খোকন

শ”য়ে শয়ে সহপাঠী বন্ধুর ভিড়ে কেউ কেউ হৃদয়ের গহীনে ঢুকে পড়ে ডেঙ্গু মশার মত কামড়ে ধরে থাকে। সেই কামড় যন্ত্রণার চেয়ে মধুর লাগে বড় বেশী। তারা কেন জানি কখনো হারায়ে যায় না কোন অবস্থাতে। সেজন্য তাদের আমি ডাকি নিবেদিত বন্ধুরা।

খোকন তেমন একজন। অতি আপন। শুধু বন্ধু না, আমার আইডল বলা যায় ওকে। ভীষণ নকল করতাম ওকে আমি সব কিছুতে। নকল করব না কেন, বলেন ! ক্লাসের সেরা ছাত্র। আর আমি ছিলাম লাড্ডু মার্কা। অথচ ওর সাথে আমার মারাত্বক খাতির হয়ে গেল কেমন করে যেন। ডাক নাম খোকন হলেও ভাল নামটা বড় বাহারি তার – সামস ই তাব্রীজ। আমি ক্লাস এইটে ভর্তি হলাম সেন্ট্রাল গভ হাইস্কুলে। খোকন মনে হয় সেভেনে। ময়মনসিংহের পোলা। কথায় একটু টান পাই। আমি নোয়াখাইল্যা। সেটা নিয়ে কেন জানি খুব কুঁকড়ে থাকতাম। কারণ নোয়াখাইল্যাদের সবাই জাপানী বলে টিটকারি মারত।

যাইহোক, ভাল ছাত্ররা ক্লাস ক্যাপ্টেন হয়। দুজনের একজন বিদ্যুৎ,আরেকজন খোকন। স্ট্যাম্প জমানো দিয়েই মনে হয় খোকনের সাথে খাতির হল। আমি আর্টসের আর ও সায়েন্সের। তবুও কাছাকাছি হয়ে গেলাম। ওরা ক্রিকেট খেলে। আমি খেলতে পারি না। সাইড লাইনে বসে তালিয়া বাজাই। খোকন টিফিন বিলি করে।কাছের বন্ধুরা ডাবল পায়। আমিও পাই। লুচি আর ভাজি রোল করা। একবার খাইলে বার বার খাইতে মন চায়।

হাতের লেখা তার মুক্তার মত ঝরঝরে। ওর মত করে লেখার চেষ্টা করতাম। কবিতা লেখতে পারে। আমি কোন মেয়েকে একবার প্রেম পত্র লেখবো। কেমনে লেখবো জানি না। খোকন লেখে দিলো। লেখার ভিতর কবিতা জুড়ে দিলো। ইনফ্যাক্ট দলিল লেখকের মত সবার প্রেমপত্রের লেখক ছিল খোকন। কিন্তু নিজে ওসবে যেতো না।

ক্লাসের লাড্ডু ছাত্র হয়েও ক্লাসের সেরা ছাত্রের নোট পেতাম আমি। তাই কতজনের হিংসার পাত্র হয়ে গেলাম। ফাইনাল পরীক্ষার পর অফুরন্ত অবসরে আমরা যেন রাতারাতি ছাড়া গরুর মত পুরো স্বাধীন হয়ে সারাদিন রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াই। প্রচুর সিনেমা দেখি। মাঠে, সিঁড়ির গোড়ায় বসে আড্ডা দেই। তখন আমার বাহন হল খোকেনের বাইসাইকেলের রড। তার বাইকের রডের উপর বসে সারা ঢাকা শহর চক্কর খাই রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে। কথার খই ফুটে। দুনিয়া কাঁপায়ে হাসাহাসি করি। বাসায় আর ফিরতে ইচ্ছা করে না।

আমি থাকি ২০ নং নিউ ইস্কাটন রোডে। খোকন থাকে ৩১৬ নং পশ্চিম রামপুরায়। প্রতিদিন সকাল এবং বিকাল দুই বেলা খোকন বাসায় আসতো আমাকে নিতে। আমাদের ছোট্ট একটা দল ছিল যারা সবাই প্রতিদিন দেখা করে একত্র হতাম। খোকন, ইলিয়াস, নাসিমুল, শফিক, কামাল, সাকি( মারা গেছে ), শান্তি, সামসু মামু, জুয়েল মামু, পুতুল। আর কারো নাম মনে আসছে না, সরি। এদের ভিতর আমরা পাঁচজন – খোকন, নাছিমুল, ইলিয়াস, শফিক এবং আমি একদম বান্ধা ছিলাম। হরিহর আত্মা।

খোকন যেমন হইচই করা ছেলে তেমনি হুটহাট করে ক্ষেপেও যায়। ক্ষেপে গিয়ে হটাত আড্ডা ছেড়ে সাইকেল চালিয়ে হাওয়া হয়ে যেত আমাকে সাথে না নিয়ে। তখন আমার অবস্থা করুন হয়ে যেত। হেঁটে বাসায় যেতাম। আবার রাস্তায় চলার পথে কথায় কথায় লেগে গেলে সে আমাকে মৌচাকের মোড়ে নামিয়ে দিয়ে বলতো – যা এবার হেঁটে বাসায় যা। দেখ কেমন লাগে।

কয়েকদিন আর আসতো না আমাকে নিতে। তখন আমার অবস্থা হত খাঁচায় বন্দী পাখীর মত। মন খারাপ লাগতো। হাঁসফাঁস করতাম। কিন্তু একা অতদুর যাব কেমন করে। খালি বারান্দায় এসে উঁকি দিয়ে দেখতাম গলির মুখে খোকনের সাইকেলে বসা ঘামে ভেজা মুখটা দেখা যায় কিনা।

ওদের বাসার ফোন নাম্বার ছিল খুব সম্ভবত ৪০১৯৮৫ । কথা বন্ধ থাকলে ভয়ে ভয়ে ওকে ফোন করতাম। ভুলেও ফোনে আসতো না এমন ঘাউড়া সে।

তিন চারদিন পার হলে সে নিজে নিজে এসে হাজির হত। এসে বাসার নীচ থেকে হাঁক দিতো – ঐ মুরাইদ্যা, নীচে নাম। এই হাঁক শুনলে মনে হত যেন সব সুখ আবার ফিরে এসেছে।

এক রকম শার্ট প্যান্ট বানাতাম আমরা। তখনো রেডিমেড পেতাম না জিন্স। কাপড় কিনে পিরজংগী মাজারের টেইলরে গিয়ে শার্ট প্যান্ট বানাতাম। প্যান্টের ব্যাক পকেটে প্রিয় ইংলিশ সিরিজের ছবিওয়ালা কাপড়ের পট্টি লাগাতাম।

স্টুডিওতে গিয়ে গ্রুপ ছবি তুলতাম। বিশেষ করে ইদের দিনে তো অবশ্যই।

এসএসসি’র রেজাল্টের দিন এগিয়ে আসলে ভয়ে আধমরা হলাম। পত্রিকা লুকিয়ে ফেলতাম। অবশেষে সেই বিশেষ দিনে খোকনের সাইকেলে চেপে বকশী বাজারের বোর্ড অফিসে গেলাম রেজাল্ট আনতে। অংকে খারাপ করেছিলাম। তাই থার্ড ডিভিশনের তালিকায় নাম খুঁজে দেখি, নাম নাই। সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিলাম আর বাসায় ফেরা যাবে না। বাসায় ফিরলে মেরে হাড্ডি গুড়িয়ে দেবে। স্কলার ছেলে খোকন সাতটা লেটারসহ স্টার মার্ক নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে। খুশী হয়ে আমাকে খবরটা জানালো। তারপর আমার মনমরা মুখ দেখে রেজাল্ট জানতে চাইলো। বললাম – নাম খুঁজে পাই নাই। ফেল মারছি মনে হয়। এবার সে খুঁজতে গেল। সেকেন্ড ডিভিশনের তালিকায় আমার নাম আছে। এসে বলার পরেও বিশ্বাস করি নাই। ধরে নিয়ে দেখিয়ে আনলো। দেখে নিজের বিশ্বাস হচ্ছিলো না।

খোকন ঢাকা কলেজে ভর্তি হল। বাসা থেকে আমাকে ঢাকা কলেজে পরীক্ষা দিতেও দিলো না। অলরেডি আড্ডাবাজ হয়ে যাওয়ায় বাসার ধারনা ঢাকা কলেজে গেলে নাকি আমি সারাক্ষণ নিউমার্কেট আর বলাকায় গিয়ে ক্লাস করবো। অতএব খোকনের সাথে কলেজ বিচ্ছেদ। আমি নটরডেমে গেলাম। দুই কলেজ হলেও আমাদের যোগাযোগ একটুও কমে নাই। খোকন প্রায় চলে আসতো আমার কলেজে। কলেজের পাশে আমাদের আরাধ্য আড্ডা ভূমি মতিঝিল কলোনী। তাই আড্ডা বন্ধ হল না।

কলেজ জীবন ফুরিয়ে গেল অল্প দিনে। এরপর আমি গেলাম ঢাকা ভার্সিটিতে। খোকন চলে গেল ময়মনসিংহ মেডিকেলে ডাক্তারি পড়তে। এত দূরত্বও আমাদের বন্ধুত্বে ভাটা ধরাতে পারে নাই। আমি প্রায় প্রায় ট্রেনে চড়ে ওর হোস্টেলে গিয়ে থাকতাম। খোকন ঢাকায় এলে দুই একদিন আমার সাথে হলে থেকে তারপর নিজের বাসায় ফিরত।

এভাবে আমাদের হৃদয়ের সম্পর্ক অটুট রইলো। তবে হ্যাঁ, ওর আর আমার ভিতর অনেক ঝগড়া লেগে থাকতো। খুব সামান্য কিছু নিয়ে লেগে যেত। কখনো অল্পদিন আবার কখনো অনেকদিন কথা বন্ধ থাকতো দুজনের। আমাদের কথা বন্ধ হলে অন্য বন্ধুরা খুশী হত। কারণ আমরা অনেকের হিংসার কারণ ছিলাম।

পাশ করে আমি ব্যাংকে ঢুকলাম। খোকন বিসিএস পাশ করে পুলিশে ঢুকেছে। এটুকু জানি। তখন আবার কথা বন্ধ একটা বিষয় নিয়ে। অল্প কিছুদিন চাকরী করে ঢাকা আমার কাছে একদম ভাল লাগছিল না। কারণ হলে থেকে উশৃংখল জীবনে অভ্যস্ত আমি বাসায় থেকে বিরক্ত হচ্ছি। ঠিক সেই সময়ে বিদেশে চলে যাওয়া বন্ধুরা ফোন করে উস্কানি দেয়া শুরু করলো ওদের কাছে চলে যেতে। মা বাপ নাই। মায়া মমতার কেউ নাই। কোন পিছুটান নাই। তাই সত্যি সত্যি একদিন সব গুছিয়ে আমি বিদেশে চলে গেলাম। খোকন জানলোও না।

বাইরে এসে আমি ওকে আবার মিস করা শুরু করলাম। আত্মিক বন্ধু।নিবেদিত বন্ধু। হৃদয়ের সঙ্গী। এমন সঙ্গী সাত জনমেও অনেকে পায় না। আমি পেয়েছি। তাই ওদের হারাতে পারি না। হারাতে দেই না। দিলে যে নিজেই শূন্য হয়ে যাবো।

খোঁজ খবর নিয়ে আবার ওর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করলাম। তদ্দিনে সে পুলিশের লোভনীয় চাকরী ছেড়ে দিয়ে অনেক সময় নষ্ট করে আবার তার ডাক্তারি পেশায় ফিরে এসেছে। তবে এবার আর পুরোপুরি রোগীর নাড়ী টেপার কাজে না, ডাক্তার বানানোর কারিগর হিসাবে শিক্ষকতায় গেল। ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, পড়ুয়া ছেলে খোকনের জন্য আদর্শ পেশা আসোলে শিক্ষকতা। অল্প বয়স থেকে সব বিষয় ওর জানা এবং জ্ঞানের পরিধি দেখে সব সময় মুগ্ধ হতাম। শিক্ষক হিসাবে তার কোন তুলনা হবে না। সে শিক্ষক হিসাবে স্থায়ী হল।

কথা ছিল, খোকন যখন চেম্বারে বসে রোগী দেখবে, আমি তার একদিনের পুরো রোজগার ড্রয়ার থেকে উঠিয়ে নিজের পকেটে রাখবো, এতে সে আপত্তি করতে পারবে না। সে বিকেলে অল্প কয় ঘণ্টা রোগী দেখে। তাই আমার পাওনাটা বুঝে নেয়ার জন্য হলেও আমাকে একবার ওর কর্মস্থলে যেতে হবে ঢাকার বাইরে। যেতে হবেই।

বন্ধু মানে কার কাছে কি আমি জানি না। আমার কাছে এর অর্থ খুব সিম্পল। আর সেটা হল – বন্ধু এমন কেউ সে যত সময় পার হবে, তত বেশী চকচক করবে খাদ ছাড়া খাঁটি সোনার মত। কখনো ক্ষয়ে যায় না। রং হারায় না। বন্ধু সে যার কণ্ঠ শুনলে মনের ভিতর অস্থির ঢেউ উঠে। রক্ত টগবগ করতে শুরু করে। খোকন তুই আমার তেমন একজন বন্ধু। পরম প্রিয় সম্পদ।

লাভ ইউ এজ অলওয়েজ !