নেড়ি কুকুর ও টোকাই

পথ কলি আর পথের কুকুরের বন্ধুত্ব – কি অদ্ভুত ব্যাপার। রাস্তার দুই ভিন্ন প্রজাতির ভিতর এই নিবিড় বন্ধুত্ব এর রহস্য খুঁজে বের করেছে Sam Edmonds নামের অনুসন্ধিৎসু একজন অষ্ট্রেলিয়ান ফটো সাংবাদিক। নিজ দেশের নামী দামী লেখক মানুষেরা এত নীচু শ্রেনীর প্রজাতি নিয়ে লিখে সময় নষ্ট করবে এটা ভাবা বোকামি। তাছাড়া, এসব আজাইরা খবর পড়বেই বা কে ! অষ্ট্রেলিয়ান এই সাংবাদিক শুধু রাস্তার মানুষ আর কুকুর নিয়ে ছবি তুলেই ক্ষ্যান্ত হন নাই। তিনি তাদের নিয়ে একটা সুন্দর প্রতিবেদনও লিখেছেন, যার নাম দিয়েছেন Rabindra boys. এমন নাম দেয়ার কারন হল, তিনি ঢাকার রবিন্দ্র সরোবর পার্কে এই সুবিধা বঞ্চিত শিশুর দল ও কুকুরদের একসাথে দেখেছে। দেখেছে কেমন করে এসব শিশুরা সারাদিন রাস্তায় চেয়ে চিন্তে পয়সা নিয়ে খাবার কিনে নিজেরাও খায়, তাদের সাথে থাকা কুকুর গুলিকেও খাওয়ায়। দেখেছে এই কুকুরগুলির সাথে পথকলি মানব শিশুদের গভীর বন্ধুত্ব এবং ভালবাসার সম্পর্ক।

আমরা সবাই জানি, কুকুর খুব বিশ্বস্থ প্রানী। নিজের জীবন দিয়েও কুকুর তার মনিবের জীবন রক্ষা করে। বিশ্বের সব উন্নত, সভ্য দেশগুলিতে মানুষের মত কুকুর, বিড়ালেরও অনেক সামাজিক অধিকার রয়েছে। আমেরিকায় দেখি অনেক মানুষ কুকুরকে নিজের সন্তানের মত ভালবাসে। কুকুরের পেছনে অনেক পয়সা খরচ করে। শীতকালে কুকুরের জন্য আলাদা গরম জামা কাপড় কেনে। কুকুরের অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।

প্রতিবেশী এক বিদেশী বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম “ তুমি কুকুরের জন্য এত কষ্ট কর, সময় দাও, পয়সা খরচ কর – তুমি কেন কোন সুবিধা বঞ্চিত শিশুকে দত্তক নাও না ? তাহলে তোমার ও ভাল লাগত আর একজন মানুষ পৃথিবীর আলো দেখতে পেতো তোমার উসিলায়।”

তাঁর জবাব খুব সংক্ষিপ্ত ছিল “ মানুষ বেঈমানী করে কিন্তু কুকুর সেটা করে না।” আমাদের দেশেও অনেক মানুষ কুকুর পোষে। সাধারন মানুষ সাধারন কুকুর আর বড়লোক মানুষ বড়লোক প্রজাতির বিদেশী কুকুর পোষে। তাদের কাছে কুকুর পোষা কোন সখের ব্যাপার নয়, বরং আভিজাত্যের প্রতীক। তাছাড়া প্রশিক্ষন প্রাপ্ত বিদেশী কুকুর বাসায় থাকলে কোন অনাহুত মানুষ বাসায় ঢুকতে সাহস করবে না, এটাও একটা মূল কারণ।

রাস্তার কুকুর নিয়ে কেউ কি কখনো ভাবে ?

যেই দেশে অর্ধ মিলিওন শিশু পথে ঘুমায়, না খেয়ে, আধ পেটা খেয়ে, একই প্রজাতির মানুষের পায়ের লাথি, হাতের মার খেয়ে, চরম অবহেলায়, দেশের সকলের দৃষ্টি সীমার ভিতরে থেকেও না থাকার মত হয়ে বাঁচে- সেই দেশে রাস্তার নেড়ি কুকুর নিয়ে কে ভাবে ? এত দয়া মায়া অন্ততঃ আমাদের দেশের মানুষের মনে নাই।

সবার বাসার সামনে, শহরে কিংবা মফস্বলে, খাবারের দোকানগুলির সামনে এক টূকরা এঁটো খাবারের আশায় করুন চোখে তাকিয়ে বসে থাকে এই কুকুরগুলি। অনেক মানুষ এদের খাবার দেয়। আবার দেখেছি অনেকে লাঠি পেটা করে তাড়ানোর চেষ্টা করে এই কুকুর। কাউকে কাউকে দেখেছি কুকুরের গায়ে গরম পানি ঢেলে দিতে। কিন্তু অনেক মার খেয়েও এরা কিন্তু যে যেই এলাকায় থাকে, সেটা কখনো ছেড়ে যায় না। এলাকার মানুষ, বাড়ির মালিক এদের স্বীকার না করলেও এসব নিরীহ কুকুর নিজেদেরকে এলাকার একজন, বাড়ির একজন মনে করে সারা দিন রাত সেখানেই ঘোরা ঘুরি করে। পাহারা দেয়। অবাঞ্চিত, অপরিচিত মানুষ দেখলে ঘেউ ঘেউ করে প্রতিবাদ জানায় । বাড়ির লোকজনকে হুশিয়ার করে দেয়।

অসুখ বিশুখ, খাবারের অভাবে মাথা খারাপ না হলে কিংবা খুব বেশী জ্বালাতন না করলে এসব কুকুর কিন্তু কখনো কোন মানুষকে আক্রমণ করে না। মানুষ কিন্তু মানুষকে বিনা কারনে আক্রমণ করে বসতে পারে ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য। কিন্তু রাস্তার কুকুর শুধু আত্মরক্ষার্তে কাউকে আক্রমন করে, এছাড়া নয়।

আমাদের দেশে এসব রাস্তার কুকুর ধরে মেরে ফেলার ইতিহাস আছে। সরকারি হিসাবে বছরে প্রায় বিশ হাজার কুকুর ধরে মেরে ফেলে সমাজকে উটকো ঝামেলামুক্ত করার পরিসংখ্যান পড়েছি অনলাইনে। এটা সত্যি কথা যে, রাস্তার কুকুরের শরীরে অনেক রোগ বাসা বাঁধে। অন্য বিষাক্ত বন্য পশুর সাথে বনে বাদাড়ে কাটিয়ে, ওদের সাথে নিজের খাদ্য আর জীবন বাঁচানোর যুদ্ধে অনেক বিষাক্ত আঘাত হজম করে এসব নেড়ি কুকুর। নিজের শরীরে বহন করে অনেক রোগের বিষাক্ত জীবানু।

রাস্তার কুকুরের শরীরে Rabies থাকে। Rabies হল এক ধরনের মারাত্বক ভাইরাস। যা অন্য পশুর কামড় খেয়ে ওদের মুখের লালার সাথে কুকুরের শরীরের রক্তে মিশে যায়। কিংবা কোন ক্ষতস্থানে বসা মশা মাছির মাধ্যমেও সংক্রামিত হয়। তেমন কোন কুকুর কাউকে কামড়ালে কুকুরের মুখের লালা থেকে সেই ভাইরাস মানুষের শরীরের সংক্রামিত হয়। কিন্তু সাথে সাথে চিকিতসা নিতে পারলে এই ভাইরাসে কেউ মরে না। সেই কারনে কুকুর কামড়ালে খুব অল্প সময়ের ভিতর সেই মানুষকে ইনজেকশন নিতে হয়।

একটা সময় ছিল অন্য দশ জনের মত আমার ভিতরেও এসব কুকুর কেন, রাস্তার মানুষদের জন্যও কোন দয়ামায়া ছিল না। যেহেতু আমাকে শেখানো হয় নাই, আমারও ধারনা ছিল,
রাস্তার মানুষ মানে সব চোর। আর রাস্তার কুকুর মানে হল উটকো ঝামেলা। যে কোন সময় ঘরে ঢুকে আমাদের খাবারে মুখ বসাতে পারে। কাউকে কামড়ে দিতে পারে। ওরা নোংরা, রাস্তায় থাকে তাই ওদের শরীরে অনেক রোগ আছে। কখনো ইচ্ছা হয় নাই, মনে মায়া জাগে নাই ঘর থেকে একটু খাবার এনে দিতে। মানুষের জন্যই মায়া জাগে না মনে ,তাহলে রাস্তার নেড়ি কুকুরের জন্য কেমন করে মায়া হবে? বরং পথের পাশে দেখলে ঢিল ছুড়ে মারতাম। চলার পথে শুয়ে থাকলে লাথি মেরে সরিয়ে দিতাম। কই, ওরা কখনো সেজন্য আমাকে কামড়ে দেয় নাই। লাথি খেয়েও ‘কেঁউ কেঁউ’ করে কেঁদে সরে গিয়ে পালিয়ে যেত না। বরং রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে করুন দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। তখন সেই করুন দৃষ্টি আমার মনে কোন সহানূভুতি জাগায় নাই। কিন্তু, কেন জানি না এখন সেই সব করুন দৃষ্টি চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। হয়ত মানবিক পরিবেশে মিশে আমার ভিতর মানবিকতা জেগে উঠছে।

মনে আছে, বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এসব নেড়ি কুকুরদের ভিতর প্রাকৃতিকভাবে যৌন তৎপরতা বেড়ে যেত। এমন কোন কুকুর জোড়াকে পেলে মানুষ যেন তাদের জ্বালাতন করে ভীষন আনন্দ পেত। তাদের ঢিল মেরে, লাঠি পেটা করে অস্থিরভাবে অত্যাচার করত একদল মানুষ। তার সাথে রাস্তায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে আরো বেশী মানুষ হাসা হাসি করত। ঠিক যেমন করে একদল মানুষ যখন রাজন জাতীয় কিশোরদের হাত পা বেঁধে অত্যাচার করে, আরেক দল মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে সেটা উপভোগ করে- কিন্তু কেউ বাঁধা দেয় না। কখনো কেউ বলে নাই যে এমন করা ঠিক না। মানুষের যেমন শারিরীক চাহিদা আছে,পশুদেরও আছে। তখন তো আমিও এসব দেখে আহত হতাম না। বরং আনন্দ পেতাম। এখন মনে হলে অপরাধ বোধ জেগে উঠে। অবাক ব্যাপার হল, মানুষের নিজের ঘর বিবাহিতা সংগিনী থাকা সত্বেও মানুষ নিজের নোংরা অভিলাষ চরিতার্থ করতে পতিতার কাছে যায়, পরকিয়া করে, ধর্ষনের মত জঘন্য অপরাধ করে অবলীলায়। অথচ পশু পাখীর প্রাকৃতিক কর্মকান্ড মানুষের কাছে হাসি, প্রহসন, ব্যঙ্গ কৌতুকের ব্যাপার হয়ে যায়।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ক্ষুধার জ্বালায়, অসুখ বিশুখে আক্রান্ত রাস্তার অভিভাবকহীন প্রায় বিশ হাজার কুকুর শুধু ঢাকা শহরে কতৃপক্ষের দ্বারা nulling মানে ধরে মেরে ফেলা হয়। Rabies ভাইরাসে আক্রান্ত রাস্তার পাগল হয়ে যাওয়া কুকুরের কামড় খেয়ে মরে বছরে প্রায় দুই হাজার মানুষ। এ ছাড়াও বছরে অন্ততঃ দুই লাখ কুকুরের কামড়ের ঘটনাও রয়েছে রিপোর্টে।

‘অভয়ারন্য’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে এসব অভিবাবকহীন পশুর স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করছে জেনে খুব ভাল লেগেছে। অবশেষে ,কত্তৃপক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে। এখন কতৃপক্ষ এসব নেড়ি কুকুর না মেরে ফেলে ওদের শরীরে ভাইরাস দূর করতে ইনজেকশন দেয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছে বিদেশী সংস্থার সহায়তায়। সম্প্রতি পরীক্ষামূলকভাবে নরসিংদির একটা গ্রামে পাইলট প্রোগ্রাম চালিয়ে নেড়ি কুকুরদের ভিতর পুরুষ কুকুরদের ধরে ওদের ইনজেকশন দিয়ে ষ্টেরিলাইজ করা হয়েছে। যাদের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে ওদের আলাদা করে চেনার জন্য ঐ সব কুকুরের গলায় কালো রঙের বেল্ট ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।

আশা করছি, অন্য সব প্রকল্পের মত না বন্ধ হয়ে এই উপকারী প্রকল্পটা অনেক দিন চালু থাকবে। এদের দ্বারা দেশের সব পথের কুকুর, বিড়াল উপকৃত হবে, রোগ মুক্ত হবে। ওদের ধরে মেলে সাফ করার পাশবিক পদ্ধতির চাইতে এমন সুস্থ চিন্তার প্রকল্প হাতে নেয়া অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

অভয়ারন্যের মত পশু স্বার্থ সংরক্ষন সমিতির মত সংঘঠন গুলির প্রচেষ্টায় সরকারী উদ্যোগে এক সময় যদি দেশের সব পথের কুকুর বিড়ালের মত পশুরা রোগমুক্ত হয়ে একটা ঘরে ঘর খুঁজে পায় সেটা হবে অনেক বড় মহৎ একটা কাজ। তাহলে হয়ত এক সময় আমাদের দেশের গৃহে বসবাস করা মানুষ রাস্তা থেকে একজন করে পথ কলি শিশুকে নিজের করে নিজের ঘরে নিয়ে যাবে। ষোল কোটি মানুষের দেশে, পৃথিবীর অর্থনীতির লিষ্টে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে স্বীকৃত বাংলাদেশে রাস্তায় ঘুমানো সুবিধা বঞ্চিত মাত্র অর্ধ মিলিয়ন শিশু কেন একটা করে ঘর খুঁজে পাবে না। এটা কি হয় নাকি?

মানুষ যদি রাস্তার কুকুর বিড়ালের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে পারে এত মানবিক হয়ে, একদিন দেশের সব টোকাইরাও এমন সচেতন মানুষদের সহায়তায় সুস্থ,স্বাভাবিক আলোকিত জীবনের সন্ধান পেয়ে যাবে। আমি খুব আশাবাদী।

তাহলেই হয়ত Sam Edmonds এর মত বিদেশী সাংবাদিক আমাদের দেশে এসে রবীন্দ্র সরোবর পার্কে ভাইরাস আক্রান্ত অনেক পথের কুকুরের সাথে পথকলি শিশু সুমাইয়া, বুলেট, শাকিল, ওসমান, নয়ন, মটূ, কালু,রোমিও, বাঘা’দের নিয়ে প্রতিবেদন লেখার সুযোগ পাবে না। ওরা অসুস্থ হবে না। অত্যাচারিত হয়ে রাজনের মত অকালে প্রাণ হারাবে না। পেশাদার অপরাধীতে পরিনত হবে না। সর্বোপরি নোংরা রাজনীতির খেলার মাঠে পাঠার বলি হয়ে অকালে প্রাণ হারাবে না কিংবা অন্যের প্রান নেয়ার জন্য হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াবে না।

মুরাদ হাই, নিউইয়র্ক
৪ রা আগষ্ট, ২০১৫