সাপ
আমার যত ভয়, এই সাপ প্রাণীটাকে।
সেই ছেলেবেলায় যে সাপের ভয় মনে ঢুকেছিল, সেটা এখনো একই রকম আছে।
খামোকাই যখন তখন সাপের ভয়ে আঁতকে উঠি এখনো।
যুদ্ধের সময় গ্রামের বাড়িতে থাকার সময় আমি জীবনে প্রথম সাপ দেখি। আমাদের টিনের দোতলা বাড়ির নীচতলার উত্তর দিকের ঘরটা বেশ অন্ধকার ছিল। মাটির ফ্লোর ঘরে। দুই পাশের দুই রুমের মাঝখানে দোতলায় উঠার জন্য কয়েক ধাপ পাকা সিড়ি, তারপর কাঠের সিড়ি। সিড়ির যায়গাটা ছিল দেখতে একদম চৌরাস্তার ট্রাফিক আইল্যান্ডের মত। উত্তরের ঘর থেকে যেকোন দিকে যেতে হলে ঐ সিড়ির আইল্যান্ডের ধাপে উঠে যেদিকে যাবার সেদিকের কয়েক ধাপ সিড়ি বেয়ে নামতে হতো।
পুরো বাড়ির শুধু সিড়ির ঐ আইল্যান্ড ছাড়া বাকি ফ্লোরের সব টুকুই কাদা দিয়ে সমান করে লেপানো মাটির ছিল। গরমের দিনে মাটির ফ্লোরে খালি পায়ে হাটতে অনেক আরাম লাগতো।
আমাদের বড় দুলাভাই ছিলেন পেশায় কাজি। ওনার কাজিগিরির ভাল পসার ছিল আমাদের বাড়ির কাছের বাজারে। উপার্জন বেশি ভাল হতো সপ্তাহের যে দুইদিন বাজারে হাট বসতো তখন। তাই উনি হাটবারের আগেই সাইকেল চালিয়ে সাত মাইল দূরে অবস্থিত হাতিয়া টাউন থেকে চরঈশ্বরে আমাদের বাড়িতে চলে আসতো। আমাদের বাড়ির নীচ তলার উত্তর রুম মুলতঃ গেস্ট রুম হিসাবে ব্যবহার হতো। কাজি দুলাভাই সেই উত্তর রুমে ঘুমাতো।
কাজি দুলাভাই আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড় হলেও উনি আমাদের সাথে অত্যন্ত বন্ধুসুলভ ব্যবহার করতেন।
বাড়ির জরুরি কোন সিদ্ধান্তের ব্যাপার হলে বুদ্ধিমান কাজি দুলাভাইর মতামত নেয়া হতো সবার আগে। স্বয়ং বাবা পর্যন্ত ওনার বড় মেয়ের জামাইকে না জিজ্ঞেস করে কিছু করতেন না।
কাজি দুলাভাই এত বন্ধু সুলভ ছিলেন যে সেই ছোটবেলায় উনি আমাদের সবাইকে অনেক কিছুতে ওস্তাদ বানিয়ে ফেলেছিলেন গোপনে। পাশাপাশি অনেক ভাল কিসসা কাহিনী শোনাতেন। মজার মজার চুটকি বলে সবাইকে হাসাতেন। আমরা ছোটরা সবাই ওনার প্রচন্ড ভক্ত ছিলাম। আবার মজার কোন ঘটনা ঘটাতে আমরা বড় ছোট সবাই মিলে কাজি দুলাভাইর উপর ঝাপিয়ে পড়তাম।
আগের দিনে বিয়ে বাড়ির গায়ে হলুদে সবচেয়ে বেশি মজা হতো। এত বেশি হলুদ মাখামাখি হতো যেখানে বাড়ির জোয়ান বুড়া কাউকে বাদ রাখা হতো না।
বড়দার বিয়ের গায়েহলুদে সবাই মিলে বাড়ির সামনের উঠানে পানি ঢেলে কাদা বানিয়ে সেখানে সবাই সবাইকে কাদা মাখাচ্ছিল।
হটাৎ সবাই পরামর্শ করে বাড়ির ভিতর থেকে কড়া ইস্তিরি দেয়া আর্দির সাদা পাঞ্জাবী, মাথায় টুপি পরা কাজি দুলাভাইকে ডাকতে গেলো।
দুলাভাই খুব চালাক ছিলেন। উনি হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন, কিছু একটা ঝামেলা আছে। তাই উনি উঠে গিয়ে বাবা’র পাশে গিয়ে বসে পড়লেন।
বাবা’র সামনে কারো কিছু করার সাহস ছিল না আমাদের। তাই চাচাকে পাঠানো হলো দুলাভাইকে ডেকে আনার জন্য। চাচা শুধু ওনাকে বাড়ির মূল দরজা পর্যন্ত এনে দিলেন। তারপর আমরা সবাই কাজি দুলাভাইকে চ্যাংদোলা করে কাঁধে তুলে নিয়ে উঠানের কাদায় এনে ফেললাম। শুরু হয়ে গেলো ওনাকে কাদায় চুবানো।
মেহেদি, হলুদ, তার সাথে ঘন কাদা সব মিলিয়ে সে কি অবস্থা ! সবাই রঙ কাদা মেখে সং সেজে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এত অত্যাচারের পরেও দুলাভাই কখনো মাইন্ড করতো না।
কাজি দুলাভাই খুব চোখ কান খোলা ধরনের মানুষ ছিলেন। সব কিছু আগে থেকেই আন্দাজ করতে পারতেন। একবার বর্ষাকালে বৃষ্টির দিনে আমি দোতলা থেকে বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে দেখি সামনের উঠানে কালো কালো কি যেনো নড়ছে।
আমি ভাবলাম সাপ জাতিয় কিছু হবে। দৌড়ে নীচে গিয়ে দুলাভাইকে বললাম।
উনি বের হয়ে উঠানে নেমে একটু পরে আমাকে বলে, একটা বেতের ঝুড়ি নিয়ে আয়।
অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, কেন!
উনি হেসে উত্তর দেয়, আরে গাধা,এগুলি কই মাছ। বৃষ্টি হলে কই মাছ পুকুর ছেড়ে মাটিতে উঠে আসে।
দৌড়ে বাড়ির ভিতর থেকে একটা বেতের ঝুড়ি এনে দিলাম।
দুলাভাই কানে হাঁটা কই মাছ সব উঠিয়ে নিয়ে বলে, ভিতরে গিয়ে বল, বেশি করে পেয়াজ দিয়ে দোপিয়াজি করতে ।
সাপ ধরার, সাপের ছোবল খাওয়ার অনেক লোমহর্ষক গল্প শুনেছি দুলাভাইর কাছে। আমাদের বাড়িটা অনেক পুরনো আমলের। অনেকগুলি ঘর । বেশিরভাগ ঘর খালি পড়ে থাকে। পুরনো ফার্নিচার দিয়ে বোঝাই সব। উত্তর রুমের পাশে সিড়ির নীচে একটা ঘর ছিল, ওটাকে আমরা বলতাম মাইঝকানের ঘর। ওখানে কেউ থাকতো না।
তখনও গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না। সিড়ির গোড়ায় সন্ধ্যা বাতি হিসেবে একটা চেরাগ জ্বলতো। সেই আলোয় খুব বেশি কিছু দেখা যেতো না। ঘর গুলিতে হারিকেন থাকতো। সেই আলোতেও পুরো ঘর দেখা যেতো না। তাই সন্ধার পর বাড়ির প্রায় অন্ধকার এখানে সেখানে আমরা পায়ের আন্দাজে হেটে বেড়াতাম। অসুবিধা হত না।
শুধু ঐ সিড়ি পার হতে গেলে গা শিরশির করে উঠতো। কারন দুলাভাইর কাছে শুনেছি, অনেক নাকি এই সিড়ির চিপা থেকে উনি মাছ ধরার বড়শি দিয়ে বিষাক্ত সাপ ধরে ছিলেন। এই ভয়ে আমি হাঁটার সময় খালি এদিক ওদিক ভাল করে তাকাতাম রাতের বেলায়। রাতের বেলায় বাথরুম চাপলে কখনো নীচে যেতাম না ভয়ের চোটে।
সেই বর্ষাতে ঘটলো আমার জীবনের সব চেয়ে লোমহর্ষক আর ভীতিকর ঘটনা। মাঝের ঘর পার হতে গেলে রাতের বেলায় কেমন যেন ফোঁস ফোঁস আওয়াজ শুনতাম। প্রথমে ভেবেছি আমার মনের ভুল। পরে দুলাভাইকে বললাম, উনিও হেসে উড়িয়ে দিলেন। পরে একদিন উনি নিজেও শুনলেন সেই আওয়াজ।
একদিন সকাল বেলায় হইচই শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উঠে কি হয়েছে দেখার জন্য দৌড়ে দোতলা থেকে নামতে যাবো, তখুনি দুলাভাইকে দেখি সিড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে কি যেন করছে। আমাকে দেখে বলে, ‘নামিস না, উপরেই থাক। সাপ ধরা পড়েছে।
ঊপর থেকে দিনের বেলায় অনেক জোরে জোরে ফোঁস ফোঁস আওয়াজ শুনছিলাম।
আমি বড়শিতে কেঁচো লাগিয়ে পুটি মাছ ধরতাম পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে। রাতের বেলায় সাপের আওয়াজ শুনে বিচক্ষন দুলাভাই বুঝে ফেলল, সিড়ির চিপায় সাপ আছে।
উনি আমার বড়শিতে ধান ক্ষেত থেকে কোলাব্যাং ধরে গেঁথে সিড়ির চিপায় সাপের জন্য ফাঁদ পাতলো। বড়শির নাইলন সুতা সিড়ির হাতলের সাথে শক্ত করে বেধে দিলো। তারপর সারা রাত না ঘুমিয়ে টর্চলাইট হাতে নিয়ে পাহারা দিলো। ওনার পাতা ফাঁদে সাপ বাবাজী ঠিক পা দিয়ে ধরা খেলো।
নাম ভুলে গেছি, আমাদের গ্রামে একটা সাপুড়ে ছিল, ওকে খবর দেয়া হলো। সে এসে বড়শিতে আটকানো সাপ টেনে বের করে তার ঝাপিতে ঢুকিয়ে ফেলল। আমি দোতলা থেকে তাকিয়ে সাপটা এক পলক দেখেছিলাম। আজ পর্যন্ত সেই চেহারা ভুলি নাই। সাপের রঙ দেখতে অনেকটা গাড়ো মেরুন রঙ এর। মাথার কাছে ডিজাইন করা। সাপুড়ে বলেছিল,ওটা নাকি অনেক বিষাক্ত সাপ। আমাদের গ্রামে বলে’হানক’ সাপ।
এর কিছুদিন পর পুরো বাড়ির ফ্লোর কংক্রিট দিয়ে পাকা করে ফেলা হলো। আমিও ঢাকা চলে গেলাম। কিন্তু সাপের ভয় কখনো দূর হয় নাই মন থেকে। যেখানে থেকেছি, গিয়েছি, আশেপাশে ভাল করে দেখে নিয়ে পা দিয়েছি। আমাদের সেই বাড়ি এখনো আছে, ঠিক আগের মত। সেই সিড়ির আইল্যান্ডটাও আছে।
আমি প্রতি বছর ঢাকায় গেলে অল্প কয়দিনের জন্য হলেও গ্রামে বেড়াতে যাই। গেলে আমার সেই কথা মনে পড়ে যায়। কাজি দুলাভাই আর বেঁচে নাই। কিন্তু উত্তর রুমটা এখনো সেইভাবে আছে। সিড়ির জায়গাটা সহ পুরো বাড়িতে সোলার সিস্টেমে অনেক বাল্ব লাগানো আছে, অনেক আলোও আছে। তবুও আমি গ্রামে যাবার সময় চার ব্যাটারির ভাল টর্চলাইট নিয়ে যাই। রাত হলে আমি সারাক্ষন টর্চ লাইট জালিয়ে অনেক দূর থেকে সব ভাল করে দেখে নিয়ে পা ফেলি। ভীতি এখনো রয়ে গেছে।
অনেকে সাপের খেলা দেখতে পছন্দ করে। আমি ভয়ের চোটে কোন দিন এই খেলা দেখি নাই। ডিস্কভারি চ্যানেলে অনেক সাপ দেখায়। অমন কিছু দেখালে আমি চ্যানেল বদলাই। ইংরেজি আনাকোন্ডা মুভি দেখে আমি রাতের বেলায় ঠিক মত ঘুমাতে পারি নাই।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে আমি নিউইয়র্কে বসবাস করি। পার্ক ঝোপঝাড় দেখলে আমি সাবধানে পা ফেলি। যদিও কোন দিন সাপ দেখি নাই এখানে। কিন্তু মনের ভিতর ভয়টা রয়ে গেছে।
ঢাকায় আমাদের বনানি বাসার পিছন দিকে অনেক বড় একটা হাস্না হেনা ফুলের গাছ ছিল। রাত হলে এই ফুলের গন্ধে পুরো বাড়ি মৌ মৌ করত।
কে যেনো একবার বলল, এই ফুলের গন্ধে সাপ আসে। বনানি তখন সত্যিকার অর্থেই বনে ভর্তি ছিল। বাসায় অনেক ছোট ভাই বোন। তাই বাবা একদিন হাসনা হেনার গাছটা কেটে ফেলে দিলেন।
আমার খুব ফুলের বাগান করার বাতিক আছে। নিউইয়র্কের গরমকাল মাত্র আড়াই তিন মাসের হয়। অতটুকু সময়ের সামার আসলে অন্যদের মত আমিও বাগান করায় ব্যস্ত হই। অনলাইন, নার্সারি খুজে খুজে সখের ফুল গাছ কিনে লাগাই।
বছর পাঁচেক আগে গ্রোসারী করতে গিয়ে পাকিস্তানি দোকানে দেখি হাস্না হেনা ফুল গাছ বিক্রি করছে।
সিউর হওয়ার জন্য নাম জিজ্ঞেস করায় দোকানি উত্তর দিল, এটার নাম কুইন অফ দি নাইট। সাদা ফুল ধরে আর রাতের বেলায় গন্ধ ছড়ায়। বুঝে ফেললাম, এটাই হাসনা হেনা ফুল গাছ। কিনে নিয়ে আসলাম। ভাল করে নতুন মাটি ভরে টবে লাগালাম। গাছ বড় হয়ে ফুল ধরার আগেই শীত চলে এলো।
শীতকালে গাছ বাইরে থাকলে মরে যাবে। তাই আমি আমার প্রিয় গাছগুলি ঘরের ভিতর নিয়ে আসি।
বেলী ফুল ধরেছে, সুন্দর গন্ধে প্রান জুড়িয়ে যায়, কয়দিন পর হাসনা হেনা গাছেও ফুল ধরলো।
গন্ধ পেয়ে অদ্ভুত ভাল লাগতে শুরু করলো ।
একদিন রাতের বেলায় উপর তলায় বেড রুমে শুয়ে হাস্না হেনার গন্ধ পেয়ে হটাৎ মাথায় চিন্তা এলো – আচ্ছা, এই গন্ধে যদি সাপ চলে আসে, কি উপায় হবে?
আমার ছেলেরা তাদের ঘরে ঘুমিয়ে আছে। কল্পনা করতে লাগলাম, সিড়ি বেয়ে সাপ উপরে উঠে আমার ছেলদের ঘরে গিয়ে ওদের বিছানায় লেপের নীচে ঢুকছে।
ব্যস, আমার ঘুম হারাম হয়ে গেলো। ভয় পেতে শুরু করলাম। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেতে শুরু করলো। স্ত্রী পাশে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
আস্তে আস্তে ওকে ডাক দিলাম, কোন উত্তর নাই। বুঝলাম, ওকে উঠানো যাবে না।
কি করব ভাবতে লাগলাম। যদি এর মধ্যে সাপ ঘরে ঢূকে বসে থাকে তাহলে আমার একা নীচে যাওয়াও নিরাপদ নয় ।
একবাড় ভাবলাম, ৯১১ এ কল করে ওদের বুঝিয়ে বলি। কিন্তু পরক্ষনে সেই চিন্তা বাতিল করে দিলাম, ওরা যদি আমাকে পাগল ভাবে?
সাপ নাকি ঠান্ডা যায়গায় থাকেনা। বুঝলাম নিউইয়র্ক ঠান্ডা, কিন্তু ঘরে তো হিট চলছে। সাপ যদি আরামের লোভে, ফুলের গন্ধে অলরেডি ঘরে ঢুকে ফনা তুলে বসে থাকে, তাহলে আমার কি উপায় হবে? ভেবে নিজেই ঘামাতে শুরু করলাম। একা নীচে গিয়ে দেখে আসার সাহসের অভাব অনুভব করলাম। পরমুহুর্তে ছেলেদের কথা মনে হলো। আমার কথা বাদ। আমার ছেলেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার। ওদেরকে সাপের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতেই হবে। সাহস সঞ্চয় করে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। লাইট অন করে বেইসবল ব্যাট হাতে নিলাম। এক এক করে সব বাতি জালিয়ে দিলাম। তারপর পা টিপে টিপে নীচ তলায় এসে সব বাতি জালিয়ে দিলাম।
দেখি, দরজার পাশে হাসনা হেনার গাছটায় অনেক ফুল ধরে আছে। সুন্দর গন্ধ বের হচ্ছে। আমার সেদিকে মন নাই। আমি এদিক ওদিক ভাল করে তাকিয়ে খুজলাম, সাপ কোথাও একে বেঁকে ফনা তুলে হাঁটছে কিনা। কিছু না দেখতে পেয়ে সাহস করে এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে।
মেইন ডোর খুলে হাস্নাহেনা’র টবটা তুলে বাইরে রেখে দরজা বন্ধ করলাম দ্রুত।
কাজটা নির্ঝঞ্জাটে করতে পেরে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। ঘরে এসে বাতি নিভিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। পরদিন স্ত্রীকে আমার রাতের এডভেঞ্চারের গল্প বললাম। শুনে সে হাসতে হাসতে শেষ। বলে, পঁচিশ টাকা পানিতে গেলো। তারপর ফোন করে পুরো পৃথিবীর সবাইকে জানিয়ে দিলো। কয়দিন পরে প্রচন্ড ঠান্ডায় গাছটা মরে গেলো।
ফ্লোরিডা আমার খুব ভাল লাগে। আমার ছোটবেলার খুব প্রিয় একটা বন্ধু থাকে ফোর্ট লডারডেলে। অনেকবার বেড়াতে গেছি ওর বাসায়। বাসার পাশেই লেক। বড়শি ফেল্লেই তেলাপিয়া, ক্যাট ফিস ধরে। মনের আনন্দে বিয়ার খেতাম রোদে বসে, আর মাছ ধরতাম। বিয়ের পর ওদিকে যাওয়া কমে গেছে। কিন্তু কথা হয় প্রায়ই। গল্পের ছলে মিন্টু একদিন বলে ওর ছেলে নাকি বাসার পিছনে ঘাসের উপর সাপ দেখে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। আমি এই কথা শুনে তাজ্জব। মিন্টু নতুন বাড়ি কিনেছে। পিছনে নাকি সুন্দর লেক, অনেক মাছ আছে। মনে মনে প্ল্যান করছিলাম,দেখতে যাবো। কিন্তু সাপের কথা শুনে আমি চুপ হয়ে গিয়েছি।
এছাড়াও ফ্লোরিডার এভারগ্লেডে নাকি অনেক বড় বড় অজগর সাপ আছে। একবার টর্নেডোর সময় এক্সটিক এনিম্যালের ট্রাক উলটে অনেক সাপ খোপ বের হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা মাঝে মাঝে হাইওয়েতে উঠে আসে। গাড়ির তলায় পিষ্ট হয়ে মরে। পিষ্ট হোক আর যাই হোক, আমি তো অজগর দেখলে দম ফেটে মরে যাবো।
তাই মিন্টু অনেক পিড়াপিড়ি করেও আমাকে ওর ওখানে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারছে না।
একবার ব্যবসার কাজে লাস ভেগাস গেলাম আমরা তিন জন। কাজ শেষ হলে আমরা গ্রান্ড ক্যানিওন বেড়াতে যাবার প্ল্যান করলাম। পিঙ্ক জীপ নামে একটা গাইডেড ট্যুর আছে। ওটার একটা ভাড়া করে ওদের গাইড সহ আমরা রওনা দিলাম। গাইড বেটা অনেক বেশি কথা বলছিল। জায়গায় জায়গায় গাড়ি থামিয়ে মরুভুমির নানা রকমের আগাছার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল। আমার কাছে সব মনে হচ্ছিল উলু খাগড়ার মত। কিন্তু লোকটা আপনমনে কোন গাছের ছাল দিয়ে কি অসুখ ভাল হয়,তার বিস্তারিত বর্ননা করে যাচ্ছিল।
হটাৎ কানে গেলো সাপে কামড়ালে জসুয়া গাছের রস লাগালে তৎক্ষণাৎ বিষের তেজ কমে যায়। মরে যাওয়ার ভয় থাকেনা, এসব।
আমার কানে সাপ কথাটা যাওয়ার সাথে সাথে অনেক কথা মনে পড়ে গেলো। আরে, আমরা তো আরিজোনার মরুভুমিতে আছি দুপুর বেলায়। কোন মানুষের চেহারা দেখা যাচ্ছেনা। মাথার উপর তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রীর চেয়েও বেশি। এধরনের মরুভুমিতে একধরনের বিষাক্ত সাপ থাকে, যার নাম র্যাটল স্নেক। সেবা প্রকাশনীর ওয়েষ্টার্ন গল্পে পড়েছি, ওয়েষ্টার্ন মুভিগুলিতে এই সাপ দেখেছি। ওরা বিদ্ঘুটে আওয়াজ করে। দেখলে গা ঘিনঘিন করে উঠে।
সাপের কথা শুনে আমার মনে হলো, যে কোন মুহুর্তে ওখানে সাপ বের হতে পারে। আমি বলে উঠলাম, এখানে আর থাকার দরকার কি, খালি মরুভুমি, আপদ বিপদের কোন ঠিক নাই। কেউ বুঝে নাই, আমার প্রব্লেম কোথায়। কিন্তু চলে গেলাম ঐ যায়গা ছেড়ে দ্রুত।
আমার শহরের অনেক পাগল বাসিন্দা বাসার ভিতর অনেক জীব জন্তু পালে সখ করে। এই শহরে এটা সম্পুর্ন বে আইনী কাজ। কিন্তু ধরা না পড়লে, কোন বিপদ না হলে কেউ তো টের পাচ্ছেনা। অনেকে বাসার বাথটাবে এলিগেটর রাখে। বড় বড় পাইথন রাখে। এমন কি বাসায় চিতা বাঘও রাখে। সিটি টের পেলে তখন ওসব জব্দ করে।
একবার এক লোকের সখের অজগর তার ঘর থেকে পালিয়ে গেলো/ খবর ছড়িয়ে পড়লে খোজাখুজি শুরু হলো। শেষ পর্যন্ত কেউ ওটাকে খুজে পেলো না। সাপ বাবাজী নিজে উদয় হল আরেক বাসার সুয়র লাইনের ভিতর দিয়ে ঢুকে টয়লেট বলের ভিতর দিয়ে বের হয়ে। বাসার মালিক দেখতে পেয়ে পড়িমড়ি করে ছুটে পুলিশ ডেকেছে।
পার্ক্স ডিপার্ট্মেন্টের মানুষেরা এসে এই সাপ ধরেছে।
এমন খবর শুনে সেই থেকে অকারনে আমি টয়লেটে গিয়ে যখন বসি, অবচেতন মনে খালি মনে হয় এখন যদি টয়লেটের ভিতর থেকে কোন সাপ বের হয়ে আমাকে দংশন করে, কি উপায় হবে আমার, কে রক্ষা করবে আমাকে?
হে খোদা ! আমার কি হবে, কবরে গেলে নাকি অনেক বড় বড় সাপ আক্রমন করে বাঁচার উপায় কি?
জসুয়া গাছের রস খেতে হবে মরার আগে, তাইলে মনে হয় কিছু হবে না।
২৬ নভেম্বর, ২০১৪।