#উত্থান৬ – Rise of a thug

ঈদের ছুটির শেষে ঢাকা শহর আবার গরম হতে শুরু করলো। মানুষেরা কাজে আর ছাত্ররা ক্যাম্পাসে ফিরতে শুরু করেছে।
পোলাপানের হাউকাউ দেখতে ভালই লাগে পিস্টনের। কাউরে চেনে আবার অনেকেরে চেনে না। কিন্তু তবুও কেন জানি সবাইরে আপনা মনে হয়।
ছাত্রদেরকে তার খুব সরল সিদা মনে হয়। তাতো হবেই। কতই বা বয়স হবে ওদের। তার বয়সী হবে। শুধু বাপের বয়সী কিছু বুইড়া বান্দর আছে যেগুলি ছাত্র সাইজা ক্যাম্পাসে বইসা থাকে জনম ভর। পোলাপানের লিডার হয়। অগোরে নাকে দড়ি বাইন্দা ঘুরায়। কামের ছ্যারার লাহান খাটায়।

ছাত্রগো বয়স কম। বাপমায়ের আদরের সন্তান। ভাতের কষ্ট দেখে নাই। তাই সবাই শুধু আনন্দ খুঁইজা বেড়ায়। মিছিল করার মধ্যেও এক ধরনের আনন্দ আছে। আর এই কারণে কেউ বাধ্য হয়ে আবার কেউ শুধু সখে নানান দলের ভক্ত হয়ে যায়।

হলের গেস্ট রুমের নীল রেক্সিনে মোড়ানো সোফায় কাত হয়ে শুয়ে গেটের দিকে তাকিয়ে আনমনে এসব কথা ভাবছিল পিস্টন। ঠিক তখন নুলা এসে ঢুকল গেস্ট রুমে। পাশের সোফায় বসে পিস্টনের দিকে তাকিয়ে বলে – তুমি এইহানে হুইয়া রইছো, ওস্তাদ। আর আমি তামাম দুইন্যা খুঁইজা আইলাম তোমারে।

ঠাণ্ডা গলায় জিগায় পিস্টন- খুঁজস ক্যান ! কুনো খাস কামের খবর আছে নি ?

– আবার জিগায়। কয়দিনেই সব ভুইলা গেলা ক্যামনে, বুঝি না।

পিস্টন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো শোনার অপেক্ষায়।

নুলা বলে – মন্ত্রী সাবে তোমারে খবর পাঠাইছে। সুমবারে বটতলায় আম্লিগের বড় গেদারিং হইবো। গুল্লি মাইরা ওইটা পণ্ড কইরা দিতে কইছে।

এবার পিস্টনের সব কথা মনে পড়লো। ঈদের আগে এই বিষয়ে আলাপ হইছে মন্ত্রীর লগে। এমন না যে পিস্টন সরকারী দলের বান্দা মাস্তান। তয় পুলিশী ঝামেলা এড়াতে হলে ওদের ছায়ায় থাকা বুদ্ধিমানের কাজ। এমন নীতি শিখেছে সে রাসুর কাছ থেকে।

তবে সে অবাক হয় এত আর্মি,পুলিস হাতে থেকেও এরশাদ বেটা কেন এমন ভীতু, এটা পিস্টন বুঝে না। বেটায় পারলে সুযোগ সুবিধা দিয়া দ্যাশের তামাম খুনী, মাস্তানদের নিজের দলে ঢুকিয়ে নেয়।

এরশাদের একটা ব্যাপার অবশ্য পিস্টনের খুব পছন্দ – সেটা হল কাজের আগেই পয়সা দিয়ে দেয়। এরশাদকে পছন্দ করলেও পিস্টন মিন্টু রোডের ময়দার বস্তার মতন মটকু মন্ত্রীটা আর পুলিসের ওসিরে একদম সহ্য করতে পারে না। মাঝে মইধ্যে মন চায় দুনোটার পেটের ভিত্রে একটা কইরা সীসা হান্দায়া দিয়া খেইল খতম কইরা দিতে। এই কাজটা করা তার বাম হাতের মামলা। তবুও করতে পারে না।

মাথার ভিতর মেশিন চালু হয়ে গেলো পিস্টনের। কলাবাগান, হাতিরপুল, গুলবাগের গ্রুপরে খবর দিতে হবে। আহসান মঞ্জিলের আকবর শেঠের লগে ভাল খাতির হইছে তার। ছোট্ট একটা কাম কইরা দিয়া তার আপনা মানুষ হইছে পিস্টন। শেঠ তারে বলে দিছে, দরকার হইলে যেন শুধু একখান চিরকুট লেইখা তারে খবর পাঠায়। পিস্টন নিজে খুব সাহসী পোলা। গুলি করতে তার হাত কাঁপে না। কিন্তু শেঠের গ্রুপের একশন দেইখা তার মত পোলারও কইলজা কাঁইপ্পা গেছে। শেঠ গুলী করণের চেয়ে জবাই করতে আরাম পায় বেশী। ঠাঠারি বাজারের কসাইর দলের সবাই শেঠের চেলা চামুণ্ডা। তার কাছেও খবর পাঠাল।

**
সোমবারে ভার্সিটির ক্লাস শুরু হল। ক্যাম্পাস গরম। আগের রাতে বটতলায় চকির পাটাতন বানিয়ে মঞ্চ তৈরি হল। মাথার উপর লাল সালুর শামিয়ানা টানানো। কলরেডি কোম্পানির চোঙ্গার মত লম্বা মাইক ঝুলছে গাছের ডালে। ল্যাম্প পোস্টের সাথে। নেতা কর্মীরা মঞ্চের আশেপাশে ভিড় জমাতে শুরু করলো। শ্লোগানের আওয়াজ কলাভবনের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে। অনেক বড় বড় নেতাদের সাথে ডঃ কামাল হোসেনও এসেছেন মঞ্চে।

এরশাদকে টেনে নামিয়ে ফেলার বক্তৃতা পর্ব শুরু হয়েছে।

পিস্টনের দল ভাগ ভাগ হয়ে টি,এস,সি, মধুর ক্যান্টিন এলাকা দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকল। সবার হাতে অস্ত্র। ‘ধুম ধুম’ শব্দে কয়েকটা ককটেল ফাটল। তার পাশাপাশি বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ শুরু হল। সেই সাথে ‘ধর, ধর’ রব।

ব্যস, ক্যাম্পাস জুড়ে ভীত সন্ত্রস্থ ছাত্রদের নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেলো।
কলাভবনের দক্ষিণ গেইটে বসা ছিল খোকনরা। খোকন সুর্যসেন হল সংসদের জি,এস। পিস্টনের সাথে তার ভাল খাতির আছে। চোখাচোখি হতে পিস্টন চোখ টিপল। খোকন বুঝল তাকে সরে যেতে ইঙ্গিত দিলো পিস্টন। বুঝল আজ ক্যাম্পাসে লাশ পড়তে পারে কারো। খোকন উঠে গেল সাথের সঙ্গীদের নিয়ে। তারপর অন্যদের সাথে তারাও দৌড়াতে শুরু করলো লাইব্রেরীর দিকে।

পাশ থেকে একটা মেয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে – ‘আমার একটা স্যান্ডেল খুলে পড়ে হারিয়ে গেছে। একটু খুঁজে দিবেন,প্লিজ।’
বলে করুণভাবে খোকনের দিকে তাকালো।

খোকন তাকিয়ে দেখে ফুঁপিয়ে উঠা মেয়েটা আর কেউ নয়, ইতিহাসের আফরোজা। এই মেয়েকে খোকনের খুব পছন্দ। তাই কয়েক দিন তার পিছে ঘুরেছে। কথা বলতে চেয়েছে। কিন্তু পাত্তা পায় নাই। এই মুহূর্তে আফরোজার এক পায়ে স্যান্ডেল আরেক পা খালি দেখে খুব হাসি পেলো খোকনের।

সে হেসে উঠে বলে – ‘এখন কেন আমার দিকে তাকিয়ে স্যান্ডেল এনে দিতে বলছো ! যখন পিছে পিছে ঘুরছি, একটুও পাত্তা দিলা না। এখন একবার শুধু বল, আমার লগে প্রেম করবা, তাইলে শুধু স্যান্ডেল খুঁজে এনে দিবো না, তোমাকে কোলে তুলে নিয়ে নিরাপদে শাহবাগে পৌঁছে দিয়ে আসব।’

খুব কাছে কোথাও বিকট শব্দ করে একটা বোমা ফাটল। এবার খোকন আর দেরী না করে আফরোজার হাত আঁকড়ে ধরে মসজিদের গেইটের দিকে দৌড়াতে শুরু করলো। ঠিক তখুনি চোখে পড়লো সাদা লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী পরা একদল লোক মসজিদের গেইট দিয়ে কলা ভবনের দিকে ধেয়ে আসছে। সবার হাতে বিভিন্ন রকমের লম্বা লম্বা রামদা,চাপাতি। রোদের আলো পড়ে ছুরির ব্লেডগুলি চকচক করছে। ওদের দেখে খোকনের বুকের ভিতরটা হিম হয়ে গেলো ভয়ে। ভয়ে আফরোজা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো খোকনের হাত আঁকড়ে ধরে।
রামদা হাতে সাদা লুঙ্গি বাহিনী ওদের পাশ দিয়ে দৌড়ে চলে যেতেই খোকন গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা রিক্সায় উঠে বসলো আফরোজাকে সাথে নিয়ে। একটু পর কারো আর্ত চিৎকার শোনা গেলো – ওরে বাবারে, আমারে মাইরা ফালাইলো। কেউ আমারে বাঁচান। মঞ্চের দিক থেকে দৌড়ে পালাতে দেখে একজনকে ছুরির পোঁচ বসিয়ে দিলো শেঠের লুঙ্গি বাহিনীর একজন।

ওদিকে বটতলার কাছে পিস্টন আর নুলার বাহিনী লঙ্কা কাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছে। তিন দিক থেকে আক্রমণ করে, গুলি ছুঁড়ে ছত্রভঙ্গ করে দিলো জমায়েত। মঞ্চে বসা বড় নেতারা সবাই মঞ্চের পাটাতনের চকির তলায় গিয়ে লুকিয়েছে। মঞ্চের আশেপাশে, অপরাজেয় বাংলার ডানে বামের পথে ঘাটে পা থেকে খুলে পড়া স্যান্ডেল আর জুতার ছড়াছড়ি। মন্ত্রীর নির্দেশ ছিল দু চারটা লাশ ফেলে দেয়ার। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে এলেও ক্যাম্পাসের ছাত্রদের বুকে গুলি চালানোর কোন ইচ্ছা নাই পিস্টনের। সেই কথাটা আজ ক্যাম্পাসে ঢোকার আগে সে সবাইকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে। কেউ যেন ভুলেও কারো গায়ের দিকে গুলি না চালায়।
কিন্তু তবুও গুলি খেয়ে আহত হল কয়েকজন।

পিস্টনের ‘ডান হাত’ নুলা বেশিরকম ভয়ঙ্কর প্রকৃতির মানুষ। ফাঁকা গুলি করতে তার কখনো ভাল লাগে না। তার নীতি হল – গুলির দাম আছে। ফাঁকা গুলি করা মানে অপচয়। গুলি তৈরি করা হয়েছে কাউকে আহত করতে, কাউকে খুন করতে – ফাঁকা আওয়াজ করতে নয়। তাই সুযোগ পেলে সে মানুষের গায়ের দিকে গুলি চালায়। পিস্টনের ভয়ে বুকে গুলি করতে পারে না। তবে হাতে পায়ে করতে দ্বিধা করে না।

ক্যাম্পাসে সেদিন শুধু পিস্টনরাই আসে নাই অস্ত্র নিয়ে। ছাত্রলীগের গুর্খারাও এসেছে নেতাদের নিরাপত্তা দিতে। গোলাগুলিতে দুই পক্ষের কয়েকজন মারাত্বকভাবে আহত হল। যদিও সংখ্যায় তারা কম ছিল বলে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু সেই দলের কালা ফারুকের দিকে চোখ পড়েছে পিস্টনের দিকে। পিস্টনের চোখ পড়েছে কালা’র দিকে। দুজনের ভিতর পুরনো হিসেব নিকেশ আছে চাঁদাবাজি নিয়ে। সুযোগ পেয়েও পিস্টন তার দিকে গুলি করলো না। চোখ ফিরিয়ে নিলো।

পিস্টনের দল সরে পড়ল ক্যাম্পাস থেকে। তারপর পুলিশ বাহিনী এসে ঢুকল। তাদের নিরাপত্তায় নেতারা ক্যাম্পাস ছেড়ে বেড় হল।

কাফেটারিয়ায় বসে ভাত খাচ্ছিল পিস্টন। এক ছেলে এসে তাকে খবরটা জানালো। শুনে তার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। মাথা গরম হল। কালা নাকি কলা ভবনের দক্ষিণ গেইটে বসে আড্ডারত সুর্যসেনের মাহিনের গায়ে হাত তুলেছে।

মাহিনরা দল বেঁধে বসেছিল ওখানে। কালা’র দলের এক ছেলে মাহিনের সাথে বসে থাকা এক মেয়েকে একটা বাজে কমেন্ট করায় মাহিন তার উপর ক্ষেপে গেল। সে বুঝতেই পারে নাই এরা কত ভয়ঙ্কর মানুষ। উঠে দাঁড়িয়ে কমেন্ট করা ছেলেটার কলার ধরে টেনে আনলো। তারপর তাকে মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাইতে বলল। শুনে ছেলেটা বিশ্রী দাঁত বের করে হাসতে শুরু করলো। ঠিক তখুনি কালা এগিয়ে এলো। এসে মুখে কিছু না বলে মাহিনকে কষে এক চড় মারলো। চড়ের ধাক্কায় মাহিন উপুড় হয়ে পড়ে গেলো। তার চোখের চশমা ছিটকে পড়লো।

তার পর পরই কালা কোমর থেকে রিভলবার বের করে মাহিনের দিকে তাক করে ধরে গালি দিয়ে বলে – ‘অই ফকিন্নির পোলা, হিরো সাজস ! খাড়া, তর হিরোগিরি ছুটাই আমি।’
বলেই গুলি করতে গেল।

কয়েকজন মিলে কালার হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিলো।

বলে – আরে, আরে, করেন কি ! খুন কইরা ফালাইবেন নাকি সামান্য কারণে ! মাফ কইরা দেন। আপ্নাগোরে চিনবার পারে নাই।

মাহিনের বন্ধুরা তাকে টী তুলে নিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ল। তারা হল গেইটে পৌঁছালে পিস্টন এগিয়ে এসে মাহিনকে একপাশে নিয়ে গিয়ে জানতে চাইলো কি হয়েছিলো। মাহিন কিছু বলতে পারলো না। কিন্তু অপমানে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো।

মাহিনের সাথে পিস্টনের এক ধরনের অলিখিত ভাল লাগার সম্পর্ক আছে। ঢাকার ছেলে মাহিন সখ করে হলে এসে থাকে। অনেক বন্ধু বান্ধব আছে তার। দল বেঁধে ক্যাম্পাসে আড্ডা মারে। কোন ঝুট ঝামেলায় নাই। হলে আসতে যেতে তার সাথে দেখা হয় পিস্টনের। কখনো কথা হয় নাই। এক রাতে মগবাজারের হেলু ঝালুরা তাকে মারতে এলে পিস্টন এসে মাহিনের রুমে লুকিয়েছিল। মাহিন তাকে জানালার সান শেইডে নামিয়ে দিয়ে জানালা বন্ধ করে রেখেছে। হেলুরা তার রুমে ঢুকে না পেয়ে চলে গেছিলো সেবার। সেদিনের উপকারের কথাটা পিস্টন ভুলে নাই। মনে রেখেছে।

কালা ফারুক জহুরুল হক হলে থাকে। তার ভাই নাকি আর্মির বড় অফিসার। সেই জোরে বখে যাওয়া কালা ফারুক অনেক অন্যায় কাজ করে বেড়ায়। রাস্তায়, ক্যাম্পাসে মেয়েদের ওড়না ধরে টান মারে। বাজে মন্তব্য করে। খুন খারাবি করেছে অনেক। পিস্টনের সাথে তার দ্বন্দ্ব আছে। কিন্তু মুখোমুখি হয় নাই কখনো।
আজ পিস্টনের ইচ্ছা হল,সব হিসাব চুকিয়ে দিতে। মাহিনের গায়ে হাত তোলায় তার মনে হচ্ছে যেন তার নিজের গায়েই হাত পড়েছে।

নাহ, এবার আর কালাকে ছাড়া হবে না। মাথার রক্ত টগবগ করে ফুটতে শুরু করলো। রুমে ফিরে এসে কেরুর জিনের বোতল থেকে পেগের পর পেগ টেনে চলল সে। টু ইন ওয়ানে গোলাম আলীর গজল ‘আহিস্তা আহিস্তা’ বেজে চলেছে।

মাত্র সন্ধ্যে হতে শুরু করেছে। নুলা এসে রুমে টোকা দিলো। নুলা রুমে ঢুকতেই পিস্টন লাফিয়ে উঠে বলে – চল, আজই কালাকে খরচ করে দিবো।

নুলা পিস্টনের চোখে খুনের নেশা দেখতে পেলো। বুঝল এখন আর তাকে থামানো যাবে না। খাটের তলা থেকে স্টেনটা বের করে লোড করলো। একটা বাজারের ব্যাগে ভরে নিলো সেটা। কোমরে গোঁজা আছে পয়েন্ট থার্টি এইট পিস্তল। দুজনে চুপচাপ হল ছেড়ে বের হয়ে রিকশায় চড়ে জহুরুল হক হলে এলো। গেইটে নামতেই কেউ একজন পিস্টনকে দেখে

ভেতর দিকে দৌড় দিলো। ধুম ধাম আওয়াজে সব রুমের খোলা দরজাগুলি বন্ধ হতে শুরু করলো।

পিস্টন দারওয়ানকে জিজ্ঞেস করলো – কালা কই রে !

খোলা স্টেন হাতে পিস্টনকে দেখে দারওয়ান কাঁপতে কাঁপতে শুধু বলল – স্যার, আল্লার কসম, আমি জানি না।

আর কথা না বলে ওরা দুজন তিনতলায় উঠে এলো। কালা যে সব রুমে থাকতে পারে সব কটায় লাথি মারল । দরজা খুলল। কিন্তু কালা নাই। সে নাকি তিনতলা থেকে লাফিয়ে নেমে পালিয়েছে।

পিস্টন হল গেইটে ফিরে এসে চিৎকার করে ঘোষণা করলো – ‘কালাকে জানিয়ে দিস, তার সময় শেষ। তাকে আমার হাতে মরতে হবে। তার আগে সে যেন আজ ক্যাম্পাসে যার গায়ে হাত তুলেছে,তার কাছে গিয়ে মাফ চেয়ে নেয়।’

বলে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে বেরিয়ে এলো।

পিস্টন এফ রহমান হলে এলো। সেখানে অনেক মাস্তানের মুরুব্বীরা থাকে। তাদের কাছে গিয়ে বলল, আপনারা আজ রাতে মিটিং ডাকেন। কালা তার সীমা অতিক্রম করেছে। তাকে থামান। নইলে আমি তাকে থামাতে বাধ্য হবো।

সেই রাতে গুলশান ১ এর ‘লা ডিপ্লোমেট’ বারে ঢাকার সব বড় মাস্তানদের মিটিং বসলো। বড় মাস্তানেরা সবাই সবাইকে সন্মান করে। কেউ কারো পথ মাড়ায় না। এরা কেউ কোন দলের বাঁধা ধরা সৈন্য না। বরং ভাড়ায় যায়। কাজ করে দিয়ে পয়সা নেয়। সবাই পিস্টনের নীতিকে পছন্দ করে। রাসুর আপন মানুষ পিস্টন। তাই তাকে আরো বেশী ছাড় দেয়। সবার কথায় বোঝা গেলো, তারা সবাই কালার বেয়াদবিতে মহা বিরক্ত। কালার গুরু মোহাম্মদও স্বীকার করলো সে কথা। তারপর সে কথা দিলো – কালা মাহিনের কাছে ক্ষমা চাইবে। এই সিদ্ধান্তে মিটিং শেষ হল।

পরদিন দুপুরবেলায় মাহিন হলে তার রুমে শুয়েছিল। সাথে বন্ধুরা আছে। রুমের দরজা খোলা। হটাত একসাথে অনেকগুলি ছেলে সেই রুমে ঢুকল। হল ছাত্রলীগের পরিচিত মুখ ছাড়াও সাথে এসেছে কালা ফারুক।

সে এগিয়ে এসে চোখ থেকে সানগ্লাসটা নামিয়ে মাহিনের কাছে গিয়ে হাত ধরে বলে – ভাই, কাল আমার ভুল হইছে। শুনছি আপনি নাকি বালা মানুষ। আর আমি কিনা না বুইজা আপনার গায়ে হাত তুইলা ফালাইছি। সেই অপরাধে ঢাকা শহরের আমার সব মুরুব্বীরা আমারে বকা ঝকা করতাছে। আমি যা করনের কইরা ফালাই নিজের খুশিতে। সেজন্য এই জিন্দেগীতে কারো কাছে মাফ চাই নাই। তয় আইজ আপনের কাছে মাফ চাইতেছি। আপনে আমারে মাফ কইরা দেন। – বলে মাহিনের হাত জড়িয়ে ধরল।

মাহিন একদম প্রস্তুত ছিল না এমন কিছুর জন্য। তবুও কোন রকমে ঠি’ক আছে, ঠিক আছে’ বলে দায় সারল।

সেদিন কালা তার কাছ থেকে মাফ চেয়ে চলে গেলো। তারপর এক সপ্তাহ ধরে তাকে আর ক্যাম্পাসের কোথাও দেখা গেলো না।

একদিন পত্রিকার পাতায় খবর ছাপা হলো – ধামরাইয়ে ধানক্ষেতের আইলে একটা মুণ্ডু ছাড়া লাশ পাওয়া গেছে ষোল টুকরা করা অবস্থায়। তার পাশে পাওয়া সানগ্লাসটা দেখে আন্দাজ করা যায় ওটা কালা ফারুক ছাড়া আর কেউ না।

পরে জানা গেছে, কালাকে তার দলের বিরক্ত কাঊকে দিয়ে ডাকিয়ে শাহবাগে নিয়ে মাথায় বস্তা বেঁধে মাইক্রবাসে উঠিয়ে ধামরাইয়ে নিয়ে যায় সাদা পাঞ্জাবী, সাদা লুঙ্গি আর মাথায় গোল টুপি পরা পুরাণ ঢাকার কয়েকজন পরহেজগার মানুষ। কাজ শেষে ঢাকায় ফিরে আসার পর কালা তাদের সাথে ছিলনা। উল্টা তাদের অনেকের পাঞ্জাবীতে লাল রক্তের ছোপ লেগেছিল।