২০ নং নিউ ইস্কাটন রোড

মগবাজার চৌরাস্তা থেকে বাংলামটরের দিকে যেতে হাতের বাঁয়ে প্রথম চিপা গলিতে ঢুকলে দ্বিতীয় বাড়িটাই ছিল ২০নং নিউ ইস্কাটন রোড। এই বাড়িটার দোতলার বাম দিকের সাড়ে তিন রুমের ছোট ফ্ল্যাটটিতে আমরা অনেক বছর ভাড়া থেকেছি।

কিশোর থেকে যুবক বয়সের অনেক কয়টা বছরের তিতা আর চিনির মত মিষ্টি বহু স্মৃতি জড়ানো আছে এই ঠিকানায়। তাই সব সময় মনে থাকে এই ঠিকানা।

আমি তখন নটরডেম কলেজে পড়ি। বাবা বনানী বাড়ি বেশি টাকায় ভাড়া দিয়ে আমাদের অনেক ভাই বোনদের নিয়ে এই বাসা ভাড়া নেন। তিন রুমের সাথে ছোট একটা চিলে কোঠা থাকায় আমরা বলতাম সাড়ে তিন রুম। আমাদের সবার স্বপ্ন ছিল ঐ জানালা বিহীন চিলে কোঠায় একা থাকার। বড় আর চাকুরীজীবি হওয়াতে পদাতিকতার বলে বড় ভাই একা থাকতো ঐ চিলে কোঠায়। উনি অফিসে চলে গেলে তালা বন্ধ রুমটার দিকে তাকিয়ে আমরা সবাই নীরবে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতাম। মাঝে মাঝে ঘর গোছানোর জন্য ভাই চাবি দিয়ে যেতো সবার ছোট ভাই আজাদকে, আর কাউকে নয়।

বাকি তিন রুমের একটায় বাবা, একটায় বোনেরা আর যেটা আসোলে ড্রয়িং রুম হবার কথা সেটাই ছিল আমাদের বাকী ভাইদের বেড্ রুম। একটা সেমি ডাবল খাট, একটা চোকি আর ফ্লোরে বিছানা করে আমাদের শোবার ব্যবস্থা হোতো। খাটে আমি শুতে চাইতাম না, কারন একটু ভুল নড়া চড়া করলেই প্রায় মাঝ রাতে খাটের তোষকের নিচের পাটাতন খুলে গিয়ে ভেজাল হয়ে যেতো। তখন আবার উঠে বাতি জালিয়ে সব ঠিক করা লাগতো। তারচেয়ে ফ্লোরে ঘুমানো নিরাপদ ছিল। যদিও মশারীর ফুটো দিয়ে মশা ঢূকে ঘুমের বারোটা বাজাতো।

কলেজে পড়ি, অনেক বন্ধু হয়েছে। ক্যাপষ্ট্যান সিগারেট খাই। কলেজের বাস ভাড়ার জন্য এত সামান্য পয়সা পেতাম বাবার কাছ থেকে যে বাস ভাড়া ফাঁকি দিয়েও সিগারেট কেনার জন্য যথেষ্ঠ পয়সা হতো না। তাই কায়দা করে বানানো চোরাই চাবি দিয়ে চিলে কোঠা খুলে বড় ভাইয়ের ড্রয়ার থেকে ভাংতি পয়সা হাতানো, বাসার পুরনো খবরের কাগজ, খাতা বই, হাড়ি পাতিল বিক্রি করে আর দায়িত্ব পেলে ছুটির দিনে বাসার কাঁচা বাজারের পয়সা থেকে অভিজ্ঞ ভাবে কাট ছাট করে পয়সা মারাই ছিল আমার অতিরিক্ত পকেট মানি ম্যানেজ করার উপায়।

স্কুল থেকে পত্রমিতালী করা শিখেছিলাম। বিচিত্রার ব্যাক্তিগত বিজ্ঞাপনে পত্রমিতালীর ঠিকানা পেতাম।

খুব সখ ছিল নিজেও ওখানে নিজের ব্যাক্তিগত বিজ্ঞাপন ছাপাবো। কিন্তু সখ পুরন হয় নাই। কলেজে গিয়ে বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে আনা বিদেশি পেনপলস ম্যাগাজিন থেকে ঠিকানা নিয়ে কত চিঠি লিখেছি কত দেশে এয়ারমেইল খামে। তারপর অপেক্ষায় থাকতাম কখন ডাকপিয়ন আসবে আমার চিঠির উত্তর নিয়ে।

সে এক অন্য রকম অনুভুতি।

এক সময় মগবাজারের আমরা কয় বন্ধু মিলে নিজেরা বের করে ফেললাম একটা ইংরেজি পত্র মিতালি পত্রিকা। চাঁদা দিয়ে পয়সা তুলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সদস্য যোগাড় করে, বিদেশি পত্র মিতালিদের সাহায্য নিয়ে পত্রমিতালিতে আগ্রহী ছেলে মেয়েদের ঠিকানা ম্যানেজ করে ম্যাগাজিন ছাপানোর ব্যবস্থা করলাম। মগবাজার মোড়ে কোন কাজ নাই এমন একটা প্রেসে বসে আড্ডা দিতাম আমি আর এলাকার বন্ধুরা। সেই প্রেসে শুরু করে দিলাম আগের দিনের ম্যানুয়াল স্টাইলে ফন্ট কম্পোজ করে পেইজ সেট আপ করা, তারপর বার বার করে প্রুফ দেখা। দিন নাই রাত নাই – সারাক্ষণ পড়ে থাকতাম আমরা কয়জন সেই প্রেসে। প্রায় মাস দুই পরে একদিন ঠিক ছাপা হয়ে বাঁধাই আকারে আকাশী নীল রঙ এর কভারে হাতে পেলাম অনেক আকাংক্ষিত ম্যাগাজিন ব্রীজ ইন্টারন্যাশনাল। সে কি আনন্দ আমাদের চোখে মুখে, যেন আমরা কোন বিরাট লটারী জিতে ফেলেছি।

পত্রিকায় আমাদের ম্যগাজিন ছাপানো হয়েছে এমন বিজ্ঞাপন দেখে ম্যাগাজিনের সদস্যরা সবাই ১০ টাকার মানিঅর্ডার পাঠাতে শুরু করল আমার কাছে কপি পাবার জন্য। কলেজ থেকে ফিরলে একদিন বাবা কিছু মানিঅর্ডারের রিসিপ্ট আর টাকা এনে আমাকে দিয়ে বলে ডাকপিওন দিয়ে গেছে তোর জন্য। বাবার হাত থেকে টাকা নিয়ে মনে মনে একদিকে নিজের অর্জনের জন্য আনন্দ হচ্ছিল অন্যদিকে ভয় পাচ্ছিলাম এই ভেবে বাবা যদি এখন আমার হাত খরচ বন্ধ করে দেয়। যদি বলে -তুমিতো এখন পয়সা কামাচ্ছো। তাই আগে বেড়ে মুখ কালো করে বললাম – এসব আমার টাকা নয়, বন্ধুরা শুধু আমার ঠিকানা ব্যবহার করেছে ।

মগবাজারের বন্ধু মিন্টু কাজল রুমি আর আমি ছিলাম একে অপরের হরিহর আত্মা।

কলেজের ক্লাস শেষ হলে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়তাম আমাদের পত্রিকা নিয়ে। মগবাজার টঙ্গি ডাইভারশন রোডের রেলগেটের পাশে হোটেলে বসে মাংশের ঝোল দিয়ে ডালপুরি আর চা খেতে খেতে আমাদের আড্ডা আর মিটিং চলতো।

মগবাজার মোড়ের মসজিদের পাশে ছিল সিগারেটের দোকান। মালিক ছিল ফরিদপুরের একজন অত্যন্ত ভাল মানুষ যাকে আমাদের বাসার সবাই চাচা বলে ডাকতাম। মতিন চাচা ছিল আমার বাবার খুব বিশ্বস্ত সঙ্গী।

আমার কোন দাবী দাওয়া থাকলে ঐ চাচাকে পটিয়ে বাবার কাছে আবেদন করতাম। আর সেটা আদায়ও করে দিতেন উনি। চাচার দোকানে আমার নামে বাকির খাতার হিসাব খালি লিখাই হতো। কোথাও থেকে এসে রিক্সা ভাড়া না থাকলে চাচার দোকানে থেমে টাকা নিয়ে ভাড়া মিটিয়ে খাতায় লিখে রাখতে বলতাম। সিগারেট তো অলোয়েজ বাকি নিতাম।

এই চাচাকে নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। আমি দেশের বাইরে থেকে অনেক বছর পর দেশে ফিরে চাচার দোকানে গেলাম খোজ নিতে। গিয়ে দেখি আগের মতই চাচা আপনমনে দোকানদারী করছে।

বয়স বেড়েছে। চুল দাড়ি সব পেকে সাদা হয়ে গেছে।

আমি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলাম – চাচা এক প্যাকেট সিগারেট দেন আর খাতায় লিখে রাখেন।

আমার দিকে না তাকিয়ে নির্বিকার ভাবে উত্তর দিল – বাকি দেই না।

আমি এবার আরো জোরে বলে উঠলাম – দেন না চাচা দিয়া দিবো তো শালার পুত।

এই কথা শুনে বিরক্ত আর রাগী চেহারা নিয়ে আমার দিকে ঘুরে তাকালো। কিছুক্ষন তাকিয়েও চিনতে পারে নেই। আমি হাসতে লাগলাম। এইবার মনে হয় চিনলো। লাফ মেরে দোকানের ভিতর থেকে বের হয়েই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। বলে – ওরে বাজান এদ্দিন পর দ্যাশে আইসেন। আমি ঠিক জানতাম বাজান দ্যাশে আইসা আমারে খুজবো। ওনার চোখে আনন্দের অশ্রু। দেখে নিজেরও চোখ ভিজে এলো।

একটু পর আমি বললাম – চাচা এবার কষ্ট করে আমার বাকির খাতাটা বাইর করেন। সুদে আসোলে শোধ করুম।

আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে – কই কোন বাকিতো ছিল না।

তারপর এক প্যাকেট বেন্সন সিগারেট বের করে আমাকে দিয়ে বলে – এটা রাখেন।

দোকানের দিকে তাকিয়ে মালের স্টক দেখে মনে হলো অবস্থা বেশি ভাল না। জানতে চাইলাম কেমন চলছে ।

মন খারাপ করে উত্তর দিল – আর বেশিদিন এখানে থাকা যাবেনা। রাস্তা চওড়া করবে তাই দোকান ভেঙ্গে ফেলবে।

এরপর দেশে গেলে চাচার দোকান আর হয়ত দেখবো না। কিছু না বলে জোর করে কিছু টাকা চাচার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে কোলাকুলি করে চলে এলাম।

মনে আছে ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে বাবা যখন খুব অসুস্থ হয়ে মগবাজারের রাশ মনো ক্লিনিকে ভর্তি হলো। ঢাকায় তখন খুব গন্ডগোল হচ্ছিল। আমি তখন সুর্যসেন হলে থাকি। সেদিন রাতের বেলায় হলেও খুব মারামারি হচ্ছিল লাইট অফ করে দিয়ে। এর ভিতর মতিন চাচা জানিনা কেমন করে হলের গেট খুলিয়ে ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে করে ঠিক আমাকে খুজে বের করলো।

আমাকে পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। বলে- আপনের বাবার অবস্থা ভাল না। তাড়া তাড়ি চলেন আমার সাথে।

পরদিন ভোর বেলায় বাবা মারা গিয়েছিল। মতিন চাচা হলে এসে আমাকে ধরে নিয়ে না গেলে বাবার শেষ মুহুর্তে হয়তো আমি বাবার পাশে থাকতে পারতাম না।

পরেরবার গিয়ে দেখি সত্যি ঐ দোকান আর নাই। খোজ নিয়ে জেনেছি চাচা নাকি বাজারে বসে কলা বিক্রি করে। কিন্তু অনেক খুজেও আর পাই নাই আমার ছেলেবেলার অনেক প্রিয় আর নির্ভরযোগ্য মতিন চাচা কে।

শামসুল হুদা সাহেবের ২০ নং নিউ ইস্কাটন রোড ঠিকানার পুরনো সেই দোতলা বাড়িটা আর আছে কিনা জানিনা। কারন তার সামনে যে চাইনিজ কালচারাল সেন্টার ছিল- বছর দুই তিন আগে গিয়ে দেখেছি সেখানে এখন একটা সি,এন,জি স্টেশন। মোড়ের ক্যাফে-ডি-তাজ হোটেল, জনতা ব্যাঙ্কটা আছে। উলটা দিকে কুমিল্লা স্টোর, মসজিদও আছে। নেই শুধু মতিন চাচার দোকান, যেখানে আমি সব সময় বাকিতে সিগারেট নিতাম।

আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আমার সব চেনা জায়গা গুলি। বদলে যাচ্ছে চেনা মানুষগুলিও।

কিছুই আর আগের মত লাগে না।

তাই আমার আর ঢাকায় যেতে ভাল লাগেনা। যাওয়ার কোন কারণ খুজে পাইনা ।

তবুও আমি যাই।

হয়তো একদিন আর যাওয়া হবেনা।

না গেলেও কেউ আমাকে মিস করবে না।

৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪