পাতাল ট্রেনের গল্প ~

১৯০৪ সালে প্রথম ব্যাক্তি মালিকানায় নিউইয়র্ক শহরের মানুষের প্রতিদিনের চলাচলের জন্য সীমাবদ্ধ লাইনে রাস্তার উপরে ব্রীজ তৈরি( Elevated Train ) করে চালু হয় ‘সাবওয়ে’ সিস্টেম যা পরবর্তিতে মাটির নীচে টানেল তৈরি করে পাতাল ট্রেনে পরিনত হয় । বেশির ভাগ সাবওয়ে লাইন মাটির নীচে টানেলে চলে গেলেও এখনো কিছু Elevated Train line চালু আছে।

আংশিক বিভিন্ন ব্যাক্ত মালিকানাধীন কোম্পানী আংশিক সিটি মালিকানায় চালু হয়ে ১৯৩২ সালে রাজ্য সরকারের আওতায় চলে আসে বেশীর ভাগ লাইন যা ১৯৫৩ সালের পর থেকে সম্পুর্নভাবে রাজ্য সরকারের তত্বাবধানে শায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে।

পাঁচ বরোর শহর ‘নিউইয়র্ক’এর চার বরোর মানুষ দৈনন্দিন কাজে চলাচলের জন্য সম্পুর্নরুপে নির্ভরশীল এই সাবওয়ে’র উপর। সাবওয়ের পাশাপাশি সেইম রুটে বাস সার্ভিস থাকলেও ঝড়, বৃষ্টি, বরফ সব অবস্থাতেই সাবওয়েতে চলাচল সবচেয়ে আরামদায়ক। শুধুমাত্র স্ট্যাটেন আইল্যান্ড বরোর মানুষেরা এই সুযোগ থেকে বঞ্ছিত, কিন্তু ওরা সিটির বাস ব্যবহার করতে পারে।

প্রাথমিক সময়ে বিনা মুল্যে সাবওয়েতে যাতায়াত করা গেলেও ১৯৩২ সালে মাথা পিছু প্রতি রাইডের ভাড়া প্রথমে পাঁচ সেন্ট, পরে দশ সেন্ট করা হয়। প্রথমে নিকেল ( পাঁচ সেন্ট ) পরে ডাইম ( দশ সেন্ট) টার্নস্টাইলে ঢূকিয়ে সাব-ওয়েতে ঢোকা যেতো।

১৯৫৩ সালে এই ভাড়া পনেরো সেন্টে উন্নীত হয়। পনেরো পয়সার কোন কয়েন না থাকায় টোকেন বানানোর প্রয়োজন হয়। তাই পনেরো সেন্ট ভাড়ার সময় থেকে প্রথম পিতলের তৈরি গোল টোকেন বিক্রি শুরু হয়।ট্রেনে ঊঠার জন্য ক্রস এর মত দেখতে যাকে বলা হোতো ‘টার্নস্টাইল’, তার ভিতর ভাড়ার টোকেন ঢোকালেই এই টার্নস্টাইল ঘুরিয়ে ট্রেইন লাইনে যাওয়া যেতো।

পনেরো সেন্টের টোকেন ১৯৭০ সাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে। ১৯৭০ সালে এই ভাড়া বেড়ে ত্রিশ সেন্ট হয়। ১৯৭০ সালের বর্ধিত ভাড়ার টোকেন ১৯৫৩ সালের টোকেন এর আদলেই কিন্তু একটু বড় আকারে তৈরি করা হয়।

দুই বছরের মধ্যে ভাড়া বাড়ে আরো বিশ সেন্ট। তারপর ১৯৮০ সালে এই ভাড়া বেড়ে হয় ৬০ সেন্ট। টোকেনের চেহারা আবার পালটায়।

১৯৫৩ সালের পনেরো সেন্টের পিতলের টোকেন দেখতে ছিল পেনীর মত ছোট, মাঝখানে nYc লিখার Y অক্ষরটা ‘কাট আউট’ করে ডিজাইন করা ছিল।

১৯৭০ সালের টোকেন ১৯৫৩ সালের টোকেন এর মতই, পার্থক্য ছিল সাইজে বড়, অনেকটা নিকেলের মাপের।

১৯৮০ সালের টোকেনের ডিজাইনে আবার পরিবর্তন আনা হয়। এবার সাইজ ঠিক রেখে টোকেনের মাঝখানের Y অক্ষরটা কাট আউট না করে সলিড করে বানানো হয়।

১৯৮৬ সালে আবার পরিবর্তন আসে। ভাড়া বেড়ে হয় এক ডলার। এবার টোকেনের চেহারায় অন্যরকম পরিবর্তন আনা হয়। টোকেনের ডিজাইনে মাঝখান থেকে nYc লিখা বাদ পড়ে তার স্থানে রুপালী ধাতু ব্যবহার করা হয়, যার নামকরন করা হয় ‘Bulls Eye. এই টোকেনের এক পাশে ঘুরিয়ে লিখা ছিল Go০d For One Fare. অন্য পাশে লিখা ছিল NewYork City Transit Authority. এই টোকেনের ডিজাইন অপরিবর্তিত রেখে শুধু ভাড়া বৃদ্ধি হয় ১৯৯০-৯২ তে ১৫ সেন্ট বেড়ে হয় ১ ডলার ১৫ সেন্ট, ১৯৯২-৯৫এ বৃদ্ধি পায় ১০ সেন্ট মানে ১.২৫ ডলার।

১৯৯৫ সালে টোকেনের চেহারায় আবার পরিবর্তন আসে। এবার টোকেনের কেন্দ্রস্থল থেকে রুপালী ধাতু সরিয়ে নিয়ে তার যায়গায় শহরের পাঁচ বরোর সন্মানে পাঁচ কোনার বরফির মত কাট আউট ডিজাইন করা হয়। যার নামকরণ করা হয় ‘Five Boroughs Pentagram Token. এই টোকেনের মুল্য বাড়িয়ে করা হয় ১.৫০ ডলার।

Pentagram Tokenই ছিল ধাতুর তৈরি শেষ টোকেন যা ২০০৩ সালে ক্রেডিট কার্ডের মত ম্যাগ্নেটিক মেট্রো কার্ড চালু হলে দীর্ঘ সময় যাবত ব্যবহার হলেও আস্তে আস্তে বাজার থেকে তুলে নেয়া হয়। এখন আর ধাতুর তৈরি টোকেন ব্যবহৃত হয়না একেবারেই। এসব টোকেন এখন যাদুঘরে স্থান করে নিয়েছে।

ধাতব টোকেনের ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে। ক্রস এর মত বিশাল টার্নস্টাইল উঠে গেছে। এসব এখন MTA Museum এ সবার দেখার জন্য সংরক্ষন করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ের সব টোকেন দিয়ে নানারকম স্যুভেনির যেমনঃ টাই ক্লিপ, কাফ লিঙ্ক, মেয়েদের অলঙ্কার এসব তৈরি করে বাজারজাত করা হয়।

Metropolitan Transit Authority (MTA) এর টোকেন কিনলে বাসে একবার ফ্রি ট্রান্সফার পাওয়া যায়। ধরুন, আপনি এমন যায়গায় থাকেন যেখানে ট্রেইন স্টেশন নাই। তখন বিপরীত পথের ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের টোকেন বুথ থেকে বাসের ট্রান্সফার চেয়ে নিয়ে আপনার নির্ধারিত বাসে ঐ ট্রান্সফার স্লিপ দেখিয়ে ভ্রমন করা যায়।

এখন সাবওয়ের সিঙ্গেল রাইডের ভাড়া ২.৫০ ডলার। শুনলে মনে হয় অনেক, আসোলে এখনো এই ভাড়া সাধারন মানুষের আয় অনুযায়ী অনেক সস্তা। কারন আপনি যদি হলুদ ট্যাক্সিতে ২/৩ মাইল দুরত্বেও যান তার ভাড়া হবে কমপক্ষে ১৫/২০ ডলার লাগবে। কিন্তু মাত্র ২.৫০ ডলারে সাবওয়ে/বাসে আপনি শহরের সীমানায় যে কোন দুরত্বে যেতে পারেন।

প্রতিদিন পরিবর্তন, পরিবর্ধন হচ্ছে এই সিস্টেমের। আগের মত এখন আর টোকেন নাই। তার যায়গায় কিনতে হয় ক্রেডিট কার্ডের মত ম্যাগ্নেটিক মেট্রো কার্ড। এই কার্ড অনেক রকম আছে। যারা শুধু সীমাবদ্ধ ঘোরা ঘুরি করেন তারা কিনবেন যত রাইড দরকার ঠিক ততটূকুই। কিন্তু যারা সপ্তাহে ৫/৬ দিন কাজ করেন কাজ ছাড়াও প্রতিদিন একাধিকবার সাবওয়েতে উঠেন তারা কিনেন সাপ্তাহিক আনলিমিটেড রাইডের কার্ড। প্রতি ১৫ মিনিট পর বাড়তি খরচ না করে যতবার খুশি এই কার্ড ব্যবহার করা যায়। সময় বাঁচানো এবং খরচ বাঁচানোর জন্য অনেকে পুরো মাসের কার্ড একসাথে কিনে ফেলে।

প্রত্যেক সাবওয়ে স্টেশনে আগে বুথ ছিল – যেখানে বুলেট প্রুফ কাঁচ ঘেরা রুমে ক্লার্ক থাকতো। বুথ থেকে টোকেন কেনা, ম্যাপ নেয়া কিংবা কোন ঠিকানা, নির্দেশনা জানতে চাইলে জানা যেতো। অটোমেশনের প্রভাবে বড় স্টেশনগুলি ছাড়া সব স্টেশনের এই টোকেন বুথগুলি উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। সেখানে দেয়া হয়েছে মেট্রোকার্ড কেনার জন্য ভেন্ডীং মেশিন। কেউ চাইলে ক্যাশ, ক্রেডিট কার্ড দিয়ে প্রয়োজনীয় মেট্রোকার্ড কিনতে পারে।

ভাবার কোন কারন নাই যে স্টেশনে কোন তদারকি করার মানুষ না থাকলে অনেকে তো ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করতে পারে। সেটা যে একেবারে করে না বললে মিথ্যা বলা হবে। সব স্টেশনগুলি সারভেইলেন্স ক্যামেরা দিয়ে কন্ট্রোল করা হয়। সাবওয়ে পুলিশ এসব তদারক করে লোক চক্ষুর অন্তরাল বসে। অনেক সময় দেখি কেউ ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ে পার পেয়ে যায়। আবার প্রায় দেখি, কেউ হয়ত মাত্র ফাঁকি দিয়ে ঢূকেছে, এমন সময় কোথা থেকে ভোজবাজির মত পুলিশ দৌড়ে এসে তাকে ধরে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিদিন গড়ে সাড়ে পাঁচ মিলিওন মানুষ ভ্রমন করে এই সাবওয়ে, বাসে।

ব্যাক্তিগতভাবে আমি খুব আরাম নিরাপদ বোধ করি এই সাবওয়ে, বাসে যাতায়াত করে।

অসংখ্য স্টেশনের ভিতর কিছু কিছু স্টেশনের স্থাপত্য শিল্পকলা উপভোগ করার মত সুন্দর। তাছাড়া বড় স্টেশন গুলিতে রয়েছে আধুনিক শপিং মল, কফি শপ, সাবওয়ে সিঙ্গারদের লাইভ শো।

শোনা যাচ্ছে, কিছুদিন পর আর মানুষের আলাদা করে মেট্রোকার্ড কিনতে হবে না। তখন মানুষ তাদের ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ঘষে স্টেশনে ঢুকতে পারবে।

দেড়শ বছরেরও আগে তৈরি এই সাবওয়ে সিস্টেম এই দেশের এক অত্যাচার্য সৃষ্টি। কত দুরদর্শিতা থাকলে তখন তারা ভেবে ছিল দেড়শ বছর পর এই সাবওয়ে সিস্টেমে ডেইলী পাঁচ মিলিওনের বেশি মানুষ যাতায়াত করবে।

আরো অবাক হয়েছি জেনে – কুইন্স বরো আর ম্যানহাটানের মাঝে অনেক গভীর আর খরস্রোতা হাডসন নদী। এই নদীর তলদেশের মাটির নীচে দিয়ে তৈরি করেছে সাবওয়ের টানেল। যা আজ পর্যন্ত ঠিক আছে। যদিও নিয়মিত রক্ষনাবেক্ষন করতে হয়।

বলা যায়, কম পয়সায় যাতায়াতের এই সুবিধার কারনেই সব নতুন ইমিগ্রান্ট মানুষ নিউইয়র্কে ভীড় জমায়। আর একবার এই শহরে বাস করা শুরু করলে ছেড়ে যাওয়াও অনেক কঠিন হয়ে যায়।
মুরাদ হাই, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৪