#উত্থান৪ – Rise of a Thug

রাত মাত্র আটটা বাজে। দিনের বেলার সরগরম ক্যাম্পাস সন্ধ্যা নামলে কেমন সুনসান হয়ে যায়, না দেখলে বিশ্বাস হবে না। টি,এস,সি এলাকা জীবন্ত থাকলেও কলা ভবনের পেছন দিকটা একদম গোরস্থানের মত নীরব আর সেইরকম অন্ধকার লাগে।
রিক্সায় করে মসজিদের গেইট দিয়ে হলে ফিরছিল পিস্টন। এখানে ওখানে বিল্ডিঙের ভিতর দু একটা হলদেটে আলোর বাতি জ্বললেও রাস্তায় কোন বাতি নাই। মধুর ক্যান্টিনে মনে হয় মোমবাতি জ্বলছে। আই,বি,এ’র গেইটে একটা বাল্ব জ্বলছে। কলা ভবনের পেছনের গেটে কোন আলো নাই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার পাশে লেকচার থিয়েটার। কাজ এখনো অসমাপ্ত হয়ে পড়ে আছে। আর শেষ হবেও না। এত জনে জনে চাঁদা দিতে হলে কনট্রাক্টর কাজ শেষ করবে কি করে ! শুধু সে’ই এখনো ভাগ নিতে পারলো না।

একটা মেয়ের চিৎকার শুনল নাকি ! তেমনি তো মনে হল। পরমুহূর্তে মনে হল, ধুর এই এলাকায় রাতের বেলায় মেয়ে আসবে কোত্থেকে যে চিৎকার করবে ! ভাবতে ভাবতে সে একটা বেন্সন এন্ড হেজেস ধরালো হাতের তালু দিয়ে ঢেকে ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে।

এবার একদম পরিষ্কার গলায় আওয়াজটা শুনতে পেলো। কোন ভুল নাই যে ওটা একটা মেয়ে মানুষের গলা। তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে বলছে, প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও। প্লিজ, তোমাদের পায়ে পড়ি।

মানে কি ! এমন তো শুধু সিনেমায় শুনেছে সে। নাকি সব তার কল্পনা ! বুদ্ধি করে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলো, এই মিয়া, তুমি কি কারো চিক্কুর হুনসো ! মাইয়া মাইনসের গলার মতন ?

হ, মনে অয় হুনসি।

সাথে সাথে তাকে রিক্সা দাঁড় করাতে বলল সে। তারপর ভাড়া দিয়ে তাকে বিদায় করলো। হাত থেকে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পিষে কোমরের পেছন থেকে নাইন,এম,এমটা হাতে নিলো। টেনে কক করলো। তারপর অন্ধকারের ভিতর বিড়ালের মত নিঃশব্দে পা ফেলে শব্দের উৎস লক্ষ করে এগুলো। মনে হল, থিয়েটারের দোতলা থেকে আওয়াজটা শুনতে পেয়েছে সে। কোন আওয়াজ না করে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলো সে। কিছুদূর এগিয়ে একটা চিলে কোঠার মত জায়গা থেকে সিগারেটের আগুন দেখতে পেলো।

বুঝল ওখানে কিছু একটা ঘটছে। কিন্তু ওরা কয়জন, ওদের হাতে কোন অস্ত্র আছে কিনা বুঝতে হবে আগে। থাকলেও অতর্কিতে আক্রমণ করে ভড়কে দিলে ওরা অস্ত্র বের করার সুযোগ পাবে না।

দেয়াল ঘেঁষে চিলে কোঠার কাছে গেলো ( যা সম্ভবত অফিস রুম হবে পরে)।

আবছা আলোয় দেখল চারজন পুরুষ আর একজন মহিলা আছে ওখানে। দুজন মিলে মহিলার জামা কাপড় ধরে খোলার চেষ্টা করছে। বাকি দুজন চিবিয়ে চিবিয়ে বিশ্রীভাবে হাসছে। জামা ধরে টান দিতে ছিঁড়ে গেলো। মেয়েটা দুহাত দিয়ে প্রাণপণে বাধা দিচ্ছে আর মুখে বলছে – আপনাদের পায়ে পড়ি। আমার ইজ্জত নিয়েন না। আমি ভাল ঘরের মেয়ে।
ওর মিনতি শুনে লোকগুলি আরও বিশ্রীভাবে হেসে উঠলো।

একজন বলে – চুপ কর, মারানি। ফাইজলামি করনের আর জায়গা পাও না। হলে গিয়া ছাত্রগো লগে যখন লটর পটর করো,তখন বুঝি ইজ্জত যায় না ! খালি আমরা ধরলেই তর ইজ্জত যাইবো গিয়া।

আরেকজন বলে – আইজ দেহুম, তরে তোর কুন বাপে বাঁচাইতে আহে। ইনবারচিটি বন অয়া গ্যাছে গা। এলাকা এহন আমাগো। যা মন চায় করুম। তরে এহানে রাইখ্যা দিমু কয়দিনের লাইগ্যা। সখ মিটটা গ্যালে আরেক খানে চালান কইরা দিমু মোটা টেকায়।
এই তাহলে ঘটনা। লোকগুলি সব ভার্সিটির দারোয়ান, কেয়ারটেকার। সুযোগ বুঝে মেয়েটাকে ধরে ফেলেছে একা পেয়ে। এখন রেইপ করার ধান্দা করছে। ইয়াল্লা, কত্ত বড় সাহস এদের। ভেবে চোখ কপালে উঠলো পিস্টনের। সে নিজে বড় অপরাধী। ছিনতাই করে। ডাকাতি করে। খুনও করে। কিন্তু মেয়ে মানুষের গায়ে হাত দেয় না। পছন্দ করে না।

সে বুঝে ফেলেছে এরা তার জন্য কোন বিপদ হবে না। বরং তাকে দেখলে ভয়ে হেগে মুতে এক করবে।

পিস্তলটা উঁচিয়ে ধরে একটা ফাঁকা গুলি করলো। তারপর হুংকার দিয়ে বলে উঠলো – এক শুয়োরের বাচ্চাও পালাবি না। কোন দিগদারি না কইরা চুপচাপ হাত তুইলা খাড়ায়া থাক। নইলে কইলাম সব কয়টারে ফুটা কইরা দিমু। আমার নাম পিস্টন। আমি ফাও কতা কই না, হেইডা তোরা জানোস।

গুলির আওয়াজ, তারপর পিস্টনের নাম শুনে সবাই ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো।

একজনের মুখ দিয়ে শুধু বের হল – ভাই, এবারের মত মাফ কইরা দেন। কথা দিতাছি, মায়ের কসম কইরা কই, আর জিন্দেগীতে এমুন কাম আর করুম না।

মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ছেঁড়া জামা আর ওড়না দিয়ে নিজেকে ঢাকল। সেও কাঁপছে। তবুও পিস্টনকে দেখে সাহস হল।
বলে ভাই, আমি হাতিরপুলের মেয়ে। মন্টূর বোন। আমার নাম নীরা। আপনাকে মহল্লায় যেতে দেখি। আমাকে বাঁচান।

চার ক্রিমিনালের দিকে তাকিয়ে পিস্টন বলে – তোদের সবাইকে আমি চিনি। কেউ ক্যাম্পাস ছেড়ে পালাবি না। তাইলে তোদের চৌদ্দ গুষ্টি আমি মেরে সাফ করে ফেলবো।

একটু থেমে তারপর বলে- এবার ওনার পায়ে ধরে মাফ চা,সবাই।

সাথে সাথে চারজন হুমড়ি খেয়ে পড়লো নীরার পায়ে – আম্মাগো, এবারের মত মাফ কইরা দ্যান। নইলে বউ পোলাপান সব গেরামে না খায়া মরবো।

ভাই, এদের এখান থেকে যেতে বলেন, প্লিজ ! আমার বমি আসতেছে – নীরা বলে।

পিস্টন ইশারা করতে ওরা দৌড়ে পালালো।
মেয়েটা তখনো থরথর করে কাঁপছে। দেখে ভীষণ মায়া লাগলো তার।

বলে – চলেন, আপনাকে আমি বাসায় পৌঁছে দেবো। অন্ধকারে হেঁটে মেইন রোডে এসে রিক্সা পেলো।

পাশাপাশি বসে জিজ্ঞেস করলো – এবার কণ ত, আপনে এই হাইঞ্জা রাইতে এই গুটগুইট্টা আন্দারে এহানে কি কামে আইছেন ! ওরা আপনেরে কইথেকা পাইলো !

নীরা বলে – সুর্যসেন হলের একটা ছেলে তার ছোটবোনকে প্রাইভেট পড়ায়।
কয়দিন ধরে তার কোন খবর নাই। তাই আজ বিকেলে সে এসেছিল খবর নিতে। হলের গেইটে এদের একজনকে অনুরোধ করলো ছেলেটাকে রুম থেকে ডেকে আনতে।

সে ঘুরে এসে বলে, রুমে তালা মারা। সে মনে হয় দেশের বাড়িতে চলে গেছে।

হল গেইটে একটাও রিক্সা ছিল না। তখন দারোয়ান বলে – এখানে রিক্সা পাইবেন না। চলেন আপনারে রাস্তা থেইকা রিক্সা ধরায়া দিমু। তারপর এই অন্ধকার জায়গায় আসতেই তার চেলারা এক হয়ে মুখ চেপে ধরে তাকে দালানের ভিতর নিয়ে যায়। আপনি যদি এসে না পড়তেন, আজ আমার সর্বনাশ হতো। তারপর হয়ত জানটাও হারাতাম। বলে ডুকরে কেঁদে উঠে।

সব শুনে পিস্টনের কঠিন মনও নরম হয়ে যায়। নিজের কোন ভাইবোন আছে কিনা সে জানে না। কিন্তু কোন মেয়ের সর্বনাশ ঘটানোর কথা` সে চিন্তাও করতে পারে না। যাইহোক, মনে মনে স্বস্তি পেলো মেয়েটাকে বাঁচাতে পেরেছে বলে।

রিক্সা হাতিরপুলে পৌঁছে গেলো। পিস্টন নীরাকে শিখিয়ে দিলো যেন বাসায় বলে ,রাস্তায় এক্সিডেন্ট করে জামা ছিঁড়ে গেছে। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

নীরা পিস্টনকে চেনে। জানে কত ভয়ঙ্কর ক্রিমিনাল সে। অথচ সেই মানুষটারও অন্যরকম ভাল একটা দিক আছে, না দেখলে বিশ্বাস করানো যাবে না কাউকে। উলুবনেও মুক্তো পাওয়া যায় । কি অদ্ভুত ব্যাপার !

রিক্সায় বসে হলে ফেরার পথে পিস্টন ভাবছিল, তার একটা বান্ধবী থাকলে মন্দ হতো না। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে অমন সুন্দর,স্মাট কোন মেয়ে। যাকে দেখলে মনটা ভাল হয়ে যাবে। হটাত তার রাসুর বান্ধবীর কথা মনে পড়ে গেলো। রাসু যেদিন গুলি খেলো তার পরদিন মেয়েটা রাসুর খবর না জেনে তাকে খুঁজতে হলে এসেছিল। দারওয়ানের সাথে কথা বলার সময় পিস্টন সব শুনেছে। খারাপ লেগেছে খুব। তাই সেদিন নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে আর পরিচয় দেয় নাই যে সে রাসুর খুব কাছের মানুষ। রাসুর খবর শুনে মেয়েটার চোখ দিয়ে কলকল করে অশ্রুর ধারা নামতে দেখেছে সে। দেখে খুব খারাপ লেগেছে।

ভাবছে কাল ক্যাম্পাসে গিয়ে সে কুন্তিকে খুঁজে বের করবে। তারপর তাকে সে রাসুর গল্প বলবে। ভাবতে ভাবতে হল গেইটে পৌঁছে দেখে বাইট্টা আর নুলা তার জন্য অপেক্ষা করছে।

– ভাই তুই কই আছিলি ! কতুক্ষন দইরা বইয়া আছি তর লেইগা। দেরী দেইকা ভিরমি খাইতে লাগছিলাম খারাপ কিসু অইলো কিনা ভাইব্বা। এমুন একলা আর কুনহানে যাইস না তো। কইলজা কাইপ্পা যায় আমার।

কেন এতো খুঁজলি কেন ! কুনো খাস খবর আছে নিহি !

– হ, নেতায় খবর পাঠাইসে। ইনবারচিটি খুললে পরে নাকি বটতলায় বিরাট শো ডাউন করবো আম্লীগ। ডাঃ কামাল সাব আইবো। হুকুম দিছে, কাউরে গায়ে গুল্লি করন যাইবো না। তয় চাইর পাশ থেইকা আঁতকার উপ্রে আক্রমণ কইরা গুল্লি কইরা সবতের বিচ্চি কান্দে উডায়া দিতে অইবো। ম্যালা মাল সামান লাগবো। ম্যালা মানুষ লাগবো। তাই তো তোমারে খুঁজি। তুমি অইলা আমাগো ওস্তাদ।

পিস্টনের মনে পড়লো তার স্টেনটা জ্যাম খায়া রইছে। বাইট্টারে বলে – হুন, আমার জালিডা ত খিল্লি খায়া রইছে। কাম করে না। কেডায় ঠিক করতে পারবো, জানোস কিসু ?

বাইট্টা উত্তর দেয় – এক কাম করলে অয়। রাস্তা থেইকা একটা কনস্টেবল ধইরা চোখ বাইন্দা লইয়া আমু। হ্যারে দিয়া জিনিসটা খোলায়া তেল তুল মাইরা ঠিক কইরা পরে ছাইরা দিয়া আমু।

বাইট্টার বুদ্ধি শুনে খুব খুশী হল পিস্টন – এই না হলে তুই আমার জানের দোস্ত নাকি রে ! মুস্কিল আছান সব তুই করস। ভেজালও তুইই লাগাস যদিও – বলে হেসে দিলো।
চলবে ….

আগের পর্ব পড়ুন –
#উত্থান১
#উত্থান২
#উত্থান৩