ছেলেবেলার মিষ্টি মধুর দিনের গল্প

ধুতুরা গাছে নাকি বিষ আছে শুনেছি।সেই বিষ কি পাতায় না ফুলে জানা নাই।ধুতুরা ফুল ফুটে আছে দেখলেই আমি পট পট করে ফুটিয়ে ফেলতাম। কই, আমার হাতে তো কোন ঘা হয় নাই কখনো। অবশ্য খেয়ে দেখি নাই। ফুলেই মনে হয় বিষ।

সেই সময়ে বনানী আসোলেই বন,গাছ গাছালিতে ভর্তি ছিল।হাতে গোনা বাড়ি ঘর ছিল। আশে পাশে কোন দোকানপাট ছিল না। কিছু কিনতে হলে অনেকদুর হেটে হয় যেতে হতো চেয়ারম্যান বাড়ি ( কাকলী) না হয় গুলশান -২ এর ডি,আই,টি মার্কেটে।

মাওলানা মান্নানএর ছেলে বাহাউদ্দীন, মনিরুদ্দীন বয়সে বড় হলেও আমার বন্ধু ছিল। ছিল ওদের বোন নাজুও।

নন বেঙ্গলী ওয়াসিম ছিল আমার সমবয়সী। ওর বড় ভাই বাবু,বোন বেবী সবাই ছিল আমাদের খেলার সাথী।ছিল আমার অনেক প্রিয় বন্ধু মাহি আর মিলন।
আমরা সবাই একসাথে ঘুরে বেড়াতাম বনে জঙ্গলে।লজ্জাবতী লতা দেখলেই কে কার আগে ধরবে আর পাতা গুলি ভাঁজ হয়ে যেতে দেখবো তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেতো।
ব্লুবেরীর মত দেখতে কালচে থোকা থোকা বন্য ফল ছিড়ে মনের আনন্দে খেয়ে দাঁত জিব সব কালো করে ফেলতাম।

এত কম বাড়িঘর মানুষ ছিল বনানিতে তখন যে, সবার সাথে সবার পরিচয় ছিল। বেশির ভাগ প্লটে ইটের দেয়ালের উপর টিনের চাল দিয়ে তৈরি বাসা ছিল। মাহি’দের বাড়িটা অমন ছিল।

পুরো এলাকায় মাত্র তিন বাসায় গাড়ি ছিল। তাই পরিচিত তিন গাড়ির বাইরে অন্য কোন গাড়ি দেখলেই আমরা আগ্রহ নিয়ে দেখতাম। বুঝতে চাইতাম,এরা কারা।এখানে কি চায়।

নিজেরাই খুদে গোয়েন্দার মত সন্ধানী চোখ নিয়ে ওদের ফলো করতাম। পরে আবিস্কার করেছি ,বিকেলের দিকে যদি কোন গাড়ি নিরিবিলি কোন ঝোপ ঝাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতো – মানে হল কেউ লুকিয়ে প্রেম করতে এসেছে।কেউ কেউ আসতো বন্ধুরা মিলে ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে বসে মদ খেতে। ওরা চলে গেলে আমরা খালি বোতল গুলি কুড়িয়ে আনতাম কটকটি খাওয়ার জন্য।

আমাদের প্রিয় খেলা ছিল ক্রিকেট। ওয়াসিম এর ছিল শিয়ালকোট থেকে আনা ক্রিকেটের ব্যাট আর বল। ইটের উপর ইট রেখে আমরা উইকেট বানাতাম। ওয়াসিমের ভাই বাবু’র হাতে মারাত্বক শক্তি ছিল। প্রায়ই ছক্কা মেরে বসতো।ছক্কা তখন ধরে নেয়া হতো যখন ওর হিট করা বল গিয়ে কারো বাড়ির দোতলার জানালার কাঁচ ভাংতো। আওয়াজ শুনে বুঝতাম,কাজ হয়ে গেছে। ছক্কা আ আ আ বলে চিৎকার এবং সাথে সাথে যে যেদিকে পারে পালিয়ে যেতাম ভোঁ দৌড় দিয়ে।

কারণ যে বাড়ির জানালার কাঁচ ভেঙ্গেছে,তারা একটু পরে এসে হাজির হবে।জিজ্ঞেস করে বের করবে কে করেছে এই কুকর্ম। অতঃপর তার বাবার কাছে বিচার দিয়ে মার খাওয়ানো। ধরা খেলে আমাদের আনন্দ করা কয়েকদিন বন্ধ থাকতো। আমরা রিতিমত ‘হাউজ এরেষ্ট’ হয়ে থাকতাম। তারপর আর কোন দিন এই খেলা খেলবো না এমন মুচলেকা দিয়ে বাসা থেকে বের হবার চান্স পেতাম।

খেলার জন্য মাঠের অভাব ছিল না আমাদের। বলা যায় বন জঙ্গল ছাড়া পুরো বনানি তখন ফাঁকা। যেখানে খুশি খেলা যায় কিন্তু আমাদের পছন্দ ছিল এমন জায়গা যার আশে পাশে বাড়ি ঘর ছিল। যাতে করে কোন বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালে বল গিয়ে পড়লে ‘চার’ ধরতাম এবং কোন বল কারো বাড়ির দোতলা, কার্নিশ, জা্নালায় গিয়ে পড়লে ‘ছক্কা’ ডিক্লেয়ার দিতে সুবিধা হতো। তাই কেস খাওয়ার কয়েকদিন আমরা সুবোধ বালক হয়ে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে খেলতাম তারপর আবার নিজেদের আগের মাঠে ফিরে আসতাম।

এই ক্রিকেট নিয়ে আমার একটা স্মৃতি আমি কোন দিন ভুলতে পারি না। পঁচিশে মার্চের পরদিন ওয়াসিম এসে আমাকে বলে, ওরা বনানি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তারপর সে তার ক্রিকেট ব্যাট আর বল আমাকে দিয়ে দিলো বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরুপ। সেদিন আমি অনেক কেঁদেছিলাম। কিছুদিন পর আমরা যখন ঢাকা ছেড়ে পালালাম গ্রামে। যাবার সময় খুব যত্ন করে ঐ ব্যাট বল সাথে করে গ্রামে নিয়ে গেলাম। ওখানে গিয়ে গ্রামের সমবয়সী ছেলেদের ক্রিকেট খেলা শেখালাম একসাথে খেলার জন্য।

একদিন খবর এলো গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারি আসতেসে। ওরা নাকি সবার বাড়ি ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিবে। আমাদের বাড়ির সব ফার্নিচার পাশের পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হলো যেনো পুড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। আমিও আমার ব্যাট আর বল পুকুরের সিড়িতে ডুবিয়ে ইট চাপা দিয়ে রাখলাম যেন কেউ দেখতে না পায়।

আর্মি ঠিক এলো। অনেকের ঘর বাড়ি পোড়ালো। আমাদের বাড়ি বেঁচে গেলো। পুকুর থেকে সব কিছু উঠানো হলো। আমি শিয়ালকোটের তৈরি আমার মহা মুল্যবান ব্যাট আর বল পানি থেকে উঠিয়ে আনলাম। কিন্তু মহা দুঃখের সাথে দেখি পানিতে ভিজে ব্যাটের হাতল থেকে নীচের কাঠ আলাদা হয়ে খুলে গেলো। কারন,আঠা দিয়ে লাগানো ব্যাটের দুই অংশ আলাদা হয়ে গেছে পানিতে ভিজে। কাঠের বল পানিতে ভিজে এত ভারী হল যে মনে হচ্ছিলো ওটা যেন ‘শট ফুট’ খেলার লোহার বল। আমার এই বিশাল ক্ষতিতে আমি অনেক দিন খুব কেঁদেছি।

যাইহোক, আবার বনানির স্মৃতিতে ফিরে যাই।
আমি, মাহি আর মিলন পড়তাম মহাখালী অয়ারলেস গেটের কাছে ‘আদর্শ বিদ্যালয়ে’।
আমার বড় বোনরাও যেতো ঐ স্কুলে। ওয়াসিম,বাবু,বেবী যেতো শাহীন স্কুলে।

সাদা হাফ সার্ট,নেভী হাফ প্যান্টস আর কাপড়ের সাদা কেডস ছিল স্কুল ড্রেস। বনানী আমাদের বাসা থেকে স্কুল পর্যন্ত যেতে জায়গাটা ছিল উচুনীচু খালি বিল।
বর্ষাকালে পানিতে ভরে যেতো। গরমকালে শুকিয়ে ধুধু খালি মাঠ হয়ে যেতো। লাইন বেধে অয়ারলেস এর টাওয়ার ছাড়া আর কিছুই ছিল না ওখানে।

আমাদের বিলাস বলতে ছিল পয়সা জমিয়ে দল বেঁধে অনেকদুর হেটে গুলশান ডি,আই,টি মার্কেটের ‘ইকবাল জেনারেল স্টোর’ এ গিয়ে সবুজ কিংবা কমলা রঙ এর ইগলু ললিজ আইসক্রিম খাওয়া। ৮০ পয়সা ছিল একটা আইস্ক্রিমের দাম। সময় নিয়ে খুব আস্তে আস্তে যত্ন করে সেই আইসক্রিমের স্বাদ নিতাম। মনে মনে চাইতাম আইস্ক্রিমটা যেন অনেক্ষন ধরে খেলেও শেষ হয়ে না যায়।

সেই সময়ে ওই মার্কেটে বিদেশী মানুষ ছাড়া আর কাউকে খুব কম দেখা যেতো। হা করে তাকিয়ে দেখতাম বিদেশী সাহেব,মেমদের। মনে হতো ওরা যেন অন্য গ্রহের মানুষ।পাশ দিয়ে হেটে গেলে অনেক সুন্দর সুগন্ধ লাগতো নাকে।

আরো ভাল লাগত ‘ইকবাল জেনারেল স্টোর’এর বিদেশী জিনিস পত্রের গন্ধ। অবাক কান্ড হোলো, এত যুগ পরে এখনো দেশে গেলে আমি যখন কিছু কিনতে ঐ দোকানে যাই, সেই অতি পরিচিত পুরনো সুন্দর গন্ধটা এখনো পাই। খুব নস্টালজিক লাগে তখন।

বিদেশীরা যে সব বাসায় ভাড়া থাকতো তার আশে পাশে খুঁজলে পেতাম বিদেশি সিগারেটের খালি প্যাকেট। তখন হবি ছিল এই সিগারেটের প্যাকেট জমানো।
এখন মনে হলে হাসি,তখন না বুঝে আমরা আসোলে ওদের ফেলে দেয়া ময়লা হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট খুজতাম।

বনানীতে যে কয়টা বাড়ি ছিল, বাড়িওয়ালারা প্রায় সবাই নিজেরা গরু পালতো। শাক সব্জীর বাগান করতো। আমার বাবা’র তো বিশাল লাউ বাগান ছিল।যতক্ষন বাসায় থাকত, দেখতাম বাবা বাগান পরিচর্যায় ব্যাস্ত থাকত।

লাল রঙের একটা গাভী যার নাম ছিল ‘লালী’ – বাবা’র খুব প্রিয় ছিল।খুব যত্ন করা হতো এই গরুর। অনেক দুধ দিতো লালী।
একবার লালী’র গায়ে অস্বাভাবিক কিছু দাগ দেখে জানা গেলো রাতের বেলায় সাপ নাকি আসে দুধ খেতে। শুনে আমি তো ভয়ে অস্থির। সন্ধ্যা হলেই আর বাইরে থাকতে চাইনা।

লালী’র জন্য আলাদা ঘর তৈরি করা হলো। লাইট লাগানো হলো। বাসায় কুকুর রাখা হলো। সাপ নাকি কুকুরকে ভয় পায়। সাদা রঙের কুকুরের নাম রাখা হলো টমি।

এই টমি’ও সারাদিন আমাদের সাথে সাথে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতো। একদিন রাতের বেলায় টমি খুব ঘেউ ঘেউ শুরু করলো। সবার ঘুম ভেংগে গেলো।আমরা ভাবলাম গরুর দুধ খেতে সাপ এসেছে। পরে জানা গেলো,শিয়াল দেখে ঘেউ ঘেউ করছিল টমি। বাবা তার রিভলবার দিয়ে ফাঁকা গুলি করায় শিয়াল পালালো।

আমাদের বাসার পিছনে বাবার বেডরুমের পাশে ছিল অনেক বড় একটা হাসনাহেনা ফুলের গাছ। রাত হলে সাদা ফুল মন উদাস করে দেয়া গন্ধ ছড়াতো পুরো বাড়িতে। বাসার সামনে গেটের উপর লোহার ওভাল শেপ এর আর্চের উপর ছিল মাধবীলতা ফুলের ঝাড়। গোলাপী রঙের থোকা থোকা মাধবীলতাও রাতের বেলায় ঘন্ধ ছড়াতো।
একদিন দারোয়ান এসে বল্ল, এই ফুলের গন্ধেই নাকি বাড়িতে সাপ আসে।

ব্যস,আর কোন কথা নাই। বাবা নিজের হাতে হাসনাহেনা আর মাধবীলতার ঝাড় কেটে সাফ করে ফেললো। সাপ আসবে না ভেবে হাপ ছাড়লাম কিন্তু প্রিয় ফুল গাছগুলি কেটে ফেলায় খুব মন খারাপ হয়ে ছিল।

আমাদের প্রিয় সঙ্গী টমি নিজে মেয়ে হলেও অন্য মেয়েদের খুব পছন্দ করত না। টমি’র সাথে বেশি মেশার চেষ্টা করতো আমার একদম পিচ্চি ছোট বোন নাজমা। টমি মনে হয় ব্যাপারটা খুব পছন্দ করে নাই। একদিন কামড়ে দিলো নাজমাকে।

সবাই বলা বলি করতে লাগলো, কুকুর কামড়ালে নাকি মানুষের পেটে কুকুরের বাচ্চা হয়ে যায়। আমাদের আগ্রহ হল কবে কেমন করে নাজমার পেট থেকে কুকুরের বাচ্চা বের হয় সেটা দেখার জন্য। অন্যদিকে বাবা ব্যস্ত হয়ে ডাক্তার ডেকে এনে নাজমার পেটে ইঞ্জেকশন দেয়ালো যেনো কোন ইনফেকশন না হয়।

দুঃখের বিষয় হোল, নাজমাকে কামড় দেয়ার অপরাধে টমিকে একদিম চটের ছালায় ভরে অনেক দূরে ছেড়ে দিয়ে আসা হল।খুব মন খারাপ হয়ে গেলো প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে। কিন্তু একদিন পরেই দেখি, লেজ নাড়াতে নাড়াতে টমি এসে হাজির। কাছে এসেই গায়ের সাথে ঘষা ঘষি করে আহ্লাদ করতে লাগ্লো মনের আনন্দে। আমিও মহা খুশী টমিকে দেখে।

কিন্তু বিধি বাম।বাবা’র সিদ্ধান্ত অনড়।টমি’র আর কোন জায়গা নাই আমাদের বাসায়। যে কুকুর একবার মানুষ কামড়ায় সে নাকি আর নিরাপদ নয়। এই যুক্তিতে টমিকে
পার্মানেন্টলি বিদায় করার ব্যবস্থা করা হলো। সাথে যেন কেড়ে নেয়া হলো আমার শরীরের কোন অঙ্গ ।

বহুদিন পর পর দেশে বেড়াতে গেলে এখনো বনানীতে যাই। সেই বাড়িটা আর আমাদের নিজেদের নাই। কিন্তু বাড়িটা তেমনি আছে আগের মত, এক কোনায় কাঁঠাল গাছের ছায়ায় আমার মায়ের কবরটা নিয়ে।

আশে পাশের বাকি সবকিছু বদলে গেছে।

অচেনা লাগে অনেক উচু উচু বিল্ডিং দেখলে। ছেলেবেলার পুরনো বন্ধুরা সবাই হারিয়ে গেছে।
বনানিতে এখন আর বন তো পরের কথা এক চিলতে সবুজও দেখা যায়না কোথাও। নিরিবিলি রাস্তার কালো পিচ আর দেখা যায়না। তার বদলে দেখি পিঁপড়ার মত মানুষ আর দোকানপাট। ভাঙ্গা চোরা রাস্তায় কংকালের মত লাল ইট বের হয়ে লাল ধুলায় মিশে একাকার।

আমার ছেলেবেলার নিরিবিলি বনানি যেন এখন ঠাঠারী বাজারের মাছের বাজার।

আবাসিক সুন্দর বাড়ি গুলির যায়গায় জেলখানার মত দেখতে বহুতল এপার্টমেন্ট ভবন।কোন প্ল্যান ছাড়াই এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হরেক রকমরের দোকান পাট,অফিস, স্কুল, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি।

আমার পুরনো স্মৃতির ভিতর শুধু আছে আমাদের সেই পুরনো বাড়িটা ( এখন অন্য কেউ মালিক),আছে বনানি পোষ্ট অফিসের সেই পুরনো হলুদ রঙের একতলা বিবর্ন বিল্ডিং। আর আছে ডি,আই,টি মার্কেটের সেই প্রিয় ‘ইকবাল জেনারেল স্টোর।’

কালের বিবর্তনে বাকি সব মুল্যবান স্মৃতি হারিয়ে গেছে বনানির মানচিত্র থেকে।

৬ই জানুয়ারী,২০১৫