার জীবন সার্থক মনে হল। সিঁড়ি বাইতে খুব আরাম হল পা জোড়ার। তিন চার তলা সমান উঁচুতে উঠি তারপর থেমে জিরিয়ে নেই। আবার শুরু করি। মেয়েটা আমাকে বলে – নার্ভাস লাগলে আমি যেন তার কাঁধে হাত রেখে সাপোর্ট নেই। তাইলে নাকি স্ট্রেংথ পাবো বেশী।

পয়লা ওর কথা উড়িয়ে দিলেও পরে অবশ্য কাজে লেগেছে ওর সাহায্য। নইলে হয়ত অতদুর যাওয়া সম্ভব হত না।

যাওয়ার তো কোন শেষ নাই। এ যে অসীম যাত্রা। হাজার হাজার মানুষ উপরে উঠছে তো উঠছেই। অবাক কাণ্ড হল, এরা সবাই চৈনিক মানুষ। দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে বেড়াতে এসেছে। কদাচিৎ দুই একজন ভিনদেশী মানুষ দেখি আমার মত। এজন্যই খাইরুল বলেছিল – চিনারা নিজেরা এতো মানুষ যে তাদের ট্যুরিজমের জন্য বিদেশী ট্যুরিস্টের খুব দরকার হয় না। তারা লোকাল ট্যুরিস্ট নিয়েই সন্তুষ্ট।

মেয়েটার কাঁধে ভর দিয়ে বহুদূর পর্যন্ত গেলাম। প্রায় দুই ঘণ্টা সময় চোখের পলকে চলে গেল। বড় ফানটার বোতল নিঃশেষ হল। গেলে আরো বহুদূর যাওয়া যায়। সেই যাওয়ার কোন শেষ নাই। শুধু গেলেই তো হবে না – ফিরতে হবে নিজের হাঁটুর উপর ভর করে। তারজন্য কিছু শক্তি জমা রাখা দরকার।

ফোনের হেলথ ডাটা এপ এ দেখলাম তিপ্পান ফ্লোর সমান উঁচুতে উঠেছি। ওরে বাবারে, নিজেও বুঝি নাই এতদূর চলে এসেছি। এবার পা না মচকে ভালয় ভালয় নামতে পারলেই বাঁচি। মেয়েটাকে বললাম – চল মা জননী, এবার ফিরে যাই।

উঠার চাইতে নামাটা অনেক কঠিন লেগেছে। নীচের দিকে তাকিয়ে সিঁড়ির ভাল অংশ খুঁজে খুঁজে পা ফেলে নামতে হয়েছে। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক ধপাস করে পা পড়লে ভয় পেয়েছি। মাথা ঘুরে উঠেছে। মেয়েটা হাত ধরে সামলে দিয়েছে। সময় নিয়ে আস্তে ধীরে নেমে এলাম উপর থেকে নীচে।

মনে হল যেন, আমি এইমাত্র পায়ে হেঁটে এভারেস্টের চুড়া থেকে নেমে এলাম।
নেমে প্রথমেই একটা ঢাউস সাইজের সেদ্ধ মিষ্টি আলু খেলাম, তার সাথে এক জগ পানি। আহা, কি শান্তি।

বন্ধু কন্যাকে অনেক ‘ধন্যবাদ’ দিয়ে বন্ধুকে বললাম – চল দোস্ত, অনেক হয়েছে। আজকের মত ক্ষ্যামা দেই।

ভ্রমণের তারিখ – ১৭ই নভেম্বর, ২০১৮

সাপের আন্ডা খাই। মধু দিয়ে ভাজা। খাইলে নাকি অমরত্ব পাওন যায়। দেখতে ডিমের মত লাগায় খাইরুল আমাকে ভিরমি খাওয়ালো এটা সাপের ডিম বলে। শুনে আমার পেট গুলিয়ে উঠলেও খাইরুলের খাওয়া দেখে আমার সাহস হল। আমিও কামড় দিলাম। ওমা, দেখি এতো মহা স্বাদের জিনিস। পরে জানলাম এসব মোটেও সাপের ডিম টিম না। বেইজিং এর ফরবিডেন সিটিতে বেচাকিনি হয় এই আন্ডা। খুব সুস্বাদু খাওন।

দুই হাজার বছরের পুরোনো বুদ্ধ মূর্তি। সোনার তৈরী। সাইজে আমার চাইতেও উঁচা লম্বা। দুর্ভেদ্য কাঁচের দেয়ালের ওপারে রাখা আছে। বেইজিংয়ে রাজা রাজড়াদের পুরনো মহল ‘ফরবিডেন সিটি’ দেখতে গিয়ে দেখা পেলাম এই অপূর্ব সুন্দর ভাস্কর্যের। অপূর্ব কারুকাজ করা শিল্পকর্ম।

Temple of heaven মানে স্বর্গ মন্দির। চীনা রাজা ইয়ংলু এই মন্দির বানিয়েছে ১৪০৬ সালে। এবার হিসাব করে বের করেন কয়শো বছর পার হল এটার।

উঁহু, নামটা স্বর্গীয় হলেও এখানে এসে কেউ স্বর্গে যাওয়ার জন্য প্রার্থনা করতো না। তারা প্রার্থনা করতো যেন বছরের ফসলের ফলনটা ভাল হয়। যেন না খেয়ে মরতে হয়।
সবার আগে পেটের খাবারের যোগানই হল মূল। স্বর্গ সুখের সামিল – এই কথা তারা তখনই বুঝতো। দুনিয়ায় স্বর্গ সুখ খুঁজে নিতে হয়, সবাই কেন বুঝে না !

রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে বরফ দিয়ে কোক ফান্টা খাওয়ার অভ্যাস আমার আজীবনের। এবার ধারণা পাল্টালো চীন দেশে বেড়াতে গিয়ে। জানলাম, খাবারের সাথে ঠান্ডা পানীয় খেতে হয় না। ঠান্ডা খাওয়া রীতিমত অপরাধ।

ওরা খাওয়ার সাথে ঠান্ডা পানীয় খায় না। খায় গরম পানি। তাও কুসুম গরম না, একদম ভাঁপ উঠা গরম পানি। শুধু খাবার খাওয়ার সময় না, সব সময় গরম পানি খায়।

দামী রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখছি আবার ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারকেও দেখেছি ফ্লাস্ক খুলে চুমুক দিয়ে গরম পানি পান করতে। ঠান্ডা পানি পরিপাকতন্ত্রে চর্বির স্তর জমাতে আন্তরিকভাবে সাহায্য করে আর গরম পানি করে উল্টাটা। চর্বি গলিয়ে দিয়ে পরিচ্ছন্ন করে শরীরের অন্দরের সকল সরু নদী নালা। গরম পানি খেলে সর্দি কাশিও দূর হয়।নো জোক, একদম সত্যি কথা।

শাংতুন প্রদেশে যাওয়ার কোন পরিকল্পনা ছিল না। ওখানে থাকে আমার ব্যবসার এক সাপ্লায়ার। তাকে সিম্পলি ‘হ্যালো’ বলতে ফোন করায় সে পেয়ে বসলো। খুব করে অনুরোধ করলো একদিনের জন্য হলেও তার ওখানে বেড়িয়ে যেতে। শুধু বলেই শেষ না – ট্রেনের টিকেট কিনে পাঠালো উইচ্যাটে। হোটেল রিজার্ভ করলো।

আর না করি ক্যামনে !

হাইস্পীড ট্রেনে চড়ে রাজধানীর বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে তিন ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম তার শহরে। শহরের নামটা খুব সুন্দর – জিপো। যদিও বানানে লেখে জিবো। ইংরেজী বর্নমালার চাইনিজ উচ্চারণ অনেক আলাদা। না জানলে বড় অসহায় লাগে। অর্থ বদলে যায়।

জিবোতে পৌঁছুতে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।

বেটা’র নাম ইয়োয়ান কিন্তু উচ্চারণ হয় হুয়ান। বয়সে আমার অনেক ছোট হবে, দেখে মনে হল। পরে অবশ্য জিজ্ঞেস করে জানলাম, না সে অত ছোট না – প্রায় আমার বয়সী মানুষ।

স্টেশনের গেটে দাঁড়িয়ে ছিল ছোটখাট সাইজের মানুষটা। দেখা হতে ব্যাঁকাত্যাড়া সব দাঁত বের করে হ্যান্ডসেক করে বলে – নিহাও, মিঃ হাই। তারপর হাত থেকে ব্যাগ টেনে নিলো।

ভাগ্যিস খাইরুল সাথে আছে। সে আমাদের দোভাষীর কাজ করছে। চাইনিজ ভাষা, সংস্কৃতি, মানুষের আচরণ নিয়ে এই দেশে তার আটত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা আছে।

ছোট্ট শহর জিবো। জিলা শহরের মত। কিন্তু দেখতে লাগে ঢাকার উত্তরার মত। রাস্তা সুন্দর কিন্তু কম গাড়ি। কোথাও কোন আওয়াজ নাই।সব কিছু যেন সাইলেন্ট মোডে আছে। এত নীরবতা অস্থির লাগে আমার। হুয়ান ড্রাইভ করে তার অফিসে নিয়ে গেল। অবস্থা দেখে বুঝলাম ব্যবসা ভাল চলে।

অফিসে বসে জেসমিন টি খাওয়ায়ে বলে – চল ডিনার খেয়ে আসি। তার পছন্দের রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলো। একপাশে বসার আয়োজন,আরেকপাশে সুপারমার্কেটের কাঁচা মাছ মাংশের পসরা সাজানো আছে।

আমাকে ডেকে নিয়ে বলে – তুমি কোন মাছ খেতে লাইক কর, দেখাও !

কি জ্বালা ! খাওয়াবে বলে এখন কাঁচা মাছ ঘাঁটবো নাকি ? চেনা মাছের ভিতর দেখলাম রূপচাঁদা আছে। বললাম – এটার ডিপ ফ্রাই মজা।

– ধুর, বড় দেখে কিছু দেখাও। এরা খুব ভাল রান্দে।

দেড় হাতি সাইজের একটা কিং ফিস নিলাম। মেন্যুর ছবি দেখে আরো সাত পদের খাবারের অর্ডার দিলাম।

নিজের হাত আর নয়ত কাঁটাচামচ ছাড়া জীবনে কোনোদিন আমি লাঠি লুঠি মানে চপস্টিক দিয়ে কিছু খেতে শিখি নাই। অথচ সেই আমাকে তিনদিন ধরে বড় কষ্টে দুইটা কাঠি দিয়ে উঠিয়ে খাবার খেতে হচ্ছে। পরিণামে খাবার পিছলে ছুটে গিয়ে ম্যালা ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটছে।

একের পর এক ডিশ হাজির হচ্ছে টেবিলে। কাঠি দিয়ে কসরত করে মুখে দিচ্ছি। তখুনি বিশাল ডিশে সেজে গুঁজে টোপর পরে মাছটা এসে হাজির হল।

হুয়ান দেখি মাছের ডিশটা ঘুরানোর জন্য অনেক চেষ্টা করছে। ব্যাপার কি বুঝার জন্য খাইরুলের দিকে তাকালাম।

সে বলে – চীনা রেওয়াজ হল, ঘরে মেহমান এলে সন্মান দেখিয়ে ডিশে রাখা মাছের মাথাটা তার দিকে ঘুরানো থাকবে।

শুধু তা’ই নয় – ঠোকাঠুকি করার জন্য গ্লাস উঠালে হোস্টের হাতের গ্লাস সব সময় গেস্টের গ্লাসের নীচে থাকবে।

আমাকে বলে – তুই আজ তার গেস্ট। চিফ গেস্ট। শুনে তাজ্জ্বব হয়ে গেলাম।

– বলিস কি রে, আমি চিফ গেস্ট ! আরেব্বাপ !

এই বলে কাঠি দিয়ে মাছের পিস আটকে উঠাতে গেলে কাঠি ফসকে সেটা হুয়ানের কোলে গিয়ে পড়ল। আমি বোকা বনলাম। আর সে হা হা করে হাসতে শুরু করলো।
১৯শে নভেম্বর ২০১৮

হুয়াংফু নদীকে দিয়ে আলাদা করা হয়েছে পুরান আর নতুন সাংহাই নগরীকে। পূর্ব পশ্চিমে ভাগ করা শহরের পুরোনো অংশে সব কিছু আছে, নেই শুধু হোম হিটিং সিস্টেম – আর সব সমান।

সিম্পলি পঁচিশ বছরের ব্যবধানে গড়ে উঠেছে নতুন আধুনিক সাংহাই মানে নদীর অপর পার যেখানে আগে ছিল ধুধু মাঠ। এখন দেখলে সেই কথা বিশ্বাস করা কঠিন। এখন নতুন আধুনিক সাংহাই দেখলে উঁচা সুন্দর দালান কোঠায় ভরা আমার আবাসন, প্রিয় শহর নিউইয়র্ককে ম্লান মনে হয়।

স্কলারশীপ নিয়ে ডাক্তারী পড়তে আসা বাল্য বন্ধু খাইরুলের আটত্রিশ বছর প্রবাস জীবনের সাঁইত্রিশ বছর কেটেছে এই শহরে। সে দেখেছে মাও সেতুং এর কাস্টোমারী ড্রেস মাও কোট পরা সকল স্তরের চীনা জাতির দ্রুত উত্থান,পরিবর্তন। তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ বন্ধু তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে আমার সাথে। দুই বন্ধু পায়ে হেঁটে, পাতাল ট্রেনে ঘুরি আর তার গল্প শুনি। তার স্মৃতিবহ স্থানগুলি দেখি। শুনি তার মধুর স্মৃতি রোমন্থন যা আমার পুরোনো ইতিহাস জানার আগ্রহ মেটায়।

চকবাজার, সাংহাই

বউরে খুশী করতে চকবাজারে গেছিলাম মণিমুক্তার খোঁজে। ভেজা আঙ্গিনা দেখে মনে হয় যেন সিনেমার সেটের মত চকচক করার জন্য আলগা পানি দিয়ে ধোয়া হয়েছে। আসোলে সেদিন অনেক বৃষ্টি ছিল।

জায়গাটা চীনাদের একটা বিখ্যাত মন্দির যার নাম চেঙ্গুয়ান টেম্পল। এলাকাটা বিশাল এবং দোকানপাটে ভরা। পাইকারী মালের দোকান সব। বাঙ্গালীরা এটার নাম দিয়েছে – চকবাজার। ভিড় দেখে সেইরকমই মনে হল।

জিনিসপত্রের দাম একশো টাকা চাইলে বলতে হয় পাঁচ টাকা তারপর পনের বিশ টাকায় রফা হয়। একমাত্র বউয়ের জন্য অমূল্য মুক্তার মালা কিনে ফিরে এলাম।দাদারে আদা পড়া দিয়ে বুঝ দেওন এইটারেই কয়।

ওরা বলে CRH, মানে China Rail High speed. মাত্র অল্প কয়টা বছরের ভিতর চীনারা তাদের দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সনাতন থেকে চরম আধুনিক বানিয়ে ফেলেছে।

বিদ্যুৎগতির মহা আরামদায়ক এই ট্রেনে চড়ে অল্প সময়ের ভিতর দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলে যাওয়া যায়। স্টেশন এবং ট্রেনের ভেতরের আয়োজন দেখে মনে হয়েছে যেন আমি ট্রেনে না, অতি আধুনিক কোনএয়ারপোর্ট পার হয়ে প্লেনের বিজনেস ক্লাসে ভ্রমন করছি।

কয়েক পর্বের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা এড়িয়ে বিনা টিকেটে ভেতরে ঢোকার একদম কোন উপায় নাই। উপায় নাই বিপদজনক কিছু বহন করে অনেক মানুষকে হুমকিতে ফেলে দেয়ার।

প্র্রতিটা কর্মচারীর বেশভূষা, আচরণ, কর্ম দক্ষতা, এবং দায়িত্ববোধ দেখে মনে হয়েছে ওরা কেউ যেন সিভিলিয়ান না – রেভ্যুলুশন আর্মির হাইলি ট্রেইনড একেকটা চৌকষ অফিসার।

সুন্দর আয়োজন, ভাল ব্যবহার, মৌলিক সুবিধা পাওয়ায় যাত্রীদের আচরণ বদলে যায়। কেউ ধাক্কাধাক্কি করে না। লাইন ধরে নীরবে অপেক্ষা করে। দেখাদেখি সুশীল আচরণ সবার ভিতর সংক্রামিত হয়। আমি শকুনের মত শ্যেন দৃষ্টি মেলে শুধু দেখি আর অবাক হই।

আমার বিস্ময়ের ঘোর কেটে যাওয়ার আগেই ঘোষণা শুনি – নিজের স্টেশন কাংখিত গন্তব্য আর কয়েক মিনিট দূর। যেন ব্যাগ হাতে নিয়ে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। যাত্রী উঠা নামার জন্য স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াবে মাত্র দুই মিনিট। এর বেশী এক মুহূর্তও না। দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। কেউ নামতে ভুলে গেলে চেঁচামেচি করছে না। বরং নিজে ভুলের জন্য নিজেই বোকার হাসি হাসে। তারপর পরের স্টেশনে ট্রেন থামার অপেক্ষায় থাকে।

তেমন একদিনের দূরপাল্লার এক ভ্রমণে ট্রেনের জানালায় তাকিয়ে দেখি, অগণিত উঁচা উঁচা দালান কোঠার পাশে চোখ জুড়ানো শিল্পকর্মের মত মসজিদের একটা কাঠামো। বিদ্যুৎ গতির ট্রেন সিনেমার চেয়ে দ্রুত সামনের দৃশ্য সরিয়ে নেয়। হাতে মোবাইল থাকায় আমিও বিদ্যুৎ গতিতে ছবিটা তুলতে পেরেছি।

খানা পিনায় বেগুনের এত ব্যবহার চীনারা ছাড়া আর কোন জাত করে কিনা সন্দেহ আছে। এটিও বেগুনের একটা আইটেম। খুবই মজাদার খাওয়া। চপস্টিক দিয়ে উঠিয়ে খেতে হয়েছে বলে সুবিধা করতে পারি নাই। যদি ভাত দিয়ে মেখে হাত দিয়ে লোকমা তুলে খেতে পারতাম, তাইলে খুব আরাম পেতাম। টক ঝাল স্বাদের বেগুন খেতে খুব ভাল লেগেছে। খেয়েছি বেইজিং এর একটা অথেনটিক রেস্তরাঁয়।

 

 

মাও সেতুং অনেক মানুষ মেরেছে তার দেশে। ইতিহাসের হিসাব অনুযায়ী মাও হিটলারের চেয়ে অনেক বেশী মেরেছে।
তার কম্যুনিস্ট পার্টি, নীতি, শোষণের ইতিহাস যে যেভাবে লেখুক না কেন – আজকের চায়নার আর্থ সামাজিক কাঠামো, শক্তি, মানুষের চরিত্রের পরিবর্তন বলে দেয়, এসবই তাঁর সুদূর প্রসারী দূরদৃষ্টির প্রতিফলণ।

আমার বিচারে মাও এর একশো ত্রিশ কোটি জনগোষ্ঠীর এত শক্তিশালী, সুখী এবং সুন্দর দেশ বর্তমান দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টা খুঁজে পাওয়া যাবে না।

পত্রিকার খবর আর ছবি দেখে নয় – বাস্তব উপলব্দি করে বিবেচনা করা ভাল। এত বিশাল জনসংখ্যার দেশে আজ কোন কিছুর ঘাটতি নাই। বিদ্যুৎ, গ্যাস, গণ পরিবহন, কর্ম সংস্থান – সব কিছুতে তারা স্বয়ং সম্পুর্ন্ন এখন।
জনতার হাত এবং দায়িত্ববোধ দেশ গড়ার সর্বোচ্চ শক্তি – জ্বলন্ত প্রমান আধুনিক এবং সর্ব বিষয়ে সত্যিকারের মহাশক্তিশালী চীন।

আগে এত জানতাম না – নিজের চোখে দেখে, বুঝে দেশটা এবং তার স্থপতিদের প্রতি মাথা নুইয়ে আসে। সবার মাথা নত হবে ভক্তিতে, যারা সত্যিটা অনুভব করে সেটা বলার সাহস রাখে।

মাও সেতুং অবিভক্ত চীন রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ। জাপানীদের হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করে পঞ্চাশের দশকে একত্রিত করেন পুরো জাতিকে। যদিও তারপরের ইতিহাস বড় করুন। ডাক্তার, চাষি আপামর সবাইকে ‘মাও কোট’ পরে এক কাতারে কাজ করতে হয়েছে কোন বাচ বিচার ছাড়া।। কাজ না করলে মরতে হয়েছে। সুযোগ পেলে মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। অতৃপ্তি নিয়ে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিল পুরো জাতি।

এমন করুন অবস্থা থেকে বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ বিশাল চায়নার আজকের বিশাল অর্থনিতির মোড় ঘুরিয়েছে দেশের একমাত্র দলের সেক্রেটারি ডেন শিয়াওপিং। ডেন সফলতার সাথে দেশের ভঙ্গুর অর্থনিতিকে ধীরে ধীরে সফল করে তুলেছে। এবং বিফল মনের জনগণের মনে আশার আলো জ্বালিয়েছে।

আজ চায়না বিশ্বের সর্ব বৃহৎ অর্থনীতির মালিক। সারা বিশ্বের ইর্ষার পাত্র। ওদের এমন অবস্থা দেখে আমার মনেও ইর্ষা জাগে নাই, বললে মিথ্যা বলা হবে।

দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এমন একজন দায়িত্বশীল বিখ্যাত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সুযোগ হারাই কি করে !