মরণ নেশা

শীতের দুপুরে লাঞ্চ সেরে বিল্ডিংএর বাইরে দাঁড়িয়ে হীমশীতল বাতাস থেকে বাঁচার জন্য জ্যাকেটের হুডটা মাথার উপর টেনে দিয়ে বিড়ি টানছিলাম আপন মনে। সামনের সাইড ওয়াক দিয়ে হাজার কিসিমের চেহারার মানুষ আসছে আর যাচ্ছে। খুব মনোযোগ দিয়ে না, এমনিই তাকিয়ে আছি আপন মনে। হটাৎ মনে হোলো পরিচিত কেউ যেন হেঁটে যাচ্ছে একটা খাবারের ডেলিভারি নিয়ে। সিউর হবার আগেই মানুষটা বেশ সামনে চলে গেল দৃষ্টি সীমার। কিছু না ভেবেই হটাৎ চিৎকার করে ডেকে উঠলাম – হিরা ভাই ই ই।

আন্দাজ একেবারে ভুল হয় নাই। হটাৎ থেমে গিয়ে পিছন ফিরে তাকালো। কাছে এগিয়ে আসলো। আমাকে ভাল করে দেখে ঠোটের কোনায় হাসি ফুটে উঠলো।
আরে মিয়া, তুমি এখানে কি কর ? বলে উঠলো উনি।

আমি কিছুক্ষন অবাক হয়ে ভাল করে উপর নীচ দেখলাম মানুষটার। খুব ময়লা আর জীর্ন শীর্ন কাপড় পড়া। পায়ের জুতা দেশ থেকে নিয়ে আসা জোড়াই। ভাঁজে ভাঁজে ফেটে গেছে। জিন্স এর প্যান্টটা এত ময়লা যে আসল রঙ প্রায় বোঝাই যায়না। তার সাথে খুব ময়লা, ছেড়া একটা গুজ-ডাউন জ্যাকেট পরা। মাথায় স্কি ক্যাপ। হাতে কোন গ্লাভস নাই। ঠান্ডায় ফেটে চৌচির। বড় বড় নখের ভিতর ময়লা ভর্তি। কিছুক্ষন কথা না বলে তারপর সাইডে টেনে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলাম – কবে এই দেশে এসেছেন, কেন এসেছেন, কোথায় আছেন, কাপড় চোপড়ের এই হাল কেন?

উনি শুধু বলল ডেলিভারিটা দিয়ে এসে আমার সাথে দেখা করবে। আমার কাজের যায়গাটা চিনে নিলো তারপর চলে গেলো। আমি বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করে ভিতরে চলে গেলাম। উনি আর সেদিন ফিরে আসে নাই।

তারপর বেশ অনেকদিন আর দেখি নাই হিরা ভাইকে। মাস খানেক পর হটাৎ হাজির। আমি সকালে মাত্র কাজে ঢুকবো, তাকিয়ে দেখি হিরা ভাই দাঁড়িয়ে আছে গেটের পাশে।আমাকে দেখে খুশি হয়ে গেলো। চোখ মুখ দেখে বুঝলাম ওনার খবর বেশি ভাল না। এখনো নেশা করেন আগের মত। কাজ থেকে দুই ঘন্টার ছুটি নিয়ে বের হয়ে হিরা ভাইকে নিয়ে পাশের কফি শপে ঢুকলাম।

নিরিবিলি একটা টেবিল খুঁজে নিয়ে দুইজনের জন্য ব্রেকফার্স্টের অর্ডার দিয়ে ওনাকে নিয়ে বসে পড়লাম।

আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগে নিজেই বলা শুরু করলো – আমি শেষ হয়ে গেছি। আমাকে নিয়ে মন খারাপ কোরো না। তারপর বলা শুরু করলো। বছর খানেক আগে দেশ থেকে কোন একটা সরকারি ট্রেইনিং প্রোগ্রাম এ এসেছিল। আর ফিরে যায় নাই। ভেবেছিল বাইরে থাকলে কাজের চাপে নেশামুক্ত থাকতে পারবে। কিন্তু কোন লাভ হয় নাই। ভালবেসে বিয়ে করা স্ত্রী একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ওনাকে ছেড়ে চলে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও নেশামুক্ত করতে না পেরে হাল ছেড়েছেন।

পঁচাশি সালের দিকে ঢাকা ভার্সিটি থেকে পাশ করে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকুরি করছিলাম তখন। নয়টা পাঁচটা অফিস করে মগবাজার থেকে রিক্সায় শাহবাগ। সিনোরিটায় গরুভুনা, পরোটা, লেবু দিয়ে ঠান্ডা স্প্রাইট খেতে খেতে অপেক্ষা করতাম বাকিদের জন্য। সন্ধ্যা হতেই জমে উঠতো আড্ডা। আস্তে আস্তে আড্ডার রেগুলার মানুষগুলি সব চলে আসতো কেউ অফিস শেষ করে কেউ বাসা থেকে। তখন আমরা সিনোরিটা ছেড়ে পিছন দিকে পি জি হসপিটালের কোনায় গিয়ে বসতাম অন্ধকারে। বিভিন্ন পেশার ১০/১২ জন মানুষ। হিরা ভাই আসতো একটা লাল রঙের ইয়ামাহা মটরসাইকেল চালিয়ে। ছিপছিপে লম্বা, হ্যান্ডসাম মানুষ। সবসময় ফিটফাট থাকার অভ্যাস। সরকারি চাকুরি করেন। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। এসে পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে বলতো, কেউ যাও, মাল নিয়ে আসো। মাল মানে ফেন্সিডিল। এক বোতলের দাম ছিল ষাট টাকা। তিনজন খেতো এক বোতল। তারপর অবিরাম চা আর সিগারেট। রাত বারোটা পর্যন্ত চলতো আড্ডা, তারপর একজন একজন করে বিদায় হত।

তখন হিরা ভাই’র সাথে পরিচয়, বন্ধুত্ব হয়। অনেক গল্প হত। সারাক্ষন ভাবী আর মেয়ের গল্প বলতো। কেমন করে ভাবীর সাথে পরিচয়, প্রেম, তারপর বিয়ে। আমরা বাকিরা সবাই তখনো ব্যাচেলর। কারো পিছুটান নাই। তখন মোবাইলের যুগ ছিল না। একদিন হটাৎ দেখি এক সুন্দরি মহিলা আমাদের আড্ডায় এসে হাজির। এসে সোজা হিরা ভাই’র সাথে ঝগড়া শুরু করে দিলো। আমরা সবাই কি করবো বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম। হটাৎ ভাবী আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন – আপনাদের কারো বউ বাচ্চা আছে কিনা জানিনা। কিন্তু আমার স্বামী প্রতিদিন আপনাদের সাথে এখানে বসে নেশা করে। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে। মেয়ে বাবাকে খুঁজে পায়না। আপনাদের কি উচিত একটা সংসার ভেঙ্গে যেতে কাউকে সহায়তা করা ?

শুনে আমরা সবাই বোকা হয়ে গেলাম। হিরা ভাইকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। তার কিছুদিন পর আমি দেশের বাইরে চলে গেছি। আর যোগাযোগ ছিল না ওই আড্ডার কারো সাথে।

নাস্তা খেতে খেতে ওনার কথা শুনছিলাম। ভাবী ওনাকে ছেড়ে চলে গেছেন। তাই উনিও আর দেশে থাকতে চাইলেন না। বাইরে আসার সুযোগ পেয়ে নিয়ে নিলেন। আর ফিরে যাবার কোন ইচ্ছা নাই। এদেশে ওনার পরিচিত কারো সাথে যোগাযোগ করে নাই। ব্রুক্লিন এর বাঙ্গালী পাড়ায় নোয়াখালি’র কারো সাথে রুম শেয়ার করতো। কিন্তু উনি নেশা ছাড়তে পারে নাই। নিয়মিত কোন কাজ করেনা, ভাড়া দিতে পারে নাই কয় মাস। তাই বের করে দিছে ওরা।

এখন ট্রেন স্টেশনে ঘুমায়। অনেকদিন কোন রুটিন লাইফ নাই। সব শুনে বুক ব্যথা করে উঠলো। বললাম, হিরা ভাই, আপনি যদি ভাল হতে চান, আমি হেল্প করবো, চিকিৎসা করাবো। রাজি আছেন?

উনি করুন হাসি দিয়ে বলল, আমি জানি তুমি সব করবা। কিন্তু কি লাভ, আমার তো আর কিছু নাই। আমি শেষ হয়ে গেসি। এই কথা বলে কিছু টাকা চাইলো। আমার সিগারেটের প্যাকেট থেকে দুইটা সিগারেট নিয়ে সেই অনেক পরিচিত হাসি হেসে চলে গেলো।

বেশ কিছুদিন রাস্তায় চোখ রেখেও আর হিরা ভাইকে দেখি নাই। এখানে সেখানে কোন নোংরা মানুষ দেখলে কাছে গিয়ে ভাল করে তাকায়ে দেখি ওটা হিরা ভাই কিনা। এভাবে খুঁজে একদিন ঠিক পেয়ে গেলাম ওনাকে। অনেক রাতে বাসায় ফিরছি সাবওয়েতে করে। বসার যায়গা পাই নাই। রড ধরে দাঁড়িয়ে আছি। তাকিয়ে দেখি ট্রেনের এক কোনা পুরা খালি। শুধু এক হোমলেস মানুষ গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। খুব দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। আমিও অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিতে গিয়ে হটাৎ মনে হল আচ্ছা এটা হিরা ভাই নাতো! নাক চেপে কাছে গেলাম। ভাল করে তাকিয়ে দেখি আমার সন্দেহ ভুল হয় নাই। ইনি আমার অনেক পরিচিত, অনেক কাছের সেই মানুষ, হিরা ভাই।

বুঝলাম, আর কিছু করার নাই। উনি এখন অন্য জগতে আছে। আমি আর বিরক্ত না করে নিরবে সরে গেলাম ওখান থেকে। কিন্তু মনটা অনেক বিষন্ন হয়ে গেলো।

আগস্ট ৩০, ২০১৩