সিকি পয়সার গল্প

আমেরিকার টাকা পয়সা ছাপানোর দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় কোষাগার যার নাম ‘ইউএস ট্রেসারী’, তার আবার আলাদা দুইটা ভাগ আছে। কাগজের নোট ছাপায় ‘ব্যুরো অফ এনগ্রেভিং এন্ড প্রিন্টিং’। আর ধাতুর রেজকি পয়সা বানায় ‘ইউএস মিন্ট’। দুই বিভাগের কাজ আলাদা। একদল কাগজ নিয়া আরেকদল ধাতু নিয়া মাথা ঘামায়।
আজকের গল্পের বিষয় ধাতব মুদ্রার প্রস্তুতকারক ইউএস মিন্টকে নিয়ে। ১৭৯২ সালে পেনসিলভেনিয়া রাজ্যের ফিলাডেলফিয়াতে যাত্রা শুরু করে ইউএস মিন্ট। এরপর ইউএস মিন্টের আরও তিনটা শাখা হয় কলেরাডো’র ডেনভারে, ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রানসিসকোতে এবং নিউইয়র্কের ওয়েস্ট পয়েন্টে। সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় কোষাগারের অধীনে এই চারটা কেন্দ্র থেকে রেজকি পয়সা বানানো, পরিবর্তন, এবং নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
না, আজ এখানে ইউএস মিন্টের বিস্তারিত ইতিহাস লিখবো না। লিখবো দেশের বিভিন্ন মূল্যের অনেক ধাতব মুদ্রার একটার বৈচিত্রতা নিয়ে।
বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন কারণে দেখতে এক রকম হলেও ভিন্ন বিষয় নিয়ে এক ডলার, পঞ্চাশ সেন্ট ( হাফ ডলার ), পঁচিশ সেন্ট ( কোয়ার্টার ), দশ সেন্ট ( ডাইম ), পাঁচ সেন্ট ( নিকেল ), এক সেন্ট ( পেনি ) – এই কয়টা ধাতব মুদ্রাই ইউএস মিন্ট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বানিয়ে যাচ্ছে।
মনে আছে, বাংলাদেশে যখন আশির দশকের শুরুতে নীল রঙের পে ফোন চালু হল, সেই ফোনে কথা বলতে বাঘ মার্কা সিকি ব্যবহার করতে হত। আর কোন পয়সায় কাজ হত না। আগে তো বিদেশে যাই নাই। তাই অত জানতাম না। বাইরে যাওয়ার পর বুঝতে শুরু করলাম এই সিকি বা কোয়ার্টার মানে পঁচিশ পয়সার ধাতব মুদ্রা অন্য সব ধাতব মুদ্রার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং তার ব্যবহার অনেক। যেমন ধরেন – পে লন্ড্রিতে কাপড় ধুইতে কোয়ার্টার লাগে। পে ফোনে লাগে। রাস্তায় গাড়ি পার্ক করতে মিটারে কোয়ার্টার লাগে। বাসে উঠে ভাড়া দিতে মেট্রো কার্ড না থাকলে শুধু কোয়ার্টার দিয়ে ভাড়া শোধ করতে হয়। আর যারা আটলান্টিক সিটি কিংবা লাসভেগাসের ক্যাসিনোগুলিতে গেছেন, তারা তো জানেন, স্লট মেশিনে খেলতে গেলে কোয়ার্টার লাগে। এছাড়া আর কত কাজে ব্যবহার হয়, সব তো আর আমার জানা নাই।
কোয়ার্টারের মতন এত বহুল ব্যবহার আর কোন কয়েনের হয় না।
১৭৯৬ সালে প্রথম কোয়ার্টার বানানো হয়। তারপর কিছুদিন অনিয়িমত ভাবে এই কয়েনের মুদ্রণ চলতে থাকলেও ১৮৩১ সালের পর এটি স্থায়িত্ব পায়।
কোয়ার্টারের প্রথম এবং স্থায়ী মুদ্রণ হয় সামনের দিকে জর্জ ওয়াশিংটনের মাথা আর পেছনের দিকে আমেরিকার রাষ্ট্রীয় প্রতীক ঈগল পাখীর ছবি দিয়ে।
মুলতঃ তামা এবং নিকেলের সংমিশ্রিত ধাতুর হলেও কোয়ার্টার ১৯৩২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত রুপার তৈরি ছিল। তারপর থেকে শুধু তামা এবং নিকেল দিয়ে বানানো হয়।
১৯৯৯ সালে ইউএস মিন্ট কোয়ার্টার মুদ্রণে সম্পূর্ণ আলাদা ধারনা নিয়ে বৈচিত্র্য আনার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা আমেরিকার পঞ্চাশ রাজ্য এবং ছয়টা অঙ্গ প্রদেশ নিয়ে সামনের দিক অপরিবর্তিত রেখে পেছনের ছবিতে এই ছাপ্পান্নটা অঞ্চলের বিখ্যাত পার্ক, ঐতিহাসিক স্থাপনা ছবি সম্বলিত কোয়ার্টার বানানো শুরু করে।
তার ধারাবাহিকতায় বাজারে আসে –
১৯৯৯ সালে দেলোয়ার, পেনসিলভেনিয়া, নিউজার্সি, জর্জিয়া, কানেক্টিকাট কোয়ার্টার।
২০০০ সালে ম্যাসাচুসেটস, মেরিল্যান্ড, সাউথ ক্যারোলিনা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, ভার্জিনিয়া কোয়ার্টার।
২০০১ সালে নিউইয়র্ক, নর্থ ক্যারোলিনা, রোড আইল্যান্ড, ভারমন্ট, কেন্টাকি কোয়ার্টার।
২০০২ সালে টেনেসি, ওহাইয়ো, লুসিয়ানা, ইন্ডিয়ানা, মিসিসিপি কোয়ার্টার।
২০০৩ সালে ইলিনয়, অ্যালাব্যামা, মেইন, মিসোউরি, আরকান্সাস কোয়ার্টার।
২০০৪ সালে মিশিগান, ফ্লোরিডা, টেক্সাস, আইওয়া, উইসকনসিন কোয়ার্টার।
২০০৫ সালে ক্যালিফোর্নিয়া, মিনেসোটা, ওরেগণ, ক্যানসাস, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া কোয়ার্টার।
২০০৬ সালে নেভাদা, নেব্রাসকা, কলোরাডো, নর্থ ডাকোটা, সাউথ ডাকোটা কোয়ার্টার।
২০০৭ সালে মন্টানা, ওয়াশিংটন, আইডাহো, ওয়াইওমিং, ইউটাহ কোয়ার্টার।
২০০৮ সালে ওকলাহোমা, নিউ মেক্সিকো, অ্যারিজোনা, আলাস্কা, হাওয়াই কোয়ার্টার।
২০০৯ সালে ডিসট্রিক্ট অফ কলাম্বিয়া ( ওয়াশিংটন ডি,সি ), পুয়েরটো রিকো, আমেরিকান সামোয়া, ইউএস, ভার্জিন আইল্যান্ড, নর্দার্ন ম্যারিয়ানা আইল্যান্ড কোয়ার্টার।
২০০৮ সালে ইউএস মিন্ট আমেরিকার পঞ্চাশ রাজ্যের নাম এবং বিখ্যাত ছবি সম্বলিত কোয়ার্টার বের করার কাজ সমাপ্ত করে। ২০০৯ সালে ডিসট্রিক্ট অফ কলাম্বিয়া মানে ওয়াশিংটন ডি,সি এবং আরও পাঁচটা আমেরিকান টেরিটরি’র নামে কোয়ার্টার বের করে।
জেনে রাখা ভাল, ওয়াশিংটন নামে ওয়েস্ট কোস্টে আমেরিকার আলাদা রাজ্য আছে। আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডি,সি যাকে বলা হয় ডিসট্রিক্ট অফ কলাম্বিয়া – এটি কোন রাজ্য নয়। পঞ্চাশ রাজ্যের একটি নয়। আমেরিকার আইন প্রণয়ন সংস্থা ‘কংগ্রেস’ ১৭৯০ সালে মেরিল্যান্ড এবং ভার্জিনিয়া রাজ্য থেকে ভূমি অধিগ্রহণ করে ওয়াশিংটন ডি,সি নাম দিয়ে এটিকে দেশের রাজধানী হিসাবে স্থাপন করে।
ইউএস মিন্ট নতুন ছাপ্পান্নটা কোয়ার্টার বাজারে ছাড়লেও শুরুর দিকের জর্জ ওয়াশিংটনের মাথা ওয়ালা কোয়ার্টার
কিন্তু বিলুপ্ত করে নাই। সেটিও চালু আছে এবং পুনঃমুদ্রণ হয়। এই কথাও জেনে রাখা ভাল, আমেরিকা কখনো তাদের মুদ্রিত কোন কাগজের টাকা কিংবা ধাতুর মুদ্রা বাজারে ছাড়ার পর সেটি কখনো বাতিল করে নাই। শুরুর দিকে লাখ ডলার, হাজার ডলার, পাঁচশো ডলারের নোট বাজারে ছাড়লেও পরে সেগুলি পর্যায়ক্রমে বাজার থেকে তুলে নেয়। কিন্তু বাতিল ঘোষণা করে নাই।
বর্তমানে একশো, পঞ্চাশ, বিশ, দশ, পাঁচ এবং এক ডলারের নোট সর্বাধিক প্রচলিত হলেও এই দেশে ‘দুই ডলারের নোট’ও রয়েছে। সেটির ব্যবহার কম। কিন্তু বাজারে আছে এবং এটি বৈধ।
কোয়ার্টার নিয়ে আমার লেখা শেষ।
মুরাদ হাই, নিউইয়র্ক
২রা এপ্রিল, ২০১৯