হৃদয় ছোঁয়া অনুভূতি

বছর আটেক আগের কথা। নর্দার্ন ব্যুলেভার্ড আর থার্টি সেকেন্ড এভিনিউর মাঝে থাকি। বাচ্চারাও এখন থেকে আট বছরের ছোট তখন। প্রতিদিন ওদের হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যাই আবার ছুটি হলে নিয়ে আসি। নর্দার্ন ব্যুলেভার্ড খুব হাই কার ট্রাফিক এর রাস্তা। দুই পাশে গায়ে গা লাগানো বিভিন্ন দেশের মানুষের ভিন্ন ধর্মী সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সব কিছুর ভিতর আমার প্রিয় ছিল সাউথ আমেরিক্যান সব রেঁস্তোরাগুলি। যত মজার সব খাবার ওরা বানায়। তার ভিতর একটা পেরুভিয়ান রেঁস্তোরা আমার খুব বেশী পছন্দের ছিল। খুব ছোট। আট দশ জন মানুষ বসে খেতে পারবে এমন ব্যবস্থা আছে। একটা পরিবার নিজেরাই সেটা চালায়।

নীচ তলায় ব্যবসা, উপর তলায় তাদের বাসা। খুব সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো গোছানো রেঁস্তোরাটা। ইস্তিরি করা সাদা টেবিল ক্লথের উপর ফুলদানীতে তাজা ফুল রাখা। তার পাশে ছোট সুগন্ধি মোমবাতি জ্বলে। চকচক করা কাটাচামচ ছুরি সাজানো ন্যাপকিনে মুড়িয়ে। রেঁস্তোরার দরজার বাইরে একটা লোহার বেঞ্চ পাতা আছে। ছেলেদের নিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দেখতাম মালিক ভদ্রলোক বেঞ্চে বসে আয়েশ করে চুরুট টানছে। ভদ্রমহিলা পাশে বসে উলের কিছু বানাচ্ছে। আমাদের দেখলে হাত নাড়ত। মাঝে মাঝে ছেলেদের হাতে ক্যান্ডি দিত। খুব অমায়িক, হাসি মুখের ‘মা’ চেহারা|

সচরাচর আমি কখনো বাইরে একা খেতে যাই না। ছেলেদের ছাড়া কিছু খেতে ভাল্লাগে না। ওরা খুব পছন্দ করে বাইরে খেতে। বন্ধুদের সাথে খেয়ে বাসায় এসে বললে ছেলেরা জিজ্ঞেস করত, আব্বি কি খেয়েছ, কেমন মজা ছিল খাবারটা, এমন সব কথা। তখন মন খারাপ লাগে।

আমার অভ্যাস ছিল স্ত্রীর সাথে ঝগড়া লাগলে রাগ করে বাসায় কিছু খেতাম না। কত রাত কিছু না খেয়ে পেটে বালিশ চেপে ধরে ঘুমিয়ে গেছি। পরে একটু চালাক হলাম। ঝগড়া লাগলে চুপিসারে বাসার বাইরে গিয়ে কিছু খেয়ে আসতাম। একা একা রেঁস্তোরায় বসে খেতে ইচ্ছা করত না। তাই ফাষ্টফুডে ঢুকে খুব মজা না লাগলেও খেয়ে ক্ষুদা মেটাতাম। আরাম পেতাম না। তাই একদিন একাই দুপুরবেলায় সেই পেরুভিয়ান রেঁস্তোরায় গেলাম খেতে। টেবিলে বসে মেন্যু দেখছি। আমাকে দেখে কাউন্টারের পেছন থেকে পরিচিত মালিক মহিলা এগিয়ে এল।

কাছে এসে অবাক চেহারা নিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুমি একা এখানে কি কর ! তোমার ফ্যামিলী কই ?

এড়িয়ে গিয়ে বললাম, খেতে এসেছি| কি খাওয়া যায়, সাজেষ্ট কর।

ভদ্রমহিলা হেসে দিয়ে বলে, বুঝেছি। ঝগড়া করেছ।

অবাক হয়ে গেলাম। কেমন করে জানল।

জিজ্ঞেস করেই বসলাম, তুমি কেমন করে জান ?

হি হি করে হেসে দিয়ে বলে, আই নো। আই ক্যান সি ইট ইন ইউর ফেইস।

তারপর বলে, তূমি কি হালাল কিছু আশা করছ নাকি ! আমার কাছে তোমাদের হালাল মিট নাই। ফিস আছে অবশ্য।

বললাম, আমি পোর্ক মিট ছাড়া সব খাই। হালাল হারাম দেখি না। ফ্রেশ হলেই হল। তবে স্পাইসি হলে ভাল হয়।

ওকে, তাহলে আজ আমি তোমাকে সী ফুড খাওয়াই। দেখ, কেমন লাগে তোমার।

এরপর এক প্লেইট ভর্তি পোড়া কাঁচা কলার স্লাইস দিয়ে গেল আদা, রসুন আর ভিনেগার দিয়ে বানানো সসসহ। এটা এপেটাইজার। কাঁচা কলা সাউথ আমেরিক্যানদের প্রিয় খাবার। গরম তাওয়ায় কলার স্লাইস শুকনা ভাজে তেল ছাড়া, যাকে ওরা বলে’প্লেনটেইন।’ খুব মজার খাবার।

কিছুক্ষন পর মেইন ডিশ নিয়ে এল। ব্রিক ওভেন গ্রিল্ড ষ্ট্র‍্যাপড ব্যাস ফিশ উইথ লেমন,অনিওন এন্ড টমেটো। ভুনা খিচুড়ির মত দেখতে মোটা ব্রাউন রাইস। হরেক রকমের বিন ( সব্জির বিচি ) অলিভ অয়েল দিয়ে ফ্রাই করা। আভোকাডোর সালাদ।

দেখে আর ঘ্রানেই অর্ধ ভোজন হয়ে গেল আমার।

এত মজার রান্না ওরা কেমন করে আমি জানি না। এই খাবার খেয়ে পেট ফুলে যায় না। অস্থির লাগে না। আরাম লাগে। খাবার শেষ করে বিল দিতে গিয়ে ‘গুড নেইবর’ ডিসকাউন্ট পেলাম উপরি হিসাবে, না চাইতেও।

এরপর আরো অনেকবার খেয়েছি ওখানে। বাসায় ঝগড়া হলেও, না হলেও। আসলে ওদের সংগ খুব ভাল লাগে।

একদিন খেতে গিয়ে দেখি মালেকিন নাই। অর্ডার নিতে এল অন্য মেয়ে। বয়স অনেক কম।

জিজ্ঞেস করলাম, মালিক কোথায় আর তুমি কে, নতুন জব নিয়েছ এখানে ?

মেয়েটা হাসিমুখে উত্তর দেয়, ওরা আমার বাবা, মা। দু’জন বেড়াতে গেছে পেরুতে। তাই আমি এসেছি সাহায্য করতে।

আমার কৌতুহল দেখে নিজেই জানাল, সে আলাদা থাকে সিটিতে বয়ফ্রেন্ডের সাথে। কলেজ শেষ করার পর জব পেয়ে আলাদা হয়েছে। কিন্তু উইকেন্ড এবং হলিডে তে মা বাবাকে হেল্প করতে আসে এখানে। এটা নাকি তার কর্তব্য।

শুধু তাই নয়। মা বাবার এবারের দেশে যাওয়ার খরচ মেয়েই দিয়েছে উপহার হিসাবে। শুনে মন খুব ভাল হয়ে গেল।

এরপর আরো কৌতুহল অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। আমি কি খেতে চাই সেটা বলতে চাইলে মেয়ে তার আগে আমার নাম জানতে চাইল। বল্লাম, নাম জেনে কি হবে !

বলে, আমার সুবিধা হবে তোমার খাবার বানাতে। কারণ আমার মা তাঁর রেগুলার কাষ্টমারদের নাম এবং কে কেমন খাবার পছন্দ করে সে সব লিখে রাখে।

জেনে একদম অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, আমার লাষ্ট নেইম ‘হাই।’

নাম শুনে খাতা দেখে বলে, ওহ ইউ আর মি: হাই। মাই মাম’স ফেভারিট। ইউ প্রেফার সী ফুড। একস্ট্রা স্পাইসি। এম আই রাইট ?

মাথা ঝাঁকালাম। অর্ডার লিখে নিয়ে কিচেনে বলতে গেল।

আমি অবাক বিষ্ময়ে ভাবতে লাগলাম কাষ্টমারের জন্য ওদের কেয়ার করা নিয়ে। খাবার এল। খেয়ে পয়সা মেটাতে গিয়ে ডিসকাউন্টও পেলাম। মা যেভাবে লিখে রেখেছে,মেয়ে ঠিক সেটাই অনুসরন করছে।

ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নেয়ার আগে বললাম, তুমি অনেক লাকি। এত ভাল বাবা মা কারো হয়,জানা ছিল না।

হেসে দিয়ে মেয়ে বলে, কেন আমি কি আমার মায়ের চেয়ে কিছু কম করেছি তোমার জন্য ?

বললাম, না একটুও কম কর নাই। একদম মায়ের মতই হয়েছ। খুশি হয়ে বলে, সবাই বলে আমি নাকি ওদের ব্লেসড চাইল্ড।

আমি বললাম, আসলেও তুমি তাই।

চার বছর হল, আমি নর্দার্ন ব্যুলেভার্ড ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে গেছি। পনের মাইল দুরে নতুন বাসা। ইচ্ছা হলেও আর পায়ে হেঁটে যখন ইচ্ছা সেই রেঁস্তোরায় খেতে যেতে পারি না। তাই ওদের কথা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। মাস ছয় আগে কোন কাজে সেই রাস্তা ধরে যাচ্ছিলাম। ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে গাড়িতে বসে ছিলাম বিরক্ত হয়ে। বাইরে তাকাতেই দেখি আমি একেবারে আমার পুরনো বাসার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। সেই রেঁস্তোরা আর মানুষগুলির কথা মনে পড়ে গেল।

নিজেকে অপরাধী মনে হল। মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম, আজ এখুনি যাব দেখা করতে। গাড়ির লাইন থেকে বের হয়ে সাইডের রাস্তায় ঢুকে পার্ক করে সেই রেঁস্তোরায় গেলাম। দুপুরের লাঞ্চের ভীড়। সব টেবিলে মানুষ ভর্তি। গ্লেন্ডা’র ( মালেকিন ) সাথে চোখাচোখি হল। খুব ব্যস্ত।

জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ ?

মাথা নাড়ল। অপেক্ষা করতে বলল। টেবিল খালি নাই।

বললাম, খেতে আসি নাই। শুধু দেখা করতে এসেছি।

বলে, ওহ এখন তাহলে আর ঝগড়া কর না। তাই খেতে আসোনা।

ওর কথা শুনে হাসি চলে এল। বললাম, আমি কি শুধু ঝগড়া হলেই খেতে আসতে পারব, নইলে না ?

বলে, কই আসো নাতো আর। দেখি না। তোমার ছেলেগুলিকেও আর দেখি না এখন।

বললাম, ওরা তো অনেক বড় হয়ে গেছে। এখন আর আমার হাত ধরে রাস্তা পার হয় না। কলেজে পড়ে দু’জনেই। তারপর আরেকটা অপরাধবোধ জাগল। আমি যে চার বছর আগে এই এলাকা ছেড়ে চলে গেছি সেটা তো ওরা জানে না। আমি জানিয়ে যাই নাই। আসলে বলার কথা মনেও ছিল না। অথচ এখন মহিলার এত আন্তরিক কথা শুনে মনে হল, না বলে যাওয়াটা অন্যায় হয়েছে।

যা হয় হোক, ভেবে হুট করে বলে বসলাম, সরি, গ্লেনডা, তোমাদের জানানো হয় নাই। আমরা আসলে চার বছর হল, এই এলাকা ছেড়ে চলে গেছি। তাই আর আগের মত আসা হয় না।

তাকিয়ে দেখি, মহিলার চেহারাটা কেমন মলিন হয়ে গেল।

কিছুক্ষন পর বলে, আই ফিগার্ড সো। জানিয়ে গেলেও পারতে।

আবার ‘সরি’বললাম। তারপর বিদায় নিতে চাইলাম।

বলে, না বস। টেবিল খালি হয়েছে। খেয়ে যাও। ডোণ্ট ওয়ারি। ইট উইল বি মাই ট্রিট।

আরো লজ্জা পেলাম। কথা না বাড়িয়ে বসলাম। নিজেই খাওয়া সার্ভ করল। কই গেছি, কেমন এলাকা, ছেলেরা কে কোথায় কি পড়ছে সব খুঁটিয়ে জেনে নিল। বিল দিতে চাইলাম। নিল না। বাসার ঠিকানা, ফোন নাম্বার দিলাম। যেতে বলে বিদায় নিলাম। দরজার বাইরে এসে পেছনে তাকিয়ে দেখি তখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মন খারাপ হয়ে গেল। আবার খুশি লাগল এই ভেবে, এই মানুষটা অন্ততঃ আমাকে অনেক পছন্দ করে। অথচ আমি তার অনেক কাষ্টমারের একজন মাত্র।

২৮শে মার্চ, ২০১৬