রুম নম্বর ৩১৬ ~

সূর্যসেন হলের এই রুমটায় থাকতাম আমি আর ডালিম। অনেকদিন একসাথে এক বিছানায় ঘুমিয়েছি আমরা। বেডটা এত চিপা ছিল, সেটাই দুজন মানুষ কেমন করে ঘুমাতাম ভাবলে এখন খুব অবাক লাগে। এখন কিং সাইজ বেডে শুয়ে ঘুমের ঘোরে শেফালীর সাথে টাচ লেগে ঘুম ভাঙ্গলে গজগজ করি দুজনেই। অথচ তখন কি অবলীলায় ঘুমাতাম।

মাঝে মাঝে এসব স্মৃতি মনে হলে একা একা হাসি। আমি আজীবন শুকনা পাতলা মানুষ। হাত পা লম্বা লম্বা, অনেকটা মুলি বাঁশের মত। ডালিম কথার রাজা ছিল। ঘুমের ঘোরে সে আমার হাঁটুর গুতা খেলে বলে উঠতো – ইয়ে হাই সাব, আপকো হাঁটু সরাকে লও। শুনে ঘুমের ভিতরও হেসে দিতাম।

ছোট্ট একটা রুমে দুইটা যুবক কয়েক বছর একসাথে থাকলাম। কি মধুর সম্পর্ক হলে এমনটা সম্ভব ! এক বোতলের পানি দুজনে নিশ্চিন্তে মুখ লাগিয়ে ডগডগ করে খেয়ে ফেলতাম। একজনের ঠোঁটের সিগারেট আরেকজন টানতাম। জামা কাপড় জুতা শেয়ার করতাম। একটুও বাধতো না। নির্লজ্জ্বভাবে নেংটো হয়ে একে অপরের সামনে কাপড় পাল্টাতাম যেন কোন ব্যাপার না। আজ যখন একা একা এসব স্মৃতি রোমন্থন করি – ভাবি আমরা যেন একটা দম্পতির চেয়েও বেশী আপন ছিলাম।

রুমের দরজায় দেখুন খড়িমাটি দিয়ে আমাদের দুজনের নাম লেখা – উপরে ডালিম নীচে মুরাদ। এসব তার কাজ। রুমের ভিতর জানালায় পর্দা ছিল। বাসা থেকে এনে লাগিয়েছিলাম। সূর্য বাবু ঘুরে এসে আমাদের দিকে তার নল তাক করলে পর্দা ছাড়া উপায় ছিল না। জানালার দুই পাট কপাট সব সময় খোলা। নইলে বাতাস আসবে কি করে !

তিনতলার উত্তর ব্লকের মাঝ থেকে শেষ পর্যন্ত সব কয়টা রূমে আমরা বন্ধুরা থাকতাম। তাই জানালা বন্ধ করার দরকার হত না। আর চুরির ভয় ছিল নাতো, কে এই দুঃসাহস দেখিয়ে ধরা খেয়ে ইজ্জত হারাবে !

ও হ্যাঁ, আমরা মাঝে মাঝে ইলেকট্রিক চুলা দিয়ে রুমে রান্না করতাম। হাশেম নামের এক টোকাই ছিল যে আমাদের ফুল টাইম রুম সার্ভিস বয়। রান্না, কাপড় ধোয়া, ঘর গোছানো আবার মারামারি লাগলে আমাদের লাঠিসোটা এনে দেয়া সব কাজই সে করতো। আমি খুব ভাল ডাল রাঁধতে পারতাম। তার ভিতর হাতের কাছে থাকলে পুঁই শাক দিয়ে দিতাম। কয়দিন অমন রেঁধে বিরক্ত লাগলে আবার বাইরে খাওয়া শুরু হত।

এক বন্ধু একবার আমাদের রুমের সানসেট থেকে পা পিছলে নীচে পড়ে গেছিলো। হিসু ধরলে তাস খেলার আড্ডা ফেলে সে টয়লেট পর্যন্ত যেতে চাইলো না। খোলা জানালা দিয়ে পা উঠিয়ে সানসেটে নামলো। শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে থাকা সানসেটে দাঁড়ায়ে ভারসাম্য হারালো। ব্যস, ধপাস করে তিনতলা থেকে লিফটের চেয়ে দ্রুত গতিতে ধরণীতে নেমে গেলো। সবাই ভাবলো, এই রে সেরেছে, ব্যাটা বোধ হয় মরেই গেলো। হন্তদন্ত হয়ে নীচে নামলাম। আমরা তার কাছে পৌঁছনোর আগেই দেখি সে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। বলে আমি ঠিক আছি। কিছু হয় নাই। ভাগ্যিস জায়গাটায় কংক্রিট না থেকে নরম ভেজা মাটি ছিল। তাই রক্ষা পেলো। আমরাও পুলিশী ঝামেলা থেকে বাঁচলাম।

শুনেছি আমাদের কয়েক ব্যাচ আগে এই রুম থেকে লাফিয়ে পড়ে এক মেয়ে নাকি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো। প্রেমিক যুগলের ঝগড়ার জের হিসাবে মেয়েটা লাফ দিলেও বেঁচে গেছিলো। এই খবর তখনকার পত্রিকার হেডলাইন হয়েছিল। এই কারণে ক্যাম্পাসে ছেলেমেয়েরা আমাকে সেই কালপ্রিট বলে অনেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মজা নিতো।

পরীক্ষা এলে রুম ভর্তি বন্ধুরা একসাথে স্টাডি করে যে যেখানে পারতাম চিৎকাত হয়ে জুতা স্যান্ডেল যা পেতাম মাথার নীচে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। কারো কোন অভিযোগ নাই। রাত ভর ষ্টার সিগারেটের প্যাকেট ধ্বংস করে আমাদের আড্ডা চলতো পরীক্ষা শেষে। হেড়ে গলায় যে যেমন পারতাম গান গাইতাম। মোহামেডান আবাহনীর খেলা থাকলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে টিনের থালায় আওয়াজ করে একদল আরেক দলকে খেপাতাম।

মাঝে মাঝে অস্ত্র উদ্ধারের জন্য যৌথ বাহিনী রাতের অন্ধকারে হল রেইড করতো। যার কাছে যা ছিল সব হাসেমকে দিয়ে লিফটের পাশে ওকে ময়লা কাঁথা গায়ে শুয়ে থাকতে বলতাম। ডালিম হারামী তখন মাথায় টুপি চড়িয়ে বিছানায় বসে তসবী গুনতো। রুমে আগরবাতি জ্বালিয়ে দিতো। ভাব দেখাতো সে একদম গোবেচারা মানুষ। এতে ভাল কাজ হত। মাথায় টুপি দেখে পুলিশ আর আমাদের রুমে ঢুকতো না।

আহা কি মধুর সময় কেটেছে কয়টা বছর। বলা যায় মাত্র যুবক হওয়ার উন্মত্ততায় পরিবারের শাসন থেকে দূরে থেকে জীবনের শ্রেষ্ট সময় টুকু কেটেছে হল জীবনে। কখনো ভাল খাবার ( নীরব হোটেল ), কখনো ক্যাফেটেরিয়ার পঁচা খাবার আবার কখনো কলা বনরুটি খেয়ে রাত কাটিয়েছি। পয়সা না থাকলে শুধু পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। তবু কোন অভিযোগ ছিল না। সব কিছুর উর্ধে ঐ রুমটায় আমি ও ডালিম যেন স্বর্গ সুখে থেকেছি বহু দিন।

হল ছাড়ার কয়েক বছর পর আমি দেশের বাইরে পাড়ি জমালাম। ডালিমটা কিসব ব্যবসা ট্যাবসা করলো। তারপর ঢাকা ছেড়ে তার খুলনা শহরে চলে গেলো। কিছুদিন আগে ওর স্ট্রোক হয়ে বেচারা বিছানায় পড়লো। ফাইটার ছেলে হার মানতে রাজী না। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। হবেই। এত তাড়াতাড়ি হার মানার মানুষ তো না আমরা।

২০শে মে, ২০২০