স্মৃতি তুমি বাঁচার টনিক
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ভাইবারে খাইরুলের টেকষ্ট মেসেজ এসেছে। ওর ডাক নাম অরু। জানিয়েছে আমাদের আরেক বন্ধু বাদল নিউইয়র্কে আসবে বেইজিং থেকে সতের তারিখে। আমি যেন ঐ সময়ে ফ্রি থাকি। বাদল পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে চাকরি করে। চায়নার বেইজিং এ বাংলাদেশ দুতাবাসের সচিব পদে আছে। আমরা হাইস্কুলে এক সাথে পড়তাম। খুব বেশী ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমরা। কলেজ ছাড়ার পর আর দেখা হয় নাই অরুর সাথে। সে ডাক্তারী পড়তে চায়নাতে চলে গিয়েছিল। আমিও মাষ্টার্স শেষ করে আমেরিকায় চলে এলাম। বাদল ফরেন সার্ভিসে জয়েন করে ইটালী চলে গেল। দীর্ঘকাল যোগাযোগ না থাকার পর হটাত একদিন অরুর ফোন নাম্বার পেলাম আরেক বন্ধুর কাছে। আবার আগের মত যোগাযোগ সুরু হল। এত যুগ পর কথা বলতে গিয়ে মনেই হয় নাই যে আমাদের যোগাযোগ ছিল না এত দিন।

ছবিতে অরুর পরিবার। ছোট্ট ছেলেটা অরুর ভাতিজা। 
অরু ডাক্তারী পড়া শেষ করে দেশে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ তখনো চায়না থেকে পাশ করা ডাক্তারী ডিগ্রী ইভালুয়েট করত না। তাই সে মন খারাপ করে আবার চায়নাতে ফিরে গেল। সেই দেশে বিয়ে করে থেকে গেল। অভিমান করে আর দেশে ফিরে যায় নাই। তিন যুগের বেশী সময় ধরে সে চায়নাতে বসবাস করছে। সেই দেশের একজন হয়ে গেছে । সে দেশে বিয়ে এক কন্যার বাবা হয়। মেয়ে একটু বড় হলে তরু মেয়েকে ঢাকা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। ডানাকাটা পরীর মত খুব সুন্দর একটা মেয়ে ছিল তার। কিন্তু ছেলেবেলাতেই মরণ ব্যাধি তার একমাত্র মেয়েটাকে কেড়ে নিয়েছে। তারপর আর ছেলে পুলে হয় নাই ওদের। দু’জন মিলে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। সাংহাই প্রদেশে থাকে ওরা। চায়নাতে ডাক্তারী পড়লেও তখন কোন বিদেশীকে সেই দেশে লাইসেন্স দেয়া হত না। কি আর করা যাবে । তাই অন্য পেশা মানে আমদানী রফতানী ব্যবসায় শুরু করল তরু। তার বউ স্কুলে পড়ায়।

 

অরুদের বাসা ছিল টিকাটুলিতে। ৭/১ ,রামকৃষ্ণ মিশন রোড। এই ছিল ওদের ঠিকানা। এখনো মুখস্থ আছে আমার। ক্ষয়ে যাওয়া লাল ইটের অনেক পুরনো একটা বাড়ি। শেওলা পড়া অনেক উচুঁ দেয়াল ঘেরা বাড়ির গেটে অনেক পুরনো একটা পাথরের ফলকে খোদাই করে লেখা ছিল এই ঠিকানা। গেটে কোন বেল ছিল না। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে গলা উচিঁয়ে ডাকতাম , “ অরু, বাসায় আছিস ?” ওর বাবা বের হয়ে আসতেন। আমাদের দেখে অরুকে ডেকে দিতেন। কতবার যে গিয়েছি ঐ বাড়িতে হিসাব করে বলা যাবে না। ওদের বাড়িতে ভাত খেয়ে আমরা অভিসার হলে সিনেমা দেখতে যেতাম। আবার কখনো খামোকাই বঙ্গভবনের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে তোপখানা রোড, গুলিস্তান, বাইতুল মোকাররম, ষ্টেডিয়ামে ঘুরে বেড়াতাম উদ্দেশ্যহীনভাবে। এস,এস,সি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে আমাদের হাতে আসে অফুরন্ত অবসর। বাইরে রাত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ালেও বাসা থেকে খুব বেশী বকা খেতাম না। তাই সকাল হলেই আমাদের ঘুরে বেড়ানো শুরু হত।
বাদল থাকত বাসাবোতে। বাদলের বাবা সরকারী চাকুরির কারনে পাকিস্থানে ছিলেন যুদ্ধের সময়। যুদ্ধের পর ওরা ঢাকায় ফিরে এলে বাদল এসে আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়। ভাল ক্রিকেট খেলত । ইংরেজিতে তুখোড় ছিল। দুষ্টামিতে চ্যাম্পিয়ন ছিল। ডার্টি জোক বলে আসর জমানোতে ওস্তাদ ছিল বাদল। তখন থেকেই ভারী লেন্সের চশমা ছিল ওর চোখে। এতই ভারী যে চশমা ছাড়া কিছুই দেখতে পেত না। আমরা ওর চশমা লুকিয়ে রেখে ওকে অনেক জ্বালাতাম।

ঘুম থেকে উঠে অরুকে ফোন করলাম। কয়েক মিনিটের গল্পে আমরা যে কখন আমাদের ছেলে বেলায় ফিরে গিয়েছি টেরই পাই নাই। গল্পে গল্পে ঘন্টা পার হয়ে যায়। ওর কাছ থেকে জানলাম ওদের সেই পুরনো বাড়িটা এখনো আছে ঠিক আগের মতই। আশে পাশের সবাই তাদের পুরনো বাড়ি ভেঙ্গে নতুন দালান উঠালেও ওরা সেটা করে নাই। বাবা বেঁচে নাই। তিন ভাই এখনো অনেক মিলে মিশে বন্ধুর মত আছে। তাই বাড়ির ভাগ নিয়ে কাটা কাটি, মারা মারি হয় নাই। শুনে এত ভাল লাগল যেন আমি পুরনো কোন গুপ্তধনের খবর পেয়েছি।
গুপ্তধনই বটে। আমি খুব সেকেলে মানুষ। যখন দেশ ছেড়েছি ঢাকায় এত বড় দালান কোঠা ছিল না। পরিচিতজন সবার ছোট ছোট বাড়ী ছিল গাছ গাছালিতে ভরা। আশে পাশে অনেক খালি জায়গার এক কোনায় সেই বাড়িগুলি ছিল। সেই বাড়িগুলির সাথে যেন আমার জন্ম, শৈশব সব কিছু আষ্ট্রে পিষ্টে জড়িয়ে আছে।
আজকের আধুনিক গুলাশান বনানী তখন জঙ্গল ছিল। আমাদের বাসাও ছিল বনানীতে। একদম জঙ্গলের ভিতর। ভয় লাগত আমার। ভালুক দেখেছি বনানীর রাস্তায় দিন দুপুরে। অনেক দূর হয়ে যায় শাহজাহানপুরের মোড়ে মতিঝিল হাইস্কুল। তাই চলে গিয়েছিলাম মুগদাপাড়ায় বোনের বাসায়।
কমলাপুর রেলষ্টেশনের পিছনে থেমে থাকা নষ্ট মালগাড়ির ভিতর ছিন্ন মূল মানূষের সংসার আর টায়ার পুড়িয়ে রান্নার দৃশ্য দেখে সকালে স্কুলে যেতাম আবার বিকেলে ফিরে আসতাম। বাবার বাসা ছেড়ে বোনের বাসায় থাকা মানে অনেক স্বাধীনতা। সেজন্যই তো মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতাম শাহজাহানপুর, বাসাবো, টিকাটুলি, শান্তিনগর ,গুলিস্তান। খেতাম রাস্তার উপর বেঞ্চে বসে। এখন যেমন সবাই কে,এফ,সি কিংবা পিজা হাট এ গিয়ে ফেইসবুকে চেক-ইন দেয়, তখন যদি এই কারিগরি থাকত তাহলে দেখা যেত আমরা ষ্ট্যাটাস দিচ্ছি – “আমরা এখন স্কুল ফাঁকি দিয়ে অভিসারে শুধু প্রাপ্ত বয়ষ্কদের জন্য বানানো ইংরেজি সিনেমা দেখছি।” কিংবা বলতাম – “আমরা এখন মনসুর হোটেলে গরুর ঝোল দিয়ে কিমা পুরি খাচ্ছি ।” কিংবা “ মতিঝিল কনফেকশনারিতে বাটার বন খাচ্ছি । ঠান্ডা কোক জোরে টান দিতে গিয়ে সব নাক দিয়ে বের হয়ে গেছে। পুরা পয়সাই লস ।”
তখন বনানীতে নিজের বাসা হলেও কাউকে বলতে লজ্জা পেতাম। মনে হত যেন বনে জংগলে থাকি। তার চাইতে আমার মুগদা পাড়া আর বাসাবো অনেক ভাল লাগত। বন্যা হলে বাসাবোতে কোমর পর্যন্ত পানি জমে যেত। আমরা তখন নৌকায় করে বাসাবো মাঠ থেকে রেল গেইট পর্যন্ত যেতাম। তারপর বাকি রাস্তা প্যান্ট গুটিয়ে ময়লা পানির ভিতর মনের আনন্দে হেঁটে চলে যেতাম। এখানে সেখানে শুকনা জায়গায় গৃহহীন গরীব মানুষেরা বস্তা টাঙ্গিয়ে কোন রকমে থাকার ব্যবস্থা করত। এসব দেখে দেখে অভ্যস্থ ছিলাম। মনে আছে আমরা সেই সময়ের স্কুল ছাত্ররা যার যার বাসা থেকে পুরনো কাপড় এনে স্কুলের স্কাউটসদের দিতাম। ওরা গরীব মানুষের ভিতর বিলি করত এসব কাপড়। অনেকে বাসা থেকে চাল পর্যন্ত নিয়ে আসত। যদিও তখন আমরা সবাই রেশনের পঁচা গন্ধ ওয়ালা চাল খেতে বাধ্য ছিলাম।
এখন দেশে গেলে আর কোন পুরনো ঘর বাড়ি দেখি না। তাই ঢাকা শহর খুব অপরিচিত লাগে। যাকেই জিজ্ঞেস করি কোথায় থাকেন ,সবাই বলে গু্লশান বনানীতে থাকে। ওখানে থাকাই এখন যেন একমাত্র আভিজাত্যের প্রতীক। নইলে জাত থাকে না যেন। পুরনো সব মানুষেরাও কেমন যেন বদলে গেছে সবাই। সবার কথায় শুধু দেখানোর মনোভাব দেখি আর আহত হই। সেই আদি আত্মিক টান, সরলতা হারিয়ে গেছে। অশুভ প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত সবাই।
দেশে গেলে কোন অনুষ্ঠানে, দাওয়াতে অন্যদের সাথে আমার মানুষেরা আমার পরিচয় দেয় আমি আমেরিকায় থাকি। যেন এটাই আমার আইডেন্টিটি এখন।
কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে কোথায় থাকি ,কি করি আমি। নিউইয়র্ক বললে তার পর জিজ্ঞেস করে কোন এলাকায় থাকি, নিজের বাড়ি কিনা, কত দিয়ে বাড়ি কিনেছি এসব প্রশ্ন। পেশা যেন জানে এমন ভাব করে নিজেই বলতে থাকে – কি করেন ওখানে, ট্যাক্সি চালান ? নাকি দোকানে কাজ করেন ? কথার ষ্টাইলে মাথায় রক্ত চড়ে যায় । পর মুহুর্তে মনে পড়ে , আমি তো এখন আগন্তক ঢাকা শহরে। আমার কোন দাম নাই। ওরাই এখন এই শহরের হর্তা কর্তা।
তারপর জানতে না চাইলেও আপন মনে গর্বিতভাবে নিজের বয়ান দিতে শুরু করে তৃপ্তি সহকারে- কতবার আমেরিকায় গিয়েছে, ওখানে কোন কোন আত্মীয়ের লং আইল্যান্ডে বাড়ি আছে যেখানে কোন বাংগালী থাকতে পারে না। বাংগালীরা সব সস্তা এলাকায় থাকে । ওসব এলাকায় গেলে দম বন্ধ হয়ে যায়। নিজের ব্যবসা বানিজ্যের বিষদ খতিয়ান দিতে থাকে- কতগুলি গার্মেন্টস আছে , সব সাপ্লাই আমেরিকার বড় কোম্পানীগুলিতে করে। ছেলেমেয়েরা সবাই বিদেশে পড়াশোনা করে। প্রতি ছয়মাস পর পর কত লাখ টাকা টুইশন ফি পাঠায় এসব। বলে খুব তৃপ্তির ঢেকুর তোলে আর খুব করুনাভরে আমার দিকে তাকায় ।
আমি যেন সেই দৃষ্টি পড়তে পারি। সেই দৃষ্টি যেন বলছে, ‘ তুমি আমেরিকায় থাক তো কি হইসে? ওখানে তুমি ডীশ ওয়াশ কর।’ আমরা তোমাদের চাইতে অনেক বেশি ভাল আছি দেশে। ইয়োরোপ আমেরিকার চাইতে আমাদের আরাম আয়েস কম কিসে ? এটা বোঝানোর জন্য বার বার বলে ফেলে গুলশান, বারিধারায় কোথায় কোথায় এপার্টমেন্ট আছে। আমার তখন নিজের জন্য কিন্তু খারাপ লাগে না এক বিন্দুও। কারন আমি ঢাকা শহরের আদি বাসিন্দা। ওরা নতুন এসেছে। আমি বিদেশে খেটে খাই। তাই আমার অনেক গর্ব। কারণ আমি চুরি করিনা। কারো হক মেরে খাই না। আমার যা কিছু আছে সব কিছু নিজের একার কষ্টার্জিত। তাতে কোন রক্তের দাগ নাই। আমি খুব ক্লিন মানুষ। তাই মনের আনন্দে নাক ডেকে ঘুমাতে পারি কোন মাথা ব্যথা ছাড়া।
এটা সত্যি দেশে গেলে এখন আর আগের মত স্বাচ্ছন্দ বোধ করি না। নিজেকে পরগাছার মত লাগে আজকের অপরিচিত কৃত্তিম মানুষের কৃত্তিম ঢাকায়। আবার আমার খুব কাছের মানুষগুলি যারা পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে ওসব দেশেই থিতু হয়ে গেছে – ওদের সাথে গল্প করলে মনে হয় আমরা যেন মাত্র গতকাল দেশ ছেড়ে এসেছি। সবকিছু যেন এখনো আগের মতই আছে।
দেশ এখন পুরনো স্মৃতি। নিজের প্রিয় শহর এখন আধুনিকতার নামে জঞ্জালে ভরপুর অপরিচিত ,অপরিকল্পিত বস্তি। তবুও অতীত ভেবে ভেবে নষ্টালজিক হই।
বাদল আসবে নিউইয়র্কে তিন দিনের জন্য। কত যুগ পর ওর সাথে দেখা হবে এটা মনে হলেই বুকের ভিতর কেমন আনন্দের শিহরন জাগে। কত স্মৃতি আছে আমাদের একসাথে। আশা করছি কয়টা দিন আমরা খুব আনন্দে কাটাবো রাত ভর আড্ডা মেরে।
মুরাদ হাই, নিউইয়র্ক
১৬ই ডিসেম্বর, ২০১৫