দুয়ার

টুনি শুধু পড়াশুনায় ভাল না, মানুষ হিসাবেও। গ্রামের সবার প্রিয় মানুষ। চঞ্চলা হরিণীর মত ঘুরে বেড়ায় গাঁ এর এমাথা থেকে ওমাথায়। কার কোথায় কি সমস্যা, কে নাম দস্তখত করতে পারে না তাকে শিখিয়ে দেয়া, কার ছেলেকে বিদেশে চিঠি লিখে পাঠাতে হবে এই সব কাজ তাকে করে দিতে হয়।

সেই মেয়ের গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় যাওয়ার খবর জেনে সবার মন খারাপ হল। এমন কি তার স্কুলের হেডমাস্টার ফণীভূষণ বাবুরও।

তিনি মাথায় ছাতা মেলে ধরে টুনিদের বাড়ির দাওয়ায় এসে তার বাবাকে ডাকল। রুস্তম মিয়া অত বড় সন্মানী মানুষকে তার বাড়িতে দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। নিজের গামছা দিয়ে কাঠের চেয়ারটা ঝেড়ে মুছে মাষ্টার সাহেবকে বসতে দিলো। তারপর মাষ্টার সাহেবের মুখের দিকে তাকায়ে অপেক্ষায় থাকলো উনি কি বলে শোনার জন্য।

নিজের স্কুলের হেড স্যারকে তাদের বাড়িতে দেখে টুনি অবাক হয়। তিনি আগে কখনো আসে নাই তো। দৌড়ে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করে বলে – স্যার, আপনে আমাদের বাড়িতে যে !

এসএসসি’তে ফার্স্ট ডিভিশন পেলে সে বাবার কাছে আবদার করেছে ঢাকায় গিয়ে কলেজে ভর্তি হবে। এই খবরটা কানে কানে ছড়িয়ে হেড স্যারের কান গিয়ে পৌঁছেছে। উনি চায় ব্রিলিয়ান্ট টুনি গ্রামের কলেজে ভর্তি হলে কলেজের সুনাম বাড়বে। ছাত্ররা উৎসাহ পাবে।

মেয়ের আবদারে চিন্তায় পড়ে গেল ছাপোষা গৃহস্থ রুস্তম মিয়া। চার ছেলের পর কোল জুড়ে আসা মেয়েটা তার চোখের মনি। তার কোন আবদার তিনি ফেলতে পারে না।

ইচ্ছা নাই তারে চোখের আড়াল করার। আবার উপায় নাই তার আবদার না শুনে। নইলে সে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে ফেলবে। গোস্বা করে হয় বাড়ি ছেড়ে পালাবে আর না হয় বোকার মত ইঁদুরের বিষ খেয়ে ফেলবে। নিজের মেয়েকে রুস্তম মিয়া খুব ভাল করে চেনে। বলে কোন লাভ হল না।

মেয়ের ছোট খালা ঢাকায় থাকে। তাদের বাসায় গিয়ে উঠলো মেয়েকে সাথে নিয়ে। টুনিকে ভর্তি করালো হোম ইকোনোমিক্স কলেজে।

দুই সপ্তাহ ঢাকায় কাটালো রুস্তম মিয়া। মেয়েকে সাথে নিয়ে রিকশায় চড়ে মোহাম্মদপুর থেকে নীলক্ষেতে কলেজে আনা নেয়া করলো। হোস্টেলে সিট পেলে মেয়েটা ওখানে চলে যাবে। তদ্দিন এই বাসায় থাকতে হবে টুনির।

এবার গ্রামে ফেরার জন্য তৈরী হল রুস্তম মিয়া। বাবা চলে যাবে শুনে টুনি থমকে গেলো। এখানে বাবাকে ছাড়া তার একা থাকতে একদম ভাল লাগবে না। খালু লোকটা সুবিধার না। কেমন করে করে তাকায় আর হাসে। দেখলে গা রি রি করে উঠে। বাবাকে বলতে গিয়েও বলতে পারে না।

শুধু বলে – বাবা, তুমি আর কয়টা দিন থাকো।

বিকেলে বারান্দায় বসে ভায়রার সাথে চা বিস্কুট খাচ্ছে রুস্তম মিয়া। ভায়রা সরকারী চাকরি করে। অনেক চেনা জানা তার।

হঠাৎ বলে – ভাইসাব, মেয়ে বড় হয়ে গেছে। আর পড়াশুনা করিয়ে কি হবে। বিয়ে দিয়ে দেন। আমার কাছে একটা ভাল প্রস্তাব আছে।

শুনে চমকে উঠে রুস্তম মিয়া। তার এতটুকুন মেয়েকে এখুনি বিয়ে দিয়ে দেবে ? আবার ভাবে মা মরা মেয়ে, যত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়া যায়, ভাল হয়।

ভাবনায় পড়লো বেচারা। সেদিন ভায়রাকে কিছু জানালো না।

এখনো আঠারো হয় নাই মেয়েটার। দুই বেণী করে চুল বাঁধে। হাসে শিশুর মত। ওকে কেমন করে বিয়ে দেবে সে !

পরদিন ভায়রা জানায় পাত্রের কথা। ওকালতি পাশ করেছে। এখন আমেরিকায় থাকে। অবস্থা খুব ভাল। দেশে এসেছে বিয়ে করতে। তার বন্ধু মানুষ। বয়স একটু বেশী হলেও সমস্যা নাই। মেয়ের জীবন একদম সুখে শান্তিতে কাটবে বিদেশে।

পাত্রের বয়স শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো রুস্তম মিয়া। মেয়ে এখনো আঠারো পার হয় নাই। তার বিয়ে দিতে হবে বেয়াল্লিশ বছরের বাপের বয়েসী পুরুষের সাথে। দোটানায় ভুগে তিনি। সারা রাত ধরে একা একা ভাবে। ভাবে মেয়ের মা’টা বেঁচে থাকলে তার মত নেয়া যেত।

সকালে মেয়েকে নিয়ে কলেজে যাওয়ার পথে ধীরে ধীরে কথাটা বললো তাকে। বলে – তোর মা নাই। কে দেখবে তোকে। তোর ভাইরা তোকে দেখবে না। আমি মরে গেলে তুই বিপদে পড়ে যাবি।

নিজের হাতে পানির ফোটা পড়ায় তাকিয়ে দেখে তার চঞ্চল মেয়েটা নীরবে কাঁদছে রিকসায় বসে।

টুনি ভাবছে, তাইতো, তার তো কোন আশ্রয় নাই। বাড়িতে মা না থাকলে মেয়েরা ভীষণ অসহায়। সবার গলগ্রহ। বাবার ঘুম হারাম হয়। আপন আত্মীয়রা ঘরের শত্রু বিভীষণের মত হয়ে যায়। সবাই যেন খুবলে খেতে চায়। কি নোংরা সব মানুষ চারপাশে।

ঝট করে বলে ফেলে – বাবা, তুমি আমাকে এই লোকের সাথেই বিয়ে দিয়ে দাও। খুব ভাল হবে। আমি আমেরিকায় গিয়ে অনেক বড় কলেজে পড়ালেখা করতে পারব। তুমি কথা বল।

তারপর বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো।

২রা জানুয়ারি, ২০১৯