আমেরিকার শাসন ব্যবস্থা ~

না জানলে মনে হয় আমেরিকার শাসন পদ্ধতি খামোকা মহা জটিল কিছু। জানার পর অবাক হতে হয় ভেবে সেই কোন আদিম কালে আমেরিকা রাষ্ট্রের ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’ মানে স্থপতিরা কেমন সুচিন্তিতভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা গঠন করে গেছেন। প্রায় আড়াইশো বছর আগে প্রণয়ন করা শাসনতন্ত্রের বিশেষ কোন পরিবর্তন আজো করার দরকার হয় নাই।

আমেরিকার ৫০ টা স্বয়ং সম্পূর্ণ রাষ্ট্র যেন একেকটা আলাদা দেশের মত। প্রত্যেক রাজ্যের আলাদা আইন, শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন শাখার নির্বাচিত প্রতিনিধি, আলাদা বাজেট, আলাদা কর, আলাদা রাজ্য প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং আলাদা পতাকা আছে। রাজ্য সরকার প্রধান হল একজন নির্বাচিত গভর্নর। তিনি দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল লাল কিংবা নীল দলের অনুসারী হতে পারে। তবে তারা কেন্দ্রের তাবেদারি করার চেয়ে নিজ রাজ্যের স্বার্থ বেশী দেখে। প্রতিটা রাজ্যে একাধিক কংগ্রেসম্যান এবং ২ জন করে সিনেটর রইলেও তারা গভর্নরকে বাইপাস করে রাজ্যের কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। একইভাবে রাজ্যের শহরগুলির নির্বাচিত মেয়রদের বাইপাস করে গভর্নরও কিছু করে ফেলতে পারে না। কেউ সীমা অতিক্রম করে না। করলে বিবাদ বেধে যায়।

প্রতিটা রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকারের অনুগত তবে কেন্দ্র অযৌক্তিকভাবে কিছু চাপাতে চেষ্টা করলে রাজ্য সরকার সেটা প্রত্যাখ্যান করতে পারে।

প্রত্যেক রাজ্যের আয়তন এবং জনসংখ্যা অনুযায়ী কেন্দ্রে প্রতিনিধিত্ব করার প্রতিনিধি নির্বাচিত হয় যাদেরকে কংগ্রেসম্যান এবং সিনেটর বলা হয়। এই বিষয়ের বৃত্তান্ত পরে বলছি।

আমেরিকার ৫০ রাজ্যের বাইরে রাজ্য নয় কিন্তু দেশের রাজধানী করা হয় ওয়াশিংটন ডিসিকে। পার্শবর্তী মেরিল্যান্ড এবং ভার্জিনিয়া রাজ্য থেকে জমি অনুদান নিয়ে গঠন করা হয় আমেরিকার রাজধানী। এটির নামকরন করা হয় আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং স্থপতি জর্জ ওয়াশিংটনের নামানুসারে। বলে রাখা ভাল, ওয়াশিংটন নামে আমেরিকার পশ্চিম সীমান্তে আলাদা একটা রাজ্য আছে যাকে আলাদা করার জন্য বলা হয় ওয়াশিংটন স্টেট।

আমেরিকার শাসনতন্ত্রে উল্লেখ করে ওয়াশংটন ডিসিকে আলাদা রাজ্য নয়, বরং একটা কেন্দ্রীয় সরকারের আলাদা ডিসট্রিক্টের মর্যাদা দিয়ে সেখানে শাসন ব্যবস্থার ৩ মূল শাখার কার্যালয়গুলিকে একত্রিত করেছে। তিনটা শাখা হল নির্বাহী শাখা মানে প্রেসিডেন্ট ও তার সভাষদ, আইন প্রণয়ন শাখা মানে কংগ্রেস ও সিনেট এবং বিচারিক শাখা মানে কোর্ট কাচারি।

ওয়াশিংটন ডিসি পরিচালিত হয় একজন নির্বাচিত মেয়র দ্বারা তবে কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করতে পারে।

আগেই বলেছি প্রতিটা রাজ্যের আয়তন এবং জনসংখ্যা অনুযায়ী আইন সভায় যোগ দেয়ার প্রতিনিধির সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। আইন সভা আবার ২ ভাগে বিভক্ত – কংগ্রেস এবং সিনেট। রাজ্যে একাধিক কংগ্রেসম্যান নির্বাচিত হয় রাজ্যের সাইজ এবং এলাকাভেদে জনসংখ্যার ভিন্নতার জন্য। কিন্তু সিনেটের বেলায় ছোট বড় সব রাজ্যের জন্য ২ জন করে সিনেটর নির্বাচিত করা হয়।

৫০ রাজ্যের মোট কংগ্রেসম্যান ৪৩৫ জন। ৫০ রাজ্যের মোট সিনেটর মাত্র ১০০ জন। প্রশ্ন জাগে ২ টা আইন সভার কি দরকার ! এর সহজ উত্তর হল – ছোট বড় রাজ্যের স্বার্থের বেলায় সমতা রাখার উদ্দেশ্যে ব্যালেন্স তৈরী করে ২টা ভিন্ন শাখা।

কংগ্রেস আইন প্রণয়ন করে। যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রাষ্ট্রের অনুদান বিতরণ অনুমোদন করে। প্রয়োজনে প্রেসিডেন্ট কিংবা সাংবিধানিক সংস্থার প্রধানকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয়। নতুন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার অনুমোদন করে। নির্বাহী শাখা কতৃক সম্পাদন করা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুমোদন করে। এবং যে কোন বড় ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ তদন্তের দেখভাল করে।

সিনেট নির্বাহী শাখার পছন্দের প্রার্থীদের যেমন কেবিনেট সেক্রেটারী, বিচারপতি, রাষ্ট্রদূত এবং উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা যেমন সিআইএ প্রধান, এফবিআই প্রধান, সেনাবাহিনী প্রধানদের চাকরী কনফার্ম করে। দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন, আইনী সিদ্ধান্তকে বাতিল করতে পারে। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের বরখাস্ত আবেদনের কার্যকরণ করে যুক্তিযুক্ত মনে করলে।

প্রেসিডেন্ট কি যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে ?

আমেরিকার শাসনতন্ত্র যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতাকে নির্বাহী এবং আইন প্রণয়ন শাখা মানে কংগ্রেসের ভিতর ভাগ করে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট সকল বাহিনীর প্রধান সেনাপতি। তাই বলে একক সিদ্ধান্তে যুদ্ধ ঘোষণা করে না। তার জন্য কংগ্রেসের অনুমোদন নেয়া প্রয়োজন হয়।

আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত ৫০ রাজ্যের নাগরিকরা শুধু রাজ্য কিংবা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দিতে পারে। ৫০ টা রাজ্য ছাড়াও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাজ্য না হলেও ফেডারেল ডিসট্রিক্ট হিসাবে ওয়াশিংটন ডিসি’র বাসিন্দা মানে নাগরিকরা ভোট দিতে পারে। কিন্তু আমেরিকার দখলে থাকা ৫ টা দ্বীপ যেমন পোর্টরিকো, গুয়াম, ইউ,এস ভার্জিন আইল্যান্ডস, আমেরিকান সামোয়া, নর্দার্ন মারিয়ানা আইল্যান্ডসের অধিবাসীরা আমেরিকার নাগরিক হিসাবে বিবেচিত হলেও মেইনল্যান্ডের নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার নাই।

রাজ্য ভেদে কংগ্রেস সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ ~

রাজ্যের আয়তন এবং জনসংখ্যা অনুযায়ী রাজ্যের কংগ্রেস প্রতিনিধির সংখ্যা নির্ধারন হয়। এর জন্য প্রতিটা একাধিক রাজ্যকে কংগ্রেশনাল ডিসট্রিক্টে ভাগ করা হয়। এই ডিসট্রিক্টের সাইজ সব রাজ্যের জন্য সমান। ডিসট্রিক্টের ভোটার সমান হতে হবে। আদমশুমারির রিপোর্ট অনুযায়ী ভোটারের সংখ্যা নির্ধারিত হয়। এবার ধরেন ক্যালিফোর্নিয়াকে বিবেচনা করি। ভোটার বিবেচনায় এটা আমেরিকার সবচেয়ে বড় রাজ্য। এই রাজ্যের আয়তন ৪০৩,৮৮২ বর্গ কিলো মাইল। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী মোট ভোটার হল ৩,৯৫,১২,২২৩ জন। এই রাজ্যটাকে ৫৩টা কংগ্রেশনাল ডিসট্রিক্টে ভাগ করা হয়েছে। সেই হিসাবে এই রাজ্যের কংগ্রেসম্যানের সংখ্যা হল ৫৩ জন।

রাজ্য শুধু বড় হলেই হবে না যেমন আলাস্কা। এই রাজ্যের আয়তন ক্যালিফোর্নিয়ার চাইতে ২৬৭% বেশী বড় কিন্তু সবটায় জন বসতি নাই। মোট ভোটার হল মাত্র ৭০৫৭৪৯। তাই একটাই কংগ্রেশনাল ডিসট্রিক্ট এবং একজন মাত্র কংগ্রেসম্যান। তাইলে ইলেক্টরাল ভোট হওয়ার কথা ১টা মাত্র। কিন্তু না, ২ জন সিনেটর রয়েছে।। ১+২ = ৩ হল এই রাজ্যের ইলেক্টরাল ভোট। এভাবে রাজ্যভেদে ইলেক্টরাল ভোট নির্ধারিত হয়।

আমেরিকার ভোট ব্যবস্থা ~

শুধু আপনারা না, আমার কাছেও ভীষণ জটিল মনে হত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডাবল ব্যারেল ভোট ব্যবস্থাটা। ভাবতাম কত্ত বেকুব এরা। জনগণের ভোটের দাম না দিয়ে ইলেক্টরাল ভোটের দাম দেয় বেশী। কিন্ত্যু ব্যাপারটা বুঝলে মনে হবে এটার মত যুক্তি সম্মত উপায় আর কিছু হতে পারে না।

খেয়াল করুন, ৫০ রাজ্যে মোট ৪৩৫ জন জনপ্রতিনিধি মানে কংগ্রেসম্যান রয়েছে। ১০০ জন সিনেটর রয়েছে। তার সাথে যোগ হবে ফেডারেল ডিসট্রিক্ট ওয়াশিংটন ডিসিকে বরাদ্ধ করা ৩ ইলেক্টরাল ভোট। তাইলে এভাবে হয়ে দাঁড়ালো ৪৩৫+১০০+৩=৫৩৮টা ইলেক্টরাল ভোট। পপুলার ভোট মানে নাগরিক যখন ভোট দেয়। তাদের ভোটে কেউ সরাসরি নির্বাচিত হয় না। নাগরিকের ভোটের আধিক্য অনুযায়ী রাজ্যের নির্ধারিত ইলেক্টরাল ভোটগুলি প্রার্থী পেয়ে যায়।

তাইলে সমস্যাটা কোথায় ? হিলারী ক্লিনটন দুই মিলিয়ন পপুলার ভোট বেশী পেয়েও জিতলো না ক্যান ? এখানেই হল আসল ধাঁধা।

শুধু যদি পপুলার ভোটে ফলাফল বিবেচিত হত, তাইলে প্রার্থীরা শুধু ভোটের জন্য বড় রাজ্যগুলিতে প্রচারণা চালাতো। বড় রাজ্যগুলির সংখ্যাধিক্য ভোট দিয়েই তারা জিতে যেতো। ছোটগুলি গোনায় ধরত না। ছোট রাজ্যগুলি অবহেলিত থেকে যেতো। যেমন হিলারী ক্লিনটন অবহেলা করে ছোট সুইং স্টেটগুলিতে যায় নাই তাই তাদের ভোট পায় নাই। যদিও বড় রাজ্যের ভোট পেয়ে পপুলার ভোটে এগিয়ে ছিল। কিন্তু টোটাল ইল্রেক্টরাল ভোট তো ২৭০ পায় নাই। ফাউন্ডিং ফাদাররা তাই ছোট বড় সব রাজ্যকে যেন প্রার্থীরা গুরুত্ব দেয় সেজন্য পলুরার ভোট দিয়ে ইলেক্টরাল ডেলিগেট নির্বাচনের পদ্ধতি প্রণয়ন করে। এই পদ্ধতি একদম অব্যর্থ উপায়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে। কয়েকটা বড় রাজ্য দিয়ে কারচুপি করে কেউ কখনো জিততে পারবে না এই পদ্ধতির কারণে।

৫০ রাজ্যের অনেকগুলির ভিতর লাল মানে রিপাবলিকান এবং নীল মানে ডেমোক্র্যাট দলের কনফার্ম ভোট ব্যাংক আছে।আবার কতগুলি ষ্টেটে কারো একচেটিয়া জনপ্রিয়তা নাই। তারা প্রার্থী বিবেচনায় এদিক কিংবা ওদিকে হেলে যায়। যে যেদিকে হেলে মানে যাকে বেশী ভোট দেয়, সব ইলেক্টরাল ভোট অটোমেটিক্যালী সেদিকে চলে যায়। প্রতি ইলেকশনে এমন সুইং ষ্টেটগুলি বদলে যায়। এবার এমন স্টেটগুলি ছিল – উইস্কন্সিন, টেক্সাস, জর্জিয়া, মিশিগান, পেনসিলভানিয়া, অ্যারিজোনা, নর্থ ক্যারোলিনা, নেব্রাস্কা, ফ্লোরিডা এবং ওহাইয়ো।

সুইং স্টেটগুলির ইলেক্টরাল ভোট আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মূল চাবিকাঠি।

রাজ্যগুলির ইলেক্টরাল ভোট যিনি ২৭০+ পাবেন তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবে। কোন রাজ্যের ভোট গণনা নিয়ে কোন প্রার্থীর আপত্তি থাকলে উপযুক্ত প্রমাণ সহকারে আবেদন করলে সেই রাজ্যের ভোট পুনর্গননা করে বেমিল পেলে তার সংশোধন করে ফলাফল ঘোষণা বদলে ঘোষণা করা হয় যেমন ২০০০ সালে ফ্লোরিডার ভোট নিয়ে আপত্তি করায় আবার গণনা করা হলে ৫৩৭ ভোট বেশী পাওয়ায় রাজ্যের ২৯টা ইলেক্টরাল ভোট পেয়ে জর্জ বুশ এল গোরকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

জানিনা কতটুকু বুঝাতে পেরেছি আমেরিকার শাসন ব্যবস্থা এবং ইলেকশন পদ্ধতি। তবে চেষ্টা করেছি, সেটাই বা কম কি ! 🙂

মুরাদ হাই, উত্তর আমেরিকা
১৩ই নভেম্বর, ২০২০