দি ব্ল্যাক কোট

যুগে যুগে পৃথিবীর বড় বড় রাজনৈতিক নেতা নিজ নিজ দেশের প্রতি তাদের অবদান ছাড়াও বিখ্যাত হয়ছেন তাদের ব্যাতিক্রমধর্মীপোষাকের জন্য। ইতিহাসে কালজয়ী সব জন নেতাদের দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন নিয়ে, সংগ্রামের পর তাদের বিজয় গাঁথার কথা লেখা আছে। বিশদ আকারে না হলেও অনেক নেতাদের পোষাক নিয়েও অনেক কথা লেখা আছে যা পরবর্তিতে সেসব দেশে নেতাদের প্রতি সমর্থন আর শ্রদ্ধার নমুনা স্বরুপ জাতীয় পোষাক হয়ে গেছে।

চীনদেশে মাও সেতুং এর অনুকরনে সবাই অনুরুপ গলাবন্ধ কোট পরে যার নাম হয়ে গেছে ‘মাও কোট’। ভারতে মহাত্মা গান্ধীর টুপি অনেক জনপ্রিয় সবার মাঝে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে ভারতের কালজয়ী সানাই বাদক বিসমিল্লাহ খানসহ ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সবাই গান্ধী টুপি পরেছে তাঁর অনুকরনে। পরেছে আন্না হাজারে ও আম আদমি পার্টি থেকে সদ্য বিজয়ী দিল্লীর ভবিষ্যত মুখ্য মন্ত্রী অরভিন্দ কেজরিলাল পর্যন্ত।

ভারতে্র রাজনীতিকরা ভিন্ন মতাদর্শী হলেও ওরা কখনোই গান্ধীজি কিংবা নেহ্রেরুর প্রতি সন্মান জানাতে ভুল করে না। এটাই ভারতের মুক্ত গণতন্ত্র এবং গর্বের বিষয়। গুনীজনের গুনের কথা সবার মুখে মুখেই ফেরে। সেজন্যই আমরা দেখি, ভারতে কোন দল ক্ষমতায় আছে সেটা বড় কথা নয়। কারণ, দেশের স্বার্থে, জাতীয় স্বার্থে ওরা সবাই এক, অবিচল। তাই ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও গান্ধিজীর ছবি কখনো দেয়াল থেকে নামে না ভারতে।

জওহরলাল নেহেরু খুব কেতা দুরস্ত পোষাক পরতেন। শেরোয়ানি বা আচকান তখনকার সময়ে অভিজাত শ্রেনীর পোষাক ছিল। নেহেরুও আচকান,প্যান্ট পরতেন তবে একটু ভিন্ন ধরনের। ইংরেজরা ওয়েষ্টার্ন স্যুটকোট এর প্রনেতা বলে ধরে নেয়া হয়। নেহেরু ইংলন্ডে গেলে স্যুট প্যান্ট পরতেন কিন্তু ভারতে পরতেন আচকানের পরিবর্তিত রুপ প্রিন্স কোট যা আচকানের চেয়েও লম্বায় অনেক কম এবং অনেকটাই স্যুটের কোটের মাপে তৈরি। সুটের আদলে ভি-নেক স্টাইল দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তিতে নেহেরু আচকানের মত গলা পর্যন্ত বোতাম, গলার কলার মাও কোটের মত নয়, বরং খাড়া গোল কলার (যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘ম্যান্ডারিন কলার’) গলার কাছে হুক দিয়ে আটকাতে হয়। এই বিশেষ ধরনের কলার এই কোটের বিশেষত্ব। ধারনা করা হয় ১৯৩০ সালে নেহেরু প্রথম এই ধরনের কোট পরিধান করেন। তারপর থেকে এই কোটের নাম হয়ে যায় নেহেরু কোট।

পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু ১৯৪৭- ৬৪ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে এই কোট পরেছেন। এই কোটের মজার ব্যাপারটা হল শীতকালে নেহেরু লম্বা হাতার কোমরের নীচ পর্যন্ত নেহেরু কোট পরলেও গরমকালে হাতা কাটা, গলা বন্ধ লম্বায় কোমর পর্যন্ত বানানো কোট পরতেন পাঞ্জাবীর উপর। কিন্তু কোন বিশেষ রঙের নয়। দেখা গেছে গরমের দিনে পাঞ্জাবীর উপর হাল্কা রঙের হাতা কাটা কোট পরতে ভালবাসতেন নেহেরু ।

দেখা যায় বলিউডের নামী দামী অভিনেতা থেকে শুরু করে, অনেক সাধারন মানুষ, রাজনীতিবিদ সবাই এই নেহেরু কোট পরে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, নেহেরু কংগ্রেসের মানুষ ছিলেন। কিন্তু সম্পুর্ন ভিন্ন মতের মৌলবাদী বিজেপি’ দলের অনুসারী ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেও এই নেহেরু কোট পরে। নানা রঙের নেহেরু কোট নরেন্দ্র মোদীর অফিসিয়াল পোষাকে পরিনত হয়েছে ।

পাকিস্তানেও এই নেহেরু কোট পরার প্রচলন আছে। পাঞ্জাবীর সাথে নেপালীরা পরে ওয়েষ্টার্ন স্টাইলের কোট। কিন্তু সেটা মোটেও মানায় না। পাঞ্জাবীর সাথে হাতা কাটা নেহেরু কোট অনেক দৃষ্টি নন্দন পোষাক, কোন সন্দেহ নাই। পাকিস্তানের অনেক রাজনীতিক, সেলিব্রিটিরা এই নেহেরু কোট পরে। হয়তো তারা এটাকে নেহেরু কোট নামে না ডেকে শুধুই ওয়েষ্ট কোট বলে, আমার জানা নাই যদিও।

বাংলাদেশে এই কোট পরার প্রচলন করেন বাঙ্গালীর একচ্ছত্র নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানে রাজনীতির অসংখ্য বাঙ্গালী নেতার মাঝে শুধু শেখ মুজিবকেই এই কোট পরতে দেখা যেতো। বাঙ্গালিদের প্রধান নেতা হিসাবে এই কোট পরায় বঙ্গবন্ধুকে অন্যদের চেয়ে আলাদা এবং সত্যিকারের দলনেতা হিসাবে আলাদা করতে অসুবিধা হতনা। তখন নেহেরুর মত শেখ মুজিবও হাল্কা রঙের হাতা কাটা কোট পরতেন পাঞ্জাবীর সাথে।

১৯৭১ সালে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষনে কোনঠাসা হয়ে পড়ে থাকা বাঙ্গালী জাতিকে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দেবার দিনে বাঙ্গালীর প্রান পুরুষ বঙ্গবন্ধু সেদিন পাঞ্জাবির উপর হাতা কাটা কালো রঙের কোট পরেছিলেন। তারপর থেকে বঙ্গবন্ধু মানেই সাদা পাঞ্জাবি পাজামার সাথে কালো রঙের হাতা কাটা কিন্তু গলা বন্ধ কোট পরিহিত সুপুরুষ এক বাঙ্গালীর প্রতিচ্ছবি।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকায় ফিরেছিলেন এই কালো কোট পরে। শেখ মুজিবের প্রতি অকুন্ঠ সন্মান আর সমর্থন দেখিয়ে দেশের তৎকালীন সরকারের সকল মন্ত্রী, এম পি,আমলা, দলের নেতা কর্মীসহ অনেক সাধারন বাঙ্গালী কালো রঙের এই কোট পরতেন।

চীনের মাওএর সন্মানে ‘মাও কোট’, ভারতে ‘গান্ধী টুপি’, ‘নেহেরু কোট’ এর মত বাংলাদেশেও শেখ মুজিবের প্রতি অকুন্ঠ সন্মান দেখিয়ে এক সময় এই কালো কোটের নাম হয়ে গেলো – ‘মুজিব কোট।’ এই কোট হয়ে গেলো অঘোষিতভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পোষাক। এই কোটের বিশেষত্ব একটাই, সেটা হল মুজিব কোট মানে অন্য কোন রঙের নয়, শুধুই কালো রঙের গলা বন্ধ হাতা কাটা কোট।

একটা সময় পর্যন্ত দল মত নির্বিশেষে সবাই এই কালো কোট পরতে খুব ভাল বাসতো। কিন্তু খুব কম সময়ের ভিতর দেশে দলীয় অরাজকতা, দুর্ভিক্ষ, এবং স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান খুন হয়ে যাবার পর দেশে স্বাধীনতার সময়ে এক হয়ে যাওয়া জাতির ভিতর বিভেদ তৈরি হয়ে গেলো। সেই বিভেদ বাঙালি জাতির অনেক প্রিয় নেতা শেখ মুজিব এবং বাঙালি জাতির প্রিয় পোষাক মুজিব কোট ও আলাদা হয়ে গেলো। এরপর থেকে শুধু আওয়ামী লীগের সমর্থকরা এই মুজিব কোট পরে, সাধারণ মানুষেরা নয়।

চীন দেশে সবাই মাও এর সমর্থক না হলেও মাও কোট পরে। ভারতে সবাই নেহেরু কিংবা কংগ্রেসের সমর্থক না হলেও নেতার প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা ফ্যাশন যাই হোক, সবাই বাহারি রঙ এ বানানো নেহেরু কোট পরে। নরেন্দ্র মোদি কংগ্রেস নয়, বিজেপির নেতা হয়েও নেহেরু কোট পরে। পাকিস্তানের জাতীয় নেতারাও এই কোট পরে। কারণ ভিন্ন মতের হলেও ওদের জাতীয়তা বোধ অনেক প্রবল ।

বাংলাদেশের মানুষেরা মুখে অন্য কোন জাতির চাইতে অনেক বেশি পরিমানে নিজেদের দেশ প্রেমের কথা বললেও বাস্তবে জাতি হিসাবে এত মেকি, বর্নবাদী, হিংসুক, আত্মকেন্দ্রিক জাতি আর দ্বিতীয়টি খুজে পেতে কষ্ট হবে। তার চাইতে বেশি বর্নবাদী এবং দেশের একমাত্র চিরস্থায়ী ধারক বাহকের দাবীদার হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চায় মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্বে থাকা শেখ মুজিবের দল ‘আওয়ামী লীগ।’এই দলের অনুসারীরা তাদের দলের প্রতি আনুগত্যের বাইরে সবাইকে দেশ বিরোধী হিসাবে বিবেচনা করে।

তার নমুনা হিসাবে এক জাতি হয়েও অন্য দলের মানুষদের অবলীলায় রাজাকার বলতে দ্বিধা করে না। শেখ মুজিব কোন দলের নয়, পুরো বাঙ্গালী জাতির নেতা হলেও আওয়ামী লীগের নীতিমালার সংকীর্নতার জন্য শেখ মুজিবকে দেশের নয়, শুধু আওয়ামী লীগের নেতা, শুধু তাদের নেতা হিসাবে আলাদা করে সাধারন মানুষের মন থেকে কেড়ে সরিয়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে দেশের মানুষের প্রিয় নেতার প্রিয় পোষাক মুজিব কোট পরার অধিকার। এখন যে কেউ ইচ্ছা করলেও এই কালো কোট পরতে পারেনা। পরতে হলে তাকে আওয়ামী লীগ করতে হবে, নইলে আওয়ামী লীগের সমর্থক ভাবা হবে। এই কালো কোট পরে নিরপেক্ষ থাকার কোন উপায় নাই।

যেমন বাংলাদেশে এখন নিরপেক্ষ বলতে কোন মানুষ আর নাই। সক্রিয় কিংবা নীরব ভাবে হলেও প্রতিটা মানুষ কোন দলের পক্ষে নেয়। পক্ষ নেয়ার কারন হিসাবে বলা যেতে পারে –

১)এক দলের প্রতি ঘৃনা অপর দলের প্রতি অনিচ্ছাসত্বেও নিরুপায় সমর্থন,
২) ব্যাক্তি স্বার্থ উদ্ধার, বিনা পুঁজিতে দ্রুত বড় লোক হবার উপায়।

মনের ভিতর যাই থাক, কালো কোট পরলেই দলের মানুষ হয়ে যায় যে কেউ। কালো কোট এখন কোন সাধারন পোষাক নয়, ওটা শুধুই আওয়ামী লীগের পোষাক হয়ে গেছে কার্যকরভাবে।

এত বিভেদ, এত কলহ, এত রক্তপাত হচ্ছে এই ভুমিতে, তাহলে কেন সে বেচারা এত সংগ্রাম করেছিল এই জাতির মুক্তির জন্য ! আজ যদি অলৌকিকভাবে বঙ্গবন্ধু দুনিয়াতে ফিরে আসতে পারতো, তাহলে এসব দেখে ভদ্রলোক নিজেই আর পৃথিবীতে থাকতে চাইতেন না।

মুরাদ হাই, ১১ই ফেরুয়ারী, ২০১৫