চোতরা পাতা

চোতরা পাতা যার আরেক নাম বিছুটি পাতা চেনে না এমন মানুষ মনে হয় কম আছে। ছোট বেলায় আমাদের বন্ধুদের অনেকেই হাতের ভিতর চোতরা পাতা রেখে কারো সাথে হ্যান্ডশেক করার নামে হাতে ঘষে দিত। আসোলে কারো ধারনাই ছিল না এই পাতার বিষাক্ততা সম্পর্কে। আমি নিজেও এই পাতার খারাপ দিক বিষয়ে কিছু জানতাম না। এই পাতা মানুষের শরীরের কোন অঙ্গে স্পর্শ করালে সেই স্থানে অনবরত চুলকাতে থাকে। অল্প কিছুক্ষনের ভিতর সেই চুলকানীর স্থান লাল হয়ে ফুলতে থাকে। এটা আসোলে এই পাতার বিষ ক্রিয়ার এলার্জিক রিএকশন। যদিও কখনো কারো কোন খুব খারাপ খবর পাই নাই। তবে অনেক মানুষের ভোগান্তি দেখে বোকার মত হাসা হাসি করেছি।

নিজে বাবা হবার পর সন্তান নিয়ে ডাক্তারের অফিসে যেতে যেতে জেনেছি সব অষুদ সবার জন্য সহায়ক নয়। এটা প্রথম টের পেয়েছি আমার বড় ছেলের কানে ইনফেকশন হলে তাকে যে এন্টিবায়োটিক দেয়া হয়েছিল সেটায় তার শরীরে মারাত্বক ভাবে এলার্জিক রিএকশন হয়। হাত, পা, চোখ লাল হয়ে ফুলে যায়। ঠোট ফুলে যায়। বুঝি নাই কেন এমন হয়েছে। কিন্তু ভয় পেয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে জেনেছি, এটা অষুদের বিরুপ প্রতিক্রিয়ার কারণে হয়েছে। এরপর থেকে সব সময় খেয়াল করেছি, ডাক্তারের কাছে গেলে নার্স প্রাথমিক চেকআপের সময় জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়, কোন অষুদে কার এলার্জি আছে। জানা থাকলে রোগ ভাল করার জন্য অষুদ খেয়ে উলটা আরো বেশী বিপদজনক অবস্থায় পড়তে হয় না।

কিশোর বয়স থেকে আমি চোতরা পাতা চিনি। কাউকে জ্বালাতে হলে আমরা সেই সময়ে চোতরা পাতা লাগিয়ে মজা দেখতাম। মনে আছে, যুদ্ধের সময় যখন গ্রামের বাড়িতে ছিলাম – প্রতিদিন ভোর বেলায় মক্তবে যেতে হত আরবী পড়ার জন্য। এমনিতে শীতের সকালে পুকুরের ঠান্ডা পানিতে হাত মুখ ধুতে ভাল লাগত না। তার উপর বাড়তি ঝামেলা ছিল হুজুরের জন্য প্রতিদিন একেকজনকে নির্ধারিত সংখ্যার “ঢিলা” বানিয়ে নিয়ে যেতে হত। ঢিলা মানে হল, নরম কাদা দিয়ে গোল করে রসগোল্লার মত বানিয়ে রোদে শুকিয়ে শক্ত করতে হত। হুজুর এই ঢিলা দিয়ে প্রশ্রাব করে নিজেকে পবিত্র করার সুন্নত পালন করত যাকে বলা হত “ঢিলা কুলুখ।”

দুই একদিন পর পর কাদা দিয়ে এসব ঢিলা বানানো আমার মোটেও পছন্দ হত না। তাই একদিন চাচাতো ভাইয়ের বুদ্ধিতে বানানো ঢিলা চোতরা পাতায় ঘষে তারপর কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে হুজুরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। অনেকেই ঢিলা নিয়ে আসে। হুজুরের কাছে গিয়ে সব একসাথে মিলিয়ে ফেললে ওনার বোঝার উপায় ছিল না কে এই অপকর্ম করেছে। শুধু পরে জেনেছি, তিনি আমার তৈরি সেই ঢিলা ব্যবহার করে চুলকানী থামাতে সারাদিন পুকুরে নেমে বসেছিল। তবে এরপর থেকে উনি আর আমাদেরকে ঢিলা বানাতে বলে নাই।

চোতরা পাতার ইংরেজি নাম হল gympie gympie. এই পাতার বিষয়ে বলা হয় এটা শরীরের সংস্পর্শে আসলে এক ধরনের টক্সিন নিস্বরন করতে থাকে, যার প্রতিক্রিয়া এতই ভয়ংকর যে পশু কিংবা মানুষ সেই যন্ত্রনায় আত্মহত্যা করে এই জালা মুক্ত হতে চায়। জানা যায়, একজন মানুষ জঙ্গলে প্রাকৃতিক কাজ সেরে ভূল্ক্রমে এই চোতরা পাতা ছিড়ে টয়লেট পেপার হিসাবে ব্যবহার করে। অল্প কিছুক্ষনের ভিতর তার অবস্থা এতই শোচনীয় হয় যে, সেই মানুষ নিজেকে নিজে গুলি করে হত্যা করে।

এই ধরনের আরেকটা আগাছা আছে যার নাম Poison Ivy. এই গাছের পাতাও চোতরা পাতার মতই ভয়ংকর। দেখলে মনে হয় খুব নিরীহ লতা পাতা। যে কারো বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ডে এই আগাছা জন্মায়। বাগান পরিষ্কার করতে গিয়ে কেউ যদি খালি হাতে এই আগাছা ছিড়ার চেষ্টা করে তাহলে অনেক ভয়ংকর বিপদে পড়ে যেতে পারে। এমন হলে ডাক্তারের পরামর্শ হল, দেরী না করে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে চলে যাওয়া উচিত। অন্যথায় দুর্বল চিত্তের কেউ হলে খুব অল্প সময়ে এলার্জিক রিয়েকশনের কারণে হার্টের কার্ডিয়াক এটাক হয়ে মরেও যেতে পারে।

প্রবাসে আমরা বাঙ্গালীরা সবাই নিজেদের ব্যাক ইয়ার্ডে ফুল গাছ এবং সব্জির বাগান করতে পছন্দ করি গরমকালে। তাই সবাই বাগান শুরুর আগে আগাছা সাফ করি। এই সময়ে কারো খালি হাতে এসব করা উচিত নয়। হাতে গার্ডেন গ্লাভস পরে এসব কাজ করা উচিত। এবং কাজ শেষে অবশ্যই খুব ভাল করে হাত ওয়াশ করা উচিত। বাগানে ব্যবহার করা জুতা, স্যান্ডেল পায়ে বাসার ভিতরে যাওয়াও ঠিক নয়।

ডাক্তারের অফিস থেকে এই পাতা সম্পর্কে জানার পর দেখি আমার বাসার ব্যাক ইয়ার্ডের ওয়ালে এই পয়জন আইভী আগাছা আছে। সবাইকে দেখিয়ে সাবধান করেছি যেন হাত না লাগায়। তবে আমি সেই বিষাক্ত আগাছা এখনো কেটে ফেলি নাই। রেখে দিয়েছি, যদি কাজে লেগে যায়। শয়তান মানুষের তো অভাব নাই। এখানে না লাগলেও দেশে অবশ্যই কাজে লাগবে, তাতে কোন সন্দেহ নাই। 😛

মুরাদ হাই, নিউইয়র্ক
৩১শে আগষ্ট, ২০১৫