আমার খেলাঘর

যদি নিজের শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করি আর তার সাথে সেই সময়ের বাড়িটা চোখের সামনে থাকে কেমন অদ্ভুত লাগে না ! হ্যাঁ বাড়িটা এখনো একদম আগের চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে আমি নস্টালজিয়ায় ভুগছি। আজকের ঢাকায় এক চিলতে জায়গার দাম যখন আকাশ ছোঁয়া, সেখানে ষাটের দশকে তৈরী পুরোনো ফ্যাশনের দোতলা বাড়িটা আশির দশকে আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর ২০১৯ সালেও অক্ষত অবস্থায় অবিকল একই অবয়বে দেখতে পাবো একদম ভাবি নাই।
ষাটের দশকের শুরুতে আমার জন্ম হয়। বাবা তখন দেশের ক্ষমতাধর আইন প্রণেতা। মায়ের নামে বনানীর ঘন বন জঙ্গলের ভিতর জায়গা কিনে এই বাড়িটা বানান। প্রথমে বাম পাশের দেয়াল ঘেঁষে স্কুলের মত দেখতে পাশাপাশি ঘরের লম্বা একটা একতলা দালান বানিয়ে আমরা থাকা শুরু করি। তার আগে থাকতাম মতিঝিল কলোনীর কমলাপুর স্টেশনের পাশে পেঁচানো সিঁড়ির ডি টাইপ কোয়াটারে। আমরা সেই বাসার তিনতলায় থাকতাম যার বারান্দায় দাঁড়ালে কমলাপুর স্টেশনটা খুব কাছ থেকে দেখা যেতো।
বনানীতে এসে থাকা শুরু করে প্লটের খালি জায়গার অর্ধেকে আমাদের লাল সিরামিক ইটের দোতলা বাড়ির কাজ শুরু করে বাবা। সারাদিন মিস্তিরিদের সাথে ক্যাটক্যাট করতে দেখতাম বাবাকে। আর দেখতাম খালি জায়গায় মাচা বানিয়ে লাউ কুমড়ার বিশাল বাগান বাবার।
বাড়ির একতলা একদিন বানানো শেষ হল। হলুদ একতলা ছেড়ে লাল ইটের বাড়ির একতলায় উঠে গেলাম। খুব সুন্দর বাসা। মোজাইক করা ফ্লোর। অনেকগুলি রুম। মনে আছে সব মিলিয়ে বড় বড় চারটা বেডরুম, একটা ফুটবল মাঠের মত লম্বা ড্রইং রুম, সামনে পিছে বারান্দা মাঝে লম্বা করিডোর আর সব রুমের সাথে একটা করে টয়লেট।
কলোনীর ছোট্ট পরিসর থেকে এসে খোলামেলা জায়গা পেয়ে বাসা, বাগান, উঠান সব যেন হয়ে গেল আমাদের খেলার মাঠ। বাসার আশেপাশে বাসা একদম ছিল না। দূরে গাছপালার ফাঁকে একটা দুইটা বাসা দেখা যেতো। তাই ভয়ে রাস্তায় যেতাম না।
মায়ের জন্য বাবার শখ করে বানানো বাসাটায় মায়ের বেশীদিন থাকা হল না। উঠার পরপরই মা চলে গেল। মনে আছে সেদিন বাসায় বড়বোন কামরুনের বিয়ের আয়োজন চলছে। হ্যাঁ, বাড়িতেই বিয়ে হবে। হৈহৈ কান্ড। বাড়ি ভর্তি মানুষ। বাবা সরকারী মানুষ। মাধবীলতার বিশাল ঝাঁড়ের গেটে বন্ধুকধারী পুলিশ পাহারায় থাকে। মনে আছে দোতলা আন্ডারকন্স্ট্রাকশন ছিল। সেখানে পুলিশেরা থাকতো। সব মিলিয়ে সাতজন।
বাসার সামনে ডেকোরেটরের বড় বড় হাঁড়িতে রান্না চলছে। আর সেদিনই কিনা সন্তান সম্ভবা মায়ের প্রসূতি বেদনা শুরু হয়ে গেলো। মা কোনভাবেই মেয়ের অনুষ্ঠান ফেলে হাসপাতালে যাবে না। বাবা জোর করে তাঁকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠালেন ছোটমাকে সাথে দিয়ে। বেশী সময় লাগে নাই। কয়েক ঘন্টা পর মায়ের মৃত্যু সংবাদ চলে এলো। ডাঃ মেহেরুন্নেসার তত্ত্বাবধানে থাকা মা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই কোন অজানা কারণে মরে গেলো।
তাই বলে কি বিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে ?
না হয় নাই। দেশের সব বড় বড় মানুষেরা আমন্ত্রিত। বিয়ের অনুষ্ঠান যথারীতি হয়েছে। মা যে নাই কেন জানি না এই কথাটা বুঝতে পারি নাই। আমরা ছোটরা বিয়ের অনুষ্ঠানে হৈচৈ করেছি।
আমার বয়স তখন সাত। আমার ছোট আজাদ, তার ছোট লায়লা আর একদম ছোট নাজমা। নাজমা মনে হয় তখনো হামাগুড়ি দেয়। আমার বড় সকিনা বুজি, তার বড় সুলতানা বুজি, তার বড় জাইনদা, তার বড় কামুজি আর মায়ের সবচে বড় সন্তান শাইন্দা মানে শামীম। আমরা আপন মোট নয় ভাই বোন। এছাড়া সৎ ভাইবোন আরো ম্যালা আছে।
বিয়ে শেষ। বাবার ঘরে বোনের বাসর ঘর সাজানো হয়েছে। দুলাভাইরা ঢাকার বাইরে থেকে এসেছে। তাই বিয়ের পর আমাদের বাসায় রয়ে গেছে। মনে আছে আমাদের ছোট চারজনকে সাথে নিয়ে বোন দুলাভাই সেদিন তাদের বাসর রাত কাটিয়েছে।
বাবার ঘরের উল্টাপাশের ঘরটায় ঘরে মায়ের লাশ রাখা ছিল। বড় বড় বরফের টুকরা দিয়ে ঢেকে রাখা। কিছু না বুঝে আমি শুধু জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি আর ভাবি এত বড় বরফ কেমনে বানায় !
বাসার খালি অংশটার কোনায় মাকে কবর দেয়া হল। জাইনদা (জাহাঙ্গীর) কাদামাটি দিয়ে সেই কবর লেপে মসৃন করে। কবরের মাঝখানে একটা কাঁঠালের চারা লাগায়। বাঁশের খুঁটিতে একটা বাল্ব ঝুলিয়ে দেয়া হয় যেন কবরে আলো থাকে। আলোতে বসে জাইনদা কোরান শরীফ পড়ে সারাক্ষণ সারাবেলা। কেউ তাকে কবরের পাশ থেকে উঠাতে পারে না।
বাবা কোন নরম মানুষ ছিল না। বরং শক্ত রাশভারী এবং ভীষণ বদরাগী মানুষ তিনি। নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এতিম বাচ্চাদের নিয়ে বসে থাকার বান্দা তিনি না। বয়স কম বলেই কিনা জানি না, মায়ের জন্য কেন জানি কান্নাকাটি করি নাই। ধুলাবালি মেখে খেলাধুলাতেই বেশী ব্যস্ত তখন।
সেবারই তো মনে হয়, আমাদের সাদা রংয়ের কুকুর টমি ছয়টা বাচ্চা প্রসব করলো। আমরা সেই বাচ্চাদের নিয়ে খেলি। নাজমা একটা বাচ্চা নিয়ে দৌড় দিলে কুকুর তার সন্তান হারানোর আতংকে নাজমাকে কামড়ে দিলো। হায় হায়, একি হল ! কুকুর কামড়ালে নাকি পেটে কুকুরের বাচ্চা হয়। এরপর আমাদের সে কি অধীর অপেক্ষা, কখন নাজমার পেট থেকে অনেকগুলি কুকুরের বাচ্চা বের হবে। আমরা ওর পেটের সাথে কান লাগিয়ে শুনার চেষ্টা করি কুকুরের বাচ্চার আওয়াজ পাই কিনা !
ডাক্তার এসে নাজমার পেটে ইনজেকশন দিয়ে গেলো। আর বাবা হুকুম দিয়ে বাচ্চাকাচ্চা সহ কুকুরটাকে বাসা থেকে সরিয়ে দিলো। সেদিন খুব মন খারাপ হল। মা মরার পর কাঁদতে হয় বুঝি নাই। কাঁদি নাই। কিন্তু টমির জন্য অনেক কেঁদেছি।
মা মরার পর আমাদের ভাইবোনের অবস্থা হল ছিন্নমূলের মত। একবার ঢাকা আবার হাতিয়া এভাবে চলছিল। আরেকটু বড় হলে ঢাকায় এনে স্কুলে ভর্তি করানো হল। অয়ারলেস গেইটের কাছে আদর্শ বিদ্যালয়ে। আমি আজাদ সকিনা বুজি, আর মিসতারা বুজি একসাথে স্কুল ড্রেস পরে উঁচা নিচা মাঠ ঘাট পেরিয়ে হেঁটে হেঁটে সেই স্কুলে যাই।
বাসার পেছনটায় বাবার ঘরের পাশে একটা হাসনা হেনার গাছ। রাতভর ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করে পুরো বাসা। বাসার সামনেটায় গেটের উপর গোলাপী রংয়ের মাধবীলতার ঝাঁড়। সন্ধ্যা হলে ওরাও সুবাস ছাড়ে। এছাড়া বাগানে রজনীগন্ধা আর বেলী ফুলের গাছ।
আহা,ফুলের গন্ধে পুরো এলাকা মৌ মৌ করে।
বাসার আশেপাশে সাপ দেখা গেছে। সাপ তো থাকবেই। বনানী জুড়ে যে বন জঙ্গল ছাড়া আর কিছু নাই। দোষ হয়ে গেল হাসনা হেনা গাছের। সেই ফুল নাকি সাপকে আকৃষ্ট করে। কেউ এসে এ কথা বলায় বাবা হুকুম দিলো বিশাল গাছটা কেটে ফেলতে। নাই হয়ে গেল ফুল গাছটা। কিন্তু সাপ তবুও আসে।
বাবা গাছ গাছালি খুব পছন্দ করতো। সহজে কাটতে চাইতো না। বরং নতুন নতুন গাছ এনে লাগাতো। আমাদের প্লটে আগে থেকে অনেক কাঁঠাল গাছ ছিল। একটা গাছ একদম বাসার লাগোয়া। সেই গাছটার গোড়া থেকে কাঁঠাল ধরতো। বড় অদ্ভুত লাগতো আমার কাছে। মুচি ছিঁড়ে খেয়ে ফেলতাম। পাশের খালি জায়গাটায় ছিল বিশাল বড় লিচু গাছ। এত লিচু ধরতো যে খাওয়ার মানুষ ছিল না। বাবা পুরো বাড়ি জুড়ে লাগিয়েছিল নারিকেল গাছ, আতাফল, কালোজাম, পেয়ারার গাছ। খেতে পেরেছি সব কয়টা গাছের ফল। বাবার দুর্বলতা ছিল ফলমূলের প্রতি। মনে পড়ে করাচী থেকে কাঠের বাক্স ভরে ফল নিয়ে আসতো।
ছিন্নমূলের বাউন্সিং বলের মত যুদ্ধের সময় বনানী থেকে হাতিয়ায় পাঠানো হল আমাদেরকে। পাঠিয়ে মা হীন এতিমদের ফেরত আনার কথা ভুলে বাবা। একাত্তুরে গিয়ে চুয়াত্তুরে ফেরত আসলাম ঢাকায়। বনানী বাসা তখন ভাড়া দেয়া। এসে থাকি শাহজাহানপুরে একটা ছোট্ট বাসায়। সেখান থেকে মুগদাপাড়ায় সুলতানা বুজির বাসায়। তারপর বাসাবোতে। এস এস সি শেষ করে আবার বনানীতে। বনানী বাজার থেকে ছয় নম্বর বাসে আট আনা ভাড়া দিয়ে নটরডেম কলেজে যাই প্রতিদিন। বাবার রোজগার নাই তখন। খরচ চালাতে বনানী বাসা আবার ভাড়া দেয়া হল। তার আয় দিয়ে ২০ নিউ ইস্কাটন রোডের বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি। দুই টাকা রিকশা ভাড়ার দূরত্বের এই বাসা থেকে একদিন আমি সূর্যসেন হলে চলে গেলাম। হলে থাকা অবস্থায় দেনার দায় কাটাতে বাবা একদিন বাইশ কাঠা জায়গার বনানী বাড়িটা বেচে দিলো মাত্র বাইশ লাখ টাকায়। দেনা শোধ করে বাকি টাকা ছেলে মেয়েদেরকে ভাগ করে দিয়ে বাবা তিরাশিতে মরে গেল। ছিয়াশিতে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে সূর্যসেন হল ছাড়লাম ঢাকার বনানীতে বড় হওয়া আমি তখন ঠিকানাবিহীন মানুষ। আমার শৈশব, আমার মায়ের কবরসহ বাড়িটা তখন অন্যের মালিকানায় চলে গেছে। নিজেকে ঢাকায় রিফ্যুজির মত মনে হল। কোনমতে তিন বছর কাটিয়ে একদিন আমি স্থায়ীভাবে ঢাকা ছেড়ে দিলাম। পালিয়ে গেলাম ঢাকায় বড় হওয়া আমি ঢাকায় ঠিকানা বিহীন হয়ে।