পরীর বিলাস

পরী আজ রোজা রেখেছে।

সারাদিন শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছে কি কি খাবে ইফতারীতে। মাত্র আসরের নামাজ হয়েছে। তাকিয়ে দেখলো মা নামায পড়ে তসবিতে চুমু খেতে খেতে জায়নামাজ ভাঁজ করে রাখছে। বাবা বাসায় ফিরবে সন্ধায় ইফতারের আগে। বাবা জানে পরী আজ রোজা রেখেছে। নিশ্চয়ই অনেক কিছু কিনে নিয়ে আসবে।

পরীরা থাকে মতিঝিল কলোনির ছোট সরকারী বাসায়। অনেক সাধারন, অল্প বেতনের সরকারী চাকরি। সেই বাসার দেয়ালে রং নাই এখানে সেখানে। স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল।
অল্প পাওয়ারের বাতি জ্বলে ঘরে। একটা মাত্র ঘরে একটা কাঠের চোকি, একটা আলনা। আর একটা রঙচটা লোহার আলমারি। সেই আলমারিতে বড় আয়না লাগানো। পরী সেই আয়নায় নিজেকে দেখে যখন তখন।

পরী পাশের সরকারি স্কুলে পড়ে ক্লাস ফাইভে। স্কুল রোজার জন্য বন্ধ। খুলবে একেবারে ঈদের তিনদিন পর। ওর বান্ধবীদের অনেকে তাদের মামা খালার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছে। পরীরা কখনো গ্রামে যায় না। সেখানে কেউ নাই ওদের। তাই সারা বছর ধরে কলোনীর এই এক রুমের বাসাই ওদের একমাত্র আশ্রয়।

কিছুদিন আগেও পরী কলোনীর মাঠে খেলতে যেতো বান্ধবীদের সাথে। এই বছর থেকে মা আর মাঠে যেয়ে দেয় না। বলে পরী নাকি বড় হয়ে গেছে। তাই এখন শুধু সালোয়ার কামিজ না, ওড়নাও পরতে হয়। মা রাতের বেলায় বারান্দায় মাদুর বসে চুলে তেল দিয়ে বেনী বেঁধে দিতে দিতে কত কিছু শেখায় মেয়েকে।

মায়ের সাথে পরীর অনেক গভীর বন্ধুত্ব।

বাবার সাথে অনেক কথা হয় না। বাবা কেমন মনমরা হয়ে থাকে সারাক্ষন। বাসায় ফিরে কাপড় পালটে লুঙ্গি পরে টিম টিমে আলোয় বসে অফিস থেকে নিয়ে আসা পত্রিকা পড়ে।

ওদের কোন টিভি নাই। ফ্রিজ নাই। টিভির খুব সখ নাই পরীর। সাপ্তাহিক নাটক দেখার জন্য মায়ের সাথে পাশের বাসায় যায়। ওই বাসায় টিভি, ফ্রিজ সব আছে। সবচেয়ে ভাল লাগে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি খেতে। পাশের বাসার আন্টি তেল আর পিঁয়াজ দিয়ে মুড়ি চানাচু্র মেখে খেতে দেয়। তারপর ফ্রিজ থেকে সুন্দর বোতলে রাখা ঠান্ডা পানির বোতল বের করে গ্লাসে পানি ঢেলে খেতে দেয় ।

পরী মন্ত্রমুগ্ধের মত সেই বোতলের দিকে তাকিয়ে দেখে। সবুজ বোতলের গায়ে কেমন ঘাম জমে আছে বিন্দু বিন্দু। বোতলের ছিপি খুললে ধোঁয়ার মত ঠান্ডা বাতাস বের হয় একটু। চানাচুর খেয়ে বোতলের সেই ঠান্ডা পানি খেতে পরীর কি যে ভাল লাগে ! পরী খুব যত্ন করে একটু একটু করে খায় সে পানি, যেন হুট করে শেষ হয়ে না যায়।

আজ শুয়ে শুয়ে পরী ভাবছিল, ইশ ওদের যদি অমন একটা ফ্রিজ থাকতো, কত ভাল হতো। যখন ইচ্ছা, যতবার ইচ্ছা ঠান্ডা পানি খেতে পারতো। এই ঠান্ডা পানি খেতে যেনো স্কুলে কিনে খাওয়া বরফ আইস্ক্রিমের চাইতেও বেশি মজার।

মা পরীকে রোজা রাখতে দেয় না। আজ রেখেছে মা’কে অনেক পটিয়ে। অনেক গরম পড়েছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে বাইরের গাছটায় একটা পাতাও নড়ছে না। মাথার উপর হলদেটে ময়লা ফ্যানটা ঘটাং ঘটাং করে আওয়াজ করে যাচ্ছে কিন্তু গায়ে বাতাস লাগে না একটুও।

ইফতার হতে আরো দুই ঘন্টা বাকী। মা পাকেরঘরে ইফতারের আয়োজন করছে। বুট পিঁয়াজূ, বেগুনি ভাজবে। পরীর জন্য ফিরনী বানাবে। পরীর সেদিকে মন নাই। সে ভাবছে ইফতারের সময় যদি এক বোতল ফ্রিজের ঠান্ডা পানি খেতে পারতো তাহলে প্রান জুড়িয়ে যেতো। মা মাটির কলসিতে রাখা ঠান্ডা করা পানি দিয়ে চিনি আর লেবুর রস মিশিয়ে সরবত বানাবে। কিন্তু সেই সরবত ফ্রিজের পানির মত অত মজার হয় না।

বাবার কাছে সে কখনো কিছু চায় না। পরী জানে বাবা মুখে কিছু বলে না কিন্তু তাকে অনেক ভালবাসে। সেবার ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষায় থার্ড হওয়ায় বাবা তাকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়েছিল। মাটির ব্যাঙ্কে আগের জমানো টাকা পয়সার সাথে সেই পঞ্চাশ টাকাও ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছে পরী।

হটাৎ তার মাথায় বুদ্ধি এলো। সে বাবাকে তার ব্যাংকের জমানো সব পয়সা দিয়ে দিবে তাদের বাসার জন্য একটা ফ্রিজ কিনে আনতে। তাহলে ঠান্ডা পানি খেতে না পারার জন্য আর কোনদিন মন খারাপ হবে না। এই সুন্দর প্ল্যানটা করতে পেরে ওর মন অনেক ভাল হয়ে গেলো। একটু আগেই গরমে পানির তৃষ্ণায় গলার ছাতি ফেটে যাচ্ছিল কিন্তু এখন আর খারাপ লাগছে না। বরং মনের ভিতর অন্যরকম একটা আনন্দের ঢেউ উঠলো।

সে লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়লো। এক দৌড়ে পাকঘরে মায়ের পাশে গিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো – মা আমি তোমাকে সাহায্য করি ?

মা রোজা রেখে ক্লান্ত তবুও মেয়ের হাসি মুখ দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো।

একটু পর দরজার কড়া নড়ে উঠলো। বাবা এসেছে – বলে পরী দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। দ্যাখে বাবা দুই হাতে প্যাকেট নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে। সে হাত বাড়িয়ে প্যাকেট গুলি নিলো বাবার হাত থেকে। পাকঘরে নিয়ে প্যাকেট গুলি খুলল কি এনেছে দেখার জন্য। কলাপাতা দিয়ে ঢাকা একটা মাটির শানকিতে হালিম এনেছে, যা পরীর অনেক প্রিয় খাবার। আরেকটা প্লাস্টিকের ব্যাগের মুখ খুলে শক্ত মত কিন্তু ঠান্ডা কিছু হাতে ঠেকলো। বের করে এনে দেখে ধানের কুড়া দিয়ে মাখানো বরফের বড় একটা টুকরা।

মুহুর্ত্যে পরী ফ্রিজের কথা ভুলে গেলো।

তাড়াতাড়ি বরফের টুকরাটা পানিতে ধুয়ে একটা পরিষ্কার পাতিলে রেখে মাকে দেখিয়ে বলে – মা দেখো বাবা বরফ নিয়ে এসেছে। আজ আমরা অনেক ঠান্ডা সরবত দিয়ে ইফতারী খাবো।

বলে আনন্দে খিলখিল করে হেসে উঠল। অল্পতে মেয়ের এত আনন্দ দেখে মায়ের চোখের কোনে পানি চিকচিক করে উঠলো। কিন্তু বুঝতে না দিয়ে তিনিও হেসে দিলেন মেয়ের সাথে।

৭ই মার্চ, ২০১৫