#উত্থান৫ – Rise of a thug
সন্ধ্যার পর বাইট্টা আর নুলা সোহরোওয়ার্দী উদ্যান থেকে পিস্তল ঠেকিয়ে স্টেনগান ওয়ালা এক কনস্টেবলকে উঠিয়ে নিয়ে এলো চোখ বেঁধে। পুলিশ বেচারা ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেললো। ভেবেছে তার স্টেনগানটা নেয়ার জন্য তাকে হাইজ্যাক করা হয়েছে। তারপর তাকে জানে মেরে ফেলবে। তাই ভয়ে কাঁপুনি থামাতে পারছে না।
রিক্সায় দুইজনের মাঝখানে পুলিশটাকে বসিয়ে তারা তাকে শাহবাগ দিয়ে কাঁটাবন বস্তিতে নিয়ে আসছিল। লোকটার ভীতি দেখে নুলা রসিকতা করতে ছাড়ল না।
বলে – ওস্তাদ, কাঁপুইন ক্যা রে ! আমারে যহন আপনের জাত ভাইরা ধইরা নিয়া রাইফেলের বাট দিয়া পিডায়া পা’টা লুলা বানায়া দিলো, হেইদিনও কিন্তুক আমি কুনো কাঁপা কাঁপি করি নাই। মাইরের চোটে শুধু বেহুশ হয়া গেছিলাম। হ্যার পর থন আমি আর ঠোলা দেকবার পারি না। আতের কাসে পাইলেই গলাটা টিপ্পা দরতে মুন চায়। মাগার মুন চাইলেও আপনেরে মারার পারুম না। ওস্তাদের নিসেদ আসে। আপনেরে দিয়া কামডা সাইরা ছাইরা দিমু নে। ডরাইয়েন না। মারুম না। আপনের যন্ত্ররও লমু না। কতা দিলাম।
বলে কি ! ওরা নাকি তার অস্ত্র নিবে না। জানেও মারবে না। তাইলে কি মুক্তিপণ চাইবো নাকি ?
সাহস করে বলে ফেলে – ভাই রে, আমারে আটকায়া তো টেকা পয়সা কিসু পাইবেন না। কিসুই নাই আমার।
– না টেকা চামু না। গেলেই দ্যাকবেন কি কাম আপনের।
যাদুঘরের পেছনে এসে নেমে গেলো ওরা রিক্সা থেকে। তারপর সুড়ুত করে বস্তিতে ঢুকে গেলো। জরিনার ঘরে এসে ঝাঁপ বন্ধ করে চোখের বাঁধন খুলে দিলো পুলিশের। পানি খেতে দিয়ে তাকে থিতু হওয়ার সময় দিলো। তারপর বাইট্টা চটের ব্যাগ থেকে পিস্টনের জালিটা বের করে পুলিশের সামনে রেখে বলে – এই মালডা জাম খায়া গেছে। খুইলা তেলতুল মাইরা ঠিকঠিক কইরা চালু কইরা দ্যান।
পুলিশটা এবার ফোঁস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে কাজে নামলো। মুহূর্তের ভিতর স্টেনটা খুলে ফেললো পার্ট বাই পার্ট। বাইট্টার এগিয়ে দেয়া গান অয়েল মাখালো ত্যানা দিয়ে। ঘসে মেঝে চকচক করে তারপর লাগালো আবার। এরপর কয়েকবার কক করে ফাঁকা ট্রিগার টিপে দেখালো সব ঠিক আছে। বাইট্টা সেটায় ম্যাগাজিন লাগিয়ে এক রাউন্ড গুলি ছুঁড়ল আকাশে। সব ঠিক আছে।
সে খুশী হয়ে পুলিশকে এক হাজার টাকা দিলো। আবার চোখ বাঁধলো। তারপর এ গলি, ও গলি হাঁটিয়ে দিকভ্রান্ত করে অন্য পথে তাকে গেটের বাইরে নিয়ে রিক্সায় উঠালো। কয়েক চক্কর ঘুরলো এদিক ওদিক। তারপর তাকে আজিমপুর গোরস্থানে নামিয়ে দিয়ে ওরা ফিরে এলো।
**
সুর্যসেন হল গেইটে একটা পে ফোন লাগানো হল। নীল রঙের ফোন।দেখতেই ভাল লাগে। কিন্তু মাত্র অল্প কয়দিন টিকলো সেটা। যে কয়দিন ছিল, বিশ্ব প্রেমিক শান্ত পকেট ভর্তি বাঘ মার্কা সিকি নিয়ে সারাদিন তার অসংখ্য প্রেমিকার সাথে কথা বলে ফোনটা বিজি করে রাখতো। পোলাপান বিরক্ত হলেও শান্ত সবার সিনিয়র ভাই, তাই কেউ কিছু বলতে পারতো না। কিন্তু ব্যাপারটা সবার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলো। তাই কাউকে কিছু না বলে পিস্টন একরাতে টান মেরে ফোন সেটটা ওয়াল থেকে ছুটিয়ে নিয়ে রুমে রেখে দিলো।
ব্যস, আলাদীনের চেরাগ সবেধন নীলমণি ফোনটা হারিয়ে গেলো।
মাহিনের সেদিন খুব জরুরী একটা ফোন করার দরকার ছিল। পুরো হলের ভিতর একটাই ফোন আছে। আর সেটা থাকে হল প্রভোস্টের রুমে। বেচারা সাহস করে স্যারের রুমে গেলো ফোন করতে। স্যার পে ফোন হারানোর জন্য দশ কথা শুনিয়ে, তাকে ফোন করতে না দিয়ে একরকম ঝেটিয়ে বিদায় করলো। সে খুব মন খারাপ করে অফিস রুমের সামনের বারান্দায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
পিস্টন মাত্র হল থেকে বের হতে যাচ্ছে। চোখের সামনে মাহিনের বিমর্ষ মুখ দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। ভদ্র ছেলে হিসাবে খুব পছন্দ করে সে মাহিনকে।
তাই কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে -কি ভাই, মন খারাপ কেন !
মাহিন বলতে চাইলো না। কিন্তু পিস্টন ইন্সিস্ট করায় স্যারের দুর্ব্যবহার করার কথাটা বলল। পিস্টন বুঝলো মাহিনের গোবেচারা ভদ্র এপ্রোচ দেখে প্রভোস্ট তাকে পাত্তা দেয় নাই।
সে মাহিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে প্রভোস্টের রুমে ঢুকল। তাকে দেখে প্রভোস্ট ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বলে – বাবা, আসো, বস। কি খবর তোমার !
প্রশাসনের অনেকের মত তিনিও ভাবে, পিস্টন একজন প্রভাবশালী ছাত্র। আদৌ ছাত্র কিনা সেটা নিয়ে কখনো ভাবার দরকার মনে করে নাই।
মাহিন প্রভোস্টের কথার উত্তর না দিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে ফোনটা টেনে নিয়ে শুধু বলল – স্যার, কয়টা জরুরী ফোন করতে হবে।
প্রভোস্ট তটস্থ হয়ে উত্তর দেয় – হ্যাঁ, হ্যাঁ অবশ্যই কর। তোমাদের জন্যই তো ফোন।
পিস্টন মাহিনের দিকে তাকিয়ে বলে – ফোন করেন।
ত্রিশ সেকেন্ডে ফোন সেরে অফিস থেকে বের হয়ে মাহিন ধন্যবাদ দিতে গেলে পিস্টন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে – সবখানে ভদ্রতার দাম নাই, ভাই। বুঝলেন ! ফোন তো হেই বেডার বাপের না। হলের দরকারেই দেয়া। তাইলে দরকার হইলে আমার মতন কইরা টাইনা লইয়া করবেন। আর যদি না পারেন তাইলে আমারে কইয়েন।
তারপর মাহিনকে অবাক করে দিয়ে বলে – সবাইকে বলার দরকার নাই। কিন্তু আপনার ফোন করার দরকার হলে আমার রুমে চইলা আইসেন।
– আপনার রুমে ফোন আছে নাকি !
হ, আছে তো। অফিস রুমের ফোনের লাইন টাইনা নিয়া লাগাইয়া লইসি।
মাহিনের চোখ কপালে উঠলো। মুখে কিছু না বলে মনে মনে বলে – আসলেই দুনিয়ায় ভাল মানুষের কোন দাম নাই।
**
হলের পেছনে বিশাল কাঁটাবন বস্তি। ঠিক মাঝ বরাবর গোলাকৃতি একতলা একটা দালান আছে। আকাশ থেকে তাকালে মনে হবে হয়তো ছোটখাটো কোন খেলার মাঠের গ্যালারী। বাস্তবে ওটা হলো ঘোড়া রাখার আস্তাবল। বর্তমান সোহরোওয়ার্দি উদ্যান আদিকালে রমনা রেইস কোর্স নামে ঘোড়দৌড়ের মাঠ ছিল। সেই রেইসের সব ঘোড়া থাকতো এই আস্তাবলে।
কালের আবর্তে সব বদলেছে। মানচিত্র বদলেছে। ঘোড়দৌড়ের মাঠ এখন উদ্যান। একাত্তুরে সেই উদ্যানে বিজিত বাহিনী বিজয়ী বাহিনীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্ম সমর্পণ করেছে। পরাজয় মেনে নিয়ে স্বাক্ষর দিয়ে বন্দী হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ রচিত হয়েছে। কিন্তু ঘোড়ার আস্তাবলটা তেমনি রয়ে গেছে। তবে সেখানে ঘোড়ার বদলে ছিন্নমূল মানুষের আবাস রচিত হয়েছে। সীমানা ভাগাভাগিতে সেই ঘোড়া ঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় চলে এসেছে।
বস্তি শুধু ছিন্নমূল মানুষের আবাসন না। অপরাধ জগতের আস্তানাও বটে।
সরকারী ভূমি হলেও সেখানে মানুষের ফ্রি না, ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়। বস্তির মাস্তানরা সেই ভাড়া নিতো। আবার তাদের আয়ের উপর বখরা বসাতো হলের প্রভাবশালী নেতা মাস্তানরা। বস্তির মানুষদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলত এমন কিছু ছাত্র নামের কুলাঙ্গার।
অনেকদিন ধরে এমন বখরা ভাগাভাগি চলে আসছে। ব্যাপারটা কানে এলো পিস্টনের। হুকুম জারী করে দিলো আর কেউ বস্তি থেকে চাঁদা তুলতে পারবে না। সেই চেষ্টা করলে তার লাশ পড়ে যাবে। তবুও একবার হলের এক প্রভাবশালী নেতা সেই আদেশ অমান্য করে পিস্টনের হাতে চড় খেয়ে তারপর থেমেছে।
পিস্টন পুরো শহরে চাঁদাবাজি করে। বখরা নেয় কারো কাজ করে দিয়ে আবার কারো মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে। কিন্তু বস্তির মানুষের কাছে সে গড ফাদারের মত আদরের। তাই তার দরকারের সময় তারাই তাকে লুকিয়ে রাখে।
শুক্রাবাদে ব্যবসায়ী খুন করে পালিয়ে শান্তি পাচ্ছিলো না। তখন বস্তির বুড়ি মা তাকে তার ঘোড়া ঘরের রুমের ভিতরের গোপন কুঠুরির ভিতর এক সপ্তাহ লুকিয়ে রেখেছিল নিরাপদে। তাই এই মানুষগুলির প্রতি তার অনেক মায়া জন্মে গেছে।
তার মন্ত্রী গুরুর সহায়তায় যখন পুলিশ তার উপর থেকে নজরদারি সরিয়ে নিলো তারপরই সে সেই গর্ত থেকে আবার বাইরে বের হয়েছে।
**
ঈদের ছুটিতে শুধু হল না, পুরো শহর প্রায় ফাঁকা। এই সময়ে রিক্সায় ঘুরে বেড়াতে অনেক সুখ। রাস্তায় শহরের ছেলে মেয়েরা জোড়া বেঁধে রিক্সায় ঘুরছে। পিস্টন শাহবাঘের কোহিনুর কনফেকশনারীতে বসে কলিজার সিঙ্গারা খাচ্ছিল। কোহিনুরের মালিক পুরাণ ঢাকার মটু তাকে খুব পছন্দ করে। অনেক চাঁদাবাজি থেকে পিস্টন তাকে বাঁচিয়েছে। সেখানে বসে পিস্টন বাইরে রাস্তায় মানুষের আসা যাওয়া, খিলখিল হাসির আওয়াজ শুনছিল। মনে মনে ভাবছিল ,তার কেন অমন একটা নির্ঝঞ্ঝাট জীবন নাই। কেন তার এমন জীবন কাটাতে হবে ! মনের মত সুন্দর একটা মেয়ের সাথে প্রেম হলে মন্দ হতো না।
চোখের সামনে ভেসে উঠলো রাসুর বান্ধবী কুন্তির মুখ। মেয়েটাকে একদিন এক পলক দেখেছে শুধু। সে দেখায় মনে হয়েছে তার ভিতর আগুন আছে। থাকলেই কি ! তার মত অশিক্ষিত মাস্তানের সাথে অমন ভদ্র গোছের শিক্ষিতা মেয়ে কথা বলতে যাবে কোন দুঃখে ? এই কথাটা মনে হওয়ায় নিজেকে খুব নিঃস্ব মনে হল তার আজ।
মনে পড়লো তার তো কোন অক্ষর জ্ঞান ছিল না। রাসু তার রুমে বসিয়ে শুধু নিজের নামটা লিখতে শিখিয়েছিল। ব্যস, ঐ পর্যন্তই। এই ক্যাম্পাসের ছাত্র, শিক্ষক, প্রশাসনের অনেকে ভাবে সেও একজন ছাত্র। সত্যি হলে কতই না ভাল হতো।
কাজটা ঠিক হবে না। তবুও তার ইচ্ছা হল কুন্তির সাথে দেখা করবে সে। এখনতো সে নাই। ঈদের ছুটির পর কুন্তি হলে ফিরে আসলে সে কুন্তির সাথে দেখা করবে। রাসুর প্রসঙ্গ ধরে কথা বলবে। নিজের নাম বললে নিশ্চয়ই তাকে চিনবে। কিন্তু তাই বলে সে মাস্তান সুলভ কোন আচরণ করবে না কুন্তির সাথে। সুন্দর আচরণ করবে। সিঙ্গারা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কিন্তু তার ভাবনায় ছেদ পড়ে নাই। দোকানের মেসিয়ার এসে বলে – স্যার, চা আনছি। শুনে হুঁশ ফিরে এলো তার। চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে মনের আনন্দে হেসে ফেললো পিস্টন। ভাবছে কুন্তিকে গিয়ে বলবে – সবাই তাকে পিস্টন বলে ডাকলেও তার আসল নাম জুলহাস। জুলহাস আহমেদ। জুলহাসের সাথে আহমেদটা সে এইমাত্র যোগ করলো। শুনতে বেশ ভাল লাগে। নামটা ঠিক করতে পেরে আরো খুশী লাগলো।
খুশী মনে গরম চায়ে লম্বা চুমুক দিতে গিয়ে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেলে চিৎকার করে উঠলো। তার অমন ছেলেমানুষী কাণ্ড দেখে মা বাবার সাথে পাশের টেবিলে বসা পুতুলের মত সুন্দর ছোট্ট মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠলো।
চলবে…।।
আগের পর্বগুলি –
#উত্থান১
#উত্থান২
#উত্থান৩
#উত্থান৪