জায়া পরিবৃতা

নারীর স্বাধীনতার সময়কাল কখন আমি ঠিক জানিনা। আদৌ কখনো আছে কিনা, সন্দেহ আছে। পুরুষ জাতিও পুরোপুরি স্বাধীন নয়। জীবনের মাত্র অল্প কয়টা বছর তারা স্বাধীন থাকে – সেই সময়টা শুরু হয় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর, আর শেষ হয়ে যায় বিয়ের পরদিন থেকে। ঠাট্টা করছি না। একেবারে নির্জলা সত্যি কথা বলছি অনেক পরিসংখানের ভিত্তিতে।

তাহলে আগে জানা দরকার এই স্বাধীনতার সংজ্ঞা কি ?

খুব সহজ উত্তর। পুরুষের স্বাধীনতা হল, রাত ভর জেগে থেকে দিন ভর ঘুমাবে। ভুল করেও বিছানা কিংবা নিজের কাপড় গুছিয়ে রাখবে না। এশট্রে না পেয়ে চায়ের কাপে সিগারেটের ছাই ঝাড়বে। বন্ধুর সাথে আড্ডায় বসলে নাওয়া খাওয়া ভুলে যাবে।

আড্ডা বেশী জমে গেলে বাসায় না ফিরে বন্ধুর বাসার সোফায় ঘুমিয়ে রাত কাটিয়ে দেবে। বাসার দরকারি জিনিস কেনার টাকা দিয়ে বাইরে বিরিয়ানি খেয়ে চলে আসবে কিংবা কাউকে ধার দিয়ে দিবে নিশ্চিন্তে। বেহিসাবী, বোহেমিয়ান জীবনধারায় চলার আনলিমিটেড ফ্রিডম থাকবে।

চোখ ফোটার পর থেকে কলেজ শেষ করা পর্যন্ত মা,বাবা তার পাশাপাশি বড় ভাই কিংবা বোনের নজরদারী এবং নিষ্পেষনে জীবন তেজপাতার মত হয়ে যায়। ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে বাসার উৎপাত একটু কমে। হলে কিংবা হোষ্টেলে থাকার জন্য চলে যেতে পারলে পাওয়া যায় সম্পুর্ন স্বাধীন জীবনের স্বাদ।

সেই স্বাধীনতাকে গলা টিপে হত্যা করা হয় বিয়ের অল্পদিন পরেই। প্রেম করে হউক কিংবা আয়োজনের বিয়ে হউক, কোন পার্থক্য নাই। নারী অল্পদিন পরেই প্রেম ভালবাসা ভুলে গিয়ে পুরুষের মা চরিত্রের আকার ধারন করে।

পুরুষ বেটা’র ভালবাসা জানালা দিয়ে পালায় তখন। জান নিয়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। হাতে পায়ে যেন শেকল পরে থাকে। পুরুষ ছোটবেলায় একবার মিথ্যা বলা শেখে মার খাওয়ার ভয়ে। আবার মিথ্যা বলা শুরু করে বিয়ের পর স্ত্রীর সাথে। সখ করে নয়। ঝগড়া বিবাদ এড়াতে। চলতে থাকে স্বামী স্ত্রীর ইঁদুর বিড়ালের মত লুকোচুরি খেলা।

মিথ্যা বলে ধরা পড়লে মায়ের কাছে যেমন বকুনী খেতে হত, স্ত্রী তাঁর চাইতে একটুও কম যায় না। তখন ভাবতে হয়, স্ত্রী যেন শুধু সন্তানের মা নয়, স্বামীরও। নইলে এমন কঠিন হাউজ রুলস ইমপৌজ করে কেমন করে সবার উপর!

নারী পুরুষের এই রূপ যে শুধু আমাদের জাতের বেলায় হয় তা’ নয় কিন্তু। আমার শ্বেতাংগ ব্যবসায়িক পার্টনারকে জিজ্ঞেস করি ,তোমার ফেইসবুক আইডি কি। সে উত্তর দেয়, পাগল নাকি ! আমার ওসব নাই।

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, নাই কেন, সমস্যা কোথায় ?

সে উত্তর দেয়, দেখো বাপ, বিয়ের আগে অনেক শয়তানি করেছি। চাইনা বিয়ের পর তাদের কারো সাথে কথা বলতে গিয়ে বউয়ের হাতে ধরা খেয়ে জীবন দুর্বিসহ হউক। তাই আমি নিজের সুখের জন্য অতীতের কোন কিছু ফেইসবুক দিয়ে বউয়ের চোখের সামনে আনতে চাই না।

ব্যবসার কাজে প্রতি বছর এক সপ্তাহের জন্য আমরা লাগ ভেগাসে যেতাম বানিজ্য মেলায় অংশ নিতে। যাওয়ার আগে পার্টনারের স্ত্রী তাকে বলে, ঘর থেকে নিজেকে তৃপ্ত করে যাও যত খুশী। ওখানে গিয়ে কিছু করতে যেও না। কিছু করলে ঠিক আমার কাছে ধরা পড়ে যাবে। সেই ভয়ে বেচারা মেলায় গিয়ে কোন মহিলা প্রতিনিধির সাথে কথা বলতেও বার বার এদিক ওদিক তাকাতো যেন তার বউ তাকে দেখতে পাচ্ছে।

ভয়ের মাত্রাটা একবার বুঝুন।

আমার দেশে বেড়াতে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য হল, চুটিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া। বন্ধুরাও যেন আমার অপেক্ষায় বসে থাকে। তখন তারা সবাই তাদের রেগুলার রুটিন ব্রেইক করে। কেউ বাসায় খেতে যায় না দুপুরে। অনেক সময় রাতেও খায় না।

ওদের মোবাইল বাজতে থাকে অনবরত। বোঝা যায় বাসা থেকে বউ ফোন করছে। কখন ফিরবে, কেন দুপুরে খেতে যাচ্ছে না। ওরা একবার সত্যি কথা বলে। আবার মিথ্যা কথা বলে – ট্র্যাফিক জ্যামে আটকা পড়েছে। অফিসে একটা জরুরী মিটিং আছে তাই ফিরতে দেরী হবে ইত্যাদি। বনধুদের স্ত্রীরা জানে ,আমি ঢাকায় গেলে ওদের স্বামীরা হটাত লাগামহীন হয়ে যায় কয়দিনের জন্য। কিন্তু তবুও তারা স্বামীদের ছাড় দিতে রাজী নয়। আর সেজন্যই স্বামীরাও অনবরত মিথ্যা কথা বলে যায় স্ত্রীদের সাথে।

এক বন্ধুর স্ত্রী তো আমার স্ত্রীকে বলেই ফেলল, আচ্ছা মুরাদ ভাইএর কি ঢাকায় আর কেউ নাই দেশে ? সারাক্ষন যে শুধু বন্ধুদের নিয়ে পড়ে থাকে।

স্ত্রীর সামনে অনেক মানুষ তার বন্ধুর সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না। আমতা আমতা করে।আমি তখন বুঝতে পারি। ওদের নিস্তার দিয়ে ফোন রেখে দেই।সব চেয়ে মজার ব্যাপার হল, ছোট বেলায় বাবা বাসায় না থাকলে কিংবা ফিরতে অনেক দেরী করলে আমাদের ভাই বোনদের খুব খুশী লাগত। যেন আমরা সবাই স্বাধীন তখন। পড়তে বসতে চাইতাম না।

বাবা ঢাকা থেকে করাচী গেলে ফিরত এক দুই সপ্তাহ পরে। তখন আমরা অনেক আনন্দে থাকতাম। সেই একই রকম আনন্দ অনুভব করি, স্ত্রী যখন একা দেশে বেড়াতে যায় আমাকে আর ছেলেদের ফেলে। খুব খুশী লাগে। কারণ বিছানা গোছাতে হয় না। ঘর বাড়ি গুছিয়ে রাখার কোন দরকার হয় না। ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরম করার ভয়ে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসি। একই রকম আনন্দ দেখি বন্ধুদের মাঝেও।

আজ ঢাকা থেকে প্রিয় বন্ধু আমাকে ফোন করল অসময়ে। খুব অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করার আগে সে বলে, স্ত্রী তার ভাই বোনের সাথে ওমরাহ করতে আরব দেশে গেছে। ফিরবে ঈদের পর। তার গলার স্বরে খুব উচ্ছাসের সুর। আমাকে বলেই ফেলল, চলে আসবি নাকি দুই সপ্তাহের জন্য। চুটিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে। কেউ ডিস্টার্ব করবে না। শুনে আমি হো হো করে হেসে দিলাম।

তারপর ভাবলাম, নিজের জীবনে এসেও আমরা কেমন বন্দী বন্দী অনুভব করি নিজের ঘরেই। একটু ছুটি পেলেই কম বয়েসী ছেলেপুলের মত আনন্দে পাগল হই।

২৩শে জুন, ২০১৬