রিকশায় হাতিরঝিল ভ্রমণ

ঢাকায় রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো খুব মিস করি। এখন তো রিকশার রাস্তাই নাই। যাওবা আছে, জ্যামের কারণে মজা নাই। তাই উঠা হয় না। ফেইসবুকে পরিচয় হওয়া এক পিচ্চি ( মানে আমার হাঁটুর সমান বয়সের এক মানুষ ) লেখা পড়ে বলেছিল ঢাকায় গেলে সে আমার আশা পূরন করে দিবে। গত বছরের এপ্রিলে আমি ঢাকায় গেলে ফেইসবুকে আমার নিত্য দিনের ষ্ট্যাটাস পরে সে আমার উপস্থিতি জেনে যায়। ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে ঠিকানা জেনে নেয়।

পরদিন খুব সকালে সে হোটেলে এসে হাজির হয়ে যায়। তাকে নিয়ে সকালের নাস্তা খেতে হোটেলের ডাইনিংএ যাই। সে নাস্তা দেখে নাক সিঁটকে বলে এসব কোন খাবার নাকি। পাতলা আটার রুটি, ডিমের অমলেট আর ডাল ভুনা। পরে ফ্রুট সালাদ আর দুধ ছাড়া চা। অর্ডার মত ডাইনিং হল আমাকে প্রতিদিন সকালে এই নাস্তা খেতে দেয়। তেল ছাড়া এই খাবার খেয়ে আমি খুব স্বস্তি বোধ করি।

পিচ্চি আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করল আশেপাশে দারুন স্বাদের নাস্তা খাওয়ার রেঁস্তোরা আছে। সেখানে খাবার এত মজা যে একবার খেলে নাকি প্রতিদিন খেতে চাইবো। রাজী করাতে না পেরে সে বাধ্য হয়ে মুখ কালো করে আমার সাথে নাস্তা খেল একটুখানি। তারপর বলে,চলেন আপনাকে নিয়ে বাইরে যাব।

আমি সাধারনত নিজের বন্ধু বান্ধব ছাড়া আর কারো সাথে বের হই না। একা তো যাইই না। অনেক পরিচিত ঢাকা শহর এখন একেবারেই অপরিচিত লাগে। সেদিন ছিল শুক্রবার। পিচ্চির চেহারায় অনেক আগ্রহ দেখে ওর সাথে বের হয়ে পড়লাম। জানতে চাইলাম কোথায় নিয়ে যাবে । উত্তর দেয়, আপনাকে রিকশায় করে ঘুরাবো। আজই আরামে ঘোরার দিন। ছুটির দিন বলে রাস্তাঘাটে মানুষ, গাড়ি ঘোড়া অনেক কম দেখা যাচ্ছিল। রাস্তায় বের হয়ে অনেকগুলি রিকশার সাথে কথা বলে ব্যর্থ শেষে একজনকে রাজী করালো। রিকশায় চড়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল।

হাতিরঝিল আগে আমার দেখা হয় নাই। দেশের বাইরে বসে রঙচঙে ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। রিকশা গুলশান এক নম্বর দিয়ে সেদিকেই রওয়ানা হল। রিকশাওয়ালা মনে হল ঢাকায় নতুন এসেছে। বোকাসোকা সরল চাহনি। কথায় কথায় খালি হলুদ দাঁত বের করে হেসে দেয়। সে বলে, সাব আমি কিন্তু চিনি না। চিনায়ে নিয়েন।

হাতির ঝিলে ঢোকার মুখে পুলিশ আমাদের হাত নেড়ে সেদিকে যেতে নিষেধ করল। একটা উঁচা লম্বা বিল্ডিং এর সিঁড়িতে আলস্যভরে বসে আছে বন্দুক হাতে আর্ম ব্যাটেলিয়নের ড্রেস পরা দুই পুলিশ। পিচ্চি রিকশা থেকে নেমে ওদের দিকে এগিয়ে গেল। অনুনয় করে বলে ভাই, প্লিজ যেতে দেন না। আজ তো শুক্রবার। বেশী গাড়ি নাই। পুলিশ নির্বিকারভাবে মাথা নাড়ল। এবার পিচ্চি যে কাজটা করল – সেটা দেখে এবং তার কথাগুলি শুনে পেট ফেটে হাসি আসল। কিন্তু আমি না হেসে জোর করে মুখ গম্ভীর করে বসে রইলাম।

সে পুলিশদের খুব করুনভাবে বলে,সে পুলিশদের খুব করুনভাবে বলে, ভাই, আমার সাথের এই লোক বিদেশে থাকে। খুব খারাপ অসুখ হইসে। বেশীদিন বাঁচবে না। ডাক্তার সময় বাইন্দা দিসে। তাই দেশ দেখতে আসছে। ওনার সখ হাতিরঝিল ঘুইরা দেখবে রিকশায়। তাই নিয়ে এসেছি। দুই দিন পর মইরা যাইবো। দেন না ভাই, লোকটার মনের আশা পুরন কইরা।

এমন কথা শুনে দুই পুলিশের মন গলে গেল। একবার খুব মায়ার দৃষ্টিতে আমাকে দেখে নিয়ে তারপর ছেড়ে দিল। সে গম্ভীরভাবে এসে রিকশায় উঠল। আমাকে মরন ব্যাধীর রোগী বানানোতে ইচ্ছা করছিল পিচ্চিকে ধাক্কা মেরে রিকশা থেকে ফেলে দেই। কিন্তু সেটা না করে একটু দূরে গিয়ে রিকশাওয়ালাসহ আমরা তিনজন অট্ট্রহাসিতে ফেটে পড়লাম। করিতকর্মা ছেলের বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলাম না।

মনে পড়ে গেল অনেক পুরনো দিনের আরেক স্মৃতি। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার দিনগুলিতে একবার হলের কারো কাছে পয়সা ছিল না দুপুরে ভাত খাওয়ার। তখন বন্ধুরা বুদ্ধি করে আমার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে,বেশীদিন বাঁচব না- এমন কথা ছড়িয়ে দিল। মেয়েদের মন এমনিতে খুব নরম। ওরা সবাই আমার উপর খুব সহানুভুতিশীল হয়ে পড়ল। বেশ কয়দিন খুব বেশী ভাল খাবার খেয়ে ভালই দিন কাটছিল আমার, সাথে বন্ধুদেরও। পরে যখন সত্য প্রকাশ হয়ে পড়ল,মেয়েদের মাইরের হাত থেকে কেউ রক্ষা পাই নাই। আজ এত বছর পর এই পিচ্চি আমাকে সেই একই মরণব্যাধীর রোগী বানিয়ে পুলিশের করুনা আদায় করে নিল।

রিকশায় বসে আরাম পাচ্ছিলাম না। একটূ ব্রেক করলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ার দশা হচ্ছিল অনেকদিন না চড়ার কারনে।

সে বুঝতে পেরে বলে, মিয়া, আপনেরে রাস্তাঘাটে পাইলে তো টোকাইরা বটি কাবাব বানায়া খায়া ফালাইবো। যে কেউ বুইঝা ফালাইবো আপনে এই শহরে নয়া মাল।

তারপর সে আমার সামনের দিকে হাত দিয়ে রিকশার হুড ধরে থাকল যেন আমি আচমকা হুমড়ি খেয়ে পড়ে না যাই। ওর কথা শুনে মুখে হাসলেও মনে মনে ভাবলাম,হায়রে এক সময় আমি শহরের এক মাথা থেকে আরেক মাথা দাবড়ে বেড়িয়েছি রিকশায় চড়ে – সেই আমি এখন রিকশায় চড়তে গিয়ে পড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়। তাইতো, আমি আসোলেই এই শহরে এখন নয়া বাতিল মাল।

হাতিরঝিলের অনেক গল্প শুনেছি। চোখ ঝলসানো ছবি দেখেছি অনলাইনে। এই প্রথম নিজের চোখে দেখার সুযোগ পেলাম। খুব ভাল লাগছিল ঢাকার ভিতর এত মনোরম জায়গা দেখে। সবুজ আর সবুজ চারিদিকে। মাঝে মাঝে এখানে সেখানে লেইক। যদিও লেইকের পানি ময়লা এবং গন্ধ ছড়াচ্ছিল। শুরুর দিকে ব্যবস্থাপনা খুব ভাল থাকলেও এখন মনে হল এর রক্ষনাবেক্ষনে ভাটা পড়েছে।

এক লেইনের রাস্তা আমার কাছে খুব বিপদজনক মনে হল। মটর বাইক, গাড়ি গুলি খুব বেপরোয়া গতিতে পাশ কাটাচ্ছিল। যে কোন সময় মারাত্বক বিপদ ঘটে যেতে পারে মনে হল। ছুটির দিন বলেই হয়ত অনেক মানুষের আনাগোনা দেখলাম। বিশেষ করে কপোত কপোতীর ভীড় অনেক এখানে সেখানে। জায়গায় জায়গায় পুলিশ বক্স থাকা উচিৎ বলে মনে হল। তাহলে হয়রানী আর ছিনতাইয়ের সম্ভাবনা কমে যাবে। মনে হল রাতের বেলায় পুলিশ না থাকলে বিপদজনক হতে পারে ওখানে বেড়াতে যাওয়া। মোদ্দা কথা হল, খুব ভাল লেগেছে আমার কাছে এই হাতিরঝিল। পিচ্চিকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম ওর ননস্টপ ধারা বিবরনীর জন্য।

অনেক সময় নিয়ে হাতিরঝিল ঘুরে দেখে আমরা রামপুরা এসে পৌঁছালাম। পিচ্চি সেখানে আমাকে চা খাওয়াতে চাইল। আমি রাজী হলাম না। বললাম,চা কম খাই। তাছাড়া বাইরে কিছু খেলেই পেট ব্যথা শুরু হয়ে যায়। তখন কোথায় দৌড়াবো ? তখন সে রিকশাওয়ালাকে ফিরতি পথের শর্টকাট পথ বুঝিয়ে দিল। অনেক রাস্তা ঘুরে এক সময় আমরা তেজগাঁও আড়ং এ এসে থামলাম। সে রিকশা ভাড়া দিতে চাইল।

আমি বাঁধা দিয়ে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করি, কত চাও ভাই, বলে ফেল?

রিকশাওয়ালা গামছা দিয়ে মুখ মোছে আর হাসে। কিছুই বলে না। একটা একশ’ টাকার নোট দিলাম। সে তখনো হাসে। তারপর আরেকটা একশ’র নোট দিলাম। হাসি একটু প্রসারিত হল। এরপর আরো একটা নোট দিলাম। এবার সে সন্ত্রস্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইল আসলে আমি টাকাগুলি দিব নাকি পরীক্ষা করছি।
শেষে আরো দুইশ’ দিয়ে পাঁচশ’ মিলিয়ে দিয়ে তাকে বললাম – আজ আর কাজ কইরো না, বাসায় চলে যাও।

সে তখনো মুখের সেই হাসি যার কিছুটা আনন্দ, কিছুটা দ্বন্দ, অবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম খুব সরল মানুষ। এমন ঘটনা তাঁর জীবনে প্রথম ঘটেছে, তাই সে হতভম্ব হয়ে পড়েছে। পিঠে হাত দিয়ে আশ্বস্ত করে আমরা আড়ং এর গেটের ভিতর ঢুকলাম।

দেখি দারোয়ান আমাদের অনেক লম্বা সালাম দিল। পিচ্চি বলে, দেখি দারোয়ান আমাদের অনেক লম্বা সালাম দিল। পিচ্চি বলে, লেও ঠেলা। দারোয়ান দেইখা ফালাইসে আপনে দান বাক্স খুইলা বইসেন। তাই আশায় আশায় লম্বা সেলাম দিছে আপনেরে।

আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম।

ওকে বললাম, ওকে বললাম, রিকশাওয়ালাদের প্রতি আমার আলাদা একটা দুর্বলতার জায়গা আছে মনে। জীবনে ওদের অনেক কম পয়সা দিয়েছি, অনেক গালমন্দ করেছি। ওদের কাছে আমার অনেক ঋন আছে। একজনকে সামান্য বেশী দিয়ে সেই ঋনের কিছুটা যদি শোধ হয়, ক্ষতি কি!

জানতে চাইলাম,আড়ং এ কেন এসেছি, আমার তো কোন শপিং নাই।

সে বলে তাতে কি, আপনের নাই কিন্তু আমার আছে।

সে অনেক খুঁজে,বেছে আমাকে দিয়ে অনেকবার ট্রায়াল দেওয়ায়ে দুইটা পাঞ্জাবী জোর করে গছালো নিজের পয়সায়।

বললাম, ঠিক আছে তোমার পছন্দে আমিই না হয় কিনি।

এবার সে গম্ভীর হয়ে বলে, দেশে থাকি বলে কি এই সামান্য জিনিস কেনার পয়সাও আমার কাছে নাই নাকি ! শুনে আর বাঁধা দিতে পারি নাই।

এরপর বলে,চলেন এবার আপনাকে ঢাকা শহরের সবচেয়ে নিরাপদ আর সেরা চা খাওয়াবো।

আড়ং এর ক্যান্টিনে নিয়ে গেল। খুব সুন্দর পরিবেশ। তেমনি আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা। চা আর ডালপুরির অর্ডার দিল। সুন্দর কাটলারিতে করে খাবার দিয়ে গেল বেয়ারা। ইতস্তত করে ডালপুরি খেলাম একটা। খেয়ে দেখি অন্যরকম মজার স্বাদ। সাইজে অনেক বড় একেকটা। ভাল লাগায় ঢাউস সাইজের দুইটা পুরি খেয়ে ফেললাম। তারপর চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। মন জুড়িয়ে গেল চায়ের সুবাস আর স্বাদে। এত মজার চা ঢাকায় আর কোথায় পাই নাই। সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে আরেকটা রিকশায় চড়ে ফিরে এলাম হোটেলে। আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল পিচ্চি।

বয়সের ফারাক সরিয়ে রেখে হাসি তামাশায় সুন্দর প্রানবন্ত বেশ কিছুটা সময় উপহার দিয়ে ,মনের কোনায় দাগ কেটে রেখে গেল সে। এতই প্রানবন্ত মানুষ যে মনেই হয় নাই তার সাথে জীবনে প্রথম দেখা হয়েছিল সেদিন। বরং মনে হয়েছে যেন তার সমবয়সী বন্ধু,দু’জন দু’জনকে চিনি যুগ যুগ ধরে।
নভেম্বর ২০১৬