#উত্থান৩ – Rise of a Thug

রোজার মাস। ভার্সিটিতে ছুটি চলছে। হলের বেশীর ভাগ পোলাপান দেশের বাড়িতে চলে গেছে। শুধু ঢাকার লোকাল আর বাইরের অল্প কয়টা দুষ্টু পোলাপান কখনোই হল ছেড়ে যায় না। এ যেন তাদের স্থায়ী আবাস। আজব কান্ড কীর্তি।

পিস্টন বস্তি ছেড়ে এখন হলে থাকে। তার দলের ছেলেদের রুমে। আজ এই রুমে তো পরদিন অন্য রুমে। কোন স্থায়ী ঠিকানা নাই। কখনো ছিল না। মনে করতে পারে না তার গ্রাম কোথায় ! কোত্থেকে কিভাবে সে এই শহরে এসেছে ! কে তার বাবা মা, কিছুই জানে না। আদর ভালবাসা বলতে যা বুঝেছে সেটা পেয়েছে শুধু রাসুর কাছ থেকে। তাই মানুষটাকে ভুলতে পারে না পিস্টন। টোকাই হিসাবে কাজ শুরু করে এখন সে এই বিশাল ক্যাম্পাসের ছাত্রদের কারো কাছে খুব পছন্দের,কারো কাছে প্রচন্ড ভীতির। সবই হয়েছে রাসুর কারণে।

মনে পড়ে আগে সে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো। এর ওর কাছে হাত পাততো। কেউ সিকি আধুলি দিতো। কেউ আবার কিছু না দিয়ে উল্টা গালি গালাজ করতো। ইচ্ছা করতো রাস্তার আধলা ইট দিয়ে মানুষগুলির মাথা ফাটিয়ে দিতে।

এক ওস্তাদের কাছে পকেটমারের তালিম নিয়েছে। সে এক কঠিন তালিম। ডাব পানিতে ডুবিয়ে তার উপর ভিজে কাপড় রেখে ব্লেড দিয়ে কাটতে হতো। কাপড় কাটবে কিন্তু ডাবের গায়ে আঁচড় লাগতে পারবে না। এতো স্থির হাতে করতে হবে যেন পানিতে কোন কাঁপন না উঠে। ওরে খোদা ! ভুল করলেই বন চটকানা মারত ওস্তাদ। একদিন রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে পরীক্ষা নিলো। প্রথমদিনেই ফেইল মারল সে। ধরা পড়ে কি গন ধোলাইটাই না খেলো সেদিন। বুঝল তাকে দিয়ে এই কাজ হবে না। ওস্তাদের কাছে গিয়ে মাফ চাইলো।

কত দিন কিছু না খেয়ে শুধু কলের পানি গিলে ফুটপাথে ঘুমিয়ে পড়েছে। নেড়ি কুকুরের সাথে সেও ডাস্টবিন হাতড়ে খাবার খুঁজেছে। এই শহরের মানুষগুলিকে তার কুকুরের চেয়ে অধম মনে হয়। রাস্তার কুকুরের গায়ে হাত বুলিয়ে দিলে সে তার পাশে পাশে ঘুরে। কিন্তু পোশাক পরা মানুষগুলি চায়ের দোকানে রুটি কলা খাওয়ার সময় সে ঘুরঘুর করলে,করুন চোখে তাকিয়ে থাকলে কিছু তো খেতে দিতোই না, উল্টা গালি দিয়ে সরে যেতে বলতো। একদিন তো এক মেয়ে তার গায়ে থুথু ছিটিয়ে দিয়েছিল শুধু তাদের গাড়ির কাঁচে হাত রেখেছিল বলে। কিচ্ছু ভুলে নাই। সব মনে রেখেছে সে। তাই কারো প্রতি তার মায়া লাগে না আর।

গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়েছিল সেদিন। রাসু বন্ধুদের নিয়ে সিনেমা দেখতে এসেছে। টিকেট নাই। পিস্টনকে দেখে ডাক দিলো।

জিজ্ঞেস করে – ব্ল্যাকার কে রে এখানে।

তারপর বলে – ডেকে আন।

পিস্টন গিয়ে হলের পাশের চিপা থেকে ব্ল্যাকার ডেকে আনে। ছেলেটা করিতকর্মা দেখে রাসুর ভাল লেগে যায়। বন্ধুদের অবাক করে দিয়ে সেদিন পিস্টনকেও সাথে করে নিয়ে সিনেমা হলে ঢুকেছিল রাসু। চানাচুর আর সেভেন আপ কিনে খাইয়েছিল। শো শেষে ওকে হলের ঠিকানা দিয়ে দেখা করতে বলে সে রাতে চলে গেছিলো রাসু।
ইয়াল্লা ! মানুষ এমুন বালা অয় নাকি ! তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো। এই প্রথম কেউ তারে মানুষ মনে কইরা বালা ব্যবহার করলো। এক্কেরে প্রথম।
সিদ্ধান্ত নিলো সকাল হলেই সে হলে গিয়ে এতো ভাল মানুষটার সাথে দেখা করবে। তাকে বলবে – স্যার আমারে আপনে সাথে রাখেন। শুধু খাওন দিবেন। তাইলেই হইবো। দরকারে আপনের লাইগা জান দিয়া ফালামু।

পরদিন গেলো সে। এবং থেকে গেলো। সেই থেকে যাওয়া তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো। হলের রুমে শুয়ে লাইট বাল্বের দিকে তাকিয়ে এলোমেলো সব পুরনো কথা ভাবছিল। লাইটের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবনায় ডুব দেয়া তার প্রিয় অভ্যাস।

ভাবনাগুলি তার ঠোঁটের কোনে চিকন হাসি এনে দিলো। যে সুবেশী মানুষেরা তাকে মানুষ বলে গনতো না, আজ তারা তাকে জমা খরচ দিয়ে চলে। ভয় পায়। নাম শুনলে আতঙ্কে প্যান্ট ভেজায়। হুজুর হুজুর করে। দাবার ছক কখন কেমন করে পাল্টে যাবে, কে বলতে পারে !

হলে এখন যারা আছে,তাদের অনেকে তার সাঙ্গপাঙ্গ। ঈদকে সামনে রেখে এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, গাউসিয়া মার্কেট জমে উঠেছে। সব দোকানপাটের বেচাকিনি ভাল। সারা রাত খোলা থাকে। মানুষ তারাবি পড়ে মার্কেটে আসে। সন্ধ্যার পর তার ছেলেরা বের হয় কালেকশনে। প্রতি রাতে দোকানপাটের বখরা, ব্যাগ ছিনতাই করে রোজগার হয় ম্যালা টাকা। তার একটা অংশ আবার পুলিশ বেটাকে দিতে হয় প্রটেকশনের জন্য।

প্রটেকশন না ছাই। তার এসবের তোয়াক্কা নাই। কেউ তেড়িবেড়ি করলে ভুঁড়িটা নামায়ে দিবে এক পোঁচে। কিন্তু বাইট্টা তাকে বুঝায় আইনের মানুষের সাথে খাতির রাখনের দরকার আছে। টেকা তো হাতের ময়লা। দুইদিন আগেও দুইটা ফুটা পয়সা ছিল না পকেটে। আর এখন বান্ডিল বান্ডিল টেকা। ফাও টেকা। তার একটা ভাগ না হয় নিলো পুলিশ হারামিটা। সে নাকি আবার মন্ত্রীকেও ভাগ দেয় । হাঁচা না মিছা, কেডায় কইবো !

মিজাজটা খিঁচরাইয়া যায় হালাগো কতা বার্তা হুনলে পরে – বিড়বিড় করে বলে পিস্টন। হ্যারা মনে করে আমরা জ্যেন মন্ত্রী হালাগো হুকুমের চাকর।
ঐ ঠোলারে দিয়া সেদিন মন্ত্রী পিস্টনরে ডেকে পাঠালো। কাছে ডেকে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। চা সিঙ্গারা খেতে দেয়। তারপর বলে – হুনো মিয়া। তোমারে আমার জন্য কিসু কাপড় কালেকশন কইরা দিতে অইবো।

না বুঝে ভ্রু কুঁচকে তাকালো পিস্টন।

মন্ত্রী হেসে বলে – বুঝো নাইক্কা ! আরে মিয়া, ঈদ তো আইসা পড়লো বইলা। এলাকায় যাইতে অইবো। গেলে তো বুঝই, গরীব মাইনসেরে কিসু জাকাত দিতে অইবো। আমার টেকা থাউক আর নাই থাউক, দান খয়রাত করতেই অয়। নইলে ইজ্জত থাকে না। এর লাইগা তুমি আমারে যেমনে পারো শ’ পাঁচেক শাড়ি, শ’পাচেক পাঞ্জাবি,লুঙ্গি এসব যোগার কইরা দিবা। ক্যামনে দিবা, সেইটা তোমার বিষয়।

কয় কি হালায় ! মন্ত্রীর আবদার শুনে পিস্টন তব্দা খেলো। জাকাত দিবো তাও বিনে পয়সায় কারো কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা কাপড়ে।
ইয়া খোদা, এই হালাগোরে তুমি উপ্রে উঠায়া লউ না ক্যান, বুঝি না – ভিতরে ভিতরে গজগজ করতে লাগলো । মুখে কোন টু শব্দ নাই তার।

পিয়ন মন্ত্রীর জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে এলো। টেবিলে সাজালো। মন্ত্রী তাকে ডেকে বলে – আহো মিয়া, এক লগে খাই। কবির হোটেলের খানা। বড়ই সোয়াদ।
পিস্টন ভাবছে, এই খাবারও নির্ঘাত মন্ত্রী বেটা অন্য কারো খর্চায় খাচ্ছে। গদি পাইলে হ্যাগো কোন টেকাই খর্চা করতে অয় না পকেট থেইকা। খিদা পেয়েছিল। তাই দ্বিরুক্তি না করে খেতে বসে গেলো। ইয়া বড় গলদা চিংড়ির দোপিয়াজা, ইলিশ মাছের পেটি, রুই মাছের ঝোল, নানা রকম ভর্তা ভাজি দিয়ে পেট পুরে খেলো সে মন্ত্রীর নন স্টপ বকাবকানি শুনতে শুনতে।

খেয়ে সে বিদায় নিলো। সচিবালয়ের বাইরে বাইট্টা অপেক্ষা করছে বাইক নিয়ে। চোখে রেইবন সানগ্লাস জোড়া পরে নিলো। এমুন চশমা লাগালে তারে নাকি এক্কেরে নায়ক জসীমের মতন লাগে,জরিনা তো এই কথাই কইল। শুনে কল্পনায় নিজেরে নায়ক ভাবতে ভালই লাগল তার।

মাস্তানরা কোন বাধা ধরা রাজনৈতিক দলের সদস্য না। যখন যে ক্ষমতায় থাকে সবাই তাদেরকে খুঁজে নিজেদের দরকারে। পিস্টনের মত মানুষ ছাড়া তারা চলতে ফিরতে পারে না। পিস্টনরা হল ভাড়াটে সৈন্যের মত। শ্রমের ন্যায্য মূল্য আর ফেঁসে গেলে দরকারি আইনি সাহায্য পেতে শুধু তাদের এমন ঠোলা ও মন্ত্রীর সাহায্য লাগে। নইলে চোদ্দ শিকে কাটাতে হতো আজীবন।

পিস্টন নিজেও খুব একটা নীতির ধার ধারে না। তবে রাসুকে দেখে কিছু ব্যাপার মানতে চেষ্টা করে। মেয়েদেরকে জ্বালায় না। ছাপোষা মনে হলে অমন মানুষদের কিছু ছিনতাই করে না সে কিংবা কাউকে করতে দেয় না।

বাইকে বসে পিস্টন বাইট্টাকে নির্দেশ দিলো আজ রাতের ভিতর যেন গাউসিয়া ,চাঁদনী চক আর হকার্স মার্কেট থেকে মন্ত্রীর জন্য জাকাতের কাপড় যোগাড় করে ফেলে। তারপর বলে দেয়, একটা ভ্যানগাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে সেগুলি মিন্টু রোডে মন্ত্রীর বাসায় পৌঁছে দিতে।

পিস্টন খুন খারাবি কিংবা বড় কোন দেন দরবার না হলে নিজে সরাসরি যায় না কোথাও। বাইট্টা গেলেই কাজ হয়ে যায়। সবাই জানে – বাইট্টা হল ‘ভাই’ এর ডান হাত। একশনে সে ‘ভাই’ এর চেয়েও ভয়ঙ্কর এবং নিষ্ঠুর।

হুকুম শুনে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো বাইট্টা। পিস্টনকে হলে নামিয়ে দিয়ে বাইট্টা কাজে নামলো। সাথে নিলো তার চেলা নুলা নাসিরকে। নাসিরের একটা পা একটু ছোট। টেনে টেনে হাঁটে। তবুও কুকাজে তার তুলনা নাই। দুজন মিলে গাউসিয়ায় গিয়ে কাপড়ের সবচেয়ে বড় দোকানটায় গেলো। ওদেরকে সবাই চেনে। দেখলে ভয়ে তটস্থ হয়ে পড়ে।
চেয়ার এনে দিলো ম্যানেজার। বাইট্টা বসার আগেই তার জন্য লাচ্ছি নিয়ে এলো কর্মচারী। বাইট্টা চোখ থেকে কালো চশমা নামালো না। শার্টের উপর দিয়েও বোঝা যায় কোমরে পিস্তল আছে। সে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বলল, জাকাতের শাড়ি বের করেন। ওরা বের করলো। সব দোকানে গেলো। সবার কাছ থেকে নিলো। নিয়ে মিলিয়ে দেখলো সংখ্যা ঠিক আছে কিনা।

তারপর দোকানীদের বলল – এসব শাড়ি ‘ভাই’ এর জন্য। উনি জাকাত দিবেন। তাই আপনাদের পক্ষ থেইকা এইটা ভাইয়ের জন্য উপহার মনে করবেন। তার বিনিময়ে ভাই তো সব সময় আপনাদের দিকে খেয়াল রাখেই। কি রাখে না, বলেন !

এতোগুলি টাকার মাল ফ্রি দিতে হচ্ছে দেখে এমনিতে দোকানীদের বুক ফেটে কান্না আসছে। কিন্তু চেপে গিয়ে মুখে শুধু বলল – জ্বি তাতো অবশ্যই। ভাইয়ের জন্য আমাদের জান কোরবান।

ওদের করুন চাহনি উপেক্ষা করে মালগুলি নিয়ে বের হয়ে ভ্যানে উঠালো বাইট্টা নুলা।

ডেরায় ফিরে পিস্টনকে রিপোর্ট জানিয়ে বাইট্টা সেদিনের বিকেলটা ছুটি চাইলো। তার আবার রোকেয়া হলের এক মেয়ের সাথে বিকেলে দেখা করার কথা। সেই মেয়ে জানে বাইট্টা সাইকোলজির ছাত্র।

পিস্টনের সাথে হলের গেটে দেখা হয়ে গেলো স্বপন ভাইয়ের সাথে। হল ক্যাফেটারিয়ার মালিক। খুব সজ্জন মানুষ স্বপন ভাই। সবার বন্ধু উনি। জুনিয়র,সিনিয়র সবার। ছাত্র, অছাত্র,মাস্তান, দারওয়ান সবার কাছে শ্রদ্ধেয় মানুষ তিনি। এই আরেকজন মানুষ যাকে পিস্টন অবহেলা করতে পারে না। অসন্মান করতে পারে না। কারণ তার খারাপ সময়ে স্বপন ভাই তাকে অনেকবার ফ্রি খেতে দিয়েছে তার ক্যাফেটারিয়ায়। টাকা পয়সাও ধার দিয়েছে। সব কিছুর সাথে বেইমানি করলেও ভাতের সাথে করা যায় না – এটা পিস্টনের নীতি।

অনেক টায়ার্ড ছিল। তবু স্বপন ভাইকে দেখে ওনার সাথে আড্ডায় মেতে উঠলো পিস্টন অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত। সাথে চা সিগারেটের তুফান শুরু হল ইয়াসিন ভাইর দোকান থেকে এনে।

চলবে…।।

৭ই জুন, ২০১৮

পরের পর্ব – #উত্থান৪