ফ্যাকাশে শিশুকাল

যখন পিছনে ফিরে তাকাই,শৈশবের কত কথা মনে পড়ে। কত বয়স হলে মানুষ কথা মনে রাখা শুরু করে আমার ধারনা নাই।। নিজের বেলায় দেখি অনেক পিচ্চিকালের কথাও আমার মনে পড়ে।

নিজের ছেলেদের শিশুকালে দেখেছি কত রকমের খাবার নিয়ে ওদের মা সারাক্ষন পিছনে পিছনে দৌঁড়াত। ওনাদের ইচ্ছা হলে খেলার মগ্ন থাকার ফাঁকে কখনো কখনো না তাকিয়ে মুখ হা করত মা যেন মুখে খাবার তুলে দেয়। ঘন্টায় ঘন্টায় ভিন্ন ভিন্ন খাবার, ফল, জুস। বাসার খাবার না খেতে চাইলে ম্যাকডোনাল্ডস, বার্গার কিং এর খেলনাসহ কিড’স মিল এর মনোরম বাক্স। কিড’স মিল এর ছোট ছোট চিজ বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিকেন নাগেট পিচ্চি পোলাপাইন গপ গপ করে গিলে বরফ দেয়া সোডার গ্লাস স্ট্র দিয়ে টেনে শেষ করে ফেলত অবলীলায়। খাবার শেষ করলে দেখতাম খুশিতে ছেলের মায়ের চোখ চক চক করছে। আর আমি আপন মনে ভাবতাম, আহ কি চাঁন কপাল তোদের। চাইবার আগেই কত কি হাজির হয়ে যায় তোদের সামনে। সামান্য সর্দি জ্বর হলে ডাক্তারের কাছে দৌড়াদুড়ি শুরু হয়ে যেত। তখন আবার নরম আর ভিন্ন খাবার বানানো হত ওদের জন্য। যেন রাজপুত্তুর আর কি !

অথচ আমার শিশুকাল কেমন প্রানহীন, ফ্যাকাশে সাদাকালো ছিল। কেউ খাবার নিয়ে অপেক্ষা করত না। পিছে পিছে দৌড়াত না। মুখে তুলে দিত না। এসব কিছুই পাই নাই। এখনো স্পষ্ট মনে আছে সাদা ভাত ডাল দিয়ে মাখানো সাথে ছোট ছোট মুরগির মাংশের টুকরা দিয়ে বেড়ে দেয়া হত। ঘন্টা লাগিয়ে খেতাম সেই ভাত। সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি বুকের কাছে ডাল আর ঝোল দিয়ে ভিজিয়ে ফেলতাম। দুই গালে ভাত আর ঝোল লেগে শুকিয়ে শক্ত হয়ে যেত। তারপর কাজের মানুষদের দয়া হলে বাথরুমে ধুতে নিয়ে এত জোরে গাল ঘষে দিত যে ব্যথায় কেঁদে উঠতাম।

কলা খেতে গিয়ে বড় করে কামড় দিয়ে সেই টুকরা গিলতে গিয়ে গলায় আঁটিকে গিয়ে একবার তো মরতে বসেছিলাম। সেই সময়ে সবচেয়ে ভাল লাগত পেষ্ট্রি খেতে। পেষ্ট্রি উপরের ক্রিম চেটে চেটে খেতে এত ভাল লাগত, আহ যেন সেই স্বাদ এখনো জিবে লেগে আছে।

আরেকটু বড় হলে বড়দের দেখাদেখি বয়াম থেকে হরলিকস, ওভাল্টিন, ডানো গুড়া দুধ হাতে নিয়ে চুরি করে খেতাম। শুকনা হরলিকস, গুঁড়া দুধ খাওয়ায় অনেক ঝামেলার কাজ ছিল। দ্রুত খাওয়া যেত না। মুখের ভিতর আটকে যেত। সহজে গিলতে পারতাম না। চিনি, গ্লুকোজ ডি, পাটালি গুড়, এসব যাই পেতাম ইদুরের মত খুঁটে খুঁটে সব খেয়ে ফেলতাম।

হটাত একদিন আবিষ্কার করলাম চা বানানোর কন্ডেন্সড মিল্ক। গরুর ছবি দেয়া ছোট ক্যানের দুই দিক দিয়ে ফুটা করত ঘন এই দুধ বের করার জন্য। একদিন দেখি কালো পিপড়া সেই ক্যানের চারপাশে ভীড় করে আছে, ব্যাপার কি জানার জন্য হলদেটে আঠালো সেই দুধ আঙ্গুলে লাগিয়ে মুখে দিয়ে খুশীতে আত্মহারা হয়ে গেলাম। এমন মজার কিছু মনে হয়েছে আমি যেন জীবনেও খাই নাই। ক্যানের ফুটা দিয়ে মুখ লাগিয়ে টান দিতেই অমৃতের স্বাদ আমার গলা দিয়ে কল কল করে পেটে চলে যেত – ঠিক যেমন পেট্রোল পাম্পে তেলের হোস গাড়ির ট্যাংকে লাগিয়ে চেপে ধরলেই সাঁই সাঁই করে যেতে থাকে। এই স্বাদ আমি জীবনেও ভুলব না। আমি তো একা ছিলাম না। এই দুধ চোর বাসায় অনেকেই ছিল। দেখা যেত আমাদের ভয়ে চায়ের দুধ আলমারিতে তালা চাবি দিয়ে আটকে রাখা লাগত। কিন্তু সেটা বেশীদিন রাখতে পারত না। কারণ আলমারিতে পিপড়ার আক্রমন ঘটে অন্য সব কিছু নষ্ট হত।

বাসায় কে যেন হোমিওপ্যাথির ঔষধ খেত। সরু স্বচ্ছ কাচের শিশি’র ভিতর চিনির দানার মত সাদা ছোট ছোট গোল গোল দানা ভর্তি। খাওয়ার সময় আমি তাকিয়ে ছিলাম। তাই মনে হয় আমাকে দুই একটা দানা খেতে দিয়েছিল। বেচারা তো বুঝে নাই সেটা করে জীবনের কত বড় ভূল করে ফেলেছে। খেতে মিষ্টি এবং ঠান্ডা অনুভুতি লেগেছিল। ব্যস, সুযোগ বুঝে ওনার এক মাসের ঔষধ আমি এক সেকেন্ডে খেয়ে শেষ করে ফেলেছিলাম।

সেই সময় কারো পেশাবের সমস্যা হলে “সায়লকালি” নামের একটা সিরাপ খেতে দিত। দেখতে অনেকটা “মাউন্টেইন ডিউ” র মত। অবাক ব্যাপার হল স্বাদ ও সেইরকম। অদ্ভুত মজার সিরাপ ছিল। একটু একটু করে খেয়ে পুরো বোতল সাবাড় করে দিতাম সবার অলক্ষে।

এসব খেয়ে ধরা পড়ি নাই আমি। বরং অনেক সময় দোষ না করেও মার খেত আমার চেয়ে সামান্য বড় ভাই জামাল। কিন্তু ধরা পড়ে গিয়েছি যখন পেটে ক্রিমির উৎপাত ধরা পড়ল ঠিক তখন। এই ক্রিমির ঔষধ খেতে খুব বিশ্রী স্বাদ লাগত। তাই ঔষধ খাওয়ার ভয়ে আমি মিষ্টি জিনিস খাওয়া ছেড়েছিলাম।

সব চাইতে ভয়ংকর অবস্থা হত, যদি কখনো জ্বর কিংবা পেটে অসুখ হত। ডাক্তার এসে লাল রঙের মিকচার দিয়ে যেত খেতে। চ্যাপ্টা কাঁচের বোতলে ডোজ এর হিসাবের জন্য সাদা কাগজ লাগানো থাকত। এত বিশ্রী স্বাদ মনে হয় পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে না। মুখে দেয়ার সাথে সাথে বমি করে দিতাম। তবুও বাঁচার উপায় ছিল না। আবার খেতে হত। বাবার মার খাওয়ার ভয় থাকত।

অসুখের ঔষধ ছিল আলতা রঙের বিশ্রী স্বাদের মিকচার। আর পথ্য ছিল আরো জঘন্য কিছু খাবার। পেট খারাপ হলে Robinson’s Barley নামের পাউডার দুধের মত দেখতে এক জঘন্য জিনিস ছিল। গরম পানির সাথে মিশিয়ে বানানোর পর সেটা দেখতে নরম সুজির হালুয়ার মত হলেও খেতে লবন ছাড়া ভাতের মাড়ের চাইতেই বিস্বাদ ছিল। কিন্তু সেই অখাদ্য জিনিস খেতে হত ইচ্ছা না করলেও ফেলে দেয়া কিংবা না খাওয়ার কোন উপায় ছিল না সেই সময়ের বাবার মিলিটারি শাসন ব্যবস্থায়।

জ্বর হলে খেতে দিত সাগু নামের আরেক বিশ্রী জিনিস। সাদা ছো্ট ছোট দানা । রান্না করলে কেমন পিচ্ছিল হয়ে যেত। চিনি দিলেও খেতে ভাল লাগত না আমার।

সবচাইতে ইন্টারেষ্টিং ঘটনা ঘটেছিল যেদিন আমার মুসলমানী করানো হয়। সকাল থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। হাজাম আসার পর আমাকে ধরে নিয়ে আসল আমাদের কাজের ছেলেরা। আমি হাজামের উদ্ধেশ্যে একশ’ আশি মাইল বেগে যত গালি মুখস্থ ছিল সব বলে যাচ্ছিলাম। ধারনা ছিল, আমার গালির চোটে হাজাম রেগে মেগে উঠে চলে যাবে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটে নাই। একজন আমাকে চ্যাংদোলা করে ধরে রাখল। হাজাম বেটা কাঁচি দিয়ে কচ করে আমার শিশ্নের অংশ বিশেষ কেটে নিল। তীব্র এক জলুনি টের পেলাম। গালি তখনো চলছিল।

বাবা আমার হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট ধরিয়ে দিল। সাথে সাথে আমার গালি বন্ধ হয়ে গেল। এবং আমি জ্ঞ্যান হারালাম। জ্ঞ্যান ফেরার পর দেখি হাজাম বেটা গায়েব। কিন্তু আমাকে কালো রঙের কি যেন একটা পেঁচিয়ে দিয়ে গেছে। সেই কালো পুটুলি নিয়ে এক সপ্তাহ বিছানায় শুয়ে থাকলাম।

আমার খুব ফোঁড়া উঠত গায়ে। মনে আছে ফোঁড়া পেকে গেলে খেঁজুর কাঁটা দিয়ে ফুটা করে গায়ের জোরে টিপে পুঁজ বের করে বরিক পাউডার লাগিয়ে দিত। ব্যাথার চোটে এত চিৎকার করে কাঁদতাম কিন্তু তাই বলে কারো মনে দয়া হত না।

সব কিছু মিলিয়ে সিক্সটিজ এর শিশুকাল পেষ্ট্রি আর কন্ডেন্সড মিল্ক খাওয়া ছাড়া মোটেও আনন্দের ছিল না। মজার কোন খাবার ছিল না। মজার কোন অষূঢ ছিল না। অসুখ হলে খেতে হত সব বিশ্রী অখাদ্য আর তিতা ঔষধ।

নভেম্বর ২৫, ২০১৫