প্রেমের মরা জলে ডুবে না

তাপস আর মিতার কথা মনে হলে কত পুরনো মধুর স্মৃতি মনে পড়ে যায়। তখন নিজেরই পেট ফেটে হাসি হাসে।
কত্ত পাগল ছিলাম আমরা !

ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে জীবনে প্রথম ছেলে মেয়ে একসাথে ক্লাস করা, ঘুরাঘুরি, প্রেম করা এসব দেখলাম। সবার জোড়া থাকতে হবে। নইলে কেমন এতিমের মত লাগে, ভাবা যায় না।

কারো জোড়া আছে। কারো নাই। জোড়া মেলাতে সবার সে কি প্রাণান্তকর চেষ্টা। পড়াশুনার বেলায় অমন চেষ্টা করলে সব কয়টা পোলাপান নির্ঘাত ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে যেতো।

মিতার সাথে তাপসের বাল্যকালের প্রেম। তাপসের সাথে আঠার মত লেগে থাকে মেয়েটা। তবে খুব লক্ষ্মী আর মিশুক হওয়ায় মিতা সহজে সবার প্রিয় হয়ে গেছে।
খোকা সবার তুলনায় অসম্ভব মোটাসোটা মানুষ। একসাথে চলতে গেলে অচেনা যে কেউ তাকে আমাদের বাপ চাচা কিংবা মামা বলে ধরে নেয়। কলেজ থেকে সবাই তাকে ‘মামু’ বলে ডাকি তাকে।

তাপস আর খোকা মানিক জোড়ের মতন একসাথে চলাফেরা করে সব সময়। আমরা হলে থাকি কিন্তু ওরা দুজন বাসা থেকে আসে ক্যম্পাসে। একসাথে বাসায় ফেরে।

খোকা প্রেম ট্রেমে বিশ্বাসী না। তার মতে এসব ফালতু ব্যাপার। তারচেয়ে তাস খেলা আর লাল পানি খাওয়া মাচ বেটার আইডিয়া।

প্রেমে নিরাসক্ত সেই খোকাও একদিন প্রেমে পড়ে গেল। শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। একা প্রেমে পড়েছে। মেয়েটা কিছু জানে না। এখন বাকিটা আমাদেরকে ব্যবস্থা করতে হবে। কি মুসিবত, নিজের ব্যবস্থা নিজে করতে পারি না। তার উপর বন্ধুর ব্যবস্থা। কিন্তু একটা কিছু করতেই হবে।

মেয়েটার নাম মুক্তা।

তেজতুরি বাজারে খোকাদের বাসার উল্টা পাশের বাসায় থাকে। খোকার বেডরুম থেকে মুক্তাদের বাসার বারান্দা দেখা যায়। ব্যস, যতক্ষণ বাসায় থাকে খোকা জানালায় ঠায় দাঁড়ায়ে থাকে কখন মুক্তা বারান্দায় আসবে সেই অপেক্ষায়। আহারে, বেচারা ! আমরা ওর করুন অবস্থা দেখে মুখ লুকিয়ে হাসি।

মুক্তা ফিলসফিতে পড়ে। আমাদের জুনিয়র। কিভাবে এপ্রোচ করব ভাবছি। আমাদেরকে দেখলে এমনেই মেয়েরা ভয়ে কথা বলে না। উপায় খুঁজতে জিওগ্রাফির লাভলির সাহায্য চাইলাম। জানা গেল মুক্তা লাভলির কলেজের বান্ধবী।

ব্যস, উপায় পেয়ে গেলাম।

একদিন লাভলি মুক্তার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। ওর সাহস জোগানোর জন্য মুক্তাকে ধর্মের বোন বানালাম। তারপর আস্তে ধীরে আসল কথাটা ওর কানে দিলাম। খুব সুন্দর দেখতে মেয়েটা আমার কথা শুনে চুপ হয়ে গেল। হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বলে না। ওকে অভয় দিলাম সে না চাইলে কারো ঘাড়ে মাথা থাকবে না তাকে ডিস্টার্ব করলে।

এদিকে খোকাকে সত্যি মিথ্যা বলে ওর পয়সায় আমরা প্রায় প্রায় চাইনিজ খাচ্ছি। বিদেশী পানীয় গিলছি হরদম।

পাড়ার ছেলে হিসাবে খোকাকে মুক্তা চেনে। কিন্তু লাইক করে না। খোকার গুনের বর্ণনা করতে করতে করতে মুখে ফেনা বের করে ফেললাম। কাজ হচ্ছে না। মেয়েটা ভয় পায় বিশালদেহী মঙ্গোলিয়ান চেহারার খোকা মটুকে।

উপায় কি মেয়েটাকে বশ করার ! জোর করে বিয়ে করিয়ে দেয়া যায় কিন্তু তাতে মন পাওয়া যাবে না। খোকা অমন চায় না।

তাপস এসে খবর দিলো তার এক বন্ধু আছে যার কাছে জ্বিন আসে। ছেলেটার নাম খুব সম্ভবত রেন্টু। তাপসের পাড়ায় থাকে। ওরা নুরের চেলা মানে বর্তমান বারিধারায় থাকে।

আমি কোনদিন জ্বিন ভুতে বিশ্বাস করতাম না। তাই জ্বিনের কথা শুনে হাসি এলো। তাপস খুব সিরিয়াস হয়ে জ্বিনের কাণ্ড কীর্তির বর্ণনা দিলো।
কি আর করা, মেয়েটাকে প্রেমে মজাতে যে যাই বলে সব ট্রাই করতে থাকি।

জ্বিন রেন্টুর বাসায় গেলাম। রাতের বেলায়। গল্প করছি। হঠাৎ টিনের চালে ধুপ করে কিছু পড়ার আওয়াজ হল। তারপরই দেখি রেন্টুর সরল চেহারা আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে। এতক্ষণ ধরে স্বাভাবিক থাকা রেন্টু এবার মাতালের মত প্রলাপ বকছে। তার মুখ থেকে মদের গন্ধ বেড় হচ্ছে প্রকটভাবে। অথচ সারা বিকেল সে আমাদের সাথে ছিল এবং কিছু পান করে নাই। খোকার বেন্সনের প্যাকেট থেকে একসাথে অনেকগুলি সিগারেট বের করে মুঠি পাকিয়ে লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে এক টানে সিগারেট ফিল্টারে নামিয়ে ফেলল। দেখে আমার চোখ ছানাবড়া। আরও ছানাবড়া হল যখন সিগারেটের গন্ধ থেকে পরিষ্কার গাঁজার গন্ধ পেলাম। এসব কি করে সম্ভব ?

জ্বিন আমাদের সাথে গল্প শুরু করলো। বলে – সে সব জানে। সব দেখে। মুক্তা এখন কি করছে সেটা বলে দিলো। কি কালারের কামিজ পড়া সেটাও বলে দিলো। পরে মুক্তাকে জিজ্ঞেস করে সত্যতা যাচাই করেছি।

এরপর আর জ্বিনে বিশ্বাস না করে উপায় আছে ?

কিভাবে মুক্তার মন পাওয়া যাবে সেটা জানতে চাইলাম জ্বিনের কাছে। সে আমাদেরকে একটা তাবিজ দিলো। তারপর বলল পরদিন ভোরবেলা ফজরের পর মিরপুর মাজারে গিয়ে তাবিজটা একশ এক টাকা ছদকা দিয়ে ছুঁইয়ে আনতে হবে। তারপর সেই তাবিজ মুক্তাকে ছোঁয়ালে কাজ হবে। এই তাবিজ শুধু মুক্তাকেই ছোঁয়াতে হবে।

যেভাবে নির্দেশ দিলো সব পালন করলাম।

এখন তাবিজটা আদৌ কাজ করে কিনা পরীক্ষা করতে মন চাইলো। ভাবলাম অন্য কাউকে ছুঁইয়ে দেখি সে পটে কিনা।

আইডিয়াটা তাপসকে জানালাম। এটাও জানালাম ওর গার্ল ফ্রেন্ড মিতাকে ছুঁইয়ে দেখতে চাই সে কি করে। শুনে তাপসের মুখ শুকিয়ে গেল। আবার না ও করতে পারতেছে না। আফটার অল তার বেস্ট ফ্রেন্ডের মামলা এটা। নিরুপায় হয়ে রাজী হল। তবে তার আগে আমাকে শাসিয়ে দিলো এই বলে – মুরাইদ্যা, তোর মরা মায়ের কছম খেয়ে বল, তুই মিতা পটে গেলেও ওকে টাচ করবি না চান্স পেয়ে। তাইলে কিন্তু আমি তোরে জ্যান্ত পুঁইতা ফালামু।

~তাপস ও মিতা~

ওকে কথা দিলাম সুযোগ পেলেও কিছু করব না।

সেদিন বিকেলে ইনকোর্স পরীক্ষা শেষে নীচে নেমে এসে দেখি কলা ভবনের গেইটে মিতা বসে আছে তাপসের অপেক্ষায়। আমি তাপসের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বললাম এখুনি সময়। সে মাথা নেড়ে সায় দিলো।

সবাই চা সিগারেট টানায় ব্যস্ত হলে আমি মিতাকে বলি – মিতা, চল তুমি আর আমি রিকসায় করে একটু ঘুরে আসি। মিতা একটুও ইতস্তত না করে রাজী হয়ে গেল। আমি আর মিতা রিকসায় উঠে শাহবাগের দিকে গেলাম তাপসের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া আহত মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে।

জ্বিন বাবা যতই কেরামতি দেখাক না ক্যান, আমার বিশ্বাস হয় নাই এসবে আদৌ কোন কাজ হবে। তবুও আলগোছে তাবিজটা আমি মিতাকে ছুঁইয়ে দিলাম। তার কোন ভাবান্তর দেখি না। একদম না। সে খুব স্বাভাবিকভাবে গল্প করছে অন্য সময়ের মত। তবে আজ হাসতেছে তাপসের করুন চেহারার কথা বলে।
সে কিন্তু আসল ঘটনার কিছু জানে না।

তাবিজ কোন কাজে দেবে না মনে হল। নাকি শুধু মুক্তাকে ছোঁয়ালে কাজ হবে কে জানে ! তবে মিতাকে ছুঁইয়ে কিছু হবে না বুঝে ফেললাম। রিকসা শাহবাগে পৌঁছে গেল। রিকসায় বসে থেকেই ওর সাথে রিকসায় চড়ার আসল রহস্যটা ওকে জানালাম। শুনে সে হেসে কুটিকুটি।

জিজ্ঞেস করে – এখন কি করবেন ?

বললাম – চল তাপসকে ভয় পাওয়াই। ক্যম্পাসে ঢুকার আগে তুমি এমনভাবে আমার ঘাড়ে মাথা রাখবে যেন তাবিজের ছোঁয়ায় একদম কাবু হয়ে গেছ।

সে রাজী হল।

রিকসা ক্যম্পাসে ফিরে এলো। দুর থেকে দেখলাম ওরা সবাই সিঁড়িতে পাশাপাশি বসে আছে। তাপস একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। কাছাকাছি যেতে মিতা আমার দিকে মাথা এলিয়ে দিলো। আমি পেছন থেকে ওকে ধরে রাখলাম।

এই দৃশ্য দেখে তাপসের দুই চোখ যেন কোঠর ছেড়ে বেড় হওয়ার দশা হল। সে দৌড়ে এসে আমাকে একটানে রিকসা থেকে নামিয়ে উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞেস করে – অই শালা, তুই কি করছস, মিতার লগে ক , নইলে কইলাম মাইরা তরে মাটিতে শোয়াইয়া ফালামু।

আমি একদম চুপ। ওদিকে মিতা রিকসায় বসে হাসতে হাসতে শেষ। তখন তাপস যা বুঝার বুঝল আর কি !

১০ই অক্টবর।,২০১৯