ঠকিয়ে যত আনন্দ
রেঁস্তোরায় খেয়ে ওয়েটারকে ভাল বকশিস দেয়া কিংবা কাউকে দিয়ে কিছু করিয়ে নিয়ে তাকে খুশী করে দেয়ার প্রবনতা অন্তত: আমাদের জাতির নাই | আগের দিনে যখন বনেদিয়ানা ছিল কিন্তু পয়সা ছিল না মানুষের – তখন ও ছিল না ,এখন অনেক পয়সা হয়েও মানুষের মনে মায়া নাই | বরং কমেছে | সময়ের বিবর্তনে অনেকে জিরো থেকে হিরো হতে পারেন , সাধারন চাকুরিজীবি থেকে ধনবান হয়ে ধনীর মত জীবন যাপন করতে পারেন কিন্তু কারো মন ধনী হয় নাই | আমি কেমন করে এত বড় সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলাম ! দিয়েছি কারণ নিজের জগৎ এর খুব কাছের অনেক মানুষের সব কিছু বদলাতে দেখি কিন্তু মন দেখি সেই আগের মত হাড় কেপ্পন আর নীচু রয়ে গেছে | একটা ভাত টিপলেই যেমন হাঁড়ির সব চাল সেদ্ধ হয়েছে কিনা বোঝা যায় ,তেমনি একদল মানুষের চরিত্র দিয়ে পুরো জাতির প্রতিফলন দেখা যায় দিনের আলোর মত |

ভারী বোঝার ভারে নুব্জ বয়ষ্ক রিকশাওয়ালা
রিকশায় ভাড়া ঠিক না করে গন্তব্যে পৌঁছে কম পয়সা দেয়া , রিকশাওয়ালা যেতে আপত্তি করলে সাথে সাথে কিল থাপ্পড় দেয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা | আমিও এমন ঘটনার অংশীদার ছিলাম না বললে মিথ্যা বলা হবে | কুলির মাথায় বাজার উঠিয়ে দিয়ে নিজে রিকশায় বসে বাসায় এসে দু’জন কায়িক শ্রমের মানুষকে কেমন করে কত কম পয়সা দেয়া যায় তার জন্য আমাদের জন্মগত ট্রেইনিং আছে সবার | অফিসের কাজে অনভিজ্ঞ , ছেলে মেয়ের স্কুল হোম ওয়ার্ক জটিল লাগলেও গরীব মানুষ ঠকানোর হিসাবে আমরা খুব পারদর্শী |

চাকুরীদাতার অত্যাচারের স্বীকার কিশোরী কাজের মেয়ে
কাজের মানুষদের মাস শেষে বেতন না দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা ,ভাল ব্যবহার না করার ফলশ্রুতিতেই ওরা চুরি করে | ওরা সামান্য খাবার চুরি করলে বিশাল অপরাধ হয় অথচ তাদের কর্তারা দেশ শুদ্ধ চুরি করে ফেললেও কোন গুনাহ হয়না । বিচার হয় না। বকশিস দেয়া, উৎসাহ দিতে সামান্য উপহার দেয়া, একটু মিষ্টি কথা বলা – এসব যে খেটে খাওয়া মানুষের মনে কেমন পরিবর্তন আনে, খুব কাছে থেকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
আমার নিজের ভিতর অনেক বড় একটা অপরাধবোধ কাজ করে। ছাত্র জীবনে দুই টাকার ভাড়া আড়াই টাকা চাওয়ায় আমি রিকশাওয়ালাকে চড় মেরেছিলাম। তারপর ও অনেক বছর দেশে ছিলাম। গায়ে হাত না তুললেও মুখে গাল মন্দ কম করি নাই। দেশের ঘাড় বাঁকা ,ড্যাম কেয়ার ভাব, সাধারণ মানুষকে গরু ছাগল মনে করার প্রবনতা কেটে গেছে নিজে বিদেশে এসে যখন অন্যের অনুগ্রহে কাজ করে সপ্তাহ শেষ বেতন পেতাম। পরদেশে গতর খাটিয়ে পায়ের উপর দাঁড়িয়ে কাজ করতে গিয়ে কায়িক শ্রম কত কঠিন কাজ সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। তারপর থেকে চড় মারা সেই রিকশাওয়ালার কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে এবং খুব অনুতপ্ত হই। এরপর থেকে আমি আজ পর্যন্ত কোন দিন কাউকে ঠকাই নাই, চুরি করি নাই, মিথ্যা কথা বলি নাই। আমার মনে হয় যে কোন অপরাধ বিশেষ করে এক সৃষ্টিকর্তার বানানো ছোট বড় যে কোন মানুষের প্রতি অন্যায়ের বিচার মরনের পর নয় ,বেঁচে থাকা অবস্থাতেই হয়ে যায় সাম হাও। রোগ ,বালা, মুসিবত, দুর্ঘটনা, আর্থিক লস, বাসায় চুরি,ডাকাতি ,ছিনতাই রাহাজানি এসব আর কিছুই না – নিজের খুচরা পাপের বিচার।
বিদেশে এসে প্রথম দিকে প্রতি ঘন্টায় চার ডলার বেতনের চাকুরি করতাম । প্রানপন চেষ্টা থাকত কেমন করে কয়েক ঘন্টা বেশী কাজ করে কয়টা ডলার বেশী আয় করা যায়। রিটেইল শপের সেলসম্যান ছিলাম। কাষ্টমার খুশী হয়ে কেউ এক ডলার টিপ দিয়ে গেলে আনন্দে গদগদ হয়ে দাঁত কেলিয়ে ‘থ্যাংক ইউ’ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলতাম। ঠিক তখন মনে পড়ত দেশে রিকশাওয়ালা, বাজারের কুলি ,বাসার কাজের ছেলে ,রেঁস্তোরার বেয়ারা -এসব কায়িক শ্রমের খেটে খাওয়া মানুষদের প্রতি অবিচারের কথা।মনে হত যেন ওদের অভিসাপেই আমি দেশ থেকে এত লেখাপড়া করে ঠাট বাটের জীবন কাটিয়ে বিদেশে এসে চার ডলারের চাকরি করি আর বকশিস পাওয়ার আশায় বসে থাকি।
দেশে কোন দিন নিজে কিংবা কাউকে কোন রিকশাওয়ালাকে এভাবে বলতে শুনি নাই – ‘ভাই যাবেন?’ বরং বলেছি – ‘ অই খালি, যাবি ?’ যদি বলত , ‘না যাইতে পারুম না,গাড়ি জমার দেওনের টাইম হইসে।’ কখনোই বুঝতে চাইতাম না। গায়ের জোর খাটাতাম,এখনো মানুষ তাই করে। শিফট চেইঞ্জ হলে গাড়ি ফেরত দিতে হয় মালিকের কাছে। নইলে ঝামেলা বাঁধে। এসব তো কখনো বুঝতেই চাই নাই অনভিজ্ঞতা কিংবা বুঝতে চাওয়ার অনিচ্ছা থেকে।বাসার কাজের ছেলে কিংবা মেয়েকে কি কেউ তুমি করে বলে নাকি ! ‘তুই তোকারি’ করে বলা সাথে বকা দেয়া এবং সেটা খুব উচ্চস্বরে বলা ছাড়া যেন নিজে যে ওদের চেয়ে উঁচু শ্রেনীর সেটা বোঝানো যায় না। কথায় কথায় গায়ে হাত উঠানো যেন মালিক পক্ষের মানুষদের জন্মগত অধিকার।

হোটেল ডোরম্যান
হোটেল, রেঁস্তোরায় খেয়ে বকশিস ( Tips ) দেওয়ার রেওয়াজ যেন ভিক্ষা দেওয়ার মত। দল বেঁধে খেয়ে তারপর খোঁজা শুরু হয় মালিক যেন কে ,তার কাছে কারো নাম ভাংগিয়ে ডিসকাউন্ট নেয়া হল চিরাচরিত অভ্যাস। খেয়ে পুরা বিল দেওয়ার যার মুরোদ নাই সে কেমন করে বয় বেয়ারাদের বকশিস দেবে ? আর যদিও বা দেয় পাঁচ দশ হাজার টাকা খেয়ে খুব বেশী হলে পঞ্চাশ /একশ’ টাকা দেয়। একবার ও ভাবল না কয়জন মানুষ তাদের টেবিলে সার্ভিস দিয়েছে,ভাগে কত পাবে ওরা। যেন ফকিরকে ভিক্ষা দেয়া হল। একবার দেশে যাওয়ার পর এক সুহৃদ খাওয়াতে নিল আমাদের একদল বন্ধুকে। খাওয়ার পর ম্যানেজার বিল দিল না। কারণ সেই সুহৃদ আয়কর বিভাগের মানুষ। উনিও খুশি হয়ে পান খাওয়া দাঁত কেলিয়ে বের হয়ে আসলেন যেন বিশাল কিছু জয় করে ফেললেন। এবং যথারীতি বয় বেয়ারারা কেউ কোন টিপস পেল না।
মানুষের এত চাকচিক্য,এত পয়সা অপচয় করে অথচ বকশিস দিতে চায় না। মন যেন ভেংগে যায় কাউকে কিছু দিতে গেলে। মনে মনে ভাবি এই মানুষেরা সবাই নামায পড়ে কপালে দাগ বানিয়ে ফেলেছে। এরা কি আসলেই সঠিক হিসাবে তাদের সম্পদের যাকা’ত দেয় ? আই সিরিয়াসলি দাউট দ্যাট। যারা দেশ থেকে বেড়াতে আসে ,ওদের নিয়ে বাইরেখেতে যাই। বিলের সাথে যখন ১৫% টিপস দেই,ওরা চোখ ছানাবড়া করে ফেলে। বলে, এত দেওয়ার কি দরকার। না দিলে কি হবে ? বলি, না দিলে কিছু হবে না। ওরা মনে মনে গালি দিবে। নেক্সট টাইম এখানে আসলে খাবারের সাথে হয়ত থুথু মিশিয়ে আনবে কিচেন থেকে। সামান্য কয়টা টাকা বকশিশ দিলে ওদের মন জয় করে নেয়া যায়। সেটাই ভাবতে হবে।
এখন যখন পুরনো কথা মনে পড়ে ,আতংকে গা গুলিয়ে উঠে। অনেক সময় দল বেঁধে হোটেলে খেতে গিয়ে খাওয়ার শেষ দিকে নিজের মাথার চুল ছিড়ে খাবারে ফেলে অভিযোগ করতাম । ম্যানেজার বিরক্ত হয়ে আবার নতুন খাবার দিতে বলত, ওরা দিত। খাবারে চুল পড়ার জন্য হয়ত বেয়ারা কিংবা বাবুর্চিকে দোষারোপ করত মালিক পক্ষ। সেই কারনে নতুন খাবারে যদি ওরা থু থু মিশিয়ে দেয় কিচেন থেকে ,সেটা কারো জানার উপায় নাই। ইউটিউবে এমন থু থু মেশানোর অনেক ভিডিও দেখেছি ,যে সব কাষ্টমাররা খাবার নিয়ে বেশী কমপ্লেইন করে তাদের অর্ডারে।

ট্যাক্সি ড্রাইভার ও প্যাসেঞ্জারের গপ্পো
রিকশাওয়ালাকে বকশিস দেয়াতো কল্পনাতীত ব্যাপার যেখানে দশ টাকা বেশী দেয়া নিয়ে রিতিমত তর্কাতর্কি থেকে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে যায়। অথচ এই শহরে যে সব বাংগালী ভাইরা ট্যাক্সি চালায় ,ওদের কাছে শুনি ,ট্যাক্সিতে উঠা মানুষেরা কত দরাজ দিলের হয়। দশ বার টাকার ভাড়া হলে বিশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে ‘থ্যাংক ইউ’ দিয়ে গাড়ি থেকে নামে। বা্র, রেষ্টুরেন্টে যারা কাজ করে তারা বেতনের চাইতে বকশিস পায় অনেক বেশী। এই বকশিস দিয়ে একজন খেটে খাওয়া মানুষের শুধু হাসি মুখ , ভাল ব্যবহার পাওয়া যায় , তা’ই নয় – ওদের মন থেকে দোয়াও চলে আসে আমি মনে করি।

ঢাকার কুলি
ইয়োরোপ আমেরিকার তুলনায় এশিয়ার দেশগুলিতে বকশিস দেয়ার প্রবনতা অনেক কম। একবার সিংগাপুরে বেড়াতে গেলাম। আমেরিকায় থেকে অভ্যাস বদলে গেছে। যেখানে যাই, ট্যাক্সিতে উঠি কিংবা কোথাও বসে খাই – বিলের সাথে বকশিস রেখে আসি। ওরা অবাক হয়, পেয়ে অভ্যস্ত নয়। আমার সাথের মানুষেরা বিরক্ত হয় । বলে আমি খামোকা অপচয় করছি। এসবের কোন দরকার নাই। কিন্তু না দিলে আমি অস্বস্তি বোধ কর। সিঙ্গাপুরের হোটেলের ডোরম্যান, পোর্টাররা যখন বাইরে থেকে ঘুরে আসার পর দরজা খুলে ধরত গাড়ির, কিংবা ট্যাক্সি ডেকে দিত,হাতে কয়েক ডলার ধরিয়ে দিতাম। অবাক্ হয়ে যেতে দেখেছি। ভ্রমণ শেষে চলে আসার দিন সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম হ্যান্ডশেইক করে। সবাইকে বকশিস দিচ্ছিলাম। মনে আছে এক বয়ষ্ক মানুষ,জাতে ভারতীয় আমাকে জড়িয়ে ধরে জানতে চেয়েছিল ,আমি আসলে কোথা থেকে এসেছি। যা সত্যি তাই বলেছি। জাতে বাংগালী,এখন মার্কিন মুলুকে থাকি। কেন জানতে চাইছে জিজ্ঞেস করায় উত্তর দিয়েছিল, এই দেশে রংগিন চামড়ার কেউ বকশিস দেয় না। দিলেও ভাংতি পয়সা দেয়। শুধু সাদা জাতের মানুষেরা ভাল বকশিস দেয়, আর কেউ না।খুব খারাপ লেগেছিল এটা শুনে।
গরীব মানুষদের ঠকাতে পারলেই যেন স্বচ্ছল মানুষের যত আত্মতৃপ্তি হয়।
ছবি সংগ্রহঃ গুগল
৩রা এপ্রিল, ২০১৬