#উত্থান১ – Rise of a Thug

সূর্যসেন হলের টোকাই জুলহাস। হলের ডাকসাইটে ছাত্রদের ফুট ফরমাশ খাটে। তারা শুধু ছাত্র তো নয়। কেউ ছাত্র নেতা। কেউ বা মাস্তান। ওনারা কেউ ডাইনিং কিংবা ক্যাফেতে গিয়ে খাবার খান না। সারা রাতভর দ্যাশ দুইন্যা নিয়ে মাথা ঘামায়ে ভোরের দিকে ঘুমায়। তারপর ঘুম ভাঙ্গে বেলা গড়িয়ে গেলে।

জুলহাস সকাল থেকে করিডোরে পায়চারী করতে থাকে। কখন তার স্যারের রুম থেকে ডাক আসে,সেই অপেক্ষায়। স্যারের হাত পা টিপে দিতে হয়। মাথা বানিয়ে দিতে হয়। তারপর নাস্তা পানির জন্য স্লিপ নিয়ে স্যারের মর্জি মত কখনো ক্যাফেটেরিয়া,কখনো নীলক্ষেত থেকে নাস্তা আর খালি কেরুর বোতল ভর্তি করে ঘন দুধের চা আনতে হয়। নাস্তা পয়সা দিয়ে কিনে খায় না। স্লিপ পাঠালে খাবার চলে আসে। নইলে তো খবর খারাপ হয়ে যাবে।

জুলহাস সব কিছু দেখে মনোযোগ দিয়ে। সবার কান্ড কারখানা খেয়াল করে। ভাবে এই মানুষগুলান ক্যান যে লেখাপড়ার জায়গায় আইসা আসল কাম বাদ দিয়া হাকুইল্যা কামে দিন কাটায়, মাবুদ জানে। ফ্রি খায়। এরে ওরে ধইরা আইনা বাইন্দা মাইরধোর করে। তারপর ধরে আনা মানুষের জন্য কেউ টাকা নিয়া আসলে ছাইড়া দেয়। মানুষ গুলান এক্কেরে বদের বদ। এই কথা তার মনের ভিতর ঘুরাঘুরি করে। কিন্তু কাউরে কইতে সাহস পায় না। যদি কোন স্যার সেইটা টের পায়, তাইলে তারে জানে মাইরা ফালাইবো।

স্যারেরা এর ওর উপর জুলুম করলেও কাউরে জানে মারে না। তাছাড়া জুলহাসকে অনেক আদর করে। ভাল খেতে দেয়। নিজেদের পুরোনো শার্ট গেঞ্জি দিয়ে দেয় পরতে। বকশিশও দেয়। তাদের টোকাই বলে হলের অন্য কেউ জুলহাসের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে সাহস পায় না। শুধু মাসে মাসে বেতন পায় না – এটাই তার দুঃখ।

মাঝে মাঝে তার ইচ্ছা করে, এই কাজ ছেড়ে পালিয়ে যেতে। কিন্তু ভয় লাগে। স্যারেগো কাছে পিস্তল আছে। বন্দুক আছে। ঢাকা শহরের একোনা ওকোনা থেকে মানুষ আসে। সালাম দেয়। টেকা দেয়। অস্ত্র নেয়। আবার দেয়ও। পালালে যদি খুঁজে পায় তাইলে গুলি করে পেট ফুটা কইরা দিবো নিঘ্ঘাৎ।

নাহ, পালানো যাবে না।

কাজ শিখতে হবে। স্যারদের মতো হতে হবে। একদিন সেও তাগো মতন কোমরে পিস্তল নিয়া বখরা উঠানো শুরু করতে পারবে তাইলে।
সেদিন রাসু স্যার রুমে বইসা তার জালি থুক্কু স্টেনগান খুলে তেল মালিশ করলো। জুলহাস খুব মনোযোগ দিয়ে সব খেয়াল করলো।

ওর দিকে চোখ পড়ায় রাসু হেসে বলে – কিরে, ধরতে ইচ্ছা করে নাকি ! আয় কাছে আয়।

সে ভয়ে ভয়ে কাছে গেলো। রাসু গুলির ম্যাগাজিনটা খুলে রেখে জালিটা জুলহাসের হাতে দিলো। তারপর নিজেই লিভার টেনে কেমন করে কক করতে হয় দেখালো। এরপর ওটা ওকে দিয়ে বলে – এবার তুই কর দেখি।

জুলহাসের কোন কিছু শিখতে বেশিক্ষন লাগে না। শুধু লেখাপড়াটা করা হলো না। সেকেন্ডের মধ্যে স্টেনটা কোমরের কাছে এনে রাসুর দিকে তাক করে লিভার টেনে ট্রিগার টিপে মুখ দিয়ে আওয়াজ করলো – ঠা ঠা ঠা।

রাসু হেসে দিলো। তারপর বলে – তুই তো ব্রাশ টেনে দিলি রে। আমি তো পুরা ঝাঁজরা হয়ে গেলাম। শোন, খামোকা ব্রাশ ফায়ার করবি না। সিঙ্গেল গুলি করবি। কিন্তু তোর শত্রু বেশী হলে তখন ডাইনে বামে ঘুরিয়ে ব্রাশ ফায়ার করবি। তার আগে বোতাম সরিয়ে নিতে হবে সিঙ্গেল শট থেকে ব্রাশ ফায়ারে। বুঝলি ?

মাথা নাড়লো। বুঝে ফেলেছে জুলহাস। মজা পেলো।

তারপর সাহস করে বলে – স্যার , আপ্নের ছুডো মালডা এটটু দেহুম।

রাসু বালিশের তলা থেকে নাইন এম এম পিস্তলটা বের করলো। ম্যাগাজিন খুললো। চেম্বার থেকে গুলিটা বের করতে ভুলে গিয়ে পিস্তলটা ওর হাতে দিলো। এবার জুলহাসকে আর শিখাতে হলো না। সে পিস্তলটা হাতে নিয়ে জানালার বাইরে সই করে ট্রিগার চেপে দিলো। ঠাস করে গুলি ফুটলো। রাসু একটুর জন্য টার্গেট হয়ে যায় নাই। লাফিয়ে সরে গেলো। তারপর নিজের ভুল বুঝে কেঁপে উঠলো। গুলির আওয়াজ শুনে জুলহাসও চমকে উঠলো। বুঝলো মারাত্বক ভুল হয়ে যেত যদি নলটা স্যারের দিকে ঘোরানো থাকতো। ভয় পেলো। ভয়ে কেঁদে দিলো।

রাসু ওকে কিছু বললো না। কারণ ভুল তো তার, ওর নয়। তাই পিঠে হাত দিয়ে আশ্বস্থ করে বলে – তুই তো ভালোই পারিস দেখি। চেষ্টা করলে তুই একদিন অনেক বড় মাস্তান হতে পারবি রে।

একটু ধাতস্থ হয়ে জুলহাস লজ্জার হাসি হাসে। কথাটা তার খুব পছন্দ হয়েছে।

রাসু জুলহাসকে খুব বিশ্বাস করে। তাকে অনেক কথা বলে। তার অস্ত্র ধরতে দেয়। রাখতেও দেয় মাঝে মাঝে।

হ্যাঁ, আসলেও তাই। এইতো কিছুদিন আগে খবর এলো রাতের বেলায় হল রেইড হবে। অস্ত্র উদ্ধার অভিযান হবে যৌথ বাহিনীর। মাল সরানোর সময় পেলো না। পুলিশের ইনফর্মারের কাছ থেকে খবর পেয়েছে, চারিদিকে সাদা পোষাকের পুলিশ ঘুরছে। মাল সরানর উপায় নাই। তখন জুলহাস তাকে বাঁচিয়ে দিলো।

বলে – স্যার, মালগুলি আমারে দেন। আমি আমার ছিড়া খ্যাঁতার ভিতরে লুকায়ে নিয়ে ঘুমায়ে থাকবো। আমার ময়লা পুরান খ্যাঁতা কেউ ভুলেও ধরবো না।

আরে, দারুন বুদ্ধি তো ! স্টেন আর পিস্তলটা নিয়ে জুলহাস তার খ্যাঁতায় পেঁচিয়ে কোল বালিশ বানিয়ে ঘুমের ভাণ করে বারান্দায় লিফটের গোড়ায় শুয়ে রইলো মশার ভন ভন আওয়াজের ভিতর।

ঠিকই গভীর রাতে পুলিশ ঢুকলো হলে। তন্ন তন্ন করে খুঁজলো সব রুম। কিছুই পেলো না। চলে গেলো ভোরের দিকে।
সেই ঘটনার পর জুলহাসের প্রতি রাসুর বিশ্বাস আরো বেড়ে গেলো। তার অস্ত্র লুকোনোর গোপন জায়গাটার কথা সে আর কারো সাথে শেয়ার করলো না।

মফস্বলের ছেলে রাসুর বাল্য প্রেম অকালে হারিয়েছিল মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাওয়ায়। হাইস্কুল শেষ হতেই মেয়েটার বাবা তাকে বিয়ে দিলো দুবাইতে থাকা ডাবল বয়সের এক মানুষের সাথে। চোখের পানি মুছে তার হাত ধরে কুন্তি একদিন বিদেশে চলে গেলো। সেই থেকে স্কুলের মেধাবী ছেলে রাসু পড়াশুনায় আগ্রহ হারালো।

এস,এস,সিতে ভাল রেজাল্ট করলেও কলেজে গিয়ে নিয়মিত পড়ার আগ্রহ হারালো। মারামারি করতে শুরু করলো। সবাই ভয় পেতে শুরু করলো ওকে। ফাঁকি দিয়েও সে এইচ এস সি তে রেজাল্ট একদম খারাপ করলো না। তার ইচ্ছা ছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ঢুকার। সেই কারণে মনে হয় পরীক্ষার আগে মনোযোগী হয়েছিল । ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে গেলো।

শুরুতে সুবোধ বালক রইলেও একদিন যখন হলের রুম নিয়ে ঝগড়া লেগে তার বিছানা টেনে ফেলে দিলো আরেক ছেলে – সে সেটা সহ্য করতে পারলো না। রূমে থাকা দস্তার বদনা দিয়ে পিটিয়ে সেই ছেলের মাথা ফাটিয়ে রক্তারক্তি কান্ড ঘটিয়ে ফেললো।

নাহ, তাতে তার কোন সমস্যা হয় নাই। বরং সন্মান বেড়ে গেলো। সেদিনের পর থেকে কেউ আর তাকে বদার করে নাই। কানে কানে তার সাহসের কথা ছড়িয়ে পড়লো। বিশেষ করে ক্যাম্পাসের অপরাধ জগতে। তাকে দলে টানতে চাইলো শক্তিশালীরা। এক সময় সে জড়িয়ে পড়লো ওসবে। যার পকেটে বাড়ি থেকে পাঠানো মাসিক পাঁচশো টাকার বেশী কোনোদিন ছিল না – অল্পদিন পরেই সে বাড়ি থেকে আসা মানিঅর্ডার রিসিভ করতে ভুলতে শুরু করলো।

ভালোই চলছিল জীবন। ক্যাম্পাসে সবাই এক নামে চেনে। এখন শহরেও তাকে চেনে। চেনে ডিপার্টমেন্টের স্যারেরা। কোথাও কোন সমস্যা নাই। মাস্তানির অনেক খারাপ বদনাম থাকলেও রাসু কখনো কোনো মেয়েকে জ্বালায় না। কেউ জ্বালালে বরং সে বিরক্ত হয়। বাধা দেয়। সেজন্য মেয়েরা ওকে খুব সন্মান করে।

সেই ছেলে মানে রাসু আবার প্রেমে পড়তে যাচ্ছে। একদিন রিকশায় করে একা হলে ফিরছিলো সে আজিমপুর থেকে। নীলক্ষেতের কাছে এসে দেখে তিন চারটা ছেলে যাদের কাউকে সে চেনে না, একটা মেয়েকে ঘিরে জটলা করছে। কাছে গিয়ে রিকশা থামিয়ে বুঝতে চাইলো ব্যাপারটা কি ! মেয়েটা বার বার বলছে,তাকে যেন ছেড়ে দেয়। তার দেরি হয়ে যাচ্ছে হলে ফিরতে। গেইট বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু ছেলেগুলি নাছোড়বান্দার মতো তাকে ঘিরে রেখেছে।

রাসু নেমে এগিয়ে গেলো। ছেলেগুলিকে জিগেস করলো – এখানে সমস্যা কি, কেন ওরা এমন করছে !

ছেলেগুলি তাকে চিনতে পারে নাই। তাই পাত্তা দিলো না। বেয়াদপ কিসিমের। উল্টো তাকে নিজের চরকায় তেল দিতে বললো। সে খুব বিরক্ত হলো। মেয়েটাকে মুখ চেনা লাগছে। ক্যাম্পাসে দেখেছে হয়তো। মারামারি করতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু উপায় নাই। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলো। মেয়েটাকে বাঁচাবে সে। এগিয়ে গিয়ে দুইটা ছেলেকে একসাথে ধরে একজনের মাথার সাথে আরেকজনের মাথা ঠুকে দিলো। মাথা ফেটে রক্ত বের হতে শুরু করলো ফিনকি দিয়ে। রক্ত দেখে বাকি ছেলে দুইটা দৌড়ে পালালো সঙ্গীদের উঠিয়ে নিয়ে। যাওয়ার আগে রাসুর দিকে আঙ্গুল তুলে বলে গেলো – তোকে দেখে নেবো শালা, মনে রাখিস।

ওসব কথা কানে না তুলে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো সে এখানে রাতের বেলায় একা কি করছে। কোথায় থাকে এসব। জানলো সে রোকেয়া হলের মেয়ে। এক বান্ধবীর বাসা থেকে ফেরার পথে একটু বাজার করার জন্য নিউমার্কেটে থেমেছিল। তারপর হলে ফেরার পথে এই বিপত্তি।

রাসু বুঝলো ঘটনা সত্যি। সে তাকে হলে পৌঁছে দিতে চাইলো। মেয়েটা খুশি হয়ে তার পাশাপাশি হাঁটা ধরলো।

রাসু একবারও জানতে চাইলো না মেয়েটার কি নাম, কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ে, কিছুই না। নীরবে হাঁটছিলো। শেষে মেয়েটা বিরক্ত হয়ে নিজেই বলতে শুরু করলো – আমার নাম কুন্তি। কুস্তি না কিন্তু,কুন্তি। আমি ইতিহাসের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। এবার আপনি কি দয়া করে নিজের নামটা বলবেন, নাকি না ?

রাসু ভেবেছিলো মেয়েটা হয়ত তাকে চেনে ক্যাম্পাস থেকে। নামও জানে। অবাক হলো, চেনে না দেখে। তারপর সে নিজের নাম জানালো। শুনে মেয়েটা চমকে উঠে বলে – ও আল্লাহ, আপনি সেই মাস্তান রাসু নাতো !

রাসু মৃদু হেসে মাথা দোলায়। মুখে কিছু বলে না। মাস্তান কথাটা শুনতে ভাল লাগে নাই। একটু লজ্জা লাগলো। গ্রামে থাকা বাবার মুখটা ভেসে উঠলো মনের পর্দায়। সেই মুখ যেন তাকে তিরস্কার করছে। মায়ের মুখ কল্পনা করলো। মাও খুব খুশী না তার আচরণে। ওরা সব খবর পায় তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে।

মেয়েটা বকবক করতেই লাগলো। বলে – মনেই হয় না দেখে যে আপনাকে সবাই ভয় পায়। কই, আমার তো ভয় লাগছে না একটুও।

রাসু হেসে দিলো তার কথা শুনে। তাকে হল গেইটে পৌঁছে দিয়ে সে বিদায় নিলো।

হলে পৌঁছে গেইটে তার দলবল অপেক্ষা করছে দেখে সে তাদের সাথে বসে পড়লো। আড্ডায় মত্ত হলো। বেমালুম চেপে গেলো মেয়েটার কথা। মনের অগোচরে কেমন যেন একটু ভালোলাগার অনুভূতি পেলো শুধু। বকবক করলেও সুইট লাগে ওর কথা শুনতে। ভেবে হেসে ফেললো সে।

রুমে ফিরতে জুলহাস এলো। জিজ্ঞেস করে – স্যার রাইতে কি খাইবেন ?

আজ কেন জানি তার ক্ষিদা লাগে নাই। গেইটে চা খেয়ে মুখ আরো বিস্বাদ হয়ে আছে। কিছু খাবে না বলে তাকে বিদায় করে দিলো। ঘুরে ফিরে বার বার কুন্তির কথা মনে পড়ছে তার। ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে গেলো।

পরদিন ক্যাম্পাসে গিয়ে বটতলায় দাঁড়িয়ে সে একটা ঝামেলা মেটাচ্ছিলো। কুন্তি এসে বলে – রাসু ভাই কি খুব বিজি আছেন এখন, নইলে চলেন আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য আপনাকে এক কাপ চা খাইয়ে আনি হাকিম চত্বর থেকে।

বন্ধুদের সামনে মেয়েটার এমন চাঁছাছোলা কথা শুনে থমকে গেলো সে। বন্ধুরাও সবাই কিছু না বুঝে মুখ চাওয়া চাওয়ি শুরু করলো কৌতূহল নিয়ে।

অন্য কেউ হলে রাসু যেতো না। কিন্তু কুন্তিকে এড়াতে মন চাইলো না। বন্ধুদেরকে অপেক্ষা করতে বলে সে কুন্তির সাথে হাঁটা শুরু করলো।
হাকিম চত্বরে গিয়ে গাছের তলায় বসলো। সবাই রাসুকে তাকিয়ে দেখল। অবাক হল। রাসু কখনো কোন মেয়ের সাথে এভাবে এসে গাছতলায় বসে না।

কুন্তি গলা চড়িয়ে দুই কাপ চা আর বিস্কুট চাইলো। তারপর রাসুর সাথে আলাপ জমাতে চেষ্টা করলো। আবার জিজ্ঞেস করলো – আপনাকে দেখে কেন মাস্তানের মত লাগে না, বলেন তো ! আচ্ছা, আপনার কি রিভলবার আছে ? দেখি তো, দেখতে কেমন ।

রাসু ওর এতো কৌতূহলী কথা শুনে শুধু মুচকি হাসে। কোন উত্তর দেয় না। কিন্তু ওর কথা শুনতে ভাল লাগে অনেক।

আচ্ছা কি পারফিউম ইউজ করেছে কুন্তি ! গন্ধটা খুব সুন্দর। জিজ্ঞেস করবে নাকি ! নাহ, এখুনি এমন জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না।

পিচ্চি চা নিয়ে এলো। ঝটকা মেরে মাথা ঘুরিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিতে গেলে কুন্তির চুলগুলি রাসুর কপাল ছুঁয়ে গেলো। তখন টের পেলো, এতক্ষণ সে আসলে ওর চুলের শ্যাম্পুর গন্ধ পাচ্ছিলো। বাহ, দারুণ ভাল লাগা গন্ধটা।

এতো ভাবছে দেখে রাসু নিজের লাগাম টানতে চাইলো ।

মনে মনে বলছে – কি হচ্ছে এসব ! তুমি কি আবার প্রেমে পড়তে যাচ্ছ নাকি হে ? সাবধান হ, বাছা। আর বেলতলায় যেও না।

কুন্তি যেন রাসুর মনের কথা পড়ে ফেলল। কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বলে – যেতে হবে। ক্লাস আছে একটু পর।

তারপর বলে – শুনেন মাস্তান সাহেব, কাল আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবেন। রেডি হয়ে এখানে অপেক্ষা করবেন ঠিক দুপর দুইটায়। শুধু দয়া করে চুলগুলি সুন্দর করে ছেঁটে আসবেন। ছেলেদের এতো লম্বা আর এলোমেলো চুল দেখতে আমার একদম ভাল লাগে না। বলে কুন্তি ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটা শুরু করলো।

রাসু চোখ মেলে তার চলে যাওয়া দেখলো। মনের ভিতর খুশীর ঝলক। কাল কুন্তিকে নিয়ে বেড়াতে যাবে।

তারপর মনে হল, এখনই গিয়ে চুলটা কেটে ফেলা যাক। বটতলায় গেলে আর বের হওয়া যাবে না। তাই একটা রিক্সায় চড়ে নিউমার্কেটের দিকে গেলো।

পরিচিত নাপিত তাকে দেখে তোয়ালে দিয়ে চেয়ার পরিষ্কার করে বসতে দিলো। কেমন করে কাটতে হবে তাকে বলে সে চোখ বন্ধ করে ঝিমুতে শুরু করলো। চুল কাটা শেষ হলে তাকে জাগালো নাপিত। আয়নায় নিজেকে তাকিয়ে দেখে অন্যরকম লাগলো। আরে, ভালই তো লাগছে। নিজেকে নিজে কমপ্লিমেন্ট দিলো রাসু। পয়সা দিয়ে বের হয়ে আবার রিক্সা নিলো।

নিউমার্কেটের গেইটে একটা ছেলের দিকে চোখ গেলো। মুখ চেনা মনে হল। কোথায় যেন দেখেছে কিন্তু মনে করতে পারল না। ছেলেটা তার দিকে এক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সরে গেলো।

রাসু ছেলের ভাবনা বাদ দিয়ে কুন্তিকে নিয়ে কাল কোথায় যাবে, কি খাওয়াবে সেই ভাবনায় ডুব দিলো। রিক্সা দক্ষিণ গেইট থেকে রওনা হয়ে টি এন্ড টি বুথের কাছে এসে সিগনালে দাঁড়ালো। ঠিক তক্ষুনি চারটে ছেলে এসে রিক্সা আটকে দাঁড়ালো। দুইটার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা আছে। মুহূর্তে তাদেরকে চিনে ফেলল রাসু। কাল এদেরকে মেরেছিল সে।

জিজ্ঞেস করল – কিরে, কি চাস আবার তোরা ?

– তোর জান চাই। নিয়ে নিব এখন। দেখি তোর কোন বাপ তোকে বাঁচাতে আসে আজ।

রাসু ভয় না পেয়ে হেসে দিলো। বলে – তাই নাকি, জান নিয়ে নিবি ? তো নিলে নিয়ে নে, দেখি।

মুহূর্তে একজনের হাতে পিস্তল বেরিয়ে এলো। চকচকে একটা থ্রি টু পিস্তল। রাসুকে লক্ষ করে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেইঞ্জ থেকে পর পর তিনটা গুলি করলো। সব কয়টা গুলি তার বুকে গিয়ে লাগলো। রাসু গড়িয়ে রিক্সার পাদানিতে পড়ে গোঙাতে লাগলো।

ছেলেগুলি দৌড়ে দেয়াল টপকে কলোনির ভিতর চলে গেলো। রিকশাওয়ালা কি করবে বুঝতে না পেরে তাকে ঐ অবস্থায় চালিয়ে ক্যাম্পাসের বটতলায় নিয়ে গেলো। সেখানে রাসুর বন্ধুরা সবাই দাঁড়িয়ে হৈচৈ করছে। হটাৎ ওদের চোখ গেলো রিক্সার পাদানিতে পড়ে থাকা রাসুর দিকে। সবাই দৌড়ে এলো। একজন একটা অপেক্ষমাণ গাড়ির ড্রাইভারকে বলল এখুনি মেডিক্যালে নিয়ে চল। গেলো বটে। কিন্তু ততক্ষণে রাসুর প্রাণ বায়ু বেরিয়ে গেছে।

পরদিন কুন্তি দুপুরবেলায় হাকিম চত্বরে এসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলো। রাসু এলো না দেখে খুব রেগে গেলো। তারপর সে রাসুর হলের দিকে হাঁটা দিলো। গেইটে গিয়ে দারওয়ানকে বলে – রাসু ভাইকে গিয়ে বলেন কুন্তি ডাকছে।

দারওয়ান হতবিহবল হয়ে তাকিয়ে রইলো কুন্তির দিকে কিছুক্ষণ। তারপর কেঁদে উঠে বলে – আমাগো রাসু ভাই তো আর নাই এই দুইন্যায়।

মানে কি ! এসব কেমন কথা !

দারওয়ানের মুখে রাসুর গুলি খাওয়ার খবর জানলো। তারপর মনে পড়লো, তার হলে মেয়েরা বলাবলি করছিলো নীলক্ষেতে কে যেন কাকে গুলি করে পালিয়ে গেছে। সে যে রাসু হতে পারে, সে কল্পনাও করে নাই।

সে কোনদিন জানতেও পারবে না যে তাকে বাঁচাতে গিয়েই রাসু ঐ ছেলেগুলির চক্ষুশূল হয়ে জীবন হারালো। তবুও তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরতে শুরু করলো।

জুলহাস যখন শুনলো রাসু খুন হয়ে গেছে সে সটকে পড়ার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলো। রাসুর ছোট আর বড় দুইটা অস্ত্র তার কাছে রাখা আছে। সেই খবর রাসু আর সে ছাড়া আর কেউ জানে না। এইতো দারুণ সুযোগ ওগুলি নিয়ে সরে পড়ার। রাতের অন্ধকারে কাপড়ের সাথে ওগুলি বস্তায় ঢুকিয়ে নিয়ে সে হল ছেড়ে বের হয়ে গেলো। গিয়ে উঠলো হলের পেছনের বস্তিতে তার বন্ধুর ঘরে। বন্ধু আরেক হলের ক্যান্টিন বয়। দুজনের খুব ভাল বন্ধুত্ব আছে। বিশ্বাসও করে একে অপরকে। রাসু তাকে মালগুলি বের করে দেখাল। বন্ধুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

বলে – চল, তাইলে আমাগো পয়লা অপারেশনটা কইরা আসি অহনি।

রাতের অন্ধকারে দুই বন্ধু বের হল দুইটা অস্ত্র নিয়ে। কাঁটাবন বস্তি থেকে বের হয়ে এলিফ্যান্ট রোডের মোড়ে অন্ধকার গলিতে দাঁড়ালো। একটা গাড়ি এসে থামল। ভেতর থেকে এক ভদ্রমহিলা বের হল। গায়ে অনেক অলংকার। তারপর বের হল ভদ্রলোক। জুলহাস এগিয়ে গিয়ে পিস্তলটা চেপে ধরল ভদ্রলোকের পেছনে আলগোছে। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে – দুজনের কাছে যা আছে বাইর কইরা দিয়া দ্যান নইলে পেট ফুটা কইরা হালামু।

লোকটা শুধু বলল – তোরা ভুল করছিস। আমি পুলিশের লোক।

শুনে ভয় পেয়ে গেলো জুলহাসের বন্ধু। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে লোকটার বুক বরাবর গুলি চালিয়ে দিলো। কাটা কলাগাছের মত ধড়াস করে সে মাটিতে পড়ে গেলো। তারা দুইজন মহিলার অলংকার, হাত ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে বস্তিতে ঢুকে পড়লো।

তাদের প্রথম অপারেশন। প্রথম সফলতা। প্রথম খুনের হাতেখড়ি হল প্রথম রাতেই। তারপর আর হাত কাঁপে নাই। আস্তে আস্তে চারিদিকে তার নাম ছড়িয়ে পড়লো। বড় বড় নেতারা তাকে ডেকে পাঠায় নানা কাজে।

তবে তার নাম আর জুলহাস রইলো না। সবাই চেনে ‘পিস্টন’ নামে।

সেই নামে কাঁপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কাঁপে ঢাকা শহরের অলিগলি। চাঁদা আসে সব দোকানপাট, ঠিকাদার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। পেছনে পিস্টন বলে ডাকলেও সামনে সবাই তাকে ডাকে ‘ভাই’ বলে।

রাসু এবং রাসুর মত মাস্তানরা ছিল শিক্ষিত পরিবারের পোলাপান। সাথে অস্ত্র রাখলেও কখনো কারো দিকে তাক করে গুলি করে নাই। কারো ক্ষতি করে নাই। করতে গেলে ভয় লাগে। লজ্জা লাগে। মায়ের মুখ, বাবার মুখ ভেসে উঠে। বুক কেঁপে যায়।

পিস্টনের হারানোর কিছু নাই। চক্ষু লজ্জা নাই। গুলি করতে, গলা কাটতে হাত কাঁপে না। তাই তার ডিমান্ড অনেক বেশী। সবাই তাকে তোয়াজ করে চলে। এভাবে উত্থান হল আরেক হিমশীতল হৃদয়ের মাস্তান এবং ঠাণ্ডা মাথার খুনি পিস্টনের।

চলবে।
৪ই জুন, ২০১৮

পরের পর্ব ঃ #উত্থান২